বায়ুর মূল উপাদান হলো নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন। এছাড়া ৰাতে সামান্য পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড আছে। আরও আছে জলীয় বাষ্প ও ওজোন গ্যাস। বায়ুমণ্ডলের এই গৌণ গ্যাসগুলোকেই গ্রিনহাউস গ্যাস বলা হয়। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এসব গ্যাস ছাড়াও মনুষ্য সৃষ্ট সিএফসি (ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন), এইচসিএফসি (হাইড্রো ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন), হ্যালন ইত্যাদিও প্রিনহাউস গ্যাস। এই গ্যাসগুলোর মধ্যে গত এক শতাব্দীতে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই- অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে শতকরা ২৫ ভাগ। একইভাবে নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণও শতকরা ১৯ ভাগ এবং মিথেনের পরিমাণ ১০০ভাগ বেড়েছে। যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রধান কারণ। এছাড়া অন্যান্য কারণও রয়েছে।
আমরা যেসব দ্রব্য ব্যবহার করি, যেমন রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, প্লাস্টিক, ফোম, এরোসল প্রভৃতির ফলেও বায়ুমণ্ডলে উৎপন্ন হচ্ছে এক ধরনের প্রিনহাউস গ্যাস (এইচসিএফসি)। এই গ্যাসের কারণে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রত হয়। বায়ুমণ্ডলের অনেকগুলো স্তর আছে। ভার মধ্যে ভূ-পৃষ্ঠের নিকটবর্তী ত্তর ট্রপোস্ফেয়ার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যার গড় উচ্চতা ১২ কি.মি.। এর পরের স্তর হলো স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার। তারপরের স্তরটি হলো ওজোন স্তর, যা ২০ কি. মি. পর্যন্ত বিস্তৃত। ওজোন স্তর সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে পৃথিবীর জীবজগতকে রক্ষা করে। ওজোন স্তর ক্ষয়ের কারণে ভূপৃষ্ঠে অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাব শতকরা পাঁচ ভাগ বৃদ্ধি পেরেছে। এটাও বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার কারণ।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলো অধিক হারে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে পরিবেশ নষ্ট করছে। তাছাড়া এসব দেশ পারমাণবিক চুল্লি ব্যবহার করে, যা থেকে প্রচুর বর্জ্য সৃষ্টি হয়। এই বর্জ্যও গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধি করছে, তবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নে এর ভূমিকা অতি সামান্য। শিল্প-কারখানার বর্জ্য ও কালো ধোঁৱা থেকেও প্রচুর পরিমাণে পারদ, সিসা ও আর্সেনিক নির্গত হয় । এটাও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণ।
মহাসমুদ্রকে পৃথিবীর মানব দেহের ফুসফুসের সাথে তুলনা করা যায়। বিশ্বের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে মহাসমুদ্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সমুদ্রে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নিক্ষেপ করার ফলে ভা দূষিত হচ্ছে এবং এ দূষিত বাষ্প বাতাসে মিশ্রিত হয়েও বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র একটি দেশেও এক সময় বহু নদী-নালা, খাল-বিল ও হাওর-বাওর ছিল যা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। এখন এসব নদী-খাল-বিল শুকিয়ে গিয়েছে কিংবা ভরাট করে ফেলা হয়েছে। অনেক নদী ও খাল বর্জ্য ফেলার কাজে ব্যবহৃত হয়। এভাবে অনেক অনুন্নত দেশেই এসব নদ-নদীর অপব্যবহার হওয়ায় বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় ।
পরিবেশ দূষণের পিছনে যে কারণটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো বন উজাড়করণ। আমরা জানি, সবুজ উদ্ভিদ বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং আমাদের জন্য অক্সিজেন ড্যাপ করে। কিন্তু ব্যাপকহারে বৃক্ষ নিধন বা বন উজাড়করণের ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গেছে। ফলে বায়ুমণ্ডলে ওজোন স্তর ক্ষয়কারী সিএফসি গ্যাস অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বৰ্তমান বিশ্বে ব্যাপক হারে নগর গড়ে উঠেছে। মানুষ কাজের খোঁজে শহরে ছুটছে। ফলে শহরে জনসংখ্যার চাপ ও বিভিন্ন প্রকার যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে। এসব যানবাহনের নির্গত কালো ধোঁয়া হচ্ছে কার্বন-ডাই- অক্সাইড। তাছাড়া শিল্প-কারখানার কালো ধোঁয়াও নগরের বায়ুতে কার্বনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এটিও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির একটা কারণ।
কৃষিতে যান্ত্রিক সেচ, নাইট্রোজেন সার, কীটনাশক প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়। এসবের ফলেও বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ক্ষতি হয়। যার প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা ৰাড়ছে।
আমরা সপ্তম শ্রেণিতে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে জেনেছি। জলবায়ু পরিবর্তনের একটি প্রধান কারণ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। এর ফলে পৃথিবীর সর্বত্র আজ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশও তা থেকে মুক্ত নয়। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে বাংলাদেশে পরিবেশ ও জীবনযাত্রায় যেসব ক্ষতি হতে পারে তা হলো :
সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার ফলে উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহে সমুদ্রের পানি ঢুকে পড়ে। আর সমুদ্রের লবণাক্ত পানির প্রভাবে পাছপালা, মৎস্যখামার ও শস্যক্ষেতের ক্ষতি হয়। ইতোমধ্যেই এর প্রভাব লক্ষ করা গেছে। বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহের ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ক্ষতিখণ্ড হয়েছে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকার কৃষি জমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। জমির উর্বরাশক্তি কমে গেছে। এ কারণে এসব অঞ্চলে কৃষি উৎপাদনও কমে গেছে। অনেক রকম মিঠা পানির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে গাছপালা। এর প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবন-জীবিকার উপর। জীবিকার টানে মানুষ শহরমুখী হয়। শহরের উপরও চাপ বাড়ছে।
সমুদ্রের পানি বৃদ্ধির কারণে স্বাভাবিকের তুলনায় উঁচু জোয়ারের সৃষ্টি হয়। যা জলোচ্ছ্বাসের আকার ধারণ করে। আবার সমুদ্রে নিম্নচাপ সৃষ্টি হওয়ার কারণে সাইক্লোনের তীব্রতা বেড়ে যায়। আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ 'আইলা' ও 'সিডর' এর নাম শুনেছি। এ দুটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের দেশের উপকূলবর্তী এলাকায় প্রাণহানি ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। খাবার পানির তীব্র অভাব দেখা দেয়। ইতোমধ্যে সুন্দরবনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ বন নষ্ট হয়েছে। এর ফলে জীববৈচিত্র্য ও মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।
উষ্ণায়নের কারণে পৃথিবীপৃষ্ঠে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে আসার ফলে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর বিভিন্ন প্রকারের মারাত্মক রোগ সৃষ্টি হয়। ক্যান্সার, চর্মরোগসহ নানা ধরনের নতুন নতুন রোগের আবির্ভাব ঘটে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়। যেমন-বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ইতোমধ্যে মরুকরণের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
উষ্ণায়নের ফলে সৃষ্ট বন্যা, খরা, লবণাক্ততা প্রভৃতি কারণে গবাদি পশুর খাদ্যের অভাব হবে। বাড়বে বিভিন্ন ধরনের রোগ। এসব ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনা করে আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
কাজ- ১ : বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কী কী কারণে ঘটে, উল্লেখ করো।
কাজ- ২ : বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে মানুষ, পরিবেশ ও জীবজন্তুর কী কী ক্ষতি হয় এবং হতে পারে? উল্লেখ করো।
আরও দেখুন...