পরিচ্ছেদ ১৬.৩ : এইচআইভি (HIV)/এইডস (AIDS)

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় - বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যা ও এর প্রতিকার | | NCTB BOOK

এইচআইভির ধারণা
এইচআইভি (HIV) হলো অতি ক্ষুদ্র এক বিশেষ ধরনের ভাইরাস। এ ভাইরাস এর পুরো নাম হিউম্যান ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (Human Immuno Deficiency Virus) সংক্ষেপে এইচআইভি (HIV)। এটি মানব দেহে প্রবেশ করে দেহের নিজস্ব রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দেয়। এইচআইভি ভাইরাস অনেকদিন পর্যন্ত শরীরে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। সাধারণত এর সুপ্তিকাল ৬-৭ মাস ।
এ ভাইরাসের অবস্থান আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত, বীর্য, যোনিরস, থুতু, চোখের পানি, মূত্র এবং স্তনের দুধের মধ্যে। তবে চোখের পানি, মূত্র ও থুতুর মধ্যে এ ভাইরাসের ঘনত্ব অত্যন্ত কম থাকার ফলে এগুলোর মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না বলে বিশেষজ্ঞরা মতপ্রকাশ করেন।

এইডসের ধারণা
এইডস (AIDS) এর পূর্ণাঙ্গ ইংরেজি রূপ হলো Acquired Immune Deficiency Syndrome। এইচআইভি কয়েকটি নির্দিষ্ট উপায়ে মানব দেহে প্রবেশ করে আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা এক পর্যায়ে অতিরিক্ত পরিমাণে ধ্বংস করে দেয়। এইচআইভি সংক্রমণের সর্বশেষ পর্যায় হলো এইডস। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে এইডস আক্রান্ত ব্যক্তি অতি সহজেই অন্য যে কোনো রোগে আক্রান্ত হয়। এইডসের কোনো কার্যকর প্রতিষেধক এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। সে কারণে এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির অনিবার্য পরিণতি অকাল মৃত্যু।

কাজ -একক : এইডস সংক্রমণের কারণ চিহ্নিত কর।

কাজ-একক :এইডস ছোঁয়াচে নয় কেন? তোমার যুক্তি উপস্থাপন কর।

এইডস কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে দৈনন্দিন কাজকর্ম করলে এইডস হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। যাদের দেহে এইচআইভি আছে, তারাই শেষ পর্যন্ত এইডসে আক্রান্ত হন। যদি রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে কারও দেহে ভাইরাসটি শনাক্ত করা যায় তবেই তাকে এইচআইভি পজেটিভ বলা হয়।

এইডসের কারণ
এইডস একটি ধ্বংসাত্মক ব্যাধি। এইচআইভি সংক্রমণের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির দেহে এটি প্রবেশ করে। এইচআইভি সংক্ৰমিত পুরুষ বা নারীর সাথে যৌন মিলন কিংবা এইচআইভি বহনকারীর রক্ত অন্যের শরীরে সঞ্চালনের ফলে এইডস হয়। তাছাড়া এ ভাইরাসযুক্ত সিরিঞ্জ, সুচ, অপারেশনের যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত না করে ব্যবহার করলে, সমকামিতার মাধ্যমে, আক্রান্ত মায়ের গর্ভে সন্তান জন্ম নিলে অথবা আক্রান্ত মায়ের দুধের মাধ্যমে এটি ছড়াতে পারে। এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের সঙ্গে সুস্থ ব্যক্তির রক্তের সংস্পর্শ ঘটলে, যেমন—উভয়ের কাটা, ফোড়া, ঘা, ক্ষত ইত্যাদির মাধ্যমে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও কান-নাক ফোঁড়ার সুচ ইত্যাদি জীবাণুমুক্ত না করে ব্যবহারের ফলে এ ভাইরাস ছড়াতে পারে। এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তির অঙ্গ, যেমন-কর্নিয়া, হূৎপিণ্ড, কিডনি, লিভার প্রভৃতি বা কোষসমষ্টি কোনো ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করলে এইডস ছড়াতে পারে। এ ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির ওজন ২ মাসের মধ্যে শতকরা ১১ ভাগের বেশি কমে যায়। সার্বক্ষণিক জ্বর ও ডায়রিয়া লেগে থাকে। এক মাসের বেশি সময় ধরে তার ক্রমাগত কাশি হতে থাকে। শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ হয়। শুকনা কাশি লেগে থাকে। ঘাড় ও বগলে অসহ্য ব্যথা হয়। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ছত্রাকজনিত সংক্রমণ দেখা দেয়। অতিরিক্ত অবসাদ অনুভব করে। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত থালা-বাসন, কাপ, গ্লাস, জামা-কাপড় ইত্যাদি ব্যবহার করলে এইডস ছড়ায় না। তাছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে করমর্দন, কোলাকুলি, খেলাধুলা, লেখাপড়া এবং সেবা-শুশ্রুষা করলেও এ রোগ ছড়ায় না।

বাংলাদেশ ও বিশ্বে এইচআইভি/এইডস পরিস্থিতি
১৯৮১ সালে বিশ্বে প্রথম এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। আমাদের দেশে এইচআইভি সংক্রমণ ধরা পড়ে ১৯৮৯ সালে। ১৯৯৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যান রিপোর্টে এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা দেখা যায়- মিয়ানমার ৪৭৫, ভিয়েতনাম ২২৮, ভারত ১০৩৬, মালয়েশিয়া ২০০, পাকিস্তান ৪৬, ফিলিপাইন ১৯৮, থাইল্যান্ড- ১৯০৯৫ এবং বাংলাদেশে ৯ জন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের চারপাশে ব্যাপকভাবে এইডস ছড়িয়ে পড়েছে। ১লা ডিসেম্বর ২০০২ বিশ্ব এইডস দিবসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় AIDS / STD (Sexually Transmitted Disease) কার্যক্রমের এক পরিসংখ্যান উপস্থাপন করে। এ পরিসংখ্যানে বলা হয়, ২০০১ সালে বাংলাদেশে HIV ভাইরাস বহনকারীর সংখ্যা ছিল ১৮৮ জন, যা ৩০ ডিসেম্বর ২০০২ এ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২৪৮ জনে। National AIDS and STD Program- ২০১০ অনুযায়ী বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমিত চিহ্নিত ব্যক্তির সংখ্যা ২০৮৮, এইডস আক্রান্তের সংখ্যা ৮৫০ এবং মৃত্যুবরণ করেছিল ২৪১ জন। একই কর্মসূচি ২০১৬ এর হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমিত চিহ্নিত ব্যক্তির সংখ্যা ৫৭৮ জন। এ হিসাবে ১৯৮৯-২০১৬ পর্যন্ত এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা ৪,৭২১ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছে ৭৯৯ জন। দেশে ৩ কোটির ঊর্ধ্বে ১৫-২৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠী রয়েছে যাদের এইচআইভি সংক্রমণ এবং এইডস প্রতিরোধ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা নেই ।

বাংলাদেশে এইডস বা এইচআইভি বিস্তারের বহুবিধ কারণ রয়েছে। দেশটির পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে এইডসের বিস্তার ভয়াবহ। বিভিন্ন ব্যবসায়িক কাজকর্ম ও অন্যান্য কারণে প্রতিদিন দেশের হাজার হাজার লোক বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করছে। বর্তমানে বাংলাদেশে আশংকাজনকভাবে যৌনকর্মীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ইতোমধ্যে ৬% যৌনকর্মী এইচআইভি ভাইরাসে সংক্রমিত এবং ৫২% এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবার মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। তাছাড়া দেশে পেশাদার রক্তদাতার সংখ্যাও বেড়েছে। এসব রক্তদাতার সিংহভাগ মাদকাসক্ত । আমাদের দেশে এইডস সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা ও সচেতনতার অভাব এইডস সংক্রমণের প্রধান কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। আমাদের দেশের প্রায় ৯৯% মোটর শ্রমিক ও রিকশাচালক এইডস সম্পর্কে কিছু জানে না অথচ এরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ যৌন আচরণে লিপ্ত রয়েছে। প্রতিবছর প্রায় ৮০,০০০ লোক বাংলাদেশ থেকে বিদেশে গমন করেন। তাদের কেউ কেউ নানাভাবে এ রোগের ভাইরাস বহন করে দেশে ফিরে আসে। তাছাড়া একই সিরিঞ্জ ব্যবহার করে শিরায় মাদকদ্রব্য গ্রহণকারীর সংখ্যা দেশে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রথম এইডস সংক্রমিত ব্যক্তি দুবাইতে কর্মরত ছিল।

এইডস-এর প্রভাব
এইডস বা এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তি ও পরিবারকে সামাজিকভাবে নিগৃহীত হতে হয়। পৃথিবীর প্রায় সকল সমাজে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। তাদের প্রতি কোনো প্রকার সহযোগিতা ও সহানুভূতি দেখানো হয় না বরং সর্বক্ষেত্রে তার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করা হয়। ফলে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক মৃত্যুর পূর্বেই মানসিক মৃত্যু ঘটে।

এইডস আক্রান্ত ব্যক্তি ধীরে ধীরে কর্মহীন হয়ে পড়ে, যা তার পরিবারের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে দুর্বল করে ফেলে। তাছাড়া পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির অকাল মৃত্যুতে গোটা পরিবারের মধ্যে অসঙ্গতি ও বিপর্যয় নেমে আসে। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

কাজ-একক :বাংলাদেশে এইডস বা এইচআইভি কেন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, তোমার যুক্তি উপস্থাপন কর।

কাজ-দলগত :ব্যক্তি, পরিবার, সামাজিক ও জাতীয় পর্যায়ে এইচআইভি বা এইডস-এর প্রভাব চিহ্নিত কর।

কাজ-একক : বাংলাদেশ ও বিশ্ব প্রেক্ষাপটে এইডস বা এইচআইভি এর ওপর একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত কর।

এইডস বা এইচআইভির কারণে আমাদের দেশে নিরাপদ রক্তের প্রাপ্যতা ঝুঁকিপূর্ণ। দরিদ্র দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নত দেশগুলোর অব্যাহত উন্নয়ন এবং সেবা ব্যবস্থাও হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। বিশ্বে এইডস-এর কারণে একদিকে অকাল মৃত্যুর হার বাড়ছে এবং গড় আয়ু কমছে। আর অন্যদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়াও এইডস-এর কারণে প্রজনন হার হ্রাস পাচ্ছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র।

বাংলাদেশে এইডস প্রতিরোধের উপায়
এইডসের কোনো প্রতিষেধক নেই। মৃত্যুই এর একমাত্র পরিণাম। তাই বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে এর প্রতিরোধ। এইডস প্রতিরোধে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক।

  • ধর্মীয় অনুশাসন অনুসরণ করা এবং স্বভাব ও আচরণে সমাজ নির্ধারিত আদর্শ মেনে চলা ;
  • একমাত্র জীবনসঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকা বা একজন যৌনসঙ্গী থাকা ;
  • রক্তের এইচআইভি পরীক্ষা করে রক্ত গ্রহণ করা ;
  • . অন্যের ব্যবহৃত সুচ, ব্লেড, সিরিঞ্জ ব্যবহার না করা ;
  • কিশোর-কিশোরী এবং সকল মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা ;
  • নাক, কান ছিদ্র এবং ছেলেদের সুন্নতে খাৎনা করার সময় জীবাণুমুক্ত সুচ, কাঁচি ব্যবহার করা ;
  • শরীরে অঙ্গ প্রতিস্থাপনে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা ;
  • বিদেশযাত্রা ও প্রবাসীদের জন্য বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা ;
  • যুবসমাজকে এইডস প্রতিরোধে গণসচেতনতা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা ।

এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি আমাদের করণীয়
এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য সামাজিক ও মানসিক সমর্থনের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা জরুরি। আক্রান্তের জ্বর, ডায়রিয়া এবং ব্যথা থাকলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে। নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার ও পর্যাপ্ত বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া এইডস আক্রান্তের প্রতি পরিবার ও সমাজের অন্যান্যের মানসিক ও সামাজিক সমর্থন জরুরি। আক্রান্ত ব্যক্তিকে ঘৃণা নয়, রোগকে ঘৃণা করার নীতি মেনে চলতে হবে। আক্রান্তের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা, স্নেহ- ভালোবাসা দিয়ে তার মনকে প্রফুল্ল রাখতে হবে। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তিকে সবার কাছ থেকে আলাদা করা উচিত নয় । তাকে সাবধানে রাখতে হবে, যাতে সে অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত না হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ করা যাবে না এবং তার সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপন থেকে অন্যকে বিরত রাখতে হবে।

Content added By
Promotion