নবম অধ্যায়
ন্যায্যতা, শান্তি ও আত্মসংযম
মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও বিশ্বায়নের এই যুগে আমাদের দরকার মানবীয়, নৈতিক ও ধর্মীয় গুণাবলি সমৃদ্ধ একটি খ্রিষ্টীয় সমাজ। যীশুর দেখানো পথ অনুসরণ করে চলার জন্য ও আদর্শ পরিবার গঠনের মাধ্যমে খ্রিস্টীয় বিশ্বাসে সার্বজনীন বিশ্বসমাজ গড়ে তোলার জন্য দরকার ন্যায্যতা। ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে, শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করার প্রয়োজনে সকলের সাথে সহাবস্থান করতে হবে এবং এর জন্য প্রত্যেকের মাঝে থাকতে হবে আত্মসংযম। এই সকল গুণ নিয়ে বেড়ে উঠলে অবশ্যই ব্যক্তিজীবন ও সামাজিক পরিবেশ হবে সুখময়, যা সবারই কাম্য।
ন্যায্যতার প্রতীক দাঁড়িপাল্লা
এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা
• ন্যায়বিচারের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব;
• ন্যায়বিচার সম্পর্কে পবিত্র বাইবেলের শিক্ষা বর্ণনা করতে পারব;
পরিবার ও সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করতে পারব;
সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি আনয়নে ন্যায়বিচারের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব;
পবিত্র বাইবেলে আত্মসংযম বিষয়ক শিক্ষা বর্ণনা করতে পারব : নিজ জীবনে আত্মসংযমের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে পারব;
• শান্তিশৃঙ্খলাপূর্ণ সমাজ গঠনে আত্মসংযমের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব
নিজ জীবন, পরিবার ও সমাজে ন্যায্যতা ও শাস্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হব।
খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা
পাঠ ১ : ন্যায্যতা
ন্যায্যতা হলো একটি নৈতিক গুণ। ন্যায্যতাকে নৈতিক গুণ বলা হয় এই কারণে যে, এটি যার মধ্যে আছে, সে নৈতিক চরিত্রবান ব্যক্তিতে পরিণত হয়। ন্যায্যতা হচ্ছে ঈশ্বর ও প্রতিবেশীর যা প্রাপ্য তা ফিরিয়ে দেওয়ার অবিচল ও অবিরাম ইচ্ছা। কাজেই ন্যায্যতা দুই রকমের আছে—ঈশ্বরের প্রতি ন্যায্যতা এবং মানুষের প্রতি ন্যায্যতা। ঈশ্বরের প্রতি ন্যায্যতাকে বলা হয় 'ধর্মের গুণ'। মানুষের প্রতি ন্যায্যতা হচ্ছে প্রত্যেক ব্যক্তির অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও মানব সম্পর্কের মধ্যে মিলন স্থাপনের ইচ্ছা জাগ্রত করা। এর ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় এমন এক সমতা যা ব্যক্তি ও সমাজের মঙ্গলের সাথে সম্পর্কিত। পবিত্র বাইবেলে ন্যায্যতার কথা বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে। ন্যায্যতার নিজস্ব গভীরতম গুণ হলো সর্বদা অভ্যাসগত ও ন্যায়সম্মত চিন্তা করা ও প্রতিবেশীর প্রতি আচরণে সর্বদা সততা বজায় রাখা।
ন্যায্যতার বিশেষ দিকগুলো হলো :
১। সঠিক যুক্তিযুক্ত, যথাযথ বা সুবিবেচনাপূর্ণ হওয়া;
২। সমাজের প্রথাগত নৈতিক রীতিনীতির সাথে সংগতিপূর্ণ হওয়া বা সেগুলো অনুসরণ করে চলা;
৩। নৈতিক বাধ্যবাধকতাসমূহের প্রতি দৃঢ়ভাবে অনুগত থাকা; ৪। মানবীয় ও ঐশ্বরিক আইনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা;
৫। পরস্পরের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে সততা অনুসরণ করা;
৬। আচরণে ও মতামত প্রকাশে সৎ হওয়া এবং বাস্তবতার সাথে মিল রাখা;
৭। কাজেকর্মে সৎ, বিশ্বস্ত ও বিবেকবান থাকা।
ন্যায়ধর্মে অবিচল থেকে কাজ করা মানেই অপরের জন্য সঠিক কাজ করা। ন্যায় থেকে আসে ন্যায্যতা। ন্যায্যতা অন্তরে স্থান দেওয়ার অর্থই মানবিক মূল্যবোধে নিজেকে আলোকিত করা। যে কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জন্য ন্যায্যতা অতীব প্রয়োজনীয় একটি গুণ যা সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের কাছ থেকে আসে।
কাজ সমাজের কোন কোন ক্ষেত্রে ন্যায্যতা আছে ও কোন কোন ক্ষেত্রে নেই। দলীয় আলোচনার মাধ্যমে তার একটি তালিকা তৈরি কর ও পোস্টারের মাধ্যমে উপস্থাপন কর।
ন্যায্যতা, শাস্তি ও আত্মসংযম
৮১
পাঠ ২ : পৰিত্ৰ বাইবেলে ন্যায্যতা বিষয়ক শিক্ষা
ঈশ্বর ন্যায়বান। পবিত্র বাইবেলের অনেক স্থানে আমরা এই বিষয়ে বক্তব্য শুনি। প্রবক্তা ইসাইয়ার মধ্য দিয়ে আমরা শুনতে পাই, “তবুও ঈশ্বর কিন্তু সেই দিনের প্রতীক্ষায় রয়েছেন যখন তিনি তোমাদের প্রতি নিজের করুণা দেখাতে পারবেন; সেদিন তিনি তাঁর মহত্ত্ব প্রকাশ করে তোমাদের দয়াই করবেন । ঈশ্বর তো ন্যায়বান; তাঁর পথ চেয়ে থাকে যারা ধন্য ধন্য তারা সকলেই।" (ইসা ৩০:১৮)। সামসংগীতে আমরা একই ভাব লক্ষ করি। এখানে বলা হয়েছে, “ধার্মিকতা ও ন্যায়নীতিতে পরম প্রীত তিনি; ঈশ্বরের ভালোবাসায় জগৎ উচ্ছলিত (সাম ৩৩:৫)। প্রবক্তা ইসাইয়ার মুখ দিয়েই আরও শুনি, “আমি এই যা বলছি, তা মন দিয়ে শোন তোমরা, যারা আমার আপন মানুষ: কান পেতেই শোন তোমরা, যারা আমার আপন জনগণ। শিক্ষাবাণী আমারই মুখ থেকে উচ্চারিত হবে, আমার ন্যায়নীতিকে আমি অচিরেই বিজাতীয়দের আলো করে তুলব” (ইসা ৫১:৪-৫)। “কারণ আমি, ঈশ্বর, ন্যায়নীতি ভালোবাসি, যত চুরি জোচ্চুরি ঘৃণার চোখেই দেখি, তাই বিশ্বস্তভাবেই তাদের পুরস্কৃত করব সেদিন” (ইসা ৬১:৮)।
ন্যায়বান ঈশ্বর তাঁর জাতিকে ন্যায্যতা সহকারে অর্থাৎ বিধি বিধান মতেই পালন করেন। মেঘদলের সাথে তাঁর জাতির লোকদের তুলনা করে তিনি বলেন, “আমি নিজেই আমার মেষগুলোকে প্রতিপালন করব, নিজেই তাদের দেব শয়নের স্থান, একথা বলছেন স্বয়ং প্রভু ঈশ্বর। যে মেষটি হারিয়ে গেছে, তাকে খুঁজতে যাব; যেটি দলছাড়া হয়ে পড়েছে, তাকে দলে ফিরিয়েই আনব। যেটি আহত হয়েছে, তার ক্ষতস্থান আমি বেঁধে দিব; যেটি রুগ্ণ, তাকে সুস্থ সবল করে তুলব। আর যে মেষটি নধর, যে মেঘটি সুস্থ সবল, তাকে সর্বদাই আগলে রাখব আমি। আমার মেষগুলোকে আমি ন্যায্যতা সহকারেই প্রতিপালন করব" (এজেকিয়েল ৩৪:১৫-১৬)।
ন্যায়বান ঈশ্বরের কাছ থেকে দীনদুঃখীরা সুবিচার পাবেই। সামসংগীতের ভাষায় আমরা শুনতে পাই, “জানি, আমি জানি, দীনদুঃখী মানুষেরা ঈশ্বরের সুবিচার পাবে; দরিদ্ররা পাবে নিজেদের ন্যায্য অধিকার।" (সাম ১৪০:১২)। কিন্তু অন্যদিকে যীশু সমালোচনা করেন শাস্ত্রী ও ফরিসিদের। কারণ তারা ন্যায়নিষ্ঠতা পালন করেন না। তিনি বলেন, “হায় হায় আপনারা, শাস্ত্রীরা আর ফরিসিরা যত ভণ্ডের দল! আপনারা তো আপনাদের পুদিনা, মৌরী আর জিরার দশ ভাগ নৈবেদ্য হিসাবে দিয়েই থাকেন, অথচ বিধানের গুরুতর নির্দেশগুলো যেমন: ন্যায়নিষ্ঠা, দয়ামায়া, বিশ্বস্ততার নির্দেশ-এগুলো আপনারা কিন্তু উপেক্ষাই করেন" (মথি ২৩:২৩)।
শিষ্যচরিত গ্রন্থে আমরা দেখি, ঈশ্বর জগৎসংসারের ন্যায়বিচার করবেন, “মানুষ যে যুগে এই কথা বুঝতে পারত না, সেই যুগে পরমেশ্বর তা ক্ষমার চোখেই দেখেছেন; কিন্তু এখন মানুষের কাছে তাঁর আদেশ এই যে, সকল জায়গার সকল মানুষকেই মন ফেরাতে হবে। কারণ তিনি এমন একটি দিন স্থির করে রেখেছেন, যেদিন তিনি জগৎ সংসারের ন্যায়বিচার করবেন; আর তিনি তা করবেন তাঁরই মনোনীত একজন মানুষের দ্বারা। এর প্রমাণও তিনি তো দিয়েছেন; সেই মানুষটিকে তিনি তো মৃতদের মধ্য থেকে পুনরুত্থিত করেছেন" (শিষ্য ১৭:৩০-৩১)। তাই সামসংগীতের মাধ্যমে ন্যায়বান মানুষকে প্রশংসা করা হচ্ছে- “ধন্য তারা, ন্যায়নীতি মেনে চলে যারা, সর্বদাই ন্যায়কর্ম করে চলে যারা" (সাম ১০৬:৩)।
ন্যায়বান ঈশ্বর চান তাঁর জাতির লোকেরা যেন ন্যায়বান হয়ে ওঠে, “শোন, মানুষ, যা শ্রেয়, যা ঈশ্বর তোমার কাছ থেকে পেতে চান, তা তিনি তো নিজেই তোমাকে জানিয়ে দিয়েছেন। আর কিছু নয় শুধুমাত্র ন্যায়ধর্ম পালন করা, ভক্তি ভালোবাসাকে হৃদয়ে গেঁথে রাখা আর নম্র চিত্ত নিয়ে তোমার ঈশ্বরের সঙ্গী হয়ে জীবনপথে চলা, আর কিছু নয়, এই তো তিনি চান" (মিথা ৬:৮)। খাঁটি ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ঈশ্বর আরও বলেন, “বিশ্বপতি ঈশ্বর তো বারবার এই কথা বলছেন ন্যায়নীতির মানদণ্ডেই শাসন কর। একজন আর একজনের প্রতি ভালোবাসা, মায়ামমতা দেখাও। কোনো বিধবা, অনাথ, প্রবাসী বা দীনজনের উপর শোষণ চালিও না মনে-মনে কেউ কারও অনিষ্ট করার মতলব এঁটো না" (জাখারিয় ৭:৯) ঈশ্বর চান যেন তাঁর সেবক নিজ দেশে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করেন, “এই দেখ আমার সেবক, আমার মনোনীত জন; এ আমার একান্ত প্রিয়জন, আমার প্রাণের প্রীতিভাজন! আমি এর উপর আমার আত্মিক প্রেরণার অধিষ্ঠান ঘটাব এ তো সকল জাতির কাছে ঘোষণা করবে ঐশ ন্যায়নীতির বাণী" (মথি ১২:১৮)। তাই তাঁর সেবকের ডাক শুনে কেউ যদি না-ও আসে, তবুও একা হলেও তাকে ন্যায়নীতি অনুসরণ করতে হবে, "ন্যায়নীতির পথেই চলবে তুমি, ন্যায়নীতিরই পথে, তাহলে তুমি প্রাণে বেঁচে থাকবে এবং তোমার ঈশ্বরের দেওয়া দেশ নিজের অধিকারে রাখতেও পারবে” (ছি:বি: ১৬:২০)। ঈশ্বর তাঁর সেবককে স্মরণ করিয়ে দেন, তিনি যেন সকলের জন্যই ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত করেন, “যে লোক প্রবাসীকে, অনাথকে বা বিধবাকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তার উপর বর্তাবে অভিশাপ!” (দ্বি:বি: ২৭: ১৯)।
ইসাইয়া বলেন, “হায় রে ভারা, যারা অন্যায় যত বিধিনিয়ম জারি করে থাকে, যারা রচনা করে যত অত্যাচারের আইন। এভাবে তারা দুর্বল-অসহায় মানুষকে ন্যায়বিচার পেতেই দেয় না, আমার জাতির যত দীনদরিদ্রকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিতই করে। তারা বিধবাদের করে তোলে নিজেদের স্বার্থের শিকার: অনাথদের সব কিছু কেড়ে নেয় তারা" (ইসা ১০: ১-২)
কাজ : ন্যায্যতা সম্পর্কে পবিত্র বাইবেলের উদাহরণগুলোর সারাংশ খাতায় লেখ।
পাঠ ৩ : পরিবার ও সমাজে ন্যায্য প্রতিষ্ঠা
অষ্টকল্যাণ বাণীর চতুর্থ বাণীতে যীশু বলেছেন, “ধর্মময়তার জন্য ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত যারা, ধন্য তারা—তারাই পরিতৃপ্ত হবে" (মথি ৫:৬)। ধর্মময়তার অর্থ ন্যায্যতা। ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য যারা ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত, অর্থাৎ যাদের মনে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য একান্ত বাসনা আছে ও সর্বদা শতকরা একশত ভাগ চেষ্টা করে, তারা ঈশ্বরের চোখে ধন্য। সাধু টমাস আকুইনাসের মতে "ন্যায্যতা হলো যার যা প্রাপ্য তাকে তা ফিরিয়ে দেওয়ার ক্রমাগত ইচ্ছা।" "যার যা প্রাপ্য' বলতে দুই ধরনের পাওনা বোঝায়। প্রথমটা হলো মানুষের প্রাপ্য আর দ্বিতীয়টা হলো ঈশ্বরের প্রাপ্য। যীশু একবার বলেছিলেন, যা সিজারের, তা সিজারকেই (অর্থাৎ মানুষকে) দাও; আর যা ঈশ্বরের, তা ঈশ্বরকেই দাও” (মথি ২২:২১)। এই দুই ধরনের প্রাপ্য যখন আমরা মিটিয়ে দিতে পারি তখনই আসে প্রকৃত ন্যায্যতা ।
প্রথমে আমরা দেখি কীভাবে আমরা ঈশ্বরের প্রাপ্য মিটিয়ে দিতে পারি। ঈশ্বরের প্রাপ্য যথাযথভাবে মিটিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে পারি
১। সবসময় ঈশ্বরের ইচ্ছা পূরণ করা বা তাঁর ইচ্ছানুসারে কাজ করা। আমাদের বিবেকের মধ্য দিয়ে আমরা ঈশ্বরের ইচ্ছা জানতে পারি। বিবেকের কথা মেনে কাজ করলে ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুসারে চলা হয় ঈশ্বরের ইচ্ছানুসারে চলার জন্য যদি আমরা সত্যিই তৃষ্ণার্ত হই তবে আমাদের ভিতর থেকে সর্বদাই তাঁর ইচ্ছা পালনের আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠবে। প্রভু যীশু সর্বদা পিতার ইচ্ছা পালন করতেন । কারণ তিনি পিতার ইচ্ছা পালনের জন্য তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত ছিলেন। যীশু বলেন, "যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন, তিনি আমার সঙ্গেই আছেন। যে সমস্ত কাজে তিনি প্রীত হন, আমি সর্বদা ভা-ই করে থাকি" (যোহন ৮:২৯)। তিনি আরও বলেন, “যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন, তাঁর ইচ্ছা মেনে চলা এবং তাঁর দেওয়া কাজ সম্পন্ন করা, সেই তো আমার খাবার” (যোহন ৪:৩৪ )। গেৎসিমানি বাগানে প্রার্থনা করার সময়ও যীশু পিতার ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন : পিতা, আমার ইচ্ছা নয়, তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক। এভাবে পিতার ইচ্ছা পালনের মাধ্যমে যীশু পিতার সাথে সম্পর্ক রাখেন। তাই তিনি তাঁর অনুসারীদের উদ্দেশে বলেন, যারা আমাকে শুধু “প্রভু, প্রভু” বলে তারা নয়, বরং যারা পিতার ইচ্ছা জেনে তা পালন করে তারাই স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে। তিনি আমাদেরকে যে প্রার্থনাটি শিখিয়েছেন, সেখানেও তিনি আমাদেরকে পিতার ইচ্ছা পালনের বিষয়টি শিখিয়েছেন। আর একবার তিনি যখন লোকদের মাঝে কথা বলছিলেন, তখন একজন এসে বলল যে তাঁর মা ও ভাইয়েরা বাইরে অপেক্ষা করছেন। তখন তিনি উত্তরে বলেছিলেন, “কে আমার মা, আর কারাই বা আমার ভাই? যে-কেউ আমার স্বর্গনিবাসী পিতার ইচ্ছা পালন করে, সেই তো আমার ভাই, আমার বোন, আমার মা” (মথি ১২:৪৬-৪৯)।
২। আমাদের প্রতিদিনকার দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহের মধ্য দিয়েও পিতার ইচ্ছা প্রকাশিত হয়। সেই কাজগুলো হোক ছোট হোক বড়, সবই আমাদের যথাযথ চেষ্টা করতে হবে ভালোভাবে করার জন্য। সেগুলো পালন করার মাধ্যমেও আমরা পবিত্রতার পথে এগিয়ে চলতে পারি। এগুলোর মাধ্যমেই আমরা পিতার যা প্রাপ্য তা পিতাকে দিতে পারি।
৩ । আমাদের সকলকেই ঈশ্বর কিছু-না-কিছু গুণ দিয়েছেন। সেগুলো যদি আমরা যথাযথভাবে বিকশিত করে তোলার মাধ্যমে ফলশালী হই তখন আমরা ঈশ্বরের প্রাপ্য ঈশ্বরকে দিতে পারি। এখানে আমরা স্মরণ করতে পারি যীশুর সেই উপমাটি। যে ব্যক্তি পাঁচ শ' মোহর পেয়েছিল সে তা বাড়িয়ে এক হাজার বানিয়েছিল। যে ব্যক্তি দুই শ' মোহর পেয়েছিল সেও তা বাড়িয়ে চার শত বানিয়েছিল। তাই মনিব তাদের দুইজনকেই প্রশংসা করেছিলেন। কিন্তু যে ব্যক্তি এক শ' মোহর পেয়েছিল সে তা মাটিতে গর্ত খুঁড়ে লুকিয়ে রেখেছিল। মনিব তাকে শাস্তি দিয়েছিলেন। আমাদেরও ঈশ্বরপ্রদত্ত গুণগুলো বাড়িয়ে তুলতে হবে। তবেই আমরা ঈশ্বরের পাওনা ঈশ্বরকে দিতে পারি।
এবার আসা যাক মানুষের যা পাওনা তা মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টিতে। নিম্নলিখিতভাবে আমরা মানুষের পাওনা মানুষকে ফিরিয়ে দিতে পারি-
১। আমার পরিবার, সমাজ ও মণ্ডলী যেখানে আমি বাস করছি, আমার চারপাশে যারা আছে, তাদের প্রতি আমার করণীয়সমূহ যথাযথভাবে করার মাধ্যমে আমি তাদের পাওনা ফিরিয়ে দিতে পারি
২। অন্যের প্রতি মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করে আমরা অন্যদের প্রতি তাদের প্রাপ্য ফিরিয়ে দিতে পারি।
৩। অন্যের বিশ্বাস, ধ্যানধারণা ইত্যাদিকে স্বীকৃতি ও মর্যাদা দিয়ে আমরা তাদের প্রাপ্য ফিরিয়ে দিতে
পারি । ৪। চিন্তা, কথা ও কাজে সততার পরিচয় দিয়ে খাঁটি ও খোলামনের মানুষ হয়ে আমরা সকল মানুষের কাছে তাদের পাওনা ফিরিয়ে দিতে পারি।
৫। মানুষের মধ্য দিয়ে হোক বা সরাসরি হোক, প্রতিদিনই আমরা যতকিছু ঈশ্বরের কাছ থেকে পাচ্ছি, সবকিছুর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আমরা অন্যদের পাওনা ফিরিয়ে দিতে পারি
কাজ : ঈশ্বর ও মানুষের সাথে ন্যায্যতার সম্পর্ক স্থাপনের জন্য কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পার তা দুইটি কলামে লেখ ।
ন্যায্যতা, শাস্তি ও আত্মসংযম
পাঠ ৪ : ন্যায্যতার ফল শাস্তি
পৃথিবীর সকল দেশের সকল মানুষ শান্তি চায়। ঈশ্বরও সকল মানুষকে শান্তি দিতে চান। সেজন্যেই তিনি তাঁর একমাত্র পুত্রকে এজগতে প্রেরণ করেছেন। তিনি মানব হয়ে জন্মগ্রহণ করার বহু পূর্বে প্রবক্তা ইসাইয়ার মধ্য দিয়ে ঈশ্বর বলেছিলেন, “অন্ধকারে পথ চলছিল যারা, সেই জাতির মানুষেরা দেখেছে এক মহান আলোক, ছায়াচ্ছন্ন দেশে যারা বাস করছিল, তাদের উপর ফুটে উঠেছে একটি আলো। হে ঈশ্বর, তুমি তাদের দিয়েছ অসীম আনন্দ, কত গভীর তাদের উল্লাস। তোমার সঙ্গসুখে তারা আনন্দিত, মানুষ যেমন আনন্দিত হয় ফসল কাটার সময়ে, মানুষ যেমন উল্লসিত হয় লুণ্ঠিত সম্পদ ভাগ করার সময়ে। কেননা যে জোয়ালের ভার তাদের উপর চেপে বসেছিল, যে-বাঁক তাদের কাঁধের উপর দুর্বহ হয়ে উঠেছিল এবং তাদের নির্যাতকের সেই যে- বেতখানি, সবই তুমি ভেঙে ফেলেছ, যেমনটি ভেঙেছিলে মিদিয়ানের সেই পরাজয়ের দিনে । সৈন্যদের মাটি-কাঁপানো যত রণপাদুকা, রক্তমাখা যত পোশাক, সবই এবার পুড়িয়ে দেওয়া হবে, সবই আগুনের গ্রাসে ছাই হয়ে যাবে। কেননা আমাদের জন্যে একটি শিশু যে জন্ম নিয়েছেন, একটি পুত্রকে আমাদের হাতে যে তুলেই দেওয়া হয়েছে। তাঁর কাঁধের উপর রাখা হয়েছে। সব কিছুর আধিপত্যভার। তাঁকে ডাকা হবে অনন্য পরিকল্পক, পরাক্রমী ঈশ্বর, শাশ্বত পিতা, শান্তিরাজ, এমনি সব নামে। আহা! এবার শুরু হবে দাউদের সেই সিংহাসনের, সেই রাজত্বের সুবিস্তৃত আধিপত্যের যুগ, অনন্ত শান্তির যুগ" (ইসা ৯:১-৬)।
উপরের এই শাস্ত্রপাঠ থেকে আমরা দেখতে পাই পাপ দ্বারা মানুষ ঈশ্বরের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। মানুষ ঈশ্বরের পাওনা ঈশ্বরকে দিতে ব্যর্থ হয়েছে, অর্থাৎ ঈশ্বরের বাধ্য থাকতে ও তাঁকে ভালোবাসতে মানুষ ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু ঈশ্বর ন্যায়বান। মানুষের কষ্টের বোঝা এবার তিনি লাঘব করার জন্য দয়া দেখালেন।
আমরা উপরে দেখেছি, ন্যায্যতার ফল হলো শাস্তি। কারণ আমরা জানি, যার যা পাওনা তাকে তা দিয়ে দেওয়ার অর্থই ন্যায্যতা। আমরা আরও দেখেছি ঈশ্বরের পাওনা ঈশ্বরকে দিলে এবং মানুষের পাওনা মানুষকে দিলে ন্যায্যতা হয়। এভাবে ঈশ্বর ও মানুষের সাথে আমাদের ন্যায্যতার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। ফলে সৃষ্টি হয় শাস্তি। এখন কারও বিরুদ্ধে আর কারও কিছু বলার নেই সবাই সুখী
শাস্ত্রপাঠটিতে আমরা আরও দেখেছি, ঈশ্বর মানুষের সাথে সম্পর্ক সুন্দর করার জন্য নিজেই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তিনি নিজেই তাঁর পুত্রকে পাঠিয়েছেন। পুত্র ঈশ্বর আমাদেরকে পাপের ছায়া থেকে উদ্ধার করার জন্য ক্রুশের উপর প্রাণ দিয়েছেন। এভাবে তিনি ঈশ্বর ও আমাদের মধ্যে পুনর্মিলন স্থাপন করেছেন। এখন ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে আর দূরত্ব নেই। আমাদের এখন সর্বদা চেষ্টা করে চলতে হবে যেন ঈশ্বরের সাথে আমাদের এই সম্পর্ক নষ্ট না হয়। আমরা যেন আমাদের পাপ দ্বারা ঈশ্বরের কাছ থেকে দূরে সরে না যাই। খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা
আরও একটা দিকে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে, মানুষের সাথে আমাদের সম্পর্ক ঠিক রাখতে হবে । আমরা যখন প্রত্যেক মানুষকে তাদের পাওনা মিটিয়ে দেই তখনই মানুষের সাথে আমাদের ন্যায্যতার সম্পর্ক বিরাজ করে। এই ন্যায্যতার ফলে বিরাজ করে শান্তি ।
কাজ : ১। নিজ নিজ পরিবারে শান্তি বজায় রাখার জন্য তুমি কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পার তা লেখ । কাজ : ২। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তিগত ও দলীয়ভাবে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় তা দলীয় আলোচনার মাধ্যমে খুঁজে বের কর ও উপস্থাপন কর।
পাঠ ৫ : আত্মসংযম
আত্মসংযম হচ্ছে নিজের আবেগ-অনুভূতি এবং বিভিন্ন কিছুতে নিজের প্রতিক্রিয়া দমন করার সক্ষমতা। অন্য কথায় এটাকে আমরা বলে থাকি আত্মত্মশৃঙ্খলাবোধ। কেউ কেউ হয়তো মনে করতে পারে আত্মসংযম দ্বারা মানুষের আচরণ সীমিত করে ফেলা হয়। কিন্তু আসলে তা নয়। বিজ্ঞতা ও সাধারণ জ্ঞান নিয়ে ব্যবহার করলে আত্মসংযম আত্ম-উন্নয়ন ও কৃতকার্যতা অর্জনের একটা বড় হাতিয়ার হিসাবে কাজ করতে পারে।
নিম্নলিখিতভাবে আত্মসংযম আমাদের উপকারে আসে
১। এটি আমাদেরকে মাদকাসক্ত হওয়ার মতো আত্ম-বিধ্বংসীমূলক কাজ করা অথবা মোহাবিষ্ট হয়ে খারাপ পথে পা বাড়ানো থেকে বিরত রাখে;
২। নিজের ব্যক্তিত্বের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে এবং ভারসাম্যপূর্ণ জীবন গঠন করতে
সহায়তা করে;
৩। অত্যধিক আবেগপ্রবণ কাজ করা থেকে বিরত রাখে অর্থাৎ আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা
করে; ৪। অসহায়বোধ জাগতে দেয় না এবং অন্যদের উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা কমায়;
৫। আত্মসংযম দ্বারা আমরা মানসিক ও আবেগিক নিয়ন্ত্রণ আনতে সক্ষম হই। এরূপ সংযম মনের প্রশান্তি আনয়নে সহায়তা করে;
৬। এটি আমাদের মেজাজ ঠাণ্ডা রাখতে এবং নেতিবাচক চিন্তা ও অনুভূতিগুলো বর্জন করতে শেখায়;
৭। আত্মসংযম আমাদের আত্মমর্যাদাবোধ, দৃঢ়চিত্ততা, অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা ও ইচ্ছাশক্তি দৃঢ়তর করে:
৮। এটি আমাদের নিজের জীবনের দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করতে সক্ষম করে তোলে;
৯। এটি আমাদেরকে দায়িত্বশীল ও বিশ্বাসযোগ্য মানুষে পরিণত করে।
ন্যায্যতা, শাস্তি ও আত্মসংযম
আত্মসংযমের এত উপকারিতা থাকা সত্ত্বেও এর পথে অনেক বাধাবিঘ্ন রয়েছে। সেগুলো নিম্নরূপ :
১। আত্মসংযম সম্পর্কে আমাদের যথাযথ জ্ঞানের অভাব একটি বড় বাধা ;
২। কঠিন ও অনিয়ন্ত্রিত আবেগিক প্রতিক্রিয়া;
৩। পূর্বাপর চিন্তাভাবনা না করে, শুধু বাহ্যিক চেহারা দেখেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা;
৪। শৃঙ্খলাবোধ ও ইচ্ছাশক্তির অভাব;
৫। নিজেকে পরিবর্তন ও বিকশিত করার ইচ্ছার অভাব;
৬। আচরণ সীমিতকরণের মাধ্যম হিসেবে আত্মসংযমকে দেখা।
পাঠ ৬ : পবিত্র বাইবেলে আত্মসংযম বিষয়ক শিক্ষা
আত্মসংযমের একটা মূল্যবান শিক্ষা আমরা পাই আদিপুস্তকে কুলপতি যোসেফের কাছ থেকে। যোসেফের ভাইয়েরা তাঁর উপর ঈর্ষান্বিত ছিল। তারা যোসেফকে হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে মিশরীয় বণিকদের কাছে বিক্রি করে দিল। বণিকরা তাঁকে নিয়ে বিক্রি করল ফারাও রাজার রক্ষীদলের প্রধানের কাছে।
যোসেফ সেই প্রধানের বাড়িতে সব কাজকর্মের দায়িত্ব পেলেন। যোসেফ ছিলেন লম্বাদেহী সুদর্শন যুবক কিছুদিন যেতেই তার প্রতি মনিবের স্ত্রীর কামলালসা জাগল। তিনি তাঁকে মন্দ কাজে অনেক প্রলোভন দিলেন। কিন্তু সবসময়ই যোসেফ তাকে বললেন “না।” এতে মনিবের স্ত্রী প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তাঁর নামে মিথ্যা অপবাদ রটালেন। ফলে যোসেফকে জেল খাটতে হলো। এতেও যোসেফ তাঁর নীতিতে অটল থাকলেন।
যোসেফের মধ্যে আমরা দেখি সাধু পলের একটা শিক্ষা যথাযথভাবেই বাস্তবায়িত হয়েছে। সাধু পল বলেন, “তাই বলছি, ব্যভিচার থেকে দূরেই থাকো। মানুষ আর যেকোনো পাপই করুক না কেন, সে সব পাপ ঘটে দেহের বাইরে। কিন্তু ব্যভিচার যে করে, সে আপন দেহের বিরুদ্ধে গিয়েই পাপ করে। তোমরা কি এই কথা জানো না যে, তোমাদের দেহ হলো তোমাদের অন্তর-নিবাসী সেই পবিত্র আত্মার মন্দির, যাঁকে তোমরা পেয়েছ পরমেশ্বরের কাছ থেকে; তোমরা তো নিজেদের মালিক নও; প্রভু মূল্য দিয়ে তোমাদের যে কিনেই নিয়েছেন। সুতরাং তোমরা তোমাদের দৈহিক আচরণের মধ্য দিয়েই পরমেশ্বরের মহিমা প্রকাশ কর” (১ করি ৬:১৮-২০)।
দানিয়েল নামে ছিলেন একজন যুবক। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও তিনজন যুবক, যথাক্রমে হানানিয়া, শাদ্রাক ও মিশায়েল। তাঁদের জন্য রাজা তাঁর টেবিল থেকে খুব সুস্বাদু আমিষ জাতীয় খাবার পাঠাতেন। কিন্তু তাঁরা সেগুলো না খেয়ে নিরামিষ খাবার খেতেন। তাঁরা দীর্ঘদিন যাবৎ শুধু নিরামিষ ৮৮
খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা
খাবার খেয়ে সুন্দর স্বাস্থ্য ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি লাভ করেছিলেন। তাঁরা ঐ রাজ্যে সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান হতে পেরেছিলেন। এটা তাঁদের দ্বারা সম্ভব হয়েছিল। কারণ তাঁরা আত্মসংযম করতে শিখেছিলেন।
আত্মসংযমের সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমরা পেতে পারি যীশুখ্রিষ্টের কাছ থেকে। পবিত্র বাইবেলে আমরা দেখতে পাই দীক্ষায়ান লাভের পর শয়তান যীশুকে নিয়ে গেল মরুপ্রান্তরে। সেখানে তিনি চল্লিশ দিন ও চল্লিশ রাত উপবাস করেছিলেন। অনাহারে থাকার দরুন তিনি খুব ক্ষুধার্ত হয়েছিলেন। এই অবস্থায় শয়তান তাঁকে প্রলোভন দিতে এসেছিল। সব পরীক্ষা যীশু জয় করতে পেরেছিলেন প্রার্থনার শক্তিতে। যীশু শয়তানকে বলেছিলেন- 'দূর হও শয়তান।' সেই মুহূর্তেই শয়তান তাঁর কাছ থেকে দূর হয়ে গেল ।
কাজ : পবিত্র বাইবেলের আত্মসংযম বিষয়ক শিক্ষাগুলো কী কী ভাবে বর্তমান যুগের জন্য
প্রযোজ্য তা দলীয় আলোচনার মাধ্যমে খুঁজে বের কর ও পোস্টারের সাহায্যে উপস্থাপন কর
পাঠ ৭: ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে আত্মসংযম
মানুষ একা একা বাস করতে পারে না কারণ মানুষ সামাজিক জীব। তার বাস করতে হয় সমাজের অন্যদের সাথে মিলেমিশে। যাদের সাথে সে বাস করে তারাও তারই মতো সামাজিক। তাই তাদের সাথে তার সামাজিক আচরণ করতে হয়। সকলের সাথে শান্তিশৃঙ্খলাপূর্ণভাবে জীবন যাপন করার লক্ষ্যে মানুষকে অনেক ব্যাপারে নিজের আবেগ অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। অন্যকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নিজের অনেক কিছু প্রকাশ না করে থাকতে হয়
প্রাথমিকভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির সম্পর্ক রচনা করতে হয় পরিবারের অন্যান্য সদস্য, পরিবারের বাইরের বন্ধু- বান্ধব ও বিভিন্ন পরিচিতদের সাথে। একসাথে থাকতে গেলে পারস্পরিক সম্পর্ক গভীর হয় আদান-প্রদানের মাধ্যমে। পাওয়ার চাইতে দেওয়ার উপর যারা জোর দেয় বেশি তারা সুখীও হয় বেশি। কারণ যারা দেওয়ার চাইতে পাওয়ার উপর বেশি জোর দেয় তারা অপরের কাছে ঋণী হয়ে যায়। তাতে অন্তরে আনন্দ থাকে না। সেই জন্য পাওয়ার জন্য একান্ত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তা দমন করতে শিখতে হয়।
আত্মসংযম স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে
বিবাহের দিন থেকে শুরু করে স্বামী ও স্ত্রী একসাথে থাকতে শুরু করে। সারা জীবনই তারা একত্রে থাকে। দুইজনের ব্যক্তিত্ব দুইরকম। তাদের আচার-আচরণের রীতিনীতিও ভিন্ন। এই পার্থক্যগুলো আছে বলে সহজেই তাদের একের বিরুদ্ধে অপরের অনেক কিছু বলার থাকে। কিন্তু বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়ে একত্রে মিলেমিশে থাকার জন্য প্রতিজ্ঞা করেছেন বলে তারা আত্মসংযম করেন ও অনেক কিছু ক্ষমার চোখে দেখেন। ফলে তাদের ঝগড়া-বিবাদের পরিমাণ অনেক কমে ন্যায্যতা, শান্তি ও আত্মসংযম
৮৯
আসে । এভাবেই তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক সুন্দর ও মধুর হয়। স্বামী-স্ত্রী সবসময় একে অপরের বিষয়ে মন্তব্য করার ফলে পরস্পরের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। সেজন্যে কখনো কখনো চুপ থাকা বাঞ্ছনীয়। এই ক্ষেত্রে দরকার হয় আত্মসংযম
পিতামাতা ও সন্তানের সম্পর্কে আত্মসংযম
পৃথিবীর মধুরতম সম্পর্কগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো পিতামাতা ও সন্তানদের মধ্যকার সম্পর্ক। কিন্তু সন্তান তার মা ও বাবার সাথে এক পরিবারে বসবাস করতে করতে অনেকবার পরিবারে বিবাদ বা ঝগড়াঝাঁটি দেখে থাকে। সন্তানটি যখন দৈহিকভাবে বড় হতে থাকে তখন তার দৈহিক নানাবিধ পরিবর্তন দেখা দেয়। এর ফলে তার মনের মধ্যেও পরিবর্তন ঘটে। অনেক সময় সন্তানদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। এসময় মা ও বাবাকে অসীম আত্মসংযমের পরিচয় দিতে হয়, সন্তানদের সাথে তাদের প্রচুর পরিমাণে ধৈর্যশীল হতে হয়। সন্তানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করার জন্য বাবা ও মা উভয়কেই অনেক অপেক্ষা করতে হয়। এসময় তাদের আত্মসংযম দরকার হয়। উদাহরণস্বরূপ, সন্তান কোনো ভুল করলে বাবা-মা যদি উত্তেজিত হয়ে সন্তানকে গালাগালি করতে শুরু করে বা মারধরও করে ফেলে তাতে সন্তানের সাথে মা-বাবার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় সুতরাং মা-বাবা সন্তানদের সাথে সহনশীল আচরণ করতে থাকবেন যতদিন সন্তান বয়স্ক হয়ে নিজে জেনে শুনে দায়িত্বশীল আচরণ না করে ।
ভাইবোনদের মধ্যকার সম্পর্কে আত্মসংযম
শৈশবে বা তরুণ বয়সে ভাইবোনেরা অনেক সময়ই আবেগপূর্ণ হয়ে থাকে। তারা কথা কাটাকাটি, এমনকি অনেক সময় ঝগড়ায়ও লিপ্ত হয়ে যায়। যুক্তি দিয়ে কথা বলা এবং যুক্তি সহজভাবে গ্রহণ করার তাৎপর্য তারা বুঝে উঠতে পারে না। ভাইবোনেরা কোনো কোনো সময় মা-বাবার অনুপস্থিতিতে কোনো পরিবেশে থাকলে তাদের মধ্যে যে বয়োজ্যেষ্ঠ সে সাধারণত তুলনামূলকভাবে বেশি দায়িত্বশীল ও সহনশীল হয় এবং বাবা ও মায়ের ভূমিকা পালন করে থাকে। তখন তাদের সহনশীল হতে হয়। এই বয়সে ছেলেমেয়েদের মধ্যে আত্মসংযমের ভাব গড়ে উঠে। কেননা, যদি কখনো ছেলেমেয়েরা আত্মসংযমের অভাবের পরিচয় দেয় তখন বাবা-মা, শিক্ষক-শিক্ষিকা বা অন্য কোনো
গুরুজন তাদের তিরস্কার করে। এগুলো যেন ভবিষ্যতে আর শুনতে না হয় সেই জন্য ছেলেমেয়েরা আত্মসংযমের চর্চা করতে শুরু করে। এভাবে ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে আত্মসংযম দৃঢ় হয়ে উঠে। বয়োজ্যেষ্ঠ ভাইবোনদের মধ্যে কখনো ঝগড়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে অন্তত একজনকে আগে আত্মসংযমের পরিচয় দিতে হয়। আর তখন তাদের মধ্যে পরিবেশ আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠে ।
পরিবারের বাইরে পরিচিতদের সাথে আত্মসংযম
প্রত্যেক পরিবারের সদস্যদের সাথে তাদের পরিবারের বাইরে অনেকের সাথে পড়াশুনা বা কর্তব্যের খাতিরে বন্ধু-বান্ধব তৈরি হয় বা পরিচয় হয়। পরিবারের সদস্যদের সাথে যতখানি খোলামেলা কথা বলা যায় বা প্রয়োজনে কথা কাটাকাটি করা যায়, বাইরের পরিচিত বা বন্ধুদের সাথে ততখানি করা যায় না। এসব ক্ষেত্রে অনেক আত্মসংযমের পরিচয় দিতে হয়। এভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যেই আত্মসংযম জন্ম নেয়। উদাহরণস্বরূপ ঘরে বাবা অথবা মা তিরস্কার করলে বা গালি দিলে যেভাবে প্রতিক্রিয়া করা যায়, অফিসের বসের সাথে সেভাবে করা যায় না। এক্ষেত্রে অনেক আত্মসংযম প্রয়োজন হয়।
এক ব্যক্তির সাথে অন্য ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অনেকাংশে নির্ভর করে আত্মসংযমের উপর। মতামত প্রকাশে বা যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে যত বেশি সংযমী হওয়া যায়, পারস্পরিক সম্পর্ক তত বেশি গভীর হয়। এভাবে নিজ নিজ আত্মসম্মানবোধও বৃদ্ধিলাভ করে
কাজ : ব্যক্তিগত জীবনের আত্মসংযম কীভাবে সমাজের উপকারে আসতে পারে তা খাতায় লেখ ।
পাঠ ৮ : অন্তরে আত্মসংযম রোপণ করা
১। প্রথমে আমাকে খুঁজে বের করতে হবে আমার জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে আত্মসংযম দরকার। সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলো নিম্নরূপ হতে পারে :
ক) খাওয়াদাওয়া
বিশ্রাম
গ) মানুষের সাথে কথা বলা
ঘ) পরচর্চা
3) ধূমপান
চ) খেলাধুলা
ছ) শিশুদের সাথে আচরণ
২। উপরের কোন দিকটির কী ধরনের আবেগ (যেমন, রাগ, চাপা ক্ষোভ, অসন্তোষ, হতাশা, আনন্দ ও ভয়) আমার দমন করা বেশি প্রয়োজন ?
৩। কী ধরনের চিন্তা ও বিশ্বাস আমাকে ঐ ধরনের আচরণের মুখে ঠেলে দেয়?
৪। নিচের বিষয়গুলোর একেকটার উপর একেকবার কিছুক্ষণ চিন্তা করব। এভাবে দিনের মধ্যে কয়েকবার বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করব, বিশেষভাবে যে মুহূর্তগুলোতে আমার আত্মসংযম খুব দরকার হয় তখন-
ক) মনে মনে দুই-এক মিনিট যাবৎ বলব- আমার নিজের চিন্তা ও অনুভূতির উপর সম্পূর্ণ দখল আছে।
খ) নিজের চিন্তা ও অনুভূতি বাছাই করে নিয়ে সেগুলোর মধ্যে অনুরক্ত হওয়ার শক্তি আমার
মধ্যে আছে। গ) আত্মসংযম আমার মধ্যে অভ্যন্তরীণ শক্তি জাগ্রত করে ও আমাকে জয়লাভ করতে সাহায্য
করে
ঘ) যেকোনো বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার সময় আমি নিজেকে দমন করতে পারি ।
ঙ) আমি নিজেই আমার নিজের আচরণের কর্তা
চ) আমি ক্রমান্বয়ে আমার অনুভূতিগুলোকে দমন করতে পারছি।
ছ) ঈশ্বর আমাকে আমার জীবন পরিচালনা করার শক্তি দিয়েছেন
জ) প্রতিদিনই অল্প অল্প করে আমার চিন্তা ও অনুভূতি দমনের শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঝ) আত্মসংযম অনুশীলন করে আমি আনন্দ পাই ।
৫। এবার মনে মনে কল্পনা করি যে আমি আত্মসংযম অনুশীলন করছি। অতীতে যেখানে আমি আত্মসংযম করতে ব্যর্থ হয়েছিলাম সেরকম একটা ঘটনা স্মরণ করি। এবার মনে মনে কল্পনা করি যে সেই ঘটনাতেই আমি এবার আত্মসংযম করতে সক্ষম হচ্ছি।
৬। আমার আত্মসংযমের শক্তি তখনই বৃদ্ধিলাভ করবে ও শক্তিশালী হবে যখন আমি এটার যথাযথ অনুশীলন করব অন্তরে আত্মসংযম রোপণ করার জন্য এটিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
আত্মসংযম আমাদের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ গুণ যে, এর মধ্য দিয়ে আমরা সমস্ত রকমের ভয়ভীতি, আসক্তি, অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ পরিত্যাগ করতে সক্ষম হই। এর দ্বারা মানুষের সাথে আমাদের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে, ধৈর্য ও সহনশীলতা বৃদ্ধিলাভ করে। এভাবে আমরা জীবনে বড় বড় ক্ষেত্রে জয়লাভ করতে পারি, মহৎ মহৎ অর্জন সম্ভব হয় এবং জীবনটা আনন্দের হয়ে উঠে
কাজ : ১। তুমি কীভাবে নিজ অন্তরে আত্মসংযম রোপণ করবে তা চিন্তা করে বের কর ও খাতায়
লেখ। কাজ : ২। যে সমস্ত বন্ধুর আত্মসংযমের অভাব আছে তাদের জীবনে আত্মসংযম আনয়নের জন্য তোমরা সম্মিলিতভাবে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পার তা স্থির কর ও উপস্থাপন কর।
আরও দেখুন...