বাংলা অঞ্চল ও বাংলাদেশ: রাজনৈতিক ইতিহাসের বৈচিত্র্যময় গতিপথ
প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলা অঞ্চলের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠার ইতিহাস অনুসন্ধান করব আজ আমরা। দীর্ঘ এই আলাপের মধ্য দিয়ে অনুধাবন করার চেষ্টা করব কীভাবে রাষ্ট্র নামের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হয়েছে, কী ধরনের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে। আমরা আরও অনুধাবন করব, রাষ্ট্র ও শাসক শ্রেণির সঙ্গে ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে মানুষের সম্পর্ক কেমন ছিল এবং কী ধরনের প্রতিকূলতা মানুষ জয় করেছে।
সাধারণ মানুষের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে সেই সব বিপ্লব আর বিদ্রোহে জনমানুষের অনেক নেতাই নেতৃত্ব দিয়েছেন। হাজার বছরে গড়ে ওঠা রাজনীতি আর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তাঁদের হাত ধরেই এসেছে পরিবর্তন। মানুষের সামগ্রিক কল্যাণে নিজেদের জীবন পর্যন্ত তাঁরা বিলিয়ে নানান উত্থান-পতন আর ভাঙা- গড়ার অভিজ্ঞতাকে সঙ্গে নিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে। বাংলা অঞ্চলের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসের সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ এবং দৃষ্টান্তমূলক এই ঘটনার যিনি রূপকার তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একমাত্র নেতা যিনি বাংলা অঞ্চলের কাদা- মাটি, নদী-নালা, বিল, হাওর-বাঁওড়, বৃষ্টি আর সবুজের ভেতর দিয়ে ওঠে এসে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর আগে বাংলার ইতিহাসে এই ভূখণ্ড থেকে ওঠে আসা আর কোনো নেতা সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য, সকল ধর্মের সকল মানুষের মধ্যে ভালোবাসা ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য জীবন বাজি রেখে কাজ করেন নি। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার এক অতি সাধারণ পরিবারের সন্তান শেখ মুজিবই সর্বপ্রথম ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য
বাংলা অঞ্চলে প্রাচীন জনপদ: রাজনীতির সূচনা
ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বাংশ তথা বাংলা অঞ্চলে আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ছোটো ছোটো অনেক ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক পরিচয় গড়ে উঠতে শুরু করে। একক ও ঐক্যবদ্ধ কোনো রাজ্য বাংলা অঞ্চলে ছিল না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নাম-পরিচয়গুলোকে বলা হয় জনপদ বা ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক একক। জনপদগুলো গড়ে উঠেছিল বাংলায় আর্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের আগমনের বহু আগেই। প্রাচীনকালে লিখিত বৌদ্ধ ও সংস্কৃত গ্রন্থগুলো থেকে আমরা যে কটি জনপদের নাম জানতে পারি, তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য কয়েকটির পরিচয় সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক।
বঙ্গ
বঙ্গ নামক কোনো একটি কৌম বা জনগোষ্ঠীর হাত ধরে বঙ্গ জনপদের জন্ম হয়েছিল বলে জানা যায়। এই শব্দের অর্থ 'জলাভূমি' বা 'কার্পাস তুলা'। তবে বাংলার মতো জল-কাদা ও জঙ্গলের ভূখণ্ডে মানুষের টিকে থাকার লড়াইয়ে এই জনগোষ্ঠী বিশেষ যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিল। মহাকবি কালিদাসের লেখা থেকে জানা যায়, নৌযুদ্ধে বঙ্গীয়রা ছিল খুবই দক্ষ। বাংলার জলভিত্তিক সক্রিয় ব-দ্বীপ এলাকা তথা, বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা-ফরিদপুরের বৃহত্তর এলাকায় প্রাচীন বঙ্গ জনপদ গড়ে উঠেছিল। এর সীমানা কখনো কখনো পশ্চিম দিকেও সম্প্রসারিত হয়েছে। বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের প্রধান অংশটি অতীতের বিভিন্ন কালপর্বে বঙ্গের আওতাভুক্ত ছিল।
পুণ্ড্র
পুণ্ড্র বাংলার আরেকটি প্রাচীনতম জনপদ। পুন্ডু নামের একটি জনগোষ্ঠীর থেকেই এই জনপদের উৎপত্তি। এই জনপদের কেন্দ্র ছিল পুণ্ড্রনগর। এই পুণ্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষ বর্তমানে খুঁজে পাওয়া যাবে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রাপ্ত প্রত্নস্থল বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ে। পুণ্ড্র জনপদেরই একটি অংশের নাম প্রাচীনকালে বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রী হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিল। তোমরা জেনে আনন্দ পাবে যে, প্রাচীনকালে এই পুণ্ড্র শব্দটির অর্থ ছিল ইক্ষু বা আখ।
রাঢ়
বাংলা অঞ্চলের পশ্চিমে বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী নদীর উভয় তীরের এক বিস্তৃত জনপদ হিসেবে ছিল এর অবস্থান। দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত এই জনপদ বিস্তৃত ছিল। এই রাঢ়েই আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে তাম্র-প্রস্তর যুগের সূচনা ঘটেছিল। অজয় নদের তীরে পাণ্ডু রাজার ঢিবি নামে পরিচিত স্থানে বাংলার আদি মানুষের সমাজ ও সংস্কৃতি রচনার সর্বপ্রথম নিদর্শন পাওয়া গেছে। আবার রাঢ় এলাকাতেই আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে তাম্রলিপ্তি নামে একটি নৌ এবং সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠেছিল। বাংলার সবচেয়ে পুরোনো এই বন্দর ধরে বাংলার শস্য, বস্ত্র, সুগন্ধি মসলা গ্রিসসহ বর্তমান ইউরোপের নানান স্থানে রপ্তানি হতো।
সমতট
সমতট ছিল বাংলার দক্ষিণ-পূর্বাংশের জনপদ। মেঘনা নদীর পূর্ব তীর থেকে শুরু করে বর্তমান কুমিল্লা- নোয়াখালী-চট্টগ্রাম এবং ভারতের ত্রিপুরার প্রধান অংশ নিয়ে এই জনপদ গড়ে উঠেছিল। আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে সুয়ান জাং (হিউয়েন সাং) নামে একজন চৈনিক পর্যটক বাংলায় এসেছিলেন। তাঁর লেখা ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে আমরা জানতে পারি, প্রাচীন সমতট ছিল বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রধান একটি কেন্দ্র। এখানে তিনি অনেক স্থাপনা দেখেছিলেন। এই স্থাপনাগুলোকে বলা হতো বিহার। বিহারগুলোতে বৌদ্ধধর্মের ভিক্ষুরা বসবাস করতেন, ধর্ম এবং জ্ঞান চর্চা করতেন।
বাংলার প্রাচীন এই জনপদগুলোর কথা আমরা জানতে পারি প্রধানত বৈদিক সাহিত্য থেকে। বৈদিক সাহিত্য রচিত হয়েছিল আর্য ভাষার মানুষের হাতে। এসব গ্রন্থে বাংলার প্রাচীন জনপদের কথা এলেও খুব সম্মানজনকভাবে আসেনি। অধিকাংশ কেন এই রকম বলা হয়েছে জানো? পণ্ডিতগণ বলে থাকেন, প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে যখন আর্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষেরা বাংলা অঞ্চলে প্রবেশ করছিলেন তখন এই অঞ্চলে অনেক আগে থেকে যাঁরা বসবাস করছিলেন তাঁদের বাধার মুখে তাঁরা পড়েছিলেন। আধিপত্য বিস্তারে এই দ্বন্দ্বের কারণেই সেই সময়ের সংস্কৃত সাহিত্যে বাংলা অঞ্চলের মানুষদের তুচ্ছ করে দেখানো হয়েছে।
যাহোক, আর্যদের মধ্য থেকেই একসময় মৌর্য, গুপ্ত প্রভৃতি শক্তিশালী রাজবংশের উত্থান ঘটে। এইসব রাজশক্তির হাত ধরে বাংলায় আর্য ভাষাগোষ্ঠীর সংস্কৃতি বা বৈদিক সংস্কৃতি প্রবেশ করে। ধীরে ধীরে এইসব জনপদের নগরকেন্দ্রিক মানুষের ওপরও আর্য ধর্ম ও ভাষা-সংস্কৃতি প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।
বাংলা অঞ্চলে মৌর্য ও গুপ্তদের রাজনীতি ও ক্ষমতা সম্প্রসারণ
মৌর্যদের পর উত্তর ভারতে শক্তিশালী সাম্রাজ্য স্থাপন করেন গুপ্ত বংশের সম্রাটগণ। এই বংশের সম্রাটদের মধ্যে প্রথম চন্দ্রগুপ্ত, সমুদ্রগুপ্ত, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত প্রমুখ নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মৌর্যদের মতো গুপ্তরাও রাজ্য সম্প্রসারণবাদী নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। চতুর্থ শতকের মাঝমাঝি সময়ে সমুদ্রগুপ্ত বাংলা অঞ্চলে সৈন্য অভিযান পরিচালনা করে বঙ্গ, পুণ্ড্র প্রভৃতি জনপদ নিয়ন্ত্রণে নেন। সমুদ্রগুপ্তের পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময় মেঘনা নদীর পূর্ব তীরে সমতট পর্যন্ত গুপ্তদের আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছিল বলে গুপ্তদের বিভিন্ন উৎস হতে জানা যায়।
শাসনকাজ পরিচালনার জন্য সাম্রাজ্যের কেন্দ্র থেকে সম্রাট বড়ো বড়ো যোদ্ধা এবং সেনাপতিদের পাঠাতেন। উচ্চপদস্থ এই প্রশাসকেরা বাইরে থেকে এসে বাংলা অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। তাঁদের পাশাপাশি আসতেন নতুন ধর্ম-সংস্কৃতি আর অনেক বিদ্বান, পুরোহিত, ব্যবসায়ী মানুষজন। রাজ্য বিস্তারের পাশাপাশি নতুন ধর্ম-সংস্কৃতি বিস্তারেও তারা কাজ করতেন। এভাবে দীর্ঘকাল চলতে থাকে। কোনো এক সময় কেন্দ্রীয় সাম্রাজ্যে গোলযোগ দেখা দিলে কিংবা সম্রাট দুর্বল হয়ে পড়লে বাংলা অঞ্চলের উচ্চপদস্থ সামরিক ব্যক্তিদের অনেকেই নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা দিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলতেন। বাংলা অঞ্চলে যেসব রাজার নাম তোমরা পাবে তাদের অধিকাংশই দেখবে বাংলা ভূখণ্ডের সীমানার বাইরে বহুদূর থেকে এই অঞ্চলে প্রবেশ করেছেন। তার মানে কী জানো? তার মানে হচ্ছে, বাংলায় আদি যে অধিবাসীরা ছিলেন রাজক্ষমতা তাঁদের হাতে ছিল না। তাঁরা ছিলেন সাধারণ। প্রতিকূল প্রকৃতি আর নিজেদের বাঁচিয়ে জীবন-ধারণ করাই ছিল তাঁদের জন্য সবচাইতে বড়ো চ্যালেঞ্জ। বাংলা অঞ্চলে তাই যখনই কোনো রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তার নেতৃত্ব দিয়েছেন বাইরের অঞ্চল থেকে আসা কোনো কোনো যোদ্ধা।
বাংলা অঞ্চল: গুপ্ত পরবর্তীকালীন রাজনৈতিক অবস্থা
ষষ্ঠ শতকের শেষ দিকে উত্তর ভারতকেন্দ্রিক গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন হয়। কেন্দ্রীয় সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে কেন্দ্র থেকে দূরের রাজ্যগুলো তখন আবারও স্বাধীন হতে শুরু করে। এই সময় ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশের মতো পূর্বাংশ তথা বাংলা অঞ্চলেও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যসত্তা গড়ে ওঠার খবর পাওয়া যায়। বঙ্গ তেমনই একটি রাজ্যসত্তা হিসেবে বিকশিত হয়েছিল। বঙ্গ রাজ্যের উত্থান হয়েছিল গোপচন্দ্র নামে একজন শাসকের হাত ধরে ষষ্ঠ শতকের দ্বিতীয় দশকে। রাজ্যটির কেন্দ্রস্থল ছিল বর্তমান বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ায়। আর খুব সম্ভবত বিস্তৃত ছিল গঙ্গা নদীর দুই স্রোতোধারা অর্থাৎ পদ্মা ও ভাগীরথী নদীর অন্তর্বর্তী ভূভাগের প্রধান অংশে। এই হিসেবে বঙ্গ রাজ্যের সীমানা বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা, ফরিদপুর, যশোরের বৃহত্তর এলাকা এবং বর্তমান ভারতের পশ্চিম বাংলার দক্ষিণাংশব্যাপী বিস্তৃত হয়েছিল বলে ইতিহাসবিদ বিএন মুখার্জী গবেষণা করে জানিয়েছেন। গোপচন্দ্র ছাড়াও ধর্মাদিত্য, সমাচারদেব, দ্বাদশাদিত্য, সুধন্যাদিত্য ছিলেন বঙ্গ রাজ্যের পাঁচ জন রাজা। তাঁদের জারি করা তাম্রশাসন ও মুদ্রা পাওয়া গেছে। আনুমানিক ৫২৫ থেকে ৬০০ সালের মধ্যে এই সকল রাজা বঙ্গের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন।
গৌড় নামে আরেকটি রাজ্যসত্তার উত্থান ঘটেছিল সপ্তম শতকের শুরুর দিকে রাজা শশাঙ্কের হাত ধরে। গৌড় রাজ্যের রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ যা এখন বর্তমান ভারতের পশ্চিম বাংলা প্রদেশের মুর্শিদাবাদ জেলায় খুঁজে পাওয়া যাবে। এই গৌড় রাজ্যসত্তার অন্তর্ভুক্ত ছিল বাংলা অঞ্চলের উত্তরাংশ এবং পশ্চিমাংশের বিস্তৃত এক এলাকা; যার মধ্যে ছিল বর্তমান বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুরের এলাকাসমূহ এবং বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশ এবং বিহারের অংশবিশেষ। তবে হ্যাঁ, বঙ্গ এবং গৌড়ের সীমানা যে সব সময়
একই ছিল তা কিছুতেই বলা যাবে না। রাজাদের শক্তি ও ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সীমানাও বদল হয়ে যেত। কখনো এসব রাজ্যের রাজারা অভিযান চালিয়ে নতুন এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন, আবার কখনো অন্য এলাকার রাজাদের আক্রমণের ফলে নিজ রাজ্যের সীমানা সংকুচিত হয়েছে।