তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারে নৈতিকতা

একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি - তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি: বিশ্ব ও বাংলাদেশ প্রেক্ষিত | | NCTB BOOK

নৈতিকতা হচ্ছে এক ধরনের মানদণ্ড যা আচরণ, কাজ এবং পছন্দের ক্ষেত্রে সহায়তা করে। এটি ঔচিত্য ও অনুচিত্যের মাপকাঠিও বটে, কেননা মানবধর্ম এবং নৈতিকতা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। অনৈতিক ও বেআইনি এক বিষয় নয়। অনেক অনৈতিক কাজ আইন বিরুদ্ধ নয়, কিন্তু সকল আইন বিরুদ্ধ কাজ অবশ্যই অনৈতিক। তবে সাম্প্রতিক কালে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে নানা ধরনের অনৈতিক এবং অন্যায় কাজের মাত্রা এত বেড়ে গেছে যে পৃথিবীর অনেক দেশেই সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে। কাজেই একসময় যে কাজটি শুধু অনৈতিক ছিল সেটি অনেকক্ষেত্রে এখন বেআইনি হয়ে গেছে, অর্থাৎ সামনাসামনি কাউকে গালাগাল করে একজন পার পেয়ে যেতে পারে, কিন্তু ফেসবুকে কাউকে গালাগাল করে একজন জেলে চলে যেতে পারে।

যেহেতু পৃথিবীর প্রায় সকল মানুষ কোনো না কোনোভাবে তথ্য প্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত তাই এর ব্যবহারের নৈতিকতার বিষয়টি খুব গুরুত্ব দিয়ে নেওয়া উচিত। গুরুত্ব না দেয়া হলে একজন অনৈতিক কাজ দিয়ে শুরু করে খুব সহজেই অন্যায় এবং অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে। তাই সকল কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারে নৈতিকতা সম্পর্কে অবহিত এবং যথাযথভাবে রপ্ত হওয়ার কোনো বিকল্প নেই ।

কম্পিউটার ইথিক্স ইনস্টিটিউট ১৯৯২ সালে কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিষয়ে দশটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে। সেগুলো হচ্ছে :

১. তুমি কম্পিউটার ব্যবহার করে অন্যের ক্ষতি করবে না।

২. তুমি অন্যের কম্পিউটার সংক্রান্ত কাজে হস্তক্ষেপ করবে না।

৩. তুমি অন্য কারও ফাইলে নাক গলাবে না।

৪. তুমি চুরির উদ্দেশ্যে কম্পিউটার ব্যবহার করবে না।

৫. তুমি মিথ্যা তথ্যের জন্য কম্পিউটার ব্যবহার করবে না।

৬. তুমি লাইসেন্সবিহীন সফটওয়্যার ব্যবহার ও কপি করবে না।

৭. তুমি বিনা অনুমতিতে কম্পিউটার সংক্রান্ত অন্যের রিসোর্স ব্যবহার করবে না।

৮. তুমি অন্যের কাজকে নিজের কাজ বলে চালিয়ে দেবে না।

৯. তুমি তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের আগে সমাজের উপর এর প্রভাব সম্পর্কে চিন্তা করবে।

১০. তুমি কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় অন্যের ভালোমন্দ বিবেচনা করবে এবং শ্রদ্ধাবোধ প্ৰদৰ্শন করবে। কম্পিউটার, ইন্টারনেট কিংবা মোবাইল ফোন ব্যবহার করার সময় উপরে বর্ণিত তথ্য প্ৰযুক্তিগত নৈতিক নির্দেশনাগুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা খুবই জরুরি।

আজকাল ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনেক ধরনের অনৈতিক এবং অপরাধমূলক কাজ সংঘটিত হয়। এর ভেতর বহুল প্রচলিতগুলো হচ্ছে :

হ্যাকিং (Hacking) : কোনো কম্পিউটার সিস্টেম, নেটওয়ার্ক, ডেটার উপর অননুমোদিতভাবে অধিকার (Access) লাভ করার উপায়কে হ্যাকিং বলে। এতে ব্যক্তির তথ্যের বা সিস্টেমের ক্ষতিসাধন করা হয় এবং অনেকক্ষেত্রে কোনো ক্ষতি না করে শুধু নিরাপত্তা ত্রুটি সম্পর্কে কম্পিউটার ব্যবহারকারীকে জানান দেয়া হয়। যে সব ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গ এ ধরনের কর্মে/অপকর্মের সাথে জড়িত থাকে তাদের হ্যাকার বলে।

ফিশিং (Phishing) : ফিশিং করার অর্থ ই-মেইল বা মেসেজের মাধ্যমে ওয়েবসাইট ব্যবহারকারীকে নকল বা ফেইক ওয়েবসাইটে নিয়ে কৌশলে তার বিশ্বস্ততা অর্জন করা এবং তারপর ব্যবহারকারীর অ্যাকসেস কোড, পিন নম্বর, ক্রেডিট কার্ড নম্বর, পাসওয়ার্ড, ব্যাংক একাউন্ট নম্বরের মতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চুরি করে তাদের নানা ধরনের বিপদে ফেলা।

স্প্যামিং (Spaming) : অনাকাঙ্ক্ষিত বা অবাঞ্ছিত ই-মেইল কিংবা মেসেজ পাঠানোকে স্প্যামিং বলে। এই কাজ যারা করে তাদেরকে স্প্যামার বলা হয়। যখন কোনো ব্যবহারকারী কোনো ওয়েবসাইট ভিজিট করেন বা কোনো গ্রুপের মেসেজ বোর্ডে প্রবেশ করেন তখন স্প্যামাররা সেখান থেকে ই-মেইল অ্যাড্রেস সংগ্রহ করে ব্যবহারকারীর ই-মেইলে বিভিন্ন প্রতারণামূলক মেসেজ পাঠায়। সফটওয়্যার পাইরেসি (Software piracy) : সফটওয়্যার একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রযুক্তি পণ্য, যা প্রোগ্রামারগণ পেশাগত দক্ষতা, মেধা আর মননের সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটিয়ে তৈরি করে থাকেন এবং এগুলোর তাঁরাই স্বত্বাধিকারী হন। লাইসেন্সবিহীনভাবে বা স্বত্বাধিকারীর অনুমোদন ব্যতিরেকে এ ধরনের সফটওয়্যার কপি করা, নিজের নামে কিংবা কোনো প্রকার পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে ব্যবহারের সুযোগ নেয়া পাইরেসির আওতায় পড়ে। Business Software Alliance (BSA)-এর সূত্রমতে ব্যবহৃত সকল সফটওয়্যারের প্রায় ৩৬ ভাগই পাইরেটেড সফটওয়্যার। কপিরাইট আইন দ্বারা উন্নত দেশগুলোয় এই ধরনের অপরাধ প্রতিহত করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

প্লেজিয়ারিজম (Plagiarism) : কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কোনো লেখা, সাহিত্যকর্ম, গবেষণাপত্র, সম্পাদনা কর্ম ইত্যাদি হুবহু নকল বা আংশিক পরিবর্তন করে নিজের নামে প্রকাশ করাই হলো প্লেজিয়ারিজম। সঠিক সূত্র উল্লেখ ছাড়া কোনো কিছু রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহারও বেআইনি কাজ তথা প্লেজিয়ারিজমের আওতায় পড়ে।

সাইবার আইন

সাইবার অপরাধ দমনে বিভিন্ন দেশেই আইন চালু আছে। আমাদের দেশে ২০০৬ সালে প্রণীত ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬'-এর ৫৭(১) ধারামতে, “যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করে যা মিথ্যা ও অশ্লীল, যার দ্বারা কারও মানহানি ঘটে বা ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়, আর এ ধরনের তথ্যগুলোর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হলে অনধিক দশ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে'। এছাড়া, পর্ণগ্রাফি আইন-২০১২-তে বর্ণিত আছে, ‘কোনো ব্যক্তি ইন্টারনেট বা ওয়েবসাইট বা মোবাইল ফোন বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে পর্ণগ্রাফি সরবরাহ করলে সর্বোচ্চ ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।'

সর্বশেষ ২০১৮ সালে আমাদের দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণীত হয়, যার আংশিক উল্লেখ করা হলো :

  • কোনো ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোয় বেআইনি প্রবেশ করে ক্ষতিসাধন, বিনষ্ট বা অকার্যকরের চেষ্টা কিংবা কম্পিউটার সিস্টেম, নেটওয়ার্ক বা প্রোগ্রাম ধ্বংস/পরিবর্তন বা অকার্যকর করতে পারবেন না ।
  • ইলেকট্রনিক ডিভাইস, কম্পিউটার সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশ করতে পারবেন না, সেখান থেকে কোনো তথ্য বা উদ্ধৃতাংশ বা উপাত্তের অনুলিপি সংগ্রহ করতে পারবেন না।
  • ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে কারো সাথে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতারণা, জালিয়াতি বা ছদ্মবেশ ধারন করতে পারবেন না।
  • ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা,জাতির পিতা, জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে প্রচার বা অপপ্রচার কিংবা এতে মদদ দিতে পারবেন না। রাষ্ট্রের অখণ্ডতা, নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় এমন বিভ্রান্তিকর তথ্য অপপ্রচার বা কার্যকলাপ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা জাতিগত ঘৃণা-উস্কানি বা বিভেদ/বিদ্বেষ সৃষ্টি করে কিংবা সামাজিকভাবে বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয় এরূপ কোনো কার্যক্রম ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে করা যাবে না ।
  • ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি নষ্ট, অপমান বা অপদস্থ করা কিংবা ভয়ভীতি বা হুমকি প্রদর্শন করা যাবে না।
  • ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে ব্যাংক, বীমা ইত্যাদি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারি, আধাসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে আর্থিক ক্ষতি বা তছরুপ কিংবা অত্যন্ত গোপনীয় তথ্য চুরি, তথ্য পাচার করা যাবে না।

ডিজিটাল আইনের আওতায় উল্লিখিত কৃত অপরাধের জন্য বিভিন্ন মেয়াদের শাস্তি এবং আর্থিক দণ্ড প্রদানের বিধান রাখা হয়েছে।

তাই আমাদের জীবনের অন্যান্য প্রতিটি সেক্টরের ন্যায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিবেক, বুদ্ধি ও বিবেচনাকে নৈতিকতার মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিসহ সবধরনের অপরাধমূলক কাজের প্রবণতা হতে পরিত্রাণ পেতে পারি।

ভিন্ন ধরনের অপরাধ

অ্যান্টিয়াস্ট : প্রযুক্তি মোড়লদের বিরুদ্ধে শুনানি

আমরা যখন সাইবার ক্রাইম নিয়ে কথা বলি তখন সবসময়ই ব্যক্তিগত অপরাধ কিংবা ছোটখাটো অপরাধী সংগঠনের অপরাধ নিয়ে কথা বলি। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে সারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো অনেক বড় বড় অপরাধ করে শুধু দোষী সাব্যস্ত হয়নি তার জন্য শাস্তি ভোগ করেছে। ফেসবুক তার ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত ক্যামব্রিজ এনালিটিকাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে দিয়ে অনেক বড় অপরাধ করেছিল। হোয়াটসঅ্যাপ জন্য তাদেরকে ১১০ মিলিয়ন ইউরো জরিমানা করা হয়েছিল। কর ফাঁকি f দেওয়ার জন্য ২০১৬ সালে অ্যাপেল কোম্পানিকে আয়ারল্যান্ডকে ১৪.৫ বিলিয়ন ইউরো ফেরত দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইন ভঙ্গ করে অন্যান্য ছোট কোম্পানির অস্তিত্ব বিপন্ন করে বিশ্বাস ভঙ্গ করার জন্য গুগলকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ বিলিয়ন ইউরো জরিমানা করা হয়েছে। নিয়ম বহির্ভূত কাজের জন্য জার্মানিতে আমাজনের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে। এরকম উদাহরণের কোনো শেষ নেই, এই বড়ো বড়ো কোম্পানিগুলোর কাছে পৃথিবীর সবচাইতে বেশি ডেটা। যারা ডেটা নিয়ন্ত্রণ করে, তারা পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করে। কাজেই একধরনের আশঙ্কা আছে যে পৃথিবীর মানুষের সচেতন না হলে পুরো পৃথিবী একসময় কয়েকটি দৈত্যাকৃতির সফটওয়্যার কোম্পানির হাতে নিয়ন্ত্রিত হবে। সেটি যেন না হতে পারে সেজন্য সবার সচেতন থাকার প্রয়োজন আছে।

১.৫ সমাজ জীবনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রভাব (Impact of ICT in Social Life )

বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ। পৃথিবীর মানুষ তথ্য প্রযুক্তির সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া এখন একটি দিনও অতিবাহিত করতে পারে না। এক কথায় মানুষের জীবনযাত্রার সর্বস্তরে এর একটি অভাবনীয় প্রভাব রয়েছে। ১.৫.১ তথ্য প্রযুক্তির ইতিবাচক প্রভাব শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, কৃষি, প্রকাশনা, শিল্প-সংস্কৃতি ইত্যাদি সমাজের সর্বক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বহুমুখী প্ররোপ পরিলক্ষিত হয়ে আসছে। আইসিটির প্রভাবাধীন উল্লিখিত বিভিন্ন ক্ষেত্রের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিয়ে প্রদত্ত হলো।

শিক্ষা ক্ষেত্রে : তথ্য প্রযুক্তির সফল প্রয়োগ দ্বারা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির আবেদন, ফি ইত্যাদি পরিশোধ, ভর্তি, ফলাফল তৈরি ও প্রকাশ, রেজিস্ট্রেশন বা পরীক্ষার ফরম পুরণ, বিভিন্ন ফলাফল বিশ্লেষণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান নির্ধারণ, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সঠিক ও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি কাজে অত্যন্ত সহজ, দ্রুত ও নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে। তাছাড়া, দেশে অবস্থান করেও শিক্ষার্থীগণ বিশ্বসেরা বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, পড়াশুনা ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ডিগ্রি অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণেই।

বিজ্ঞান ও চিকিৎসাক্ষেত্রে : আমরা জানি, বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতির ধারায় তথ্য প্রযুক্তি বর্তমান উৎকর্ষতায় উন্নীত হয়েছে। ঠিক একইভাবে, তথ্য প্রযুক্তির প্রয়োগের মাধ্যমেই কিন্তু বিজ্ঞানের বহুমাত্রিক অগ্রগতিকে বহুগুণে ত্বরান্বিত করে চলেছে। অন্যান্য সেক্টর তো রয়েছেই, শুধু চিকিৎসাক্ষেত্র পর্যালোচনা করলে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের সুফল বলে শেষ করা যাবে না। অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে ও নিখুঁতভাবে রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে চিকিৎসা সেবা দেয়া, ঘরে বসে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণের পরামর্শ ও সর্বাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি জানা, সর্বশেষ আবিষ্কৃত ওষুধ সংগ্রহ ও ব্যবহারে সক্ষমতা এনে দিয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি।

ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে : ব্যাংকে অর্থ জমা-উত্তোলন, ক্লিয়ারিং হাউস বা আন্তঃব্যাংক লেনদেন, রেমিট্যান্স আদান-প্রদান, স্মার্ট কার্ড ব্যবহারে এটিএম বুথের মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন, মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন ব্যাংকিং, অনলাইনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিল গ্রহণ, দীর্ঘ বা স্বল্পমেয়াদি ঋণ অনুমোদন, ঋণের অর্থের পরিমাণ নির্ধারণ, সুদের হার নির্ণয়, মেয়াদ নির্ধারণ, শেয়ার কেনা-বেচা ইত্যাদি বহুবিধ কার্যক্রম তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে আজকাল অতি সহজেই সম্পন্ন করা যাচ্ছে। মোট কথা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা ও গ্রাহকসেবায় স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা আনয়নে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ভূমিকা প্রশ্নাতীত।

অফিস-আদালতে : আজকের বিশ্ব ব্যবস্থায় প্রায় সবধরনের প্রতিষ্ঠানের অফিস ব্যবস্থাপনায় পেশাদারিত্ব, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা, সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতে তথ্য প্রযুক্তির প্রয়োগ একটি অনিবার্য বিষয়। প্রজেক্ট প্রোফাইল তৈরি, কর্মী ব্যবস্থাপনা, টেন্ডার সংক্রান্ত কার্যক্রম, কমিশন, বেতন-ভাতা নির্ধারণ থেকে শুরু করে তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ-বিতরণে টেলিফোন, কম্পিউটার, প্রিন্টার, ইন্টারনেট প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার হয়ে আসছে। তাছাড়া, বিচারিক কার্যক্রমেও একজন বিচারপ্রার্থী অনলাইনে মামলা দায়েরসহ সাক্ষ্যপ্রমাণাদি সেখানে উপস্থাপন করতে পারছেন, যার ফলে বিচার প্রক্রিয়াতেও গতিশীলতা বেড়েছে অনেকাংশে।

শিল্প ক্ষেত্রে : বিশ্ববাজার অনুসন্ধানের মাধ্যমে কলকারখানার কাঁচামাল সংগ্রহ, পণ্যের ডিজাইন, উৎপাদন ও মাননিয়ন্ত্রণে উন্নত যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও ব্যবহার, ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রতিকূল পরিবেশে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র রোবটের ব্যবহার, জীবাণুমুক্ত খাদ্যপণ্য তৈরির ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা নিরূপণ, উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, বাজার ব্যবস্থাপনা, মজুদ ব্যবস্থাপনা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, উৎপাদিত পণ্য ক্রেতা সাধারণের কাছে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন, অনলাইনে অর্ডার গ্রহণ, পণ্য সরবরাহ, বিশ্ববাজার অর্থনীতির সাথে ভারসাম্য রক্ষা, বিশ্ববাজার প্রতিযোগিতায় প্রবেশ, প্রাধান্য বিস্তার ইত্যাদি শিল্পসংশ্লিষ্ট প্রতিটি ক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য।

কৃষি ক্ষেত্রে : কৃষি প্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রতিটি দেশের কৃষি ক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তির প্রয়োগ নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে বহু পূর্বেই। জনির ধরন, মাটির গুণগতমান, স্থানীয় আবহাওয়ার ধরন, শস্যবীজ প্রাপ্তি, দেশি বা বিশ্ববাজারে চাহিদানুযায়ী সকল তথ্য জেনে লাভজনক শস্য নির্বাচন সম্ভব তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে। বীজ বপনের সময় নির্ধারণ ও তার পদ্ধতি, জমির উর্বরতা বৃদ্ধির কৌশল, জমি তৈরির প্রক্রিয়া, পোকামাকড় আক্রমণের খরন, পোকার প্রকৃতি নির্ণয় ও নিধন, রোগ নির্ণয় ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা, ইত্যাদি কৃষি সংক্রান্ত যাৰতীয় কার্যক্রম তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে সম্ভব হচ্ছে।

উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থায় : আজকাল তথ্য প্রযুক্তি ছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা কল্পনাও করা যায় না। ব্যক্তিগত তথ্য যোগাযোগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের পণপরিবহন পর্যন্ত সর্বস্তরের যোগাযোগ ব্যবস্থায় তথ্য প্রযুক্তির প্রয়োগে ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ই-মেইল, ই-কমার্স, টেলিকমিউনিকেশন, ওয়্যারলেস যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নততর যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে।

শিল্প সংস্কৃতি ও বিনোদনের ক্ষেত্রে : তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে সারা বিশ্বে শিল্প-সংস্কৃতি ও বিনোদনের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। অবাধ তথ্য প্রবাহের কারণে সাংস্কৃতিক বিনিময় ও বিনোদনের নব নব মাত্ৰা সংযুক্তি মানৰ জীবনকে আরেশি করে তুলেছে। সেই সাথে যুগোপযোগী ভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিত হয়ে তদনুযায়ী দেশীয় সংস্কৃতির মূলধারার পাশাপাশি এর মানোন্নয়নও ঘটানো সম্ভব হচ্ছে।

১.৫.২ তথ্য প্রযুক্তির নেতিবাচক প্ৰভাব

আসক্তি : তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণহীন অবাধ ব্যবহারের ফলে পারিবারিক, সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নেতিবাচক অবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (যেমন- ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি) ব্যবহারের তীব্র আসক্তির ক্ষতিকারক প্রভাৰ আশঙ্কাজনক মাত্রায় বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে অল্পবয়সি শিক্ষার্থীরা পড়াশুনায় অমনোযোগী, নৈতিক-অনৈতিকতার তফাত শনাক্ত করতে না পারা, শুদ্ধাচারে অনীহাসহ নানা অসামাজিকতার শিখতা তাদের পেয়ে বসছে। অভিভাবকগণও এর আসক্তি থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছেন না; যার দরুন কর্মক্ষেত্রে শ্রমঘণ্টা নষ্ট, অনৈতিক কার্যকলাপে অর্থহীনভাবে সময়ক্ষেপণ, স্বাভাবিক পারিবারিক নিয়মাচারে ব্যত্যয়, সন্তানদের সময় না দেয়া বা তাদের প্রতি যত্নবান না হওয়ায় অনেক অনভিপ্রেত ঘটনার জন্ম হচ্ছে। অনলাইনে গেমসের আসক্তি আরো ভয়াবহ প্ৰভাৰ ফেলছে সামাজিক জীবনে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এতে কালক্ষেপণ মাদকাসক্তির মতো ভয়ংকর নেশাগ্রস্ততায় নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে সমাজের একটি বিরাট অংশ। এসব গেমসের জন্য নিজের সন্ধান বিক্রির মতো চরম অনৈতিক ঘটনাও সংঘটনের খবর পাওয়া গেছে। অনলাইন গেমসে আসক্ত হয়ে ব্যবহারকারীদের মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার মতো ঘটনাও বিভিন্ন দেশে ঘটেছে। জনৈক রাশিয়ান নাগরিকের সৃষ্ট গেমসের মাধ্যমে অনেক ছেলেমেয়ে আত্মহত্যা বা অকাল মৃত্যুর খবর আমরা সবাই অবগত আছি। এছাড়া বিদেশি সংস্কৃতির বিরূপ প্রভাব তো রয়েছেই। আজকালকার প্রতিটি দেশের চলচ্চিত্রে প্রদর্শিত মারামারি, খুনাখুনি ও অন্যান্য ভায়োলেন্স অনুকরণ করে উঠতি বয়সি ছেলেমেয়েদেরকে সহিংস করে তুলছে। এসবের ফলে আচার-আচরণ, মানসিকতা, পোশাক- পরিচ্ছেদে নেতিবাচক পরিবর্তন লক্ষণীয় মাত্রায় বাড়তে দেখা যাচ্ছে। অবাধ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অপব্যবহারে কুরুচিপূর্ণ ছবি বা ভিডিও এখন স্বল্পমূল্যের মোবাইল ফোনেও দৃশ্যমান।

অপরাধ : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র আসক্তির কারণে কোমলমতি শিশু-কিশোরসহ সমাজের এক বৃহদংশ বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। মতলববাজ হ্যাকাররা নানা কৌশলে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্য চুরি/পাচার, সাইবার হামলা, নেতিবাচক প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দিয়ে সমাজে অস্থিতিশীল পরিবেশের জন্ম দিতে পারে।

স্বাস্থ্যগত সমস্যা : তথ্য ও যোগাযোগ সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি বিশেষত কম্পিউটারের অত্যধিক ব্যবহারের ফলে চোখের উপর চাপ পড়ে, মাথা ব্যথা, হাত ব্যথা, ঘাড় ও পিঠের সমস্যায় আক্রান্ত হতে দেখা যায় অনেককেই রাত জেগে মোবাইল ফোন ব্যবহার, কম্পিউটার বা ইন্টারনেটে সময় কাটানোর কারণে স্নায়বিক ও মস্তিষ্কের নানাবিধ অসুস্থতাও পরিলক্ষিত হচ্ছে।

পরিশেষে বলা যায়, চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত সার্জারির চাকুর ব্যবহার যথাযথভাবে না করে খুন-খারাবির কাজের অপব্যবহার রোধ করার দায়িত্ব সার্জারি-চাকুর নয়, এই দায়িত্ব আমাদের সবার। একইভাবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমে মানব সভ্যতাকে আরো অনন্যমাত্রায় অধিষ্ঠিত করার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতেই হবে।

১.৬ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন (ICT & Economical Development)

অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে একটি দেশের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নকেই বোঝায়। উন্নত জীবনযাত্রা মানে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা, সাধারণ মানুষের আয়ের স্তর বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত হওয়া, নিরাপদ জীবন ব্যবস্থা থাকা এবং সবার উপর নাগরিকদের মৌলিক চাহিদাগুলো অনায়াসে পূরণ হওয়াকে বোঝায়। তথ্য প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতিতে নাগরিক জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে উন্নয়নের ছোঁয়ায় মানুষের জীবন আরো বেগবান, সহজ, নিরাপদ এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়েছে। সেইসাথে অবাধ তথ্য প্রবাহের জন্য পুরো পৃথিবীকেই একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত করে দিয়েছে।

আজকের বিশ্বে কম্পিউটার, সাবমেরিন কেবল এবং স্যাটেলাইট প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সকল উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোই নিজেদের মতো করে তথ্য প্রবাহের মহাসড়কে প্রবেশ করে চলেছে। এর সূত্র ধরে অর্থনীতিবিদগণ বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে, উন্নত দেশগুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর উৎপাদন খরচ অনেক কম হওয়ায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আইসিটির উন্নয়নের মাধ্যমে তাদের উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ভূমিকা

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, এদের সমৃদ্ধির পিছনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিগত উন্নয়ন অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছে। এই খাতে প্রচুর বিনিয়োগে বেড়েছে মূলধন এবং প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে বহুগুণে। ইউরোপীয় এবং উন্নত দেশগুলোয় জিডিপি- ( GDP : Gross Domestic Product) বৃদ্ধির কারণ হিসেবে অর্থনীতির গবেষকগণ টেলিকমিউনিকেশন খাতের উন্নয়নকে চিহ্নিত করে থাকলেও সিংগাপুর, কোরিয়ার মতো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণ হিসেবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নকেই চিহ্নিত করেছেন।

উন্নয়ন প্রক্রিয়া : গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংঘটনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নিচে উল্লিখিত প্রক্রিয়ায় কাজ করে থাকে :

  •    শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও বেকারত্ব দূরীকরণের ক্ষেত্রে সমঅধিকার নিশ্চিতকরণ।
  • সহজ পদ্ধতিতে তথ্য প্রাপ্তির ব্যবস্থাকরণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সক্ষমতা সৃষ্টি।
  • মানসম্মত কিন্তু তুলনামূলকভাবে কম দামের আইসিটি দ্রব্যের সহজলভ্যতা।
  •  দেশের সর্বস্তরে ই-গভর্নেন্সের (ইলেকট্রনিক গভর্নেন্স) চালুর মাধ্যমে সরকারি আমলাতন্ত্র হ্রাস।
  • প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে বৃহৎ বাজার-সুবিধা প্রদান এবং স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে যোগাযোগ এবং সহযোগিতার মনোভাব তৈরি।

জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি : আইসিটির উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে জন্ম নিচ্ছে নতুনতর অর্থনীতি, যার নাম জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি বা নলেজ ইকোনমি। জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি বিকাশের সাথে সাথে আমেরিকা, ইউরোপ কিংবা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে বিপুল পরিমাণ ডেটা প্রসেসিং বা প্রক্রিয়াকরণের। যার ফলে উন্নয়নশীল দেশসমূহ আইসিটি এনাবল্ড সার্ভিসগুলোকে কাজে লাগিয়ে অর্জন করছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। শুধু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন নয়, এর ফলে বিপুল সংখ্যক প্রশিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

বাংলাদেশের অর্থনীতি পৃথিবীর দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতি। বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য দেশের তুলনায় World Economic Forum-এর উন্নয়ন সূচকে আমরা ৩৪ তম অবস্থানে রয়েছি এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এই অবস্থান ২৪ তম হবে মর্মে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশকে উন্নয়নের সূচকে পৃথিবীর ‘পরবর্তী এগারোটি দেশের একটি দেশ বিবেচনা করা হয়।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি দুইভাবে অর্থনীতির উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। প্রথমটি হলো সরাসরি সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রির নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। আর দ্বিতীয়টি হলো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নতির ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন সেবার মাধ্যমে। এদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দেশীয় মোট উৎপাদনের ৮% ভাগ প্রবৃদ্ধি আইসিটি খাতের অবদান বলে অনুমান করা হয়। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউট-এর মতে বিশ্বের মধ্যে অনলাইন কর্মীর সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি : ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ৮০০ (আটশত) রেজিস্টার্ড সফটওয়্যার কোম্পানি রয়েছে, অনুমান করা হয় এর পাশাপাশি অনিবন্ধিত আরো অনেক সফটওয়্যার কোম্পানি দেশে কাজ করছে। সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোতে ৩০ হাজার থেকে বেশি পেশাজীবী কাজ করছেন এবং এর মোট রাজস্বের পরিমাণ ২৫০ মিলিয়ন ডলার। ২০১৬-১৭ সালে এই খাতে বাংলাদেশের আয় ছিল ৮০০ (আটশত) মিলিয়ন ডলার এবং ২০২১ সালের ভেতর এটিকে এক বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ উদ্যোগ : ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতকরণকে বোঝায়, যার মূল দায়িত্বটি পালন করতে হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে আমূল পরিবর্তন হয়েছে। দেশে বিদেশে টাকা পাঠানো অনেক সহজ হয়েছে। ইন্টারনেট দিয়ে নানা ধরনের বিল প্রদান করা যায়, এমনকি আয়কর পরিশোধ করা যায়। ২০২০ সালে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের সময় দেশে টেলিমেডিসিন ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা শুরু হয়েছিল।

আমাদের দেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সেবা জনগণের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য একসেস টু ইনফরমেশন (a2i) প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় তথ্য অফিসের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগাযোগ স্থাপনের কাজ চালু হয়েছে। এতে করে তৃণমূল পর্যায়ের প্রশাসনিক ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি সরকারি সবধরনের পরিষেবার তথ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ অফিস, সাব-পোস্ট অফিসে তথ্য ও সেবা কেন্দ্র চালু করে সরকারি সবধরনের ডিজিটাল সার্ভিস সেবা প্রদান অব্যাহত রয়েছে।

কৃষি সেবা : বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় অংশটি কৃষি খাত থেকে আসে কাজেই কৃষি ব্যবস্থায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার অর্থনীতির উন্নয়নে একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। গণমাধ্যমে নানা ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষকদের ফসল, কৃষিপদ্ধতি, বাজারজাতকরণ সম্পর্কে নানা ধরনের তথ্য দেওয়া হয়। দেশের সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কৃষকদের নানা ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ গড়ে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশ এই ধরনের উদ্যোগে সুফল পেতে শুরু করেছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বহুগুণে বেড়ে গেছে।

শিল্প ও উৎপাদন : বাংলাদেশের প্রধান শিল্প গার্মেন্টস যেখানে ২০১৮ সালে ৩৬.৬৭ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি বাণিজ্য হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার করে সমগ্র বিশ্বে নতুন বাজার ধরা, রপ্তানিযোগ্য পণ্য নির্বাচন কিংবা প্রয়োজনে ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে আলাপ-আলোচনা সবকিছুই আজকাল তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্পাদন হয়। গার্মেন্টস ছাড়াও রপ্তানি বাণিজ্যে জাহাজ নির্মাণ, মৎস্য, পাট, চামড়া শিল্প এবং ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশ বড় ভূমিকা রেখেছে এবং এ সবগুলোর বিকাশেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বড় ভূমিকা রাখা সম্ভব।

দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থান : এক সময়ে আশঙ্কা করা হতো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিস্তারের কারণে অনেকের চাকুরি চলে গিয়ে বেকারত্ব বাড়বে। বাস্তবে এর সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা ঘটেছে এবং যার ফলস্বরূপ লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক-যুবতীর কর্মসংস্থান হয়েছে। সে কারণে আইসিটি প্রফেশনালদের চাহিদা দেশে- বিদেশে বেড়েই চলছে। অতীতের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, বিশ্বে প্রায় তিন মিলিয়ন আইটি পেশাজীবীর প্রয়োজন ছিল। বর্তমানে এ সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি দাঁড়িয়েছে। যদি বিশ্ব চাহিদার প্রেক্ষিতে আমাদের দেশের প্রায় ৫০ হাজার আইটি প্রফেশনাল সরবরাহ করতে পারি তবে বর্তমান রেমিটেন্স বহুগুণে বাড়ানো সম্ভব। আমাদের দেশের প্রায় এক কোটি লোক বিদেশে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে এবং তাদের পাঠানো রেমিটেন্স আমাদের জিডিপি-এর প্রায় ১০ শতাংশ পূরণ করে থাকে। যদি এই শ্রমিকদের তথ্য প্রযুক্তিতে ন্যূনতম প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠানো সম্ভব হয় তাহলেও তারা শুধু যে উন্নততর জীবন যাপন করতে পারবে তাই নয়, আমাদের অর্থনীতিতেও অনেক বেশি অবদান রাখতে পারবে।

 

Content added By
Promotion