ব্যাংক একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা অর্থ জমা-গ্রহণ, সংরক্ষণ, স্থানান্তর ও ঋণদানের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করে। প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জন ছাড়াও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাংক অনেক কাজ করে। আধুনিক ব্যাংকগুলো বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে যেসব কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে নিচে তা উল্লেখ করা হলো-
১. আমানত গ্রহণ (Collection of deposit) : ব্যাংক সঞ্চয়ী, চলতি ও মেয়াদি হিসাবের মাধ্যমে জনগণের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অতিরিক্ত অর্থ আমানত হিসেবে গ্রহণ করে। এ লক্ষ্যে জনগণকে সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করা ব্যাংকের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
২. অর্থ বা দাবি পরিশোধ ( Payment of money): আমানতকারীগণ যে অর্থ ব্যাংকে জমা রাখে তা থেকে ব্যাংক তাদের দাবি অনুযায়ী জমাকৃত অর্থ চাহিবামাত্র পরিশোধ করে থাকে।
৩. ঋণদান (Payment of loan): ব্যাংক হলো ধার ও ঋণের ব্যবসায়ী। তাই আমানত হিসেবে বা অন্য কোনো উৎস হতে সংগৃহীত অর্থ ব্যাংক ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও অন্যদেরকে ঋণ হিসেবে প্রদান করে। উপযুক্ত খাতে ঋণদান ও তা যথাসময়ে সংগ্রহ করা সব ধরনের ব্যাংকেরই গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে বিবেচিত।
৪ . বিনিময়ের মাধ্যম সৃষ্টি (Creation of medium of exchange) : চেক, প্রত্যয়পত্র, ড্রাফট, পে-অর্ডার, ভ্রমণকারীর চেক, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদি বিনিময়ের মাধ্যম সৃষ্টি করে আধুনিক ব্যাংকসমূহ দেনা-পাওনা নিষ্পত্তি ও আর্থিক লেনদেনে সহায়তা করে।
৫. অর্থ স্থানান্তর (Transferring money) : দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে কিংবা এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ প্রেরণ একান্ত প্রয়োজন। ব্যাংকের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে চেক, ব্যাংক ড্রাফট, বিনিময় বিল ইত্যাদির মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্বল্প সময় ও খরচে অর্থ স্থানান্তর করা।
৬. ব্যবসা-বাণিজ্যে সহায়তা (Assistance in business): ঋণদান, মক্কেলদের পক্ষে দেনা-পাওনা নিষ্পত্তি, অর্থ স্থানান্তর ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কাজ সম্পাদন করে ব্যাংকসমূহ একদিকে যেমন অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে সহায়তা করে, তেমনি প্রত্যয়পত্র, পর্যটকের চেক, ব্যাংক ড্রাফট ইত্যাদি ইস্যু করে বৈদেশিক বাণিজ্যকেও সচল রাখে।
৭. কৃষি ও শিল্পের উন্নয়ন (Developing agriculture and industry) : একটি দেশের কৃষি ও শিল্প উন্নয়নের জন্য যে আর্থিক সহযোগিতা দরকার ব্যাংক তা প্রদান করে থাকে। কৃষিতে যেমন উন্নত যন্ত্রপাতি, সেচ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন আধুনিক উপকরণ সংগ্রহের জন্য ব্যাংক ঋণের সহায়তা দরকার, তেমনি শিল্পক্ষেত্রে শিল্পের ভারী যন্ত্রপাতি এবং কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রয়োজন হয়।
৮. মূলধন গঠন (Formation of capital) : জনগণের কাছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অর্থ সংগ্রহ করে তা মূলধন গঠনে ব্যবহার করা ব্যাংকের একটি অন্যতম কাজ। দেশের শিল্প ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য যে বিপুল পরিমাণ মূলধনের প্রয়োজন হয়, অর্থ বাজারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে ব্যাংক তা ব্যবস্থা করে।
৯. ঋণ আমানত সৃষ্টি (Creation of loan deposits): ঋণ আমানত সৃষ্টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের অন্যতম প্রধান কাজ। দুইভাবে এ আমানত সৃষ্টি করা যায়। প্রথমত, মক্কেল ব্যাংককে নগদ টাকা জমা দিয়ে আমানত সৃষ্টি করতে পারে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংক মক্কেলকে ঋণ মঞ্জুর করে আমানত সৃষ্টি করতে পারে । ব্যাংক ঋণের টাকা নগদে না দিয়ে মক্কেলের হিসাবে জমা করে। মক্কেল তার সুবিধামত উক্ত ঋণের টাকা চেক কেটে উত্তোলন করে। আবার, মক্কেল দেনা পরিশোধের উদ্দেশ্যে চেক লিখে তার পাওনাদারকে প্রদান করে। এভাবে ব্যাংক ঋণ আমানত সৃষ্টি করে ।
১০. বিনিময় বিল বাট্টাকরণ (Discounting bill of exchange) : ব্যবসায়ীদের জরুরি প্রয়োজনে ব্যাংক তাদের বিনিময় বিল মেয়াদপূর্তির আগেই ভাঙ্গিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেয়। এজন্য ব্যাংক নির্দিষ্ট হারে বাট্টা গ্রহণ করে এবং মেয়াদপূর্তিতে আদিষ্টের কাছ থেকে বিলের সম্পূর্ণ টাকা আদায় করে নেয়। উপরিউক্ত কার্যাবলিসমূহ ছাড়াও আরো অনেক কাজ ব্যাংক সম্পাদন করে।
বাংলাদেশে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে এমন সব ব্যাংককে বাংলাদেশের অনুমোদিত ব্যাংক বলা হয়। এ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নাম হলো 'বাংলাদেশ ব্যাংক'। বাংলাদেশের ব্যাংকসমূহকে মূলত দুই শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। যথা- তালিকাভূক্ত ব্যাংক ও অ-তালিকাভুক্ত ব্যাংক। ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৪৩টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৩টি বিশেষায়িত ব্যাংক ও ৯টি বিদেশি ব্যাংকসহ বাংলাদেশে মোট তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি। আর অনুমোদিত অ-তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ৫টি। গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী সংস্থা এবং সামাজিক উন্নয়ন ব্যাংক। এটি একটি বিশেষায়িত অ-তালিকাভুক্ত ব্যাংক, যা ক্ষুদ্রঋণ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ২০০৬ সালে দারিদ্র বিমোচনে অবদান রাখায় গ্রামীণ ব্যাংক এবং ড. মুহাম্মদ ইউনুস যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। নিচে অনুমোদিত তালিকাভুক্ত ও অ-তালিকাভুক্ত ব্যাংকের নামসমূহ দেওয়া হলো—
অনুমোদিত তালিকাভুক্ত ব্যাংক (Authorized listed banks) :
ক. রাষ্ট্রায়ত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংক (State owned commercial bank)
বাংলাদেশে ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে যেগুলোর শতভাগ মালিকানা বাংলাদেশ সরকারের।
ব্যাংকের নাম | প্রতিষ্ঠাকাল |
---|---|
১. সোনালী ব্যাংক লিমিটেড | ১৯৭২ |
২. জনতা ব্যাংক লিমিটেড | ১৯৭২ |
৩. অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড | ১৯৭২ |
৪. রূপালী ব্যাংক লিমিটেড | ১৯৭২ |
৫. বেসিক ব্যাংক লিমিটেড | ১৯৮৮ |
৬. বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লি. | ২০০৯ |
বাংলাদেশে ৪৩টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে যেগুলোর বেশিরভাগ বা সব শেয়ার বা মালিকানা রয়েছে ব্যক্তি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে।সাধারণত বাংলাদেশে পরিচালিত বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে ৩৩টি ব্যাংক প্রথাগত বা সাধারণ ব্যাংকিং কার্যক্রম করে থাকে। এদের মধ্যে রয়েছে – পূবালী ব্যাংক লি.,উত্তরা ব্যাংক লি.,আরব-বাংলাদেশ (এবি) ব্যাংক লি.,আইএফআইসি ব্যাংক লি.,ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লি.,সিটি ব্যাংক লি.,এন.সি.সি. ব্যাংক লি.,ইস্টার্ন ব্যাংক লিডাচ-বাংলা ব্যাংক লি.,ঢাকা ব্যাংক লি.প্রাইম ব্যাংক লি.,মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লি.,সাউথইস্ট ব্যাংক লি.,বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লি.,ওয়ান ব্যাংক লি.,ন্যাশনাল ব্যাংক লি.,প্রিমিয়ার ব্যাংক লি.,ব্র্যাক ব্যাংক লি.ইত্যাদি।
বাংলাদেশে পরিচালিত বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে ১০টি ব্যাংক ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম করে।
ব্যাংকের নাম |
---|
১. ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লি. ২.আইসিবি ইসলামি ব্যাংক লি. ৩. আল-আরাফাহ ইসলামি ব্যাংক লি. ৪. সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংক লি. ৫.এক্সিম ব্যাংক বাংলাদেশ লি. ৬. ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংক লি. ৭. স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লি. ৮. শাহজালাল ইসলামি ব্যাংক লি. ৯. ইউনিয়ন ব্যাংক লি. ১০. গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক লি. |
বাংলাদেশে ৯টি বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে। এই ব্যাংকসমূহ বাংলাদেশে আঞ্চলিক কার্যালয় ও শাখা কার্যালয় খুলে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
ব্যাংকের নাম |
---|
১. সিটি ব্যাংক এন.এ. ২.এইচএসবিসি ৩. উরি ব্যাংক ৪. কর্মার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন ৫. হাবিব ব্যাংক লি. ৬.স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড বাংলাদেশ ৭. ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান ৮. স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (বাংলাদেশ) ৯.ব্যাংক আল ফালাহ্ |
বাংলাদেশে ৩টি বিশেষায়িত ব্যাংক রয়েছে যেগুলোর মালিকানা বাংলাদেশ সরকারের হাতে। ব্যাংকগুলো আলাদা আলাদা বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণে গঠন করা হয়েছে।
ব্যাংকের নাম |
---|
১.বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ২.রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ৩.প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক |
বাংলাদেশে ৫ টি অ-তালিকাভুক্ত ব্যাংক রয়েছে।
ব্যাংকের নাম |
---|
১. জুবিলী ব্যাংক ২. গ্রামীণ ব্যাংক ৩. আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক ৪. কর্মসংস্থান ব্যাংক ৫. পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক |
আরও দেখুন...