গভীর সমুদ্র থেকে উপকূলীয় অঞ্চলের আধা বা ঈষৎ লবণাক্ত জলাশয় পর্যন্ত বাগদা চিংড়ি জীবনচক্র বিস্তৃত। বাগদা চিংড়ির জীবনের কিছু পর্যায়ে গভীর সমুদ্রে এবং কিছু পর্যায় মোহনা অঞ্চলের নদীসমূহে সমাপ্ত হয়। বাগদা চিংড়ির জীবনচক্রের বিভিন্ন ধাপগুলো নিচে বর্ণনা করা হলো: ভিন (egg), গ্রুপ (embryo), লাভা (larvae) (নরিয়াস লার্ভা, জুইয়া লার্ভা ও মাইসিস লার্ভা), পোস্ট লার্তা বা পিএল (post larvae- PL), জুভেনাইল বা কিশোর চিংড়ি ((juvenile) এবং পূর্ণাঙ্গ চিংড়ি (adult)।
ক. ডিম
প্রজনন মৌসুমে ডিম ছাড়ার উদ্দেশ্যে পূর্ণ বয়স্ক বাগদা চিংড়ি অভিগমন করে গভীর সমুদ্রের পরিপূর্ণ লবণাক্ত পানিতে (ন্যূনপক্ষে ৩০পিপিটি) চলে আসে এবং এখানে ডিম ছাড়ে। প্রাকৃতিক পরিবেশে স্ত্রী বাগদা চিংড়ি সাগরের ১৮ থেকে ৩৬ মিটার গভীরতায় ডিম পাড়ে। ডিমগুলো আকারে খুব ছোট এবং এদের বর্ণ সবুজ হলুদাভ বা স্বচ্ছ বর্ণের হয়ে থাকে। ডিম পাড়ার সময়েই শুক্রকীট দ্বারা ডিমগুলো নিষিক্ত হয় এবং এই নিষিক্তকরণ চিংড়ির দেহের বাইরে ঘটে থাকে। ডিম ফোটার ঠিক আগে পরিণত নপ্রিয়াসকে ডিমের মধ্যে নড়াচড়া করতে দেখা যায়। ডিমের ভ্রুণ বিভাজন শুরু হয়। প্রথমে ২ কোষ, পরে ৪ কোষ, মরুলা এবং শেষে নপ্রিয়াস ধাপে পৌঁছায়। ডিম ছাড়ার আধা ঘন্টা থেকে এক ঘন্টার মধ্যে নিষিক্ত ডিমের মধ্যে ভ্রূণ দেখা যায়। ২ কোষ, ৪ কোষ, মরুলা এবং শেষে নগ্নিয়াস ধাপে আসতে সময় লাগে যথাক্রমে ০.৫, ১০, ১.৮ ও ১১.০ ঘন্টা। একটি স্ত্রী-চিংড়ি একবারে ২ থেকে ৮ লক্ষ (ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে ১ থেকে ১২ লক্ষ) পর্যন্ত ডিম ছাড়তে পারে। নিষিক্ত ডিম সমুদ্রের পানি অপেক্ষা সামান্য ভারী বিধায় পানিতে ডুবে যায়।
খ. লার্ভা
লার্ভা অবস্থার প্রথম দশাকে নগ্নিয়াস বলে। এই নগ্নিয়াস দশার ৬টি অন্তর্দশা সম্পূর্ণ হতে ৩৬ থেকে ৪৮ ঘন্টা সময় লাগে। নপ্রিয়াসের পরের দশাকে প্রটোজুইয়া বলে। এই দশার অন্তর্দশা সম্পূর্ণ হতে ৫ দিন সময় লাগে। প্রটোজুইয়ার পরের দশাকে মাইসিস বলে। এই দশার ৩টি অন্তর্দশা সম্পূর্ণ হতে ৪ থেকে ৫ দিন সময় লাগে। মাইসিস-এর পরবর্তী দশাকে মেগালোপা বলে। মেগালোপা পর্যায়ে দেহ স্বচ্ছ বর্ণের হয়ে থাকে এবং শুঙ্গের গোড়া থেকে টেলসনের প্রাপ্ত পর্যন্ত একটি পাড় বাদামী লম্বা টানা রেখার মত দাগ থাকে।
চিত্র-১.২২: জুইয়ার বিভিন্ন দশা (১, ২ ও ৩)
চিত্র-১.২৩: মাইসিস-এর বিভিন্ন দশা (১২৩৩)
প. পোস্ট লার্ভা (পিএল)
এই ধাপের প্রথম পর্যায়ে দেহ স্বচ্ছ বর্ণের হয়ে থাকে এবং অক্ষীয় দেশে মেগালোপা ধাপের মত পাঢ় বাদামী দাগ থাকে। এই পর্যায়ের মাপকে প্রাথমিক পর্যায়ে পোস্ট লার্ভা (পিএল) বলে এবং শেষ পর্যায়ের ধাপকে আপীলোনা বলা হয় । উদর খন্ড নিরোধক খন্ডের চেয়ে ছোট হয়। এই সময় দেহ, রোস্ট্রীমের দাঁত ফুলকার আবির্ভাব ঘটে। শিরোবক্ষের খোলস ২.৭ মিনি লম্বা হলে এদের দেহ কালো বর্ণ ধারণ করে এবং খোলস ২.২-২১.০ মিমি লম্বা হলে রোম্মামের উপরিভাগে ৭টি এবং নিচে ৩টি দাঁত থাকে। এই পর্যায়ে চিংড়ি হামাগুড়ি ও সাঁতার দিতে শুরু করে।
ঘ. মুভেনাইল বা কিশোর চিংড়ি
এই পর্যায়ে চিংড়ির দেহের আকৃতি প্রায় পূর্ণাঙ্গ চিংড়ির মতো কিংবা কিছুটা বড় হয়। শিরোবক্ষের দৈর্ঘ্য ১১ সিসি হলে এদের জননেন্দ্রিয় শনাক্ত করা যায়। কিশোর চিংড়ির শিরোৰক্ষের দৈর্ঘ্য ১১ থেকে ৩৪ মিমি পর্যন্ত হয়ে থাকে। পুরুষ চিংড়ির শিরোবক্ষের দৈর্ঘ্য ৩০ মিমি হলে এরা পুরুষ জননাঙ্গ যুক্ত পেটাসমা ধারণ করে এবং স্ত্রী চিংড়ির শিরোৰক্ষের দৈর্ঘ্য ৩৭ মিনি হলে স্ত্রী জননাঙ্গে খেলিকাম দেখা যায়।
চিত্র-১.২৫: জুভেনাইল বা কিশোর চিংড়ি
৫. ভরুপ চিংড়ি
চিংড়ি এই পর্যায়ে পরিপক্কতা লাভ করে। শিরোবক্ষের দৈর্ঘ্য ৩০ মিমি হলে পুরুষ ও স্ত্রী চিংড়ির মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে এবং এই পর্যায়ে স্ত্রী চিংড়ির আকার পুরুষ চিংড়ির চেয়ে বড় হয়ে থাকে। এই সময় তরুণ চিংড়ি মোহনা থেকে গভীর সমুদ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে। পুরুষ চিংড়ি ও স্ত্রী চিংড়ির শিরোবক্ষের দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ৩৭ মিমি ও ৪৭ মিমি এ পৌঁছালে এরা প্রথম যৌন মিলনক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। এই • মিলনক্রিয়া সাধারণত সমুদ্রে যাওয়ার পূর্বে মোহনা অঞ্চলে সংঘটিত হয়ে থাকে।
চ. পূর্ণাঙ্গ চিংড়ি
এই পর্যায়ে চিংড়ি যৌন পরিপক্কতা লাভ করে। স্ত্রী চিংড়ি ডিম ছাড়ার জন্য সমুদ্রে চলে যায়। সমুদ্রের ১৬০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত এদের বিচরণক্ষেত্র। পরিপক্ক পুরুষ চিংড়ি পঞ্চম চলন পদের গোড়ায় পুংজনন ছিদ্রে শুক্রকীটের মোড়ক (spermatophores) দেখা যায়। পরিপক্ক শ্রী চিংড়ির ডিম্বকোষের উন্নতি বাইরে থেকে দেখা যায়। স্ত্রী চিংড়ির ডিম্বাশয়ের আকার ও রং এবং ডিম্বাণুর মাপের ওপর নির্ভর করে ডিম্বাশয়ের পূর্ণতা।
চিত্র-১.২৬: পূর্ণাঙ্গ বাগদা চিংড়ি
পরিপত্র স্ত্রী চিংড়ির ডিম্বাশয়কে ৫টি দশার ভাগ করা যায়, যথা-
প্রথম দশা (Immature stage): এই অবস্থায় ডিম্বাশয় খুব পাতলা ও স্বচ্ছ এবং পিঠের খোলসের ভিতর দিয়ে দেখা যায় না। এই সময় ডিম্বাণু খুব ছোট থাকে এবং ফলিকল সেল (follicle cell) এর ঘরে ঢাকা থাকে।
দ্বিতীয় দশা (earty developing stage): এই অবস্থায় ডিম্বাশয়ের কিছুটা উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। ডিম্বাশয় ঢলঢলে এবং সাদা থেকে ফিকে জলপাই রঙের একটি লম্বা ফিতার মতো পৃষ্ঠদেশে খোলসের নিচে দেখা যায়।
তৃতীয় দশা (nearly ripe stage): বর্ধিত ও হালকা নীল বর্ণের ডিম্বাশয় সহজেই দেখা যায়। এ সময় উদর অঞ্চলের ১ম ভাগে ডিম্বাশয়ের দুই পার্শ্ব একটু বেড়ে কিছুটা ডায়মন্ড বা প্রজাপতির আকার ধারণ করে।
চতুর্থ দশা (ripe stage): গাঢ় সবুজ জলপাই রঙের পরিপক্ক ডিম্বাশয় পরিষ্কার দেখা যায়। এ সময় উদর অঞ্চলের ১ম ডিম্বাশয় পরিপূর্ণ ডায়মন্ড বা প্রজাপতির আকার ধারণ করে।
পঞ্চম দশা (spent stage): এই অবস্থায় ডিম ছাড়ার পর ডিম্বাশয় প্রায় প্রথম দশার মতো দেখায়। তবে আংশিক ডিম ছাড়লে দ্বিতীয় দশার মতো দেখায়। একটি পরিপক্ক স্ত্রী চিংড়ি বছরে প্রায় ৩.০-৭.৫ লক্ষ ডিম ধারণ করে থাকে। বাগদা চিংড়ির প্রজনন গভীর সমুদ্রে ঘটে থাকে। এদের প্রজনন ক্রিয়া সাধারণত রাতে সম্পন্ন হয়ে থাকে। বাগদা চিংড়ির মিলন কাল ৩ থেকে ৪ মিনিট স্থায়ী হয়। প্রথমে পুরুষ চিংড়ির উপর সমান্তরালভাবে স্ত্রী চিংড়ি অবস্থান গ্রহণ করে। এরপর পুরুষ ও স্ত্রী চিংড়ি একে অপরকে অঙ্কীয় দেশে আকড়িয়ে ধরে এবং পুরুষ চিংড়ি স্ত্রী চিংড়ির দেহের নিচে সমান্তরালভাবে অবস্থান করে। অবশেষে পুরুষ চিংড়ি দেহের উদরের অংশ বাঁকিয়ে স্ত্রী দেহের মাঝখানে U আকৃতির বেষ্টনি তৈরি করে।
বাগদা চিংড়ির জীবন চক্রের বিভিন্ন ধাপসমূহ নিচের সারণিতে দেখানো হলো:
সারণি: বাগদা চিংড়ির জীবন চক্রের বিভিন্ন ধাপের বৈশিষ্ট্যসমূহ।
পর্যায় | শুরু হয় | সময়কাল | শিরোবক্ষ খোলসের দৈর্ঘ্য (মিমি) পুরুষ | শিরোবক্ষ খোলসের দৈর্ঘ্য (মিমি) স্ত্রী | খাদ্যাভাস | আবাসস্থল |
ডিম (সুণ) | নিষিক্তকরণ | ১২ ঘন্টা | - |
| / | সাগরের তলদেশ |
লার্ভা | ডিম থেকে ফোটা | ২০ দিন | - | ০.৫-২.২ | প্রাকটনিক | সাগরের |
জুভেনাইল | ফুলকা অঙ্গের পূর্ণাঙ্গতা | ১৫ দিন | - | ২.২.১১ | বেনাধিক | মোহনা |
কিশোর চিংড়ি | জননেন্দ্রিয়ের উপস্থিতি | ৪ মাস | ১১.`৩ | ১১-৩৭ | বেনাধিক | মোহনা |
তরুণ চিংড়ি | জননেন্দ্রিয়ের পূর্ণতা এবং প্রথম সঙ্গম | ৪ মাস | ৩০.৩৭ | ৩৭-৪৮ | বেনাধিক | অভ্যন্তরীণ ও বাইরের লিটোরাল এলাকা |
পূর্ণাঙ্গ চিংড়ি | দেহের সব অঙ্গের উপস্থিতি ও পূর্ণাঙ্গ বৃদ্ধি | ১০ মাস | ৩৭.৭১ | ৪৭-৮১ | বেনাধিক | অভ্যন্তরীণ ও বাইরের লিটোরাল এলাকা |
সারণি: বাগদা চিংড়ির জীবদ্দশায় বিভিন্ন ধাপের খাদ্যভ্যাস
ক্রম | ধাপ | খাদ্য |
০১ | ডিম থেকে নগ্নিয়াস পর্যন্ত ৬টি ধাপ | দেহে সঞ্চিত কুসুম থলি থেকে খাদ্য যোগায়। |
০২ | জুইয়া | ডায়াটম জাতীয় উদ্ভিদ কণা, স্কেকেলেটোনমা, নিটসিয়া, কিঠোরোস ইত্যাদি খাদ্য । |
০৩ | মাইসিস | রটিফার, কপিপড, আর্টিমিয়া ও উদ্ভিদ কণা জাতীয় খাদ্য। |
০৪ | পোস্ট লার্ভা | রটিফার, কপিপড, আটিমিয়া ও উদ্ভিদ কণা জাতীয় খাদ্য। |
০৫ | পূর্ণাঙ্গ চিংড়ি | ছত্রাক ও শৈবাল, গলিত জৈব পদার্থ, ছোট ছোট কুচো চিংড়ি, মশার লার্ভা, শামুকের ডিম, ক্রাস্টেসিয়ানস ইত্যাদি খাদ্য। |
সারণি: পুরুষ ও স্ত্রী বাগদা চিংড়ির মধ্যে শনাক্তকরণ বৈশিষ্টসমূহ
ক্রম | পুরুষ বাগদা | স্ত্রী বাগদা |
০১ | পুরুষ বাগদায় পেটাসমা নামক জননেন্দ্রিয় বিদ্যামান । | স্ত্রী বাগদায় থেলিকাম নামক জননেন্দ্রিয় বিদ্যমান । |
০২ | প্রথম জোড়া সন্তরণ পদের মধ্যবর্তী স্থানে পেটাসমা অবস্থিত | চতুর্থ ও পঞ্চম জোড়া সন্তরণ পদের মধ্যবর্তী স্থানে থেলিকাম অবস্থিত। |
০৩ | পুরুষ বাগদার শেষ দুই জোড়া চলন পদ বড় এবং ডেকটাইলাম সুচালো। | স্ত্রী বাগদার শেষ দুই জোড়া চলন পদ ছোট এবং ডেকটাইলাম সুচালো নয়। |
আরও দেখুন...