৫.১ পরমাণুর কণাসমূহ
তোমরা পূর্ববর্তী শ্রেণিতে পরমাণুর গঠন সম্পর্কে কিছু ধারণা পেয়েছ, তোমরা জানো যে, পরমাণু মূলত তিনটি কণা দিয়ে তৈরি, এই কণাগুলো হচ্ছে- ইলেকট্রন, প্রোটন, এবং নিউট্রন। পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস, নিউক্লিয়াসে থাকে প্রোটন ও নিউট্রন আর নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান থাকে ইলেকট্রন। ইলেকট্রন, প্রোটন, এবং নিউট্রন সম্বন্ধে কিছু তথ্য নিচে উল্লেখ করা হলো:
ইলেকট্রন (Electron)
ঋণাত্মক বা নেগেটিভ চার্জযুক্ত ইলেকট্রন হলো পরমাণুর একটি মূল কণিকা যার চার্জ -1.602 x 10-19 কুলম্ব (Coulombs)। জে জে থমসনকে (J. J. Thomson) ইলেকট্রন আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হয়, কারণ, তিনিই প্রথম ইলেকট্রনের ভর ও চার্জ নির্ভুলভাবে বের করেছিলেন। নিচে ইলেকট্রনের আরও কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো:
১) একটি ইলেকট্রনের ভর 9.109x 10-31 kg যা একটি প্রোটনের ভরের 1837 গুণ কম, তাই নিউট্রন ও প্রোটনের তুলনায় ইলেকট্রনের আপেক্ষিক ভর বিবেচনা না করলে খুব ক্ষতি হয় না।
২) ইলেকট্রনের আপেক্ষিক চার্জ -1 ধরা হয়। ইলেকট্রনকে সাধারণত e প্রতীক দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
প্রোটন (Proton)
প্রোটন হলো ধনাত্মক বা পজিটিভ চার্জযুক্ত পরমাণুর একটি মূল কণিকা যার চার্জ বা আধানের পরিমাণ +1.602 × 10-19 কুলম্ব। প্রোটন আবিষ্কারের কৃতিত্ব আর্নেস্ট রাদারফোর্ড (Ernest Rutherford) কে দেওয়া হয়। নিচে প্রোটনের আরও কিছু বৈশিষ্ট্য দেওয়া হলো:
১) একটি প্রোটনের ভর 1.673 × 10-27 kg
২) হাইড্রোজেন পরমাণু থেকে তার ইলেকট্রনটি অপসারণের মাধ্যমে প্রোটন পাওয়া যায়।
৩) প্রোটনের আপেক্ষিক চার্জ হলো +1 এবং আপেক্ষিক ভর +1 ধরা হয়। প্রোটনকে p প্রতীক দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
নিউট্রন (Neutron)
1932 সালে জেমস চ্যাডউইক (James Chadwick) নিউট্রন আবিষ্কার করেন। নিউট্রনের কোনো চার্জ নেই। শুধু হাইড্রোজেন ছাড়া সকল মৌলের পরমাণুতেই নিউট্রন রয়েছে। নিউট্রন সম্বন্ধে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিচে উল্লেখ করা হলো:
১) একটি মৌলের দুটি ভিন্ন আইসোটোপের ভর তাদের নিজ নিজ নিউক্লিয়াসে অবস্থিত নিউট্রনের সংখ্যার পার্থক্যের কারণে ভিন্ন হয়।
২) একটি নিউট্রনের ভর হলো 1.675 × 10kg যা একটি প্রোটনের ভরের চেয়ে সামান্য বেশি।
৩) নিউট্রনের আপেক্ষিক আধান বা চার্জ ০ এবং আপেক্ষিক ভর । ধরা হয়। নিউট্রনকে n প্রতীক দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
৪) নিউট্রনের একটি অত্যন্ত বিচিত্র ধর্ম আছে। এটি যখন নিউক্লিয়াসের ভেতর প্রোটনের সঙ্গে থাকে তখন এটি স্থিতিশীল, কিন্তু যদি মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন অস্থিতিশীল, 10 মিনিটের ভেতর এটি একটি প্রোটন, একটি ইলেকট্রন ও একটি নিউট্রিনোতে বিভাজিত হয়ে যায়।
৫.২ পরমাণুর মডেল (Atomic model)
পরমাণু মডেলের ধারণার উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তী শ্রেণিতে ধারণা পেয়েছ। কোয়ান্টাম মেকানিকস গড়ে ওঠার পর প্রথমবার পরমাণুর গঠন সত্যিকারভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে। এটি বিজ্ঞানের অনেক বড়ো একটি সাফল্য কিন্তু এটি একদিনে হয়ে উঠেনি, অসংখ্য বিজ্ঞানীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এটি ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। দুটি প্রচেষ্টার কথা আলাদাভাবে বলা সম্ভব, তার একটি হচ্ছে রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল অন্যটি বোরের পরমাণু মডেল।
৫.২.১ রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেন
পরমাণুর মাঝে বিপরীত চার্জ বিশিষ্ট ইলেকট্রন ও প্রোটন রয়েছে সেটি বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছিলেন কিন্তু সেটি কীভাবে রয়েছে জানতেন না। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড (Ernest Rutherford) পরীক্ষালব্ধ তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রথম এই বিষয়টির উপর আলোকপাত করেছিলেন। এ ব্যাপারে তাঁর দেওয়া মডেলটি রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল নামে পরিচিত (চিত্র ৫.১)। মডেলটি এরকম:
১) একটি পরমাণুর ধনাত্মক চার্জ এবং পরমাণুটির অধিকাংশ ভর পরমাণুর কেন্দ্রে পুঞ্জীভূত থাকে যাকে নিউক্লিয়াস বলে। নিউক্লিয়াসের ভিতরে প্রোটন ও নিউক্লিয়াসের বাইরে ইলেকট্রন থাকে। যেহেতু আপেক্ষিকভাবে ইলেকট্রনের ভর অত্যন্ত কম, তাই নিউক্লিয়াসের অভ্যন্তরে অবস্থিত প্রোটন ও নিউট্রনের ভরই পরমাণুর ভর হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২) নিউক্লিয়াস অত্যন্ত ক্ষুদ্র এবং পরমাণুর অভ্যন্তরে অধিকাংশ জায়গাই ফাঁকা।
৩) রাদারফোর্ড পরমাণু মডেল প্রস্তাব করেছিল যে, কেন্দ্রের ধনাত্মক বা পজিটিভ চার্জের চারদিকে তার আকর্ষণ বলের কারণে ঋণাত্মক বা নেগেটিভ চার্জবিশিষ্ট ইলেকট্রন ঘূর্ণায়মান থাকে। নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ইলেকট্রনের এইভাবে ঘূর্ণনকে তিনি সৌরজগতে সূর্যের চারদিকে গ্রহগুলোর ঘূর্ণায়মান অবস্থার সঙ্গে তুলনা করেন। অর্থাৎ, ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কক্ষপথে ঘুরছে।
সৌরজগতের সঙ্গে রাদারফোর্ড পরমাণু মডেলকে তুলনা করার কারণে এই মডেলকে সোলার সিস্টেম মডেল বা সৌর মডেলও বলা হয়। আবার এই মডেলের মাধ্যমে বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড সর্বপ্রথম নিউক্লিয়াসের ধারণা প্রবর্তন করেন, তাই এ মডেলকে নিউক্লিয়ার মডেলও বলা হয়।
রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেনের সীমাবদ্ধতা:
পরমাণুর কেন্দ্রে অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি নিউক্লিয়াসের অস্তিত্বের ধারণাটি পরমাণুর গঠনের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হলেও সেটি পূর্ণাঙ্গভাবে পরমাণুর গঠন ব্যাখ্যা করতে পারেনি। তখন পর্যন্ত কোয়ান্টাম মেকানিক্স গড়ে উঠেনি বলে তার মডেল পরমাণুর স্থিতিশীলতা ব্যাখ্যা করতে পারেনি। এই মডেলে ধরে নেওয়া হয়েছে যে নিউক্লিয়াসকে ঘিরে ইলেকট্রন ঘূর্ণায়মান থাকে কিন্তু ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব (Maxwell's theory) অনুযায়ী ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণনের সময় ক্রমাগত শক্তি হারাতে থাকবে। ফলে ইলেকট্রনের ঘূর্ণনপথও ছোটো হতে থাকবে এবং এক সময় সেটি নিউক্লিয়াসে পড়ে যাবে (চিত্র ৫.২)। এ থেকে বুঝা যায় যে এই মডেলে পরমাণু স্থিতিশীল হবে না। তাছাড়া এই মডেলটি ইলেকট্রনের কক্ষপথের ব্যাসার্ধ, আকৃতি কিংবা পরমাণুতে ইলেকট্রনের বিন্যাস সম্পর্কে সম্বন্ধে কোনো ধারণা দিতে পারেনি।
চিত্র ৫.২: ইলেকট্রন শক্তি হারিয়ে নিউক্লিয়াসে পতিত হচ্ছে
৫.২.২ বোরের পরমাণু মডেন
১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে বিজ্ঞানী নীলস বোর (Niels Bohr) রাদারফোর্ড পরমাণু মডেলের সীমাবদ্ধতাগুলো সমাধান করে একটি পরমাণু মডেল প্রস্তাব করেছিলেন। তখন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রাথমিক ধারণাগুলো বিজ্ঞানীরা জানতে শুরু করেছিলেন এবং সেগুলো ব্যবহার করে এই মডেলটি দেওয়া হয়েছিল। বোরের পরমাণু মডেলের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
চিত্র ৫.৩: বোরের পরমাণু মডেল KL M, N শেল দেখানো হয়েছে।
১) পরমাণুতে থাকা ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ইচ্ছেমতো যে কোনো কক্ষপথে ঘুরতে পারে না, শুধু নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধের কতগুলো অনুমোদিত বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরে থাকে। এই স্থিতিশীল কক্ষপথে ঘোরার সময় ইলেকট্রনগুলো কোনো শক্তি শোষণ বা বিকিরণ করে না।
২) এই স্থিতিশীল কক্ষপথকে সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা হয়, যেখানে -এর মান 1, 2, 3, 4... ইত্যাদি। এই কক্ষপথগুলোকে K, L, M, N শেল (shell) হিসেবেও বলা বলা হয় (চিত্র ৫.৩)। এগুলোকে কক্ষপথ বা শক্তিস্তর হিসেবেও ব্যাখ্যা করা হয়। উল্লেখ্য যে, শক্তিস্তরে n-এর মান কম সেটিকে নিম্ন শক্তিস্তর বলা হয়। আর-এর মান বেশি হলে সেটি উচ্চ শক্তিস্তর হিসেবে পরিচিত।
চিত্র ৫.৪: বোরের পরমাণু মডেল। প্রধান শক্তিস্তর (n), ইলেকট্রন এক শক্তিস্তর থেকে আরেক
শক্তিস্তরে যাওয়ার ফলে শক্তি শোষণ বা শক্তি নির্গমন দেখানো হয়েছে।
৩) কোনো প্রধান শক্তিস্তরে ইলেকট্রনের ঘূর্ণনের সময় কোনো শক্তি শোষিত বা বিকিরিত হয় না। বাইরে থেকে শক্তি প্রদান করা হলে সেই শক্তি শোষণ করে ইলেকট্রন নিম্ন শক্তিস্তর থেকে উচ্চ শক্তিস্তরে যায় (চিত্র ৫.৪)। আবার যদি ইলেকট্রন উচ্চ শক্তিস্তর থেকে নিম্ন শক্তিস্তরে যায়, তখন শক্তি বিকিরিত হয়। এই শোষিত বা বিকিরিত শক্তির পরিমাণ (AE) যেটি দুটি শক্তিস্তরের (E,, E) শক্তির মধ্যে পার্থক্যের সমান এবং এটি প্লাঙ্কের সমীকরণ দ্বারা নির্ধারিত হয়। সমীকরণটি এরকম: ΔΕ E2E1 hv
এখানে, ΔΕ হচ্ছে শোষিত বা নির্গত শক্তি, h হচ্ছে প্লাঙ্কের ধ্রুবক (6.626 10 m³kg/s), v হচ্ছে নির্গত বা শোষিত ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বিকিরণের ফ্রিকোয়েন্সি। বোরের মডেল হাইড্রোজেন (H) মৌল থেকে নির্গত এই শক্তি দিয়ে সৃষ্ট আলোর পারমাণবিক বর্ণালি সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পেরেছিল।
বোরের পরমাণু মডেনের সীমাবদ্ধতা
বোর পরমাণু মডেলের অসামান্য সাফল্য থাকলেও তার কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। এটি এক ইলেকট্রন বিশিষ্ট পরমাণুর পারমাণবিক বর্ণালি ব্যাখ্যা করতে পারলেও একাধিক ইলেকট্রন বিশিষ্ট পরমাণুর ক্ষেত্রে পারমাণবিক বর্ণালি ব্যাখ্যা করতে পারছিল না। বোরের পরমাণু মডেল অনুযায়ী ইলেকট্রন যদি এক শক্তিস্তর থেকে অন্য আরেকটি শক্তিস্তরে গমন করে, তাহলে নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তির কারণে পারমাণবিক বর্ণালিতে একটিমাত্র রেখা পাওয়ার কথা কিন্তু পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, প্রত্যেকটি রেখা আসলে অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রেখার সমষ্টি, অর্থাৎ একটি মাত্র নির্গত শক্তি না থেকে কাছাকাছি ভিন্ন ভিন্ন কিছু শক্তি রয়েছে যার কোনো ব্যাখ্যা নেই।
৫.৩ পরমাণুতে ইলেকট্রন বিন্যাস (Electronic configuration of atoms)
রাদারফোর্ড এবং বোরের মডেল, তার সঙ্গে অসংখ্য বিজ্ঞানীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে পরমাণুর গঠনে এবং পরমাণুতে কী কারণে কীভাবে ইলেকট্রনের বিন্যাস হয় সেই রহস্য উন্মোচিত হয়। তোমাদের আগেই বলা হয়েছে সেজন্য কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্য নিতে হয়েছিল, তোমরা যারা বড়ো হয়ে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করবে তারা সেই রহস্যময় জগতে উঁকি দিয়ে পুরো বিষয়টি সামগ্রিক এবং পূর্ণাঙ্গভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবে। কিন্তু এখন নিয়মগুলো কীভাবে এসেছে না জেনে শুধু ব্যবহার করে পরমাণুতে ইলেকট্রন কীভাবে বিন্যস্ত হয় সেটি জেনে নিতে পারো।
পরমাণুতে ইলেকট্রন বিন্যাসের নিয়মসমূহ সম্পর্কে তোমরা আগের শ্রেণিতে কিছুটা ধারণা পেয়েছ। তোমরা জানো যে, বোরের পরমাণু মডেলে পরমাণুর যে শক্তিস্তরের কথা বলা হয়েছে তাকে প্রধান শক্তিস্তর বলে এবং একে দ্বারা প্রকাশ করা হয়। প্রত্যেকটি প্রধান শক্তিস্তরের সর্বোচ্চ ইলেকট্রন ধারণ ক্ষমতা হলো 2n (এখানে n = 1, 2, 3, 4... ইত্যাদি হলো কক্ষপথের ধারাবাহিক সংখ্যা এবং সংশ্লিষ্ট কক্ষপথগুলো K, L, M, N নামেও পরিচিত)। অর্থাৎ n = 1 হলে, 2n² = 2 × (1) 2; তার মানে প্রথম কক্ষপথে বা শক্তিস্তরে (K কক্ষপথ বা শেল) সর্বোচ্চ 2টি ইলেকট্রন থাকতে পারে। সেভাবে n = 2 হলে, 2n = 2 × (2) = ৪ তার মানে দ্বিতীয় কক্ষপথে বা শক্তিস্তরে (L) কক্ষপথ বা শেল) সর্বোচ্চ আটটি ইলেকট্রন থাকতে পারে। এভাবে তোমরা পরের শক্তিস্তরগুলোতে সর্বোচ্চ ইলেকট্রন সংখ্যা কত। হবে সেটি বের করে ফেলতে পারবে। বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখার জন্য নিচের টেবিলে বিভিন্ন শক্তিস্তরে কিছু মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাস দেওয়া হয়েছে।
উপরের টেবিলটিতে তোমরা দেখেছ যে, হাইড্রোজেন (H) -এর পারমাণবিক সংখ্যা 1, ফলে এর ইলেকট্রন সংখ্যাও 1, সুতরাং, এই একটি ইলেকট্রন প্রথম কক্ষপথ বা শক্তিস্তর K তে প্রবেশ করছে। আবার লিথিয়াম (Li) -এর পারমাণবিক সংখ্যা ও, এক্ষেত্রে পরমাণুতে ইলেকট্রন বিন্যাসের নিয়ম অনুযায়ী প্রথম কক্ষপথ বা শক্তস্তরে 2টি ইলেকট্রন প্রবেশ করেছে। ইলেকট্রন বিন্যাসের নিয়ম অনুসারে যেহেতু প্রথম শক্তিস্তর K তে 2টির বেশি ইলেকট্রন থাকতে পারে না, তাই তৃতীয় ইলেকট্রনটি দ্বিতীয় কক্ষপথ বা L শক্তিস্তরে প্রবেশ করেছে। এভাবে সোডিয়াম (Na) -এর ক্ষেত্রেও নিয়ম অনুসারে প্রথম শক্তিস্তর K তে 2টি, দ্বিতীয় শক্তিস্তর L এ ৪টি, এবং তৃতীয় শক্তিস্তর M এ 1টি ইলেকট্রন প্রবেশ করেছে।
টেবিলের উদাহরণগুলোর সবকটির ক্ষেত্রেই পরমাণুতে ইলেকট্রন বিন্যাসের 2n² নিয়ম অনুযায়ী হয়েছে অর্থাৎ কোনোক্ষেত্রেই শক্তিস্তরে ইলেকট্রনের সংখ্যা 2n² থেকে বেশি হয়নি, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিচের শক্তিস্তর পূর্ণ না হতেই পরের শক্তিস্তরে ইলেকট্রন বিন্যস্ত হতে শুরু করেছে। যেমন- টেবিলে
লক্ষ করলে দেখা যায় যে, পটাশিয়াম (K) ও ক্যালসিয়াম (Ca) -এর পারমাণবিক সংখ্যা যথাক্রমে 19 ও 20 এই দুটিতে তৃতীয় শক্তিস্তর M -এর সর্বোচ্চ ইলেকট্রন ধারণ ক্ষমতা 18 টি। কিন্তু পটাশিয়ামের 19তম ইলেকট্রন এবং ক্যালসিয়াম -এর 19 ও 20তম ইলেকট্রন দুটি তৃতীয় শক্তিস্তর M কে অপূর্ণ রেখেই চতুর্থ শক্তিস্তরে (N) প্রবেশ করেছে।
ইলেকট্রন কেন নিচের শক্তিস্তর অপূর্ণ রেখে উপরের শক্তিস্তরে যেতে থাকে এ বিষয়টি বোঝার জন্য আমাদের একটি নতুন বিষয় জানতে হবে। সেটি হচ্ছে ইলেকট্রনের উপশক্তিস্তর।
৫.৪ উপশক্তিস্তরের ধারণা (energy sublevel)
আমরা জানি যে, প্রধান শক্তিস্তরকে n দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এই শক্তিস্তরগুলো আবার উপশক্তিস্তরে বিভক্ত থাকে এবং এই উপশক্তিস্তরকে ইংরেজি। বর্ণ দ্বারা প্রকাশ করা হয়।।-এর মান 0 থেকে 1 পর্যন্ত হয়ে থাকে। উপশক্তিস্তরকে অরবিটাল (orbital) বলা হয়। এই উপশক্তিস্তর বা অরবিটালগুলোর 0, 1, 2, 3... মান এই সংখ্যাগুলো ছাড়াও ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে এবং এরা s, p, d, এবং নামে পরিচিত। নিচে প্রধান শক্তিস্তর (n) -এর মান অনুযায়ী উপশক্তিস্তরের (1) মান এবং অরবিটাল সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হলো:
এখানে n = 1 হলে।-এর একটি মাত্র মান হওয়া সম্ভব, সেটি হচ্ছে n-1 (1-1) = 0: এক্ষেত্রে অরবিটাল হবে ১টি এবং সেটি প্রকাশ করা হবে 15 হিসেবে।
n = 2 হলে।-এর সর্বোচ্চ মান হচ্ছে 1 (21) 1;, কাজেই এবারে। -এর দুটি মান হতে পারে, । = 0, এবং । । অর্থাৎ অরবিটাল হবে ১টি, এবং সেই অরবিটাল দুটি হচ্ছে 2s ও 2p।
n = 3 হলে। -এর সর্বোচ্চ মান হচ্ছে n1 = (31) = 2;, কাজেই এবারে।-এর তিনটি মান হতে পারে, । = 0, 1এবং 2 অর্থাৎ অরবিটাল হবে তিনটি, এবং সেই অরবিটাল তিনটি হচ্ছে 35, 3p 3d । এভাবে আমরা দেখাতে পারি, 4 হলে। 0, 1, 2, 3 হবে; এক্ষেত্রে অরবিটাল হবে ৪টি এবং সেগুলো হচ্ছে 45, 4p, 4d, 4f1
n = 5 হলে অরবিটাল হবে 5 টি, কিন্তু যেহেতু 4s, 4p, 4d, এবং 4f এই চারটি অরবিটালেই পরমাণুর সবকটি ইলেকট্রন বিন্যাস করা সম্ভব, তাই পরবর্তী অরবিটাল অর্থাৎ পঞ্চম অরবিটালের আর প্রয়োজন হয় না। n 6, 7, ৪ -এর জন্যও এটি সত্যি।
আমরা প্রতিটি শক্তিস্তরকে তার উপশক্তিস্তর বা অরবিটালে ভাগ করে ফেলেছি, এখন শুধু বের করতে হবে একেকটি উপশক্তিস্তরে বা অরবিটালে কয়টি ইলেকট্রন থাকতে পারে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সমীকরণ সমাধান করে সেটি খুব সুন্দর করে দেখানো হয়, আমরা শুধু উত্তরটি বলে দিই। অরবিটালে
ইলেকট্রনের সংখ্যা হচ্ছে 2(21+ 1)।
অর্থাৎ । = 0 হলে যে কোনো n -এর জন্য অরবিটালে ইলেকট্রনের সংখ্যা 2(2 × 0 + 1) = 2
1 = 1 হলে যে কোনো n -এর জন্য p অরবিটালে ইলেকট্রনের সংখ্যা 2(2 × 1 + 1) = 6
1 = 2 হলে যে কোনো n -এর জন্য d অরবিটালে ইলেকট্রনের সংখ্যা 2(2 x 2 + 1) = 10
1 = 3 হলে যে কোনো n -এর জন্য f অরবিটালে ইলেকট্রনের সংখ্যা 2(2 x 3 + 1) = 14
এখন তোমরা খুব সহজেই দেখতে পাবে যে, যেকোনো n এর জন্য তার সবকটি অরবিটালের ইলেকট্রনগুলো যোগ করলে আমরা পাই 2n²।
নিচের টেবিলে প্রধান শক্তিস্তর (n = 1 থেকে 4 পর্যন্ত), নির্দিষ্ট শক্তিস্তরের জন্য সম্ভাব্য সবকটি উপশক্তিস্তরের মান, সংশ্লিষ্ট অরবিটালে নাম, অরবিটালে মোট ইলেকট্রন সংখ্যা, এবং প্রধান শক্তিস্তরে মোট ইলেকট্রন সংখ্যা দেখানো হলো:''
৫.৫ পরমাণুতে ইলেকট্রন বিন্যাসের নীতি
পরমাণুতে ইলেকট্রন বিন্যাসের নীতিগুলো নিচে বর্ণনা করা হলো:
১) পরমাণুতে ইলেকট্রন বিন্যাসের নীতি অনুযায়ী, ইলেকট্রন প্রথমে সর্বনিম্ন শক্তির অরবিটাল পূর্ণ করবে, পরবর্তী কালে ক্রমান্বয়ে উচ্চশক্তির অরবিটাল পূর্ণ করতে শুরু করবে। আরও সহজভাবে বললে বলা যায়, যে অরবিটালের শক্তি কম (lower energy), সেই অরবিটালে ইলেকট্রন আগে প্রবেশ করবে এবং যে অরবিটালের শক্তি অপেক্ষাকৃত বেশি, সে অরবিটালে পরে প্রবেশ করবে।'
এখন প্রশ্ন হচ্ছে দুটি অরবিটালের মধ্যে কোনটির শক্তি বেশি আর কোনটির শক্তি কম, সেটি কীভাবে বুঝা যাবে? সেটি বুঝার জন্য অরবিটাল দুটির প্রধান শক্তিস্তরের মান (n-এর মান) এবং উপশক্তিস্তরের মান (1 -এর মানের) যোগফল বের করতে হবে। যে অরবিটালের (n + 1) -এর মান কম সেই অরবিটালের শক্তি কম এবং যে অরবিটালের (n + 1) -এর মান বেশি সেই অরবিটালের শক্তি বেশি।
উদাহরণস্বরূপ, আমরা 3d এবং 4s এই দুটি অরবিটালের মধ্যে কোনটির মান বেশি সেটা বের করে দেখতে পারি:
3d: (n + 1) = (3 + 2) = 5
4s: (n + 1) = (4+0) = 4
এখানে দেখা যাচ্ছে চতুর্থ শক্তিস্তরের 45 অরবিটাল তৃতীয় শক্তিস্তরের 3d অরবিটালের চেয়ে কম শক্তিসম্পন্ন। তাই নিয়ম অনুযায়ী, ইলেকট্রন আগের অন্যান্য শক্তিস্তর পূর্ণ করার পর প্রথমে 45 অরবিটালে প্রবেশ করবে, পরে 3d অরবিটালে যাবে।'
২) n + 1 -এর মান যদি দুটি অরবিটালে ক্ষেত্রে সমান হয়, তখন যে অরবিটালটিতে n -এর মান কম, সেই অরবিটালের শক্তি কম হবে এবং সেখানে ইলেকট্রন আগে প্রবেশ করবে। উদাহরণস্বরূপ, 3d ও 4p অরবিটাল দুটির কথা বিবেচনা করা যেতে পারে:
3d: (n + 1) = (3 + 2) = 5
4p: (n + 1) = (4+1) = 5
এখানে দুটো অরবিটালেরই (n + 1) -এর মান 5, কিন্তু যেহেতু 3d অরবিটালের জন্য n -এর মান 3 এবং 4p অরবিটালের জন্য n -এর মান 4 তাই n -এর মান কম হওয়ায় 3d অরবিটালে ইলেকট্রন আগে প্রবেশ করবে।'
এই সহজ দুটি নিয়ম প্রয়োগ করে আমরা সবকটি অরবিটালকে তাদের শক্তিস্তরের মানের ক্রমানুসারে সাজাতে পারি:
1s <2s <2p <3s <3p <4s <3d <4p <5s <4d <5p <6s <4f <5d <6p 7s 5f <6d <7p <8s
অরবিটালের শক্তিক্রমকে একটি রেখা দিয়ে পরপর সংযুক্ত করা হলে আমরা শক্তিক্রমের প্যাটার্নটি দেখতে পাই
৩) আমরা জানি যে, ও অরবিটাল বা উপশক্তিস্তরে সর্বোচ্চ 2টি ইলেকট্রন, p উপশক্তিস্তরে সর্বোচ্চ 6টি ইলেকট্রন, d উপশক্তিস্তরে সর্বোচ্চ 10টি ইলেকট্রন, এবং f উপশক্তিস্তরে সর্বোচ্চ 14টি ইলেকট্রন থাকতে পারে। কাজেই কোনো মৌলের জন্য ইলেকট্রন বিন্যাস করতে হলে আমাদের সবচেয়ে কম শক্তিস্তরের অরবিটাল থেকে শুরু করতে হবে এবং অরবিটালগুলো সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমত পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত ইলেকট্রন বসিয়ে যেতে হবে। অরবিটালটি পূর্ণ হওয়ার পর পরবর্তী শক্তিস্তরে গিয়ে বাকি ইলেকট্রন বসানো শুরু করতে হবে ।
কাজেই এখন আমরা যে কোনো মৌলের জন্য ইলেকট্রন বিন্যাস করে দেখতে পারি। ইলেকট্রনের বিন্যাস আরও সহজবোধ্য করার জন্য প্রতিটি অরবিটালের প্রতীকের উপর সেই অরবিটালে কয়টি ইলেকট্রন রয়েছে সেটি লিখে রাখা হয়। উপরোক্ত নিয়ম অনুসারে নিম্নে কয়েকটি মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাস দেখানো হলো:
O (8)→ 1s 2s 2p4
Al (13)→ 1s 2s 2p 3s 3p2
K (19)→ 1s 2s 2p 3s 3p 4s1
Ca (20) 1s2 2s 2p 3s 3p 4s2
Sc (21) 1s 2s 2p 3s 3p 4s 3d1
আমরা ইতোপূর্বে দেখেছিলাম পটাশিয়াম (K) ও ক্যালসিয়াম (Ca) তাদের তৃতীয় স্তর (n = 3) অপূর্ণ রেখেই চতুর্থ শক্তিস্তর (n = 4) প্রবেশ করেছে, এখন তোমরা নিশ্চয়ই তার কারণটি বুঝতে পারছ। তৃতীয় স্তর পূর্ণ করতে হলে ইলেকট্রনগুলোকে 3d অরবিটালে প্রবেশ করতে হবে, কিন্তু 3d অরবিটালের শক্তি 45 অরবিটলের শক্তি থেকে বেশি। তাই ইলেকট্রনগুলো 3d অরবিটাল অপূর্ণ রেখে চতুর্থ শক্তিস্তরের 45 অরবিটলে প্রবেশ করেছে। আবার স্ক্যান্ডিয়াম (Sc) -এর ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি 19তম ও 20তম ইলেকট্রন 45 অরবিটাল পূর্ণ করার পরে 3d অরবিটালে তার 21তম ইলেকট্রনটি নিয়ে ফিরে এসেছে। স্ক্যান্ডিয়াম (Sc) -এর মতোই আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে Fe (26), সেটির ইলেকট্রন বিন্যাস হচ্ছে:
যদি একটি প্রধান শক্তিস্তরে ইলেকট্রন বিন্যাস শেষ করার আগেই মাঝে মাঝে পরের শক্তি স্তরে ইলেকট্রন বিন্যাস শুরু হয় এবং পরবর্তী কালে আবার আগের শক্তিস্তর ফিরে আসে, তাই বোঝার সুবিধার প্রধান শক্তিস্তরের (n) উপশক্তিস্তর বা অরবিটালকে পাশাপাশি লেখা হয়। তাই স্ক্যান্ডিয়াম Sc (21) এবং Fe (26) -এর ইলেকট্রন বিন্যাসে সবকটি তৃতীয় উপস্তর পাশাপাশি লিখে চতুর্থ উপস্তর লেখা হয়।
৫.৬ ইলেকট্রন বিন্যাসের সাধারণ নিয়মের কিছু ব্যতিক্রম
যে কোনো নিয়মেরই ব্যতিক্রম থাকে। ইলেকট্রন বিন্যাসের বেলাতেও সাধারণ নিয়ম থেকে কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায় এবং এই ব্যতিক্রমের পিছনে যৌক্তিক কারণও রয়েছে। যেমন- সাধারণত দেখা যায় যে, একই উপশক্তিস্তর যেমন- p কিংবা d অরবিটালগুলো অর্ধেক পূর্ণ (উদাহরণ: p3, d5) না হয়ে যদি সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ (উদাহরণ: p6, d10) হয়, তাহলে সেই ইলেকট্রন বিন্যাস বেশি স্থিতিশীল (stable)
হয়ে থাকে। যেমন- কপার Cu(29) -এর ইলেকট্রন বিন্যাস স্বাভাবিকভাবে হওয়ার কথা নিম্নরূপ :
প্রকৃতিতে Cl (35) -এর প্রাপ্ত পরিমাণ (75.77%) এবং তার পারমাণবিক ভর 34.968u এবং
কিন্তু 3d অরবিটাল বেশি স্থিতিশীল হবে (stable) হবে যদি অরবিটালটি সম্পূর্ণভাবে পূর্ণ হয়। এটি করার জন্য 4s অরবিটাল থেকে একটি ইলেকট্রন 3d অরবিটালে আসে। ফলে, কপার (Cu) -এর ইলেকট্রন বিন্যাস হয় এরকম:
এরকম ব্যতিক্রম ইলেকট্রন বিন্যাস ক্রোমিয়াম (Cr)- এর ক্ষেত্রেও দেখা যায়।
৫.৭ পারমাণবিক ভর এবং আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর (Atomic mass or relative atomic mass)
ধরা যাক তোমাকে একটি পরমাণুর ভর বের করতে বলা হয়েছে। আমরা জানি একটি পরমাণুর ভর বা পারমাণবিক ভর বলতে ঐ পরমাণুতে অবস্থিত ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রনের ভরের সমষ্টিকে বুঝায়। এই অধ্যায়ের শুরুতে ইলেকট্রন (9.109x10-31kg), প্রোটন (1.673 x 10-27 kg) এবং নিউট্রনের ভর (1.675 x 10-27 kg) দেওয়া আছে কাজেই আমরা নিশ্চয়ই এখন যে কোনো পরমাণুর ভর বের
করতে পারব। কিন্তু দেখতেই পাচ্ছ এই ভরগুলো খুবই ছোটো, কার্যক্ষেত্রে ব্যবহার করার জন্য আমরা সব সময়ই একটি মানানসই একক ঠিক করে নেই। নক্ষত্রের ভর সাধারণত আমরা সূর্যের ভরের সাপেক্ষে মেপে থাকি, ট্রেনের ইঞ্জিনের ভর মাপতে হলে আমরা টন ব্যবহার করি, হাতির ওজন হাজার কিলোগ্রামে প্রকাশ করা হয়, আমাদের ওজন মাপি কিলোগ্রামে, কোমল পানীয়তে কতটুকু চিনি থাকে সেটা বলা হয় গ্রামে, ওষুধে কার্যকরী রাসায়নিক দ্রব্যের পরিমাণ বলা হয় মিলিগ্রামে। স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞানীরা অণু-পরমাণুর ভর প্রকাশ করার জন্য একটি মানানসই একক বের করে নিয়েছেন। সেটিকে amu (atomic mass unit) বা সংক্ষেপে শুধু । বলা হয়। একটি কার্বন 12 (°C) আইসোটোপের পারমাণবিক ভরের অংশকে । বা পারমাণবিক ভর একক হিসেবে ধরা হয়। এর পরিমাণ
1 u = 1.661 x 10 kg
অর্থাৎ, অন্যভাবে বলা যায় এই নতুন এককে
"C পরমাণুর ভর = 12u
এবং
ইলেকট্রনের ভর 0.00054858 u
প্রোটনের ভর= 1.007276 u
নিউট্রনের ভর= 1.008664 u
তোমাদের মনে হতে পারে যেহেতু পরমাণুগুলো ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন দিয়ে তৈরি এবং আমরা আলাদা আলাদাভাবে এগুলোর ভর জানি কাজেই আমরা এখন যে কোনো পরমাণুর ভর বের করে ফেলতে পারব। কিন্তু আসলে এটি পুরোপুরি সত্যি নয়, এই ভর ব্যবহার করে আমরা পরমাণুর ভরের কাছাকাছি বের করতে পারব, কিন্তু প্রকৃত ভর ব্যবহার করতে পারব না। যেমন- আমরা এই নতুন এককে ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রনের ভরের সমষ্টি থেকে °C পরমাণুর ভর বের করে দেখতে পারি, এটি 12u আসা উচিত। যেহেতু "C পরমাণুতে চটি ইলেকট্রন, চটি প্রোটন এবং চটি নিউট্রন তাই প্রথমে এই পরমাণুর ভর:
"C পরমাণুর ভর 6x (0.00054858 1.007276 1.008664) u 12.09893148 u
তোমরা দেখতেই পাচ্ছ এটি হুবহু 12u না এসে প্রায় ০.৪% বেশি এসেছে। শুধু 12C -এর জন্য নয় যে কোনো পরমাণুর জন্যই যদি ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রনের ভরের সমষ্টি থেকে পরমাণুর ভর বের করা হয়, দেখা যাবে সেই ভর প্রকৃত পরমাণুর ভর থেকে বেশি। যেহেতু প্রোটন ও নিউট্রনের ভরের তুলনায় ইলেকট্রনের ভর নগণ্য এবং পরমাণুর ভর বের করার সময় এই ভরটিকে বিবেচনা না করলেও কোনো পার্থক্য হয় না, তাই আমরা অনুমান করতে পারি প্রোটন এবং নিউট্রন মিলে নিউক্লিয়াস
গঠন করার সময় অন্য কোনো কারণে সম্মিলিত ভর কমে যায়। তোমরা আগে নিউক্লিয়ার বলের কথা জেনেছ, নিউক্লিয়াসের ভেতরে প্রোটন এবং নিউট্রন এই নিউক্লিয়ার বলে একে অন্যকে আকর্ষণ করে এবং যেটুকু ভর কমে যায় সেটি আপেক্ষিক সূত্রের E = mc² হিসেবে শক্তিতে পরিণত হয়, এবং এই শক্তিতে নিউক্লিয়াসের ভেতরে প্রোটন ও নিউট্রন আটকে থাকে। কাজেই তোমরা বুঝতে পারছ একটি পরমাণুতে শুধু নিউট্রন ও পরমাণুর সংখ্যা জানলে তাদের আনুমানিক পারমাণবিক ভর বের করা যায়, কিন্তু প্রকৃত পারমাণবিক ভর কত সেটি জানা সম্ভব হয় না। এজন্য বিজ্ঞানীরা অনেক পরিশ্রম করে সকল মৌলের ভিন্ন ভিন্ন সকল আইসোটোপের পারমাণবিক ভর নির্ণয় করে রেখেছেন।
এবারে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্রশ্ন। ধরা যাক তোমার কাছে ক্লোরিন (CI)- এর পারমাণবিক ভর কত সেটি জানতে চাওয়া হলো। কিন্তু ক্লোরিনের আইসোটোপ দুটি, একটি Cl(35) আরেকটি Cl(37), তাদের পারমাণবিক ভর যথাক্রমে 34.968u এবং 36.956u তাহলে তুমি ক্লোরিন (CI)-এর পারমাণবিক ভর কোনটি বলবে? বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নটিরও একটি যৌক্তিক উত্তর প্রস্তুত করেছেন। যখন কোনো মৌলের একাধিক আইসোটোপ থাকে, তখন তাদের প্রাপ্ত শতকরা পরিমাণের উপর গড় (weighted average) করে মৌলটির পারমাণবিক ভর নির্ণয় করা হয়। যেহেতু প্রকৃতিতে Cl (35) -এর প্রাপ্ত পরিমাণ (75.77%) এবং তার পারমাণবিক ভর 34.968u এবং প্রকৃতিতে Cl (37) -এর প্রাপ্ত পরিমাণ (24.23%) এবং তার পারমাণবিক ভর 36.956u কাজেই ক্লোরিন মৌলের গড় পারমাণবিক ভর (75.77 x 34.968 + 24.23 x 34.956)/100=35.45u
অর্থাৎ তুমি যদি কোনো পাত্রে রাখা কিছু ক্লোরিন মৌলের ভেতর থেকে যে কোনো একটি পরমাণুর পারমাণবিক ভর বের কর তাহলে সেটি হবে 34.968u কিংবা 36.956u, কখনোই 35.45 u হবে না, কিন্তু ক্লোরিন মৌলের পারমাণবিক ভর হিসেবে ধরা হয় 35.45u। পরবর্তী অধ্যায়ের পর্যায় সারণিতে তোমরা দেখবে ক্লোরিনের পারমাণবিক ভর হিসেবে এই সংখ্যাটিই লেখা আছে।
রসায়নবিজ্ঞানে পারমাণবিক ওজন (atomic weight) বলে একটি রাশি ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে, যদিও পদার্থবিজ্ঞানে ওজন কথাটির একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে (ওজন হচ্ছে বল, ভরের সঙ্গে 9.8m/ s² গুণ করে ওজন পাওয়া যায় যার একক নিউটন (N) কিন্তু রসায়নে পারমাণবিক ওজন বলতে এককবিহীন গড় আপেক্ষিক পারমাণবিক ভরকে বোঝানো হয়ে থাকে। অর্থাৎ মৌলের পারমাণবিক ভরকে 1u দিয়ে ভাগ দিলে আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর বের হয়ে যায়, দুটি ভরের তুলনা বলে এটি একটি সংখ্যা, এর কোনো একক নেই।
মৌলের ভরসংখ্যা এবং তার শতকরা পরিমাণ জানা থাকলে গড় আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর কীভাবে বের করতে হয় তা তোমরা জেনে গেছ। এর উল্টোটা কি করা সম্ভব? অর্থাৎ যদি কোনো মৌলের দুটি আইসোটোপ থাকে এবং তুমি ঐ মৌলের গড় আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর জানো, তাহলে এ তথ্যগুলো থেকে তুমি কীভাবে ঐ মৌলের আইসোটোপ দুটির প্রকৃতিতে প্রাপ্ত শতকরা পরিমাণ বের করবে?
৫.৮ আপেক্ষিক আণবিক ভর
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর ব্যবহার করে অণুর ভর বের করা হলে তাকে আপেক্ষিক আণবিক ভর বলা হয়। অর্থাৎ অণুর ভেতর যে পরমাণুগুলো রয়েছে সেই পরমাণুগুলোর আপেক্ষিক পারমাণবিক ভরকে পরমাণু সংখ্যা দিয়ে গুণ করে প্রাপ্ত গুণফলগুলোকে যোগ করে অণুর আপেক্ষিক আণবিক ভর বের করা হয়।
উদাহরণ: CO₂ -এর আপেক্ষিক আণবিক ভর কত?
সমাধান : CO2 অণুতে রয়েছে 1টি কার্বন (C) ও 2টি অক্সিজেন (০) পরমাণু। কার্বন পরমাণুর 2 আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর 12 এবং অক্সিজেন পরমাণুর আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর 16। কাজেই CO2-এর আপেক্ষিক আণবিক ভর হচ্ছে 12 + 2 × 16 = 44
আরও দেখুন...