পুঁইশাকের চাষ
পুঁইশাকের জাতঃ পুঁই শাকের জাতকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- কাণ্ড সবুজ ও কাণ্ড লাল।
কাণ্ড সবুজ- এ জাতের কাণ্ড সবুজ ও মোটা, রসালো এবং নরম। এর পাতা চওড়া ও পুরু, পাতার রং সবুজ।
কান্ড লাল- এ জাতের কাণ্ড বেগুনী লাল, কাণ্ড শক্ত এবং তুলনামূলকভাবে চিকন। এর পাতা ছোট এবং পাতলা, পাতার কিনারা দিয়ে বেগুনীমত দেখায়। লাল জাতের পুঁই গাছের ফল বেশি ধরে। তবে কয়েকটি পুঁইশাকের উন্নত জাত পাওয়া গেছে। যেমন- বারি পুঁইশাক-১, মাধুরী, মনিষা, রূপসাগ্রীন ইত্যাদি ।
জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ
জমি তৈরি- বার বার চাষ ও মই দিয়ে জমির মাটি ঢেলাবিহীন ও ঝুরঝুরে করে তৈরি করতে হয়। জমিতে সরাসরি বীজ বুনার জন্য ১ মিটার প্রস্থ বেড তৈরি করতে হবে। বেড কতটুকু লম্বা হবে তা নির্ভর করে চাষের প্রয়োজন ও জমির দৈর্ঘ্যের ওপর। আর বেডের উচ্চতা হবে ১০-১৫ সেমি.। বেডের দুপাশে নালার গভীরতা হবে ২০ সেমি. এবং প্রস্থ হবে ৩০ সেমি.
সরাসরি বীজ বপন বা রোপণ- সরাসরি বীজ বপন বা রোপণ করলে ৭৫ সেমি. দূরে সারিতে ৪৫ সেমি. দূরে দূরে বীজ বপন বা রোপণ করা হয়।
সার প্রয়োগ
পুঁইশাকে হেক্টর প্রতি সারের পরিমাণ এবং প্রয়োগের সময় নিচে দেয়া হলো-
১ম ও ২য় উপরি প্রয়োগঃ উল্লিখিত সময়ে সার প্রয়োগ করে চারার গোড়ার চারদিকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। প্রথম ফসল কাটার পর তৃতীয়বার ইউরিয়ার উপরি প্রয়োগ এবং পটাশ সার ১ম উপরি প্রয়োগ হিসেবে দিতে হয়ে। এ সময় গাছের গোড়ার চারিদিকে ১৫-১৬ সেমি. দূরে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়। চতুর্থবার ও একইভাবে দিতে হয়।
জমিতে গন্ধক ও দস্তার অভাব হলে জিপসাম ১০০ কেজি ও দস্তা ১০ কেজি হিসেবে প্রতি হেক্টরে দেয়া যেতে পারে।
বীজ বা চারা রোপণ ও অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা
পুঁইশাকের বীজ ছিটিয়ে বপন বা লাইনে রোপণ করা যায়। আবার পলিব্যাগে চারা তৈরি করেও রোপণ করা যায়। তবে চারা তৈরি করে জমিতে রোপণ করা ভালো। চারা তৈরি করার জন্য বীজতলায় বীজ বুনে চারার বয়স ৫-৬ সপ্তাহ হলে তুলে মূল জমিতে লাগাতে হয়। বীজ বপনের পূর্বে অন্তত ১২ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখলে গজাতে সুবিধা হয়। জমিতে সরাসরি বীজ রোপণ করলে প্রতি মাদায় ২-৩টি করে বীজ রোপণ করা উচিত।
বেডে বীজ বপন বা রোপণ- বেডে বীজ বপন বা রোপণ করলে সারিতে ২-৪ সেমি. গভীর করে প্রতি গর্তে ২-৩টি বীজ বপন বা রোপণ করতে হয়। পরবর্তীতে আগাছা পরিষ্কার ও ঘাস বাছাই করার সময় প্রতি গর্তে ১টি করে সতেজ চারা রেখে বাকীগুলো তুলে ফেলতে হবে।
পলিব্যাগে চারা তৈরি- ৫ × ৫ সেমি. সাইজের ছিদ্রযুক্ত ছোট পলিব্যাগে গোবরসার ও বালি সমান অনুপাতে মিশিয়ে ভরতে হবে। ১টি ব্যাগে ১টি করে বীজ মাটির ১ সেমি. গভীরে বসাতে হবে। ৩-৫ দিনের মধ্যে বীজ গজাবে এবং ২৫-৩৫ দিনে চারা রোপণের উপযুক্ত হবে।
বর্ষা মৌসুমে পুঁইশাক লাগাতে হলে ১ মিটার প্রশস্ত বেড তৈরি করতে হবে। পানি নিষ্কাশনের জন্য কমপক্ষে ১৫ সে.মি গভীর ও ৩০ সেমি. প্রশস্ত নালা করতে হবে। নালার মাটি দ্বারা বেড় ১০-১৫ সেমি. উঁচু করা যাবে। বেডের দুই কিনারে ২০ সেমি. বাদ দিয়ে লম্বালম্বি ৬০ সেমি. মাদা তৈরি করতে হবে। বীজ বা চারা রোপণের পর পরই সেচ দেয়া উচিত। তাতে বীজ তাড়াতাড়ি গজায় এবং চারা লাগানো হলে তাড়াতাড়ি লেগে যায়। একই জমিতে প্রতি বছর পুঁইশাকের চাষ করা উচিত নয়।
পরিচর্যা
আগাছা দমন, মাটি আলগা করে সারের উপরি প্রয়োগ এবং গাছের গোড়ায় হাল্কাভাবে মাটি দেয়ার কাজ একসাথেই করা যেতে পারে। গাছ যখন ৩০-৪৫ সেমি. লম্বা হবে তখন মাথার ডগা কেটে দিলে শাখা প্রশাখা বেশি হবে। পুঁইশাক ১.৫ মিটার উঁচু করে মাচাতেও দেওয়া যেতে পারে। পুঁইশাক সুষ্ঠু বাড়বাড়তির জন্য পুরো জীবনকালে যথেষ্ট সার ও রসের প্রয়োজন হয়। তাই বেশি ফলনের জন্য ডগা কাটার পর ইউরিয়া ও এমওপি সার প্রয়োগ করে হালকা সেচ দিতে হয়।
পোকামাকড় ও রোগবালাই
পোকামাকড় দমন
পুঁইশাকে তেমন কোন মারাত্মক রোগবালাই হয় না। তবে কদাচিৎ পাতায় দাগ পড়া এবং কাণ্ড ও কীকড় পচা রোগ দেখা দিতে পারে।
রোগ- পুঁইশাকে পাতা পচা বা চারা পঁচা রোগ দেখা দিলে সে গাছ তুলে পুঁতে ফেলতে হয়।
প্রতিকার
১) রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে।
২) জমি সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
৩) জমিতে পানি নিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৪) একই জমিতে বার বার পুঁইশাক চাষ না করে শস্য পর্যায় অনুসরণ করতে হবে।
৫) ডায়াথেন এম ৪৫ বা কপার অক্সিক্লোরাইড ছত্রাকনাশক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
সেচ ও নিকাশ- পুঁইশাকে রসের প্রয়োজন বেশি তাই ১৫ দিন পর পর সেচ দিতে হয়। পানি শুকালে মাটি আগলা করাসহ আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হয়। পানি নিকাশের ব্যবস্থা রাখতে হয়।
ফসল সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ
চারা রোপণের ৬-৮ সপ্তাহ পরে ১ম বার সংগ্রহ করা যায়। ডগা ৩০-৩৫ সেমি. লম্বা হলে গোড়ায় ২-৩ টি পাতা রেখে মাটি হতে ৫-৬ সেমি. উপরে কাটতে হয়। এরপর ১৫ দিন অন্তর অন্তর ২০-৩০ সেমি. লম্বা ডগা হলেই ফসল সংগ্রহ করা যায়। এভাবে ৬-৭ বার ফসল আহরণ করা যেতে পারে। ৪ থেকে ৬ মাস পর ফুল আসলে আর ফসল সংগ্রহ করা যাবে না। আবার সারি করে ৮-১০ সেমি. পর পর বীজ বুনে/রোপণ করে ৭/৮টি পাতা হলে সম্পূর্ণ গাছসহ তুলে বিক্রি করা যায় এবং পুনরায় বীজ রোপণ করা যায়। এভাবে স্বল্প সময়ে বারবার পুইশাক সগ্রহ করা যায়। পুঁইশাক কেটে স্তরে স্তরে ছালা দিয়ে সাজায়ে পানি দিয়ে ভিজিয়ে বাজারজাত করা যায়। ফলন : হেক্টর প্রতি ২০-২৫ টন।
গিমা কলমি শাকের চাষ
কলমি শাকের জাতঃ পুকুর, খাল, বিল বা জলাশয়ের ধারে কলমিগাছ এমনিতে জন্মে থাকে। তবে কলমি শাক দু'ধরনের। (ক) কাণ্ড ও পাতা সম্পূর্ণ সবুজ ও (খ) কাণ্ড, বোটা, কীরা লালচে কিন্তু পাতা গাঢ় সবুজ। বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (RARI) কলমি শাকের মধ্য হতে নির্বাচন করে গিমা কলমির জাত উদ্ভাবন করেছেন। এ জাতটি খাড়াভাবে জন্মে থাকে। তবে বেশি বিলম্ব করলে লতায়ে যায়।
জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ
জমি তৈরিঃ মাটির প্রকারভেদে ৪/৫টি চাষ ও মই দিয়ে জমি সমতল করতে হয়। জমি গভীরভাবে চাষ করলে গিমা কলমির জন্য ভালো। তবে দোঁআশ ও বেলে দোঁআশ মাটিতে গিমা কলমি বেশি ভালোভাবে জন্মে থাকে। জমি চাষের পর ১ মিটার করে চওড়া বেড তৈরি করে বেডের পাশে বা দুই বেডের মাঝখান দিয়ে ২০-২৫ সেমি. চওড়া করে নালা তৈরি করতে হয়। এক ধরনের কলমি শাক পানিতে জন্মে থাকলেও গিমা কলমিতে পানি নিকাশের সুবন্দোবস্ত রাখতে হয়।
সার প্রয়োগঃ গিমা কলমি চাষের জন্য কম উর্বর জমি হলে জৈব সার বেশি পরিমাণে প্রয়োগ করতে হয়। জমির শেষ চাষের পূর্বে সম্পূর্ণ পচা গোবর সার, টিএসপি ও পটাশ সার সম্পূর্ণ জমিতে বা বেডে ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়। সারের পরিমাণ নিচে দেয়া হলো।
সারের নাম | হেক্টর প্রতি সারের পরিমাণ |
গোবর/কম্পাস্টে সার | ৬-৮ টন |
ইউরিয়া | ২৮০ কেজি |
টিএসপি | ১২০ কেজি |
এমওপি | ৭৫ কেজি |
ইউরিয়া সার ৪ কিন্তিতে ভাগ করে উপরি প্রয়োগ করতে হয়। চারা গজানোর পর ৮/১০ সেমি. উঁচু হওয়ার পরে সারির পাশ দিয়ে ইউরিয়া ছিটিয়ে দিয়ে মাটি নাড়াচাড়া করে মিশিয়ে দিতে হয়। গিমা কলমি ১ মাসের মধ্যেই আহরণ করা যায়। তাই ১ম আহরণ করার পর পরই ২য় কিন্তুি ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে হালকা সেচের ব্যবস্থা করতে হয়। ১ম আহরণের ৮-১০ দিন পর পুনরায় ২য় আহরণ করা যায়। ২য় আহরণ করার পর পর পুনরায় ৩য় কিস্তি ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করতে হয়। আবার ৮-১০ দিন পর শাক আহরণ করে ৪র্থ কিস্তি সারের উপরিপ্রয়াগ করে আর একবার শাক সংগ্রহ করে পরবর্তীতে বীজের জন্য রেখে দেওয়া যায়। কেননা ৪ বারের পর সাধারণত শাক হিসেবে ভালো ফলন দেয় না এবং মানগত দিক থেকে নিম্নমানের হয়ে যায় ।
বীজ/চারা রোপণ ও অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা
বীজ রোপণঃ জমি চাষের পর বেড তৈরি করে বেডে ৩০ সেমি. পর পর বা দূরত্বে লাইন টেনে প্রতি লাইনে ১০- ১৫ সেমি. পর পর ছোট গর্ত করে সে গর্তে দু'টি করে বীজ ১ সেমি. গভীরে লাগাতে হয়। বীজ রোপণের ৩-৪ দিনের মধ্যে বীজ গজায়। বীজ গজানোর পর চারা ৩৪ সেমি. হলে প্রতি গর্তে ১টি করে চারা রেখে বাকীটা উঠিয়ে ফেলতে হয়। কাটিং রোপণের ক্ষেত্রে ২/৩টি গিরাসহ কাটিং নিয়ে ১টি গিরা মাটির গভীরে পুঁতে কাটিং রোপণ করতে হয়। কাটিং রোপণের পূর্বে ছত্রাকনাশকে কাটিং ডুবিয়ে নিলে ভালো হয়। বীজের ক্ষেত্রে বীজ রোপণের পূর্বে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে নিলে চারা গজানোর হার বৃদ্ধি পায়।
অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যাঃ চারা গজানো বা কাটিং রোপণের পর ১৫ সেমি. পর পর ১টি করে গাছ রেখে বাকীগুলো ১টি উঠানের সময় আগাছা তুলে ফেলতে হয়। গিমা কলমির শিকড়ে প্রচুর আলোকবাতাস লাগার জন্য মাটি সব সময় আগলা করে রাখতে হয়। বর্ষাকালে চাষের সময় সাধারণত সেচের প্রয়োজন হয় না। তবে একনাগাড়ে ১০-১৫দিন বৃষ্টি না হলে সেচ দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। ৩/৪ বার সারের উপরি প্রয়োগ করার পর পর মাটি খুচিয়ে আলগা করে দিতে হয়, তাতে সারের কার্যকারিতা বাড়ে এবং গাছে আলোবাতাস পায়।
পোকামাকড় ও রোগ দমন
পোকামাকড়ঃ মাঝে মাঝে বিটল পোকা গাছের পাতা খেয়ে ছিদ্র করে। ম্যালথিয়ন, ডায়াজিনন বা ফেনিট্রোথিয়ন স্প্রে করে এ পোকা দমন করা যায়। পাউডারি মিলডিউ রোগে পাতায় হালকা হলুদ দাগ পড়ে এবং আস্তে আস্তে তা পরিবর্তিত হয়ে পাতায় সাদা ধূসরাভ দাগ হয়। এর ফলে গাছ দুর্বল হয়, বৃদ্ধি কমে যায়। কপার মিশ্রণ যৌগ বালাইনাশক স্প্রে করে এ রোগ দমন করা যায়।
সেচ ও নিকাশঃ লিমা কলমি প্রচুর পানি পছন্দ করে। কিন্তু পানিতে স্যাঁতসেতে অবস্থা পছন্দ করে না। দীর্ঘ ধরা হলে সেচ দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে। বৃষ্টি বা সেচের পানি বের করে দেয়ার ব্যবস্থা রাখতে হয়।
ফসল সংগ্রহ , সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ
বীজ গজানোর ৩০ দিনের মধ্যেই শাক সংগ্রহ করার উপযোগী হয়। গাছগুলো ৩০-৩৫ সেমি. লম্বা হলে মাটির লেবেল হতে বা পাছের গোড়া হতে ২/৩ সেমি. উপরে কেটে আহরণ করতে হয়। শাক কেটে ডালা / ঝুড়িতে সুচারুরূপে স্তরে স্তরে সাজিয়ে ছারার ও ঠান্ডার রাখতে হয়। তারপর মুঠি বেঁধে বাজারে পাঠাতে হয়। শাক কাটার পর খোলা মেলাভাবে রোদে রেখে দিলে খুব দ্রুত এর মান খারাপ হয়ে যায়। শাক কাটার পর ঠান্ডা ও আর্দ্র ঘরে বেশি আর্দ্রতার ২/৩দিন রাখা যেতে পারে।
ফলন- যত্নের সাথে চাষ করলে হেক্টরে ৪০-৫০টন পর্যন্ত শাক পাওয়া যেতে পারে।
এক কথায় উত্তর
১. পুঁইশাকের কয়টি জাত আছে?
২. কোন জাতের পুঁইশাকের গাছে ফল বেশি ধরে ?
৩. পুঁইশাক চাষে হেক্টর প্রতি কত কেজি জিপসাম দিতে হয় ?
৪. পুঁইশাকের চারা কত সেমি. সাইজের ব্যাগে করা হয় ?
৫. কলমি শাক কয় ধরনের হয় ?
সংক্ষিত প্রশ্ন
১. পুঁইশাক চাষে হেক্টর প্রতি সারের পরিমাণ উল্লেখ কর ।
২. পুঁইশাক চাষে অন্তবর্তী পরিচর্যা সম্পর্কে লেখ।
৩. কলমি শাক চাষে হেক্টরপ্রতি সারের পরিমাণ উল্লেখ কর।
রচনামূলক প্রশ্ন
১. পুঁইশাকের চাষ পদ্ধতি বর্ণনা কর।
২. কলমি শাকের চাষ পদ্ধতি বর্ণনা কর।
আরও দেখুন...