এই অধ্যায় শেষে আমরা জানতে পারব-
১. সিদ্ধার্থের বংশ পরিচয় ও জন্মবৃত্তান্ত;
২. বাল্যজীবন ও চার নিমিত্ত দর্শন;
৩. গৃহত্যাগ
৪. বুদ্ধত্ব লাভ ও ধর্ম প্রচার;
৫. মহাপরিনির্বাণ।
আজকে আমরা একটি ভিডিও চিত্র দেখব।
তোমরা বাসায় গিয়েও নিচের কিউআর কোড স্ক্যান করে নিচের ওয়েবসাইট থেকে এই ভিডিওটি দেখতে পারবে। স্ক্যান করার সময় প্রয়োজনে পরিবারের কোনো সদস্য অথবা শিক্ষকের সহায়তা নিতে পারো।
বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে তোমরা আরও অনেক ভিডিও পেয়ে যাবে।
ভিডিও চিত্রটিতে ভগবান বুদ্ধের জীবনী সম্পর্কে নতুন কী কী তথ্য জেনেছ, যা তোমার আগে জানা ছিল না, সে সম্পর্কে লেখো।
|
** এই পৃষ্ঠায় জায়গা না হলে একটি আলাদা কাগজে লিখে কাগজটি বইয়ের পৃষ্ঠার এক পাশে আঠা দিয়ে যুক্ত করতে পারি/খাতায় লিখতে পারি।
তোমরা ইতোমধ্যে বুদ্ধ সম্পর্কে জেনেছ। আগের শ্রেণিতে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে বুদ্ধের জীবন পরিক্রমা সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা করা হলো। 'বুদ্ধ' শব্দে অনন্ত জ্ঞান ও গুণের সমষ্টি বোঝায়। সে জ্ঞান ও গুণ বহুমাত্রিক; মানবের ইহকাল ও পরকাল বিষয়ে সামগ্রিক জ্ঞান। অমিত গুণসম্পন্ন মহাপুরুষ ছিলেন গৌতম বুদ্ধ। তিনি 'বুদ্ধ' হিসেবে জন্মগ্রহণ করেননি। বুদ্ধত্ব তাঁকে অর্জন করতে হয়েছিল। তাঁর জন্ম হয়েছিল প্রাচীন ভারতের কপিলাবস্তু রাজ্যের রাজপুত্র হিসেবে। এই রাজপুত্রই আপন অধ্যবসায়, প্রচেষ্টা ও অপরিসীম ত্যাগতিতিক্ষার মাধ্যমে বুদ্ধত্বে উপনীত হয়েছিলেন। সে জন্য বলা হয়-সিদ্ধার্থ থেকে বুদ্ধ এক মহাজীবনের ইতিহাস।
অনেক বছর আগের কথা। খ্রিস্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে হিমালয়ের পাদদেশের উত্তর-পূর্ব দিকে ক্ষত্রিয়দের একটি রাজ্য ছিল। সে রাজ্যের নাম ছিল কপিলাবস্তু। রাজ্যের রাজা ছিলেন শাক্যবংশীয়। নাম শুদ্ধোদন। রানির নাম মহামায়াদেবী বা মায়াদেবী। তাঁদের কোনো সন্তান ছিল না। বহু সাধনার পর তাঁদের একটি সন্তানের জন্ম হয়। সেই শিশুপুত্রের নাম রাখা হয় কুমার সিদ্ধার্থ। এছাড়া শাক্যবংশে জন্মগ্রহণ করার কারণে শাক্যসিংহ নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, কুমার সিদ্ধার্থের মামার বাড়ি ছিল কপিলাবস্তুর পাশের অঞ্চল দেবদহে। মায়াদেবী পিত্রালয়ে যাওয়ার পথে লুম্বিনী কাননে কুমার সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম হয়। কপিলাবস্তু থেকে কয়েক মাইল দূরে লুম্বিনী কানন।
বর্তমান বিশ্বের ভৌগোলিক পরিচয়ে লুম্বিনী নেপালের অন্তর্গত। এটি বৌদ্ধদের স্বীকৃত চার মহাতীর্থ স্থানের একটি। কুমার সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্মের ঐতিহাসিক স্মৃতির কারণে লুম্বিনী বিশ্ববৌদ্ধদের কাছে অত্যন্ত স্মরণীয় ও আকর্ষণীয় স্থান। পর্যটকদের এ স্থানের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে। লুম্বিনীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বৌদ্ধ বিহার আছে। বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগেও লুম্বিনীতে একটি বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
লুম্বিনী দক্ষিণ এশিয়ার মহাদেশের কোন দেশে অবস্থিত, চিহ্নিত করে রং করো।
আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথি। এ উপলক্ষ্যে কপিলাবস্তু নগরীতে আয়োজিত হলো উৎসব। উৎসব শেষে রাজা-রানি ঘুমিয়ে পড়লেন। সে রাতে রানি মায়াদেবী দেখলেন অদ্ভুত এক স্বপ্ন চারদিক থেকে চার দিকপাল দেবতা এসে তাঁকে শয্যাসহ তুলে নিলেন। হিমালয়ের এক মনোরম স্থানে তাঁর পালঙ্ক রেখে দেবতারা সরে দাঁড়ালেন। দেব মহিষীরা এসে মায়াদেবীকে মানস সরোবরে স্নান করালেন। সুবাসিত দিব্যবস্ত্রে ভূষিত করে নিয়ে গেলেন এক সোনার প্রাসাদে। সেখানে রানি মায়াদেবীকে তাঁরা সোনার পালঙ্কে পূর্ব দিকে মাথা রেখে শুইয়ে দিলেন।
তারপর পাশের স্বর্ণ-পর্বত থেকে একটি সাদা হাতি এলো। সেই হাতির শুঁড়ে ছিল একটি শ্বেতপদ্ম। সে সোনার প্রাসাদে প্রবেশ করে তিনবার রানির শয্যা প্রদক্ষিণ করল। তারপর রানির জঠরের দক্ষিণ দিকে শ্বেতপদ্মটি প্রবেশ করিয়ে দিল। রানির দেহ-মনে এক অপূর্ব শিহরণ খেলে গেল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল রানির।
পরদিন সকালে রানি তাঁর স্বপ্নবৃত্তান্ত রাজা শুদ্ধোদনকে জানালেন। রাজা তা শুনে খুব বিচলিত হলেন এবং জ্যোতিষীদের ডেকে এ স্বপ্নের কারণ খুঁজতে বললেন। জ্যোতিষীরা বিশদ পর্যালোচনা করে রাজাকে বললেন, মহারাজা, এটি অত্যন্ত সুখপ্রদ স্বপ্ন, এই রাজ্যের জন্য পরম সৌভাগ্যের ইঙ্গিত; আনন্দ করুন, রানি মায়াদেবীর পুত্রসন্তান হবে। এই রাজপুত্র ভবিষ্যতে মহাতেজস্বী ও যশস্বী মহাপুরুষ হবেন। আমাদের কপিলাবস্তু রাজ্যের এ যেন পরম প্রাপ্তি। এক মহাপুরুষ জন্ম নেবেন শাক্যবংশে। স্বাগত হে রাজপুত্র!
স্বপ্নবৃত্তান্ত শুনে রাজা ও রানির মন আনন্দে উদ্বেলিত হয়। কিছুদিন পর এলো বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথি। সেই পূর্ণিমার শুভলগ্নে রানির বাসনা হলো পিত্রালয়ে যাওয়ার। রাজা শুদ্ধোদন সব ব্যবস্থা করলেন। কপিলাবস্তু থেকে দেবদহ পর্যন্ত পথ সুসজ্জিত করা হলো। রানি মায়াদেবী সহচরীসহ সোনার পালকিতে চড়ে পিত্রালয়ে চললেন। পথে রানি হঠাৎ অসুস্থ বোধ করলেন। তখন পালকি পৌঁছালো দুই নগরীর মধ্যবর্তী স্থান লুম্বিনী কাননে। রানির নির্দেশে লুম্বিনী কাননে শালগাছের এক মনোরম স্থানে পালকি থামল। শালবনের শাখায় শাখায় ফুল, পাখির কাকলি। রানি একটু বিশ্রাম নিতে শালতরু তলে দাঁড়িয়ে তার একটি শাখা ধরলেন। ঠিক সেসময় তাঁর প্রসববেদনা শুরু হলো। সহচরীরা চারদিকে কাপড় দিয়ে ঘিরে দিলেন সে স্থান। সেখানেই শুভ বৈশাখী পূর্ণিমায় ভূমিষ্ঠ হন জগতের ভাবী বুদ্ধ সিদ্ধার্থ গৌতম। বৌদ্ধ সাহিত্যে বর্ণিত হয়েছে, এ সময় চার মহাব্রহ্মাসহ দিকপাল দেবতা নবজাত সিদ্ধার্থের পরিচর্যা করেছিলেন।
রাজপুত্রের জন্মের সংবাদ পৌঁছে গেল রাজা শুদ্ধোদনের কাছে। কপিলাবস্তুতে শুরু হলো উৎসব। কিন্তু সপ্তাহের মধ্যে সেই আনন্দের ধারায় নেমে এলো বিষাদের ছায়া। কুমার সিদ্ধার্থের জন্মের সাত দিন পর রানি মায়াদেবীর মৃত্যু হলো। মাতৃহারা হলেন কুমার সিদ্ধার্থ। তখন সিদ্ধার্থের প্রতিপালনের ভার নিলেন বিমাতা মহাপ্রজাপতি গৌতমী। রানি গৌতমী তাঁকে পুত্রস্নেহে পালন করেছিলেন। গৌতমীর নামানুসারে সিদ্ধার্থের আর এক নাম হয়-গৌতম।
পরবর্তীকালে গৌতম নামটি বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করে। বিশ্বে তিনি গৌতম বুদ্ধ নামে পরিচিত। সকল জীবের প্রতি তাঁর মৈত্রী ও করুণা অপরিমেয় বলে তিনি মহাকারুণিক নামেও অভিহিত। এছাড়া তাঁর অপরিমিত গুণরাশিকে কেন্দ্র করে তাঁকে বিভিন্ন বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়। যেমন সুগত, ভগবান, তথাগত প্রভৃতি।
ইতোমধ্যে সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্মকথা ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। এ সময় হিমালয় পর্বতের পাশে কালদেবল নামের এক মহা ঋষি বাস করতেন। তিনি কপিলাবস্তু নগরে গিয়ে গৌতমকে দর্শন করেন। তিনি গৌতমের বত্রিশ প্রকার মহাপুরুষের লক্ষণ দেখতে পেয়েছিলেন। রাজা শুদ্ধোদনকে তিনি বলেছিলেন, কুমার গৌতম যদি গৃহে থাকেন, তাহলে তিনি রাজচক্রবর্তী হবেন, আর যদি গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হন, তাহলে বুদ্ধত্ব লাভ করবেন। এই মহা ঋষির মন্তব্যের প্রথম অংশ রাজা ও রানিকে আনন্দিত করলেও সংসার ত্যাগের কথায় তাঁরা বিচলিত হন। কুমার সিদ্ধার্থ ভবিষ্যতে সন্ন্যাসব্রতের কথা যাতে না ভাবেন, সে জন্য রাজা বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন।
যথাসময়ে শুরু হলো সিদ্ধার্থ গৌতমের বিদ্যাশিক্ষা। সে সময়ে ৬৪ রকম লিপির প্রচলন ছিল। গুরুর সান্নিধ্যে তিনি প্রচলিত লিপি সম্পূর্ণ আয়ত্ত করেন। ক্রমে তিনি বেদ, পুরাণ, ইতিহাস, যোগ, ন্যায়, গণিত ও চিকিৎসাবিদ্যা শেখেন। ক্ষত্রিয় রাজকুমার হিসেবে তিনি শেখেন রাজনীতি, মৃগয়া, ধনুর্বিদ্যা, অশ্বারোহণ, রথচালনা ইত্যাদি। একবার তিনি শাক্য কুমারদের সঙ্গে রথচালনা প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছিলেন। প্রতিযোগিতায় একবারে জয়ের মুখে পৌঁছে রথের রাশ ছেড়ে দিয়ে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী দেবদত্তকে জয়লাভের সুযোগ করে দেন। এতে গৌতম খুব আনন্দ লাভ করেন। আর একবার শিকারে গিয়ে হাতের শিকার একটি হরিণ শাবককে ছেড়ে দিয়ে সঙ্গীদের বিরক্তি উৎপাদন করেন। কিন্তু হরিণ শিশুর প্রাণ রক্ষা হওয়ার আনন্দে তিনি অভিভূত হন। দুই ক্ষেত্রেই তিনি বন্ধুদের কাছে ধিক্কার লাভ করেন। আর একবার রোহিণী নদীতে বড় একটি গাছ পড়ে বাঁধের সৃষ্টি করল। এতে পানি চলাচলসহ নদীপথে যাতায়াতে সমস্যার সৃষ্টি হলো। তখন তিনি নিজ বুদ্ধিবলে তা অপসারিত করেন।
সিদ্ধার্থ গৌতমের বয়স ক্রমে বাড়তে লাগল। কৈশোর পেরিয়ে জীবন এগিয়ে চলছে। একদিন তিনি রাজপ্রাসাদ- সংলগ্ন উদ্যানে চিন্তামগ্ন হয়ে বসে ছিলেন। এসময় একদল বুনো হাঁস সারি বেঁধে উড়ে চলেছে। তাদের ডানার শব্দে বন মুখরিত। তিনি অপলক নয়নে তাকিয়ে আছেন মুক্ত পাখিদের চলার দিকে। তাঁর মন আনন্দে ভরে উঠল।
হঠাৎ এই আনন্দের মাঝে এলো বিষাদের ঘনঘটা। একটি হাঁস তিরবিদ্ধ হয়ে নিচে পড়ে গেল তাঁর কোলের কাছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে হাঁসের সর্বাঙ্গ। গৌতমের মন বেদনায় কেঁদে উঠল। তাড়াতাড়ি মমতাভরে হাঁসটিকে তিনি তুলে নিলেন নিজের কোলে। সরিয়ে নিলেন হাঁসের বুকের তির। আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠল হাঁস।
হাসি ফুটল সিদ্ধার্থের মুখে। অমনি এসে উপস্থিত হলেন মামাতো ভাই দেবদত্ত। চিৎকার করে দেবদত্ত বলল- আমার শরে আহত পাখি, আমাকে দাও। সিদ্ধার্থ গৌতম কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, এই আহত পাখিকে সেবা করে আমি ভালো করে তুলেছি। এই পাখি আমার।
দেবদত্ত বললেন, একে আমি তিরবিদ্ধ করেছি। এর ওপর আমার অধিকার। গৌতম বললেন, প্রাণঘাতীর চেয়ে প্রাণদানকারীর দাবি বেশি। কাজেই এ পাখি আমার। শাক্যরাজ্যের বিনিময়েও এই হাঁস আমি কাউকে দেব না। আকাশের পাখি আকাশে উড়িয়ে দেব।
এতে ক্ষিপ্ত ও রাগান্বিত হলেন দেবদত্ত। তারপর বিচার বসল রাজদরবারে। গৌতমের এক কথা-প্রাণঘাতীর চেয়ে প্রাণদানকারী বড়। প্রাণদাতার দাবিই বেশি। তিনি আরও বললেন, আমার মতো এ পাখিরও প্রাণ আছে। আঘাত করলে তোমার ও আমার যেমন যন্ত্রণা হয়, ওরও তেমনি যন্ত্রণা হয়। কিন্তু ওর মুখে আমাদের মতো ভাষা নেই। মুখ ফুটে কথা বলতে পারে না। তবুও তুমি তাকে তির মারলে।
দেবদত্ত বললেন, তোমার এত কথার প্রয়োজন দেখি না। এই হাঁস আমি শরবিদ্ধ করেছি। কাজেই আমি এর একমাত্র দাবিদার।
বিচারে অবশেষে প্রাণদানকারীর জয় হলো। গৌতম দুই হাতে আদর করে আকাশের পাখি আকাশে উড়িয়ে দিলেন। আর যেতে যেতে পাখিটি গৌতমের দিকে তাকাতে লাগল।
বয়স কম হলেও পৃথিবীর যাবতীয় চিন্তা যেন গ্রাস করেছে সিদ্ধার্থ গৌতমকে। তিনি থাকেন সর্বদা চিন্তাশীল। রাজপ্রাসাদের ভিতরেও গৌতমের মন ভরে না। তাঁর আনন্দের জন্য রাজা শুদ্ধোদন নৃত্য, গীতসহ আনন্দের উপকরণের কিছুই বাকি রাখেননি। গৌতমের মন তাতে সন্তুষ্ট নয়। সুযোগ পেলেই তিনি কোনো অজানা চিন্তায় মগ্ন হন। রাজা শুদ্ধোদন এতে বিচলিত হয়ে পড়েন।
এ সময় রাজার বিচক্ষণ মন্ত্রীরা পরামর্শ দিলেন, কুমারের জন্য গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীতঋতু উপযোগী তিনটি প্রাসাদ তৈরি করতে হবে। শুদ্ধোদন তার ব্যবস্থা করলেন। ভোগ ও বিলাসের জন্য সব সুযোগ করে দিলেন। কিন্তু সিদ্ধার্থ গৌতমের কাছে সেসব ছিল মূল্যহীন। রাজকুমারের গভীর মৌনতা ও চিন্তামগ্ন স্বভাবে বিচলিত হয় রাজা ও রানির মন। তাঁরা কুমারের মনোভাব পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেন।
গৌতমের বয়স তখন ষোলো বছর। এ সময় রাজা শুদ্ধোদন ছেলেকে বিয়ে দিয়ে গৃহমুখী করতে চাইলেন। সেকালের রীতি অনুযায়ী ঠিক হলো গৌতম অশোকভান্ড বিতরণ করবেন। বিবাহযোগ্য রমণীরা উৎসবে এসে যে উপহার গ্রহণ করেন, তার নাম অশোকভান্ড। এই উপলক্ষ্যে রাজ্যের বিবাহযোগ্য সব শাক্যকুমারী গৌতমের হাত থেকে অশোকভান্ড উপহার গ্রহণ করবেন। কুমারের বিবেচনায় সেরা সুন্দরী গ্রহণ করবেন শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। শেষে সেই শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হবেন তাঁর স্ত্রী।
একে একে সব শাক্যকুমারী উপহার নিয়ে গেলেন। অশোকভান্ড শেষ। তারপর এলেন গোপাদেবী। কুমার গৌতম রাজঅঙ্গুরীয় দিয়ে বরণ করলেন গোপাদেবীকে। যিনি যশোধরা নামেও পরিচিত। সবাই বুঝলেন- গোপাদেবীই তাঁর মনোনীত বধূ। কিন্তু তারপরও গৌতমকে শক্তি ও বিদ্যার প্রমাণ দিতে হলো। সবার সামনে গৌতম প্রমাণ করলেন, তিনি সব শাস্ত্রে পারদর্শী। পুরাণ, ইতিহাস, গণিত, ধর্মনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি-সব বিষয়ে তিনি শ্রেষ্ঠ গণ্য হলেন।
তারপর শুভদিন শুভক্ষণে সারা রাজ্যে উৎসব হলো। বিয়ে হলো সিদ্ধার্থ ও গোপাদেবীর। রাজা শুদ্ধোদন ভাবলেন, রাজকুমার এবার সংসারী হবেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে তিনি হবেন নিশ্চিন্ত।
এদিকে রাজকুমারের মনে বিরাজ করে এক অজানা অনুসন্ধানী প্রত্যাশা। ক্রমে গৌতমের বয়স হলো উনত্রিশ বছর। বয়সের দিক থেকে তিনি এখন অনেক পরিণত। জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি বুঝতে চেষ্টা করেন বিভিন্ন বিষয়। সংসারের অসারতা তিনি বুঝে ফেলেছেন। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তিনি আরও জানতে চান। এ সময় তাঁর জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় তাঁর জীবনের লক্ষ্য স্থির হয়ে যায়।
একদিন গৌতম ঠিক করলেন, নগর ভ্রমণে বের হবেন। রাজা শুদ্ধোদনও সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিলেন। পাশাপশি এই পদক্ষেপও নিলেন যে, যাতে কুমারের যাওয়ার পথে দুঃখ কষ্টের কোনো দৃশ্য না থাকে। যথারীতি কুমার একদিন তাঁর সারথি ছন্দককে বললেন, রথ সাজাও, আমি ভ্রমণে যাব। ছন্দক রথ সাজিয়ে আনলেন। প্রথমে যাত্রা করলেন পূর্ব দিকে। রাজার আদেশে চলছে চারদিকে আনন্দ, বাদ্য ও গীতধ্বনি। গৌতমের মনে হলো জগতে দুঃখ নেই, শোক নেই, কান্না নেই, হতাশা নেই। আছে আনন্দ, শোভা ও সুষমা। হঠাৎ গৌতম চিৎকার করে সারথিকে ডেকে বললেন, এ কোথায় নিয়ে এলে ছন্দক, কোন রাজ্যে আমরা রথে চড়ে ঘুরছি? ওই দেখো কে যায়? তার হাত কাঁপছে, পা টলছে, ঘাড় দুলছে। কে সে?
ঘোড়ার গতি থেমে গেল। বিষাদে ছেয়ে গেল ছন্দকের মন। তিনি বললেন, উনি এক বৃদ্ধ। বার্ধক্যের কারণে শরীরের এই জীর্ণ অবস্থা। গৌতম বললেন, সবার কি এই দশা হবে? আমারও?
ছন্দক বললেন, হ্যাঁ। সকলকে একদিন বৃদ্ধ হতে হবে।
অমনি গৌতম বললেন, ছন্দক, রথ ঘোরাও। আমি আজ ভ্রমণে যাব না। আমার মন ভালো নেই। রথ ফিরে এলো প্রাসাদে।
আর একদিন গৌতম ভ্রমণে বের হলেন। সেদিন আরও সর্তক হলেন রাজা। আবার ঘোষণা করে দিলেন রাজপথে যেন বৃদ্ধ বা অসুস্থ কেউ না যায়। কোনো দুঃখের দৃশ্য যেন গৌতমের চোখে না পড়ে। রথ ছুটে চলল। এবার দক্ষিণ দিকে। পথে পথে সুন্দরের সমারোহ, পাখির কাকলি, আনন্দের স্রোতোধারা। এমন সময় গৌতম দেখলেন এক অসুস্থ ব্যক্তি। দাঁড়াতে পারে না, চলতে পারে না। শরীর কাঁপছে, বেদনায় কাতর। কষ্টে হা-হুতাশ করছে।
গৌতম প্রিয় সারথিকে বললেন, রথ থামাও। ছন্দক! কে ওই লোক, কেন তার এত কষ্ট, কেন অমন করছে? রথ থামালেন ছন্দক। বললেন, উনি এক রোগী। অসুখে কষ্ট পাচ্ছেন।
গৌতম বললেন, সব মানুষই কি রোগের বশীভূত? আমারও কি এই দশা হবে? গোপাদেবীরও কি এই অবস্থা হবে? ছন্দক বুঝিয়ে দিলেন, জীবমাত্রেরই রোগ আছে। গৌতম সেদিনও নগরভ্রমণ বন্ধ করে রাজপ্রাসাদে ফিরে এলেন।
অন্য আর একদিন। এবার পশ্চিম দিকে চলল রথ। আনন্দের লহরি চলছে চারদিকে। এমন সময় তিনি দেখলেন, চারজনের কাঁধে এক শবাধার। পিছনে পিছনে চলছে কান্নারত বহু মানুষ।
গৌতম বললেন, ছন্দক, কে ওই শবাধারে? কেন এই শোক করছে? কেন ওরা কান্নায় মোহ্যমান?
হৃন্দকের হৃদয় অস্থির হলেও প্রিয় রাজকুমারকে সব বুঝিয়ে বলতে হলো। পরিচয় করিয়ে দিতে হলো জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি মৃত্যুর সঙ্গে
গৌতম আর ভ্রমণে গেলেন না। ফিরে এলেন রাজপ্রাসাদে।
আর একদিন বের হলেন উত্তর পথে। এবারও তাঁর চোখ খোলা, যদি দেখতে পান আনন্দের কিছু! এবার সত্যিই দেখলেন আনন্দের দৃশ্য। গৃহত্যাগী এক তরুণ সন্ন্যাসী। অরুণ বরণ তাঁর গায়ের রং। সৌম্য, দিব্য চেহারা। প্রসন্ন হাসি লেগে আছে মুখে। দুঃখের লেশমাত্র নেই চলার গতিতে ও মনে। গৌতম জিজ্ঞেস করলেন, ছন্দক! ইনি কে? দুঃখ তাঁকে কি স্পর্শ করে না? ছন্দক বললেন, তিনি সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। তাঁর ঘরবাড়ি নেই। আত্মীয়স্বজনের মায়া তিনি ত্যাগ করেছেন। সব কিছু বুঝে ফেললেন গৌতম। সন্ন্যাসীর মধ্যে তিনি দেখতে পেলেন নিজেকে। জরা, ব্যাধি, মরণের কথাও মনে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে। নতুন চৈতন্যে জেগে উঠলেন তিনি। নিজের কর্তব্য স্থির করে ফেললেন। তারপর ছন্দককে বললেন, রথ ঘোরাও, আমি আর কোথাও যাব না।
প্রাসাদে এসে রাজকুমার নিজের চিত্তকে দৃঢ় করলেন। উপলব্ধি করলেন, এখন সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে তিনি নিজেও দুঃখ থেকে মুক্তি পাবেন না। অন্যদেরও মুক্ত করতে পারবেন না। কারণ, ভ্রমণে গিয়ে তিনি যে চারটি দৃশ্য দেখলেন, সে দৃশ্য তাঁর হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করেছে। এই চারটি দৃশ্যকে বৌদ্ধ সাহিত্যে 'চারি নিমিত্ত' নামে অভিহিত করা হয়। চার নিমিত্ত থেকে বন্ধনমুক্ত জীবন 'সন্ন্যাস' অবলম্বনকেই রাজকুমার শ্রেয় মনে করলেন।
সেদিন ছিল আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথি। পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে ধরণি আলোকিত। সে আলোয় প্রদীপ্ত হলো রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতমের অন্তর। জগতের এই অনিবার্য দুঃখ-ক্লেশ থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটানো যায়। কীভাবে সকলের জন্য মুক্তির পথ উন্মুক্ত করা যায় এই চিন্তায় তিনি বিভোর। এমন সময় তিনি সংবাদ পেলেন তাঁর এক পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। উপলব্ধি করলেন, সংসারের মোহে তিনি আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। তিনি অনুভব করলেন, এ বাঁধন থেকে মুক্ত হতেই হবে। সংসারের বন্ধন ছিন্ন করার অভিলাষ পূরণের এটাই যেন উপযুক্ত সময়।
আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। চারিদিক নিস্তব্ধ। প্রাসাদে সকলেই ঘুমে আচ্ছন্ন। তিনি ডাকলেন প্রিয় সারথি ছন্দককে বললেন, আমার ঘোড়া নিয়ে এসো। আমি গৃহত্যাগ করব।
আদেশ পালনকারী ছন্দক অশ্ব কম্বককে সাজিয়ে আনলেন। বিদায়ের আগে গৌতম একবার গোপাদেবীকে দেখতে গেলেন শয়নঘরে। পুত্র রাহুলকে বুকে জড়িয়ে তিনি ঘুমিয়ে আছেন। তাঁকে আর জাগালেন না।
বিলম্বের কারণে মনের স্থিরতা নষ্ট হতে পারে, তাই শিগগির যাত্রা করা উচিত। সংসারের মায়া-মোহের বন্ধন ত্যাগ করে যাত্রা করলেন অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে। ঘোড়ায় চড়ে অনোমা নদীর তীরে পৌঁছলেন। পিছনে পড়ে রইল রাজপ্রাসাদ। সামনে অনোমা নদী। কুলকুল করে বইছে নদীর জলস্রোত। অনোমার তীরে এসে ঘোড়া থামালেন। রাজকুমার গৌতম বললেন, আর নয় ছন্দক, এখান থেকে তুমি ফিরে যাও। শুনে বুক ভেঙে যায় ছন্দকের। কিন্তু উপায় নেই। কুমারের আদেশ হলো কম্বককে নিয়ে রাজবাড়িতে ফিরে যাও।
তারপর তিনি গায়ের রাজ আভরণ খুলে ছন্দকের হাতে দিয়ে তাকে বিদায় দিলেন। গৌতমের বিয়োগব্যথা তাঁর ঘোড়া কম্বককে বিষাদে আক্রান্ত করল। প্রভুর বিদায়-দুঃখ সইতে না পেরে সেখানে প্রাণত্যাগ করল কম্বুক। বেদনাক্রান্ত হৃদয়ে ছন্দক ফিরে চললেন কপিলাবস্তুর দিকে। অন্যদিকে গৃহত্যাগী কুমার সিদ্ধার্থ গৌতম হেঁটে চললেন অনোমার তীর ধরে, বনের দিকে। কুমার সিদ্ধার্থ গৌতমের এই মহা অভিপ্রায়ের অভিযাত্রাকে বলা হয় 'মহা অভিনিষ্ক্রমণ'।
দুঃখ মুক্তির পথ অন্বেষণে গৃহত্যাগী হলেন রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতম। নদী পেরিয়ে বন ও পাহাড়। গৌতম মুক্ত মনে চলতে লাগলেন। জীবনের দুঃখ জয়ের অনুসন্ধানী লক্ষ্যে। নদীর তীরে ঋষিদের আশ্রম। কিন্তু তিনি মহান ব্রত নিয়ে চললেন শীর্ষস্থানীয় কোনো ঋষির সান্নিধ্য লাভের আশায়, যাঁকে তিনি সাধনপথের গুরু হিসেবে গ্রহণ করবেন। সাত দিন সাত রাত কাটিয়ে তিনি পৌঁছালেন বৈশালী নগরে। সেখানে স্বনামধন্য ঋষি আলাঢ় কালামের আশ্রম। তাঁর কাছে শিক্ষা অনুশীলন করলেন দর্শন, সমাধির সাত স্তর। সেখান থেকে রামপুত্র রুদ্রকের কাছে গিয়ে সমাধির আরেকটি স্তর শিখলেন। সেখান থেকে রাজগৃহের আরেক সাধকের কাছে গেলেন। সে সময় রাজগৃহের রাজা বিম্বিসারের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। রাজা বিম্বিসার কুমার সিদ্ধার্থ গৌতমের দিব্যকান্তি দেখে মুগ্ধ হন। রাজা বিম্বিসার তাঁকে সম্পত্তি ও রাজ্যের উঁচুপদ দিতে চাইলেন। কিন্তু যিনি নিজ রাজ্য ছেড়ে এসেছেন, তাঁর আবার লোভ কিসের? রাজগৃহ থেকে গেলেন উরুবেলায়। জায়গাটি তাঁর পছন্দ হলো। দুঃখের শেষ কোথায় জানার জন্য শান্তির পথ খোঁজার মানসে তিনি সেনানী গ্রামে পৌঁছালেন। সেখানে একটি সুন্দর বন দেখতে পেলেন। তার পাশে একটি নদী, নাম নৈরঞ্জনা। এলাকাটিও ছিল নীরব ও নির্জন। গভীর ধ্যানের জন্য উপযুক্ত মনে হলো।
আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে কঠিন ব্রতে মনোনিবেশ করলেন সিদ্ধার্থ। ইতোমধ্যে তিনি দীর্ঘ ছয় বছর কঠোর সাধনা করলেন। শরীর জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেল। হাঁটতে গেলে পড়ে যান, বসলে উঠতে পারেন না। তবুও দুঃখের শেষ কোথায় জানা হলো না। তখন তিনি বুঝলেন, কঠোর তপস্যায় জীবন বিপন্ন হয়। তাই তিনি অল্প অল্প আহার করে 'মধ্যপন্থা' অবলম্বন করলেন। একেবারে কঠোর সাধনা নয়, আবার বিলাসী জীবনও নয়। শ্বাস-প্রশ্বাস প্রবহমান রাখা ও মানসসিদ্ধিতে সচেতন থাকা আবশ্যক মনে করলেন। প্রতিজ্ঞা করলেন, হয় ধ্যানে সিদ্ধিলাভ অথবা মৃত্যু। এর অন্যথা নয়। এরকম প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ধ্যান অনুশীলনের এক সকালে সেখানে বনদেবতার পূজা দিতে আসে এক শ্রেষ্ঠীকন্যা, নাম সুজাতা। সুজাতা ধ্যানস্থ সন্ন্যাসীকে গভীর শ্রদ্ধায় পায়সান্ন দান করলেন। সুজাতার দেওয়া দান তিনি গ্রহণ করলেন। তারপর আবার ধ্যানস্থ হলেন এক অশ্বথ বৃক্ষমূলে বসে। সেদিন ছিল বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথি।
সে ধ্যানেই রাতের প্রথম প্রহরে তিনি জাতিস্মর জ্ঞান বা পূর্বজন্মের বিষয়ে জ্ঞান লাভ করলেন। রাতের দ্বিতীয় প্রহরে তিনি দিব্যচক্ষু সম্পন্ন হলেন। তৃতীয় প্রহরে বুঝতে পারলেন জন্ম, জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুর উৎপত্তি বিষয় । এ সময় 'চার আর্যসত্য' সম্পর্কে যথার্থ উপলব্ধি করলেন। দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখ নিরোধ এবং দুঃখ নিরোধের পথ তিনি খুঁজে পেলেন। এরই নাম চার আর্যসত্য। এই অপূর্ব জ্ঞানময় অর্জনকে বলা হয় 'সম্যক সম্বোধি বা বুদ্ধত্ব'। এ সময় তিনি জগতে খ্যাত হলেন 'বুদ্ধ' নামে। সেই থেকে তিনি গৌতম বুদ্ধ নামে পরিচিত। তারপর তিনি জগতের মানুষের কল্যাণে তাঁর অর্জিত জ্ঞান প্রচার করবেন- এ প্রতিজ্ঞা করলেন। এ সময় তাঁর বয়স পঁয়ত্রিশ বছর। যে অশ্বথগাছের নিচে বসে তিনি জ্ঞান লাভ করলেন, তার নাম হলো 'বোধিবৃক্ষ'। যে স্থানে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করলেন সেই স্থানের নাম ছিল গয়া। পরবর্তীকালে বুদ্ধের বুদ্ধত্ব লাভের ইতিহাসকে স্মরণীয় - করে রাখার জন্য এই গয়া অঞ্চলটি 'বুদ্ধগয়া' নামে খ্যাত হয়। এটি বর্তমান ভারতের বিহার প্রদেশে অন্তর্গত।
'রাজকুমার সিদ্ধার্থ থেকে বুদ্ধ'- এই পরিবর্তনের লক্ষণীয় বিষয়গুলো কী কী লেখো।
|
** এই পৃষ্ঠায় জায়গা না হলে একটি আলাদা কাগজে লিখে কাগজটি বইয়ের পৃষ্ঠার এক পাশে আঠা দিয়ে যুক্ত করতে পারি/খাতায় লিখতে পারি।
বুদ্ধত্ব লাভের পর তিনি চিন্তা করলেন তাঁর এ নতুন তত্ত্ব সাধারণ জাগতিক মানুষের চিন্তার অতীত। সুতরাং এই তত্ত্ব কার পক্ষে বোঝা সম্ভব। জগতে কে বুঝতে সক্ষম হবে সত্য তত্ত্ব। তারপর তিনি দিব্যদৃষ্টিতে চতুর্দিক অবলোকন করলেন। দেখলেন, সারনাথে জীবনের উৎস অনুসন্ধানী পাঁচজন সাধক আছেন। যারা একসময় তাঁর সহযোগী ছিলেন। তাঁদের উদ্দেশ্যেই তিনি যাত্রা করলেন।
আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে পৌঁছলেন সারনাথের ঋষিপতন মুগদাবে। সেখানে পাঁচজন সাধকের সঙ্গে একত্রিত হলেন, যাঁরা দীর্ঘকাল সেখানে সাধনারত ছিলেন। তিনি তাঁদের কাছে নতুন ধর্মতত্ত্ব প্রচার করলেন। পাঁচজন সাধক এই ধর্মতত্ত্ব উপলব্ধি করে যেন নতুন জীবন লাভ করলেন। তাঁরা বুদ্ধের কাছে দীক্ষা নিলেন। তাঁরা হলেন বুদ্ধের প্রথম শিষ্য। তাঁদের একত্রে বলা হয় 'পঞ্চবর্গীয় শিষ্য'। এই পাঁচজন ভিক্ষুর মাধ্যমেই বুদ্ধ প্রথম 'ভিক্ষুসঙ্ঘ' প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর শ্রেষ্ঠী কুমার যশ, যশের পিতা এবং ৫৪ জন সহযোগীকে বুদ্ধ ভিক্ষুসঙ্ঘে গ্রহণ করলেন। তিনি এই ৬১ জন ভিক্ষুকে চারদিকে প্রেরণ করেন ধর্ম প্রচার করার জন্য। এ সময় তথাগত বুদ্ধ নিজেও শিষ্য-প্রশিষ্যসহ বহু স্থানে পরিভ্রমণ করে তাঁর ধর্মতত্ত্ব প্রচার করেছেন। এভাবে দীর্ঘ ৪৫ বছর তিনি জীবজগতের কল্যাণের মহান ব্রত নিয়ে তাঁর অধিগত ধর্ম-দর্শন প্রচার করেন।
তথাগত বুদ্ধের ধর্মাদর্শ জগতে নতুন চেতনার সৃষ্টি করল। এই প্রথম মানুষ শুনল নিজের প্রচেষ্টাতেই তার ভবিষ্যৎ নিহিত। নিজের কর্মই নিজের ভবিষ্যৎ। অর্থাৎ, কর্মের মাধ্যমেই সৃষ্টি হবে ভবিষ্যতের সুখ-দুঃখ। এ রকম আত্মবিশুদ্ধিতার বার্তা নিয়ে প্রাচীন ভারতবর্ষে ঘুরে বেড়ালেন।
প্রচারিত হলো তাঁর ধর্মাদর্শ। এভাবে তিনি ৪৫ বছর ধর্ম প্রচার করেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি রাজগৃহ থেকে বৈশালী হয়ে কুশীনগর গমন করেন। কুশীনগরের কাছে পাবা নগরে উপস্থিত হয়ে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পাবা থেকে তিনি মল্লদের শালবনে পৌঁছালেন। এ সময় তাঁর প্রধান সেবক আনন্দকে বললেন, তাঁর শয়নের ব্যবস্থা করতে। আনন্দ যমক শালগাছের নিচে শয্যাসন প্রস্তুত করলেন। তথাগত বুদ্ধ সেখানে শায়িত হলেন। তখন বৈশাখী পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। আনন্দকে বললেন, ভিক্ষুদের তাঁর কাছে সমবেত করতে। ভিক্ষুগণ শয্যার চার পাশে অঞ্জলিবদ্ধ হয়ে বসলেন। প্রধান শিষ্য আনন্দ কাছে এলেন। বুদ্ধ তখন তাঁর শেষ বাণী বললেন, 'হে ভিক্ষুগণ! উৎপন্ন হওয়া জীবমাত্রেরই ক্ষয় অবশ্যম্ভাবী। তোমরা সচেতন হয়ে অপ্রমাদের সঙ্গে নিজ নিজ কাজ করবে।' তথাগতের এ শেষ বাণী।
তারপর আস্তে আস্তে বুদ্ধ গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হলেন। রাতের শেষ যামে ধ্যানের চতুর্থ স্তরে পৌঁছে জগতের আলো বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। সপ্তাহব্যাপী তাঁর মরদেহ রাখা হয়। ভারতবর্ষের সব রাজন্য ও শ্রেষ্ঠী সমবেত হন মল্ল রাজ্যে। আয়োজন করা হয় মহা মর্যাদাপূর্ণ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের। বুদ্ধের অন্যতম শিষ্য আয়ুষ্মান মহাকাশ্যপ তাঁর চিতায় অগ্নিসংযোগ করেন। তারপর উপস্থিত সব রাজ্যের রাজন্যবর্গ তথাগত বুদ্ধের অস্থিধাতু ও চিতাভস্ম নিতে উদগ্রীব হন। তাঁর পূতাস্থিসমূহ ব্রাহ্মণ দ্রোণাচার্য আট ভাগ করেন। মগধরাজ অজাতশত্রু, বৈশালীর লিচ্ছবি, কপিলাবস্তুর শাক্য, অল্পকল্পকের বুলিয়, রামগ্রামরাজ্যের কোলিয়, বেঠদ্বীপের ব্রাহ্মণরাজ, পাবার মল্লরাজ, কুশীনারার মল্লরাজ পূতাস্থি গ্রহণ করেন। পরে পিপ্পলিবনের মৌর্যরাজ অস্থিধাতু না পেয়ে চিতাভস্ম গ্রহণ করেন। এগুলো প্রতিটি রাজ্যের রাজাগণ নিজ নিজ রাজ্যে স্তূপ নির্মাণ করে পূজার ব্যবস্থা করেন। বর্তমান বিশ্বে বুদ্ধের এই অস্থিধাতু ধর্ম, দর্শন ও ঐতিহ্যের দিক থেকে অমূল্য সম্পদ ও পরম শ্রদ্ধার বস্তু।
চলো সব সহপাঠী মিলে একটি নাটিকার আয়োজন করা যাক। প্রথমে সবাই মিলে নাটিকার স্ক্রিপ্ট তৈরি করি।
|
** এই পৃষ্ঠায় জায়গা না হলে একটি আলাদা কাগজে লিখে কাগজটি বইয়ের পৃষ্ঠার এক পাশে আঠা দিয়ে যুক্ত করতে পারি/খাতায় লিখতে পারি।
** এই পৃষ্ঠায় জায়গা না হলে একটি আলাদা কাগজে লিখে কাগজটি বইয়ের পৃষ্ঠার এক পাশে আঠা দিয়ে যুক্ত করতে পারি/খাতায় লিখতে পারি।
ফিরে দেখা: নিচের তালিকার সকল কাজ কি আমরা শেষ করেছি? হ্যাঁ হলে হ্যাঁ ঘরে এবং না হলে না এর ঘরে (✔) চিহ্ন দাও।
অংশগ্রহণমূলক কাজ নং | সম্পূর্ণ করেছি | |
হ্যাঁ | না | |
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
আরও দেখুন...