মহাদেশ বলতে পৃথিবীর সমুদ্রের (অথবা মহাসাগরের) পানির উপরে অবস্থিত স্থলভাগকে বোঝানো হয়, পৃথিবীর পৃষ্ঠ দেশের তিনভাগই পানি এবং মাত্র এক ভাগ স্থল।
আদি পৃথিবীর উত্তপ্ত তরল উপরিভাগ ধীরে ধীরে ক্রমাগত ঠান্ডা হবার ফলে সৃষ্টি হয়েছে বর্তমান কঠিন ভূত্বক। কিন্তু এর উপরিভাগ কঠিন এবং শীতল হলেও ভূত্বকের নিচের অর্থাৎ পৃথিবীর অভ্যন্তর এখনও উত্তপ্ত। ভূত্বক এবং ম্যান্টলের উপরের কঠিন অংশ নিয়ে যে লিথোমণ্ডল গঠিত, সেটি তার নিচের ম্যান্টলের অপেক্ষাকৃত তরল বা সঞ্চালনশীল অংশের উপর অতি ধীরে গতিশীল রয়েছে। লিথোমণ্ডল অনেকগুলো মহাদেশীয় এবং মহাসাগরীয় প্লেটে বিভক্ত। এই সকল প্লেটে নানান দিকে গতিশীলতাকে প্লেট টেকটোনিক বলা হয়। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি সহজে বোঝা যাবে। তোমরা হয়তো বাসায় চুলার উপর পাত্রে দুধ গরম করার সময় তাতে সর পড়তে দেখেছ। দেখবে চুলার আগুনে আঁচ কমিয়ে দুধ জাল দিলে সর নড়াচড়া করে। দুধের সরের গতিশীলতা বেশি হওয়ায় তা আমাদের চোখে পড়ে। কিন্তু টেকটোনিক প্লেটের গতি (বছরে ৩ থেকে ৫ সেন্টিমিটার মাত্র) অতি অল্প হবার কারণে তা আমরা সরাসরি দেখতে পাই না। তবে কয়েক লক্ষ বছর ধরে এই গতি চললে তা ভূপৃষ্ঠে অনেক পরিবর্তন আনে। টেকটোনিক প্লেটের এই গতির ফলে প্লেটের উপর অবস্থিত মহাদেশগুলোও গতিশীল হয়। কখনো মহাদেশগুলো একটি অপরটির দিকে অগ্রসর হয়, আবার কখনো একটি অপরটি থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। একে মহাদেশের অপসরণ বলে। এমন ঘটনার কারণে দক্ষিণ আমেরিকা কয়েক কোটি বছরে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে পৃথক হয়ে গেছে। একসময় এই দুটি মহাদেশ একত্রে ছিল যার প্রমাণ উভয় মহাদেশ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রকার জীবাশ্ম থেকে পাওয়া গেছে।
প্রায় ২৫ কোটি বছর আগে পৃথিবীর সকল মহাদেশ মিলে একটি বৃহৎ মহাদেশ ছিল যার নাম ছিল প্যাঞ্জিয়া । সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা ভেঙে অনেকগুলো মহাদেশে বিভক্ত হয়েছে। আবার একই কারণে বর্তমান ভারত অস্ট্রেলিয়া থেকে পৃথক হয়ে বর্তমান এশিয়া মহাদেশের অংশ হয়ে গেছে এবং যে স্থানে সংযোগ ঘটেছে, সেখানে সৃষ্টি হয়েছে বর্তমান সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালা ।
তোমরা ইতোমধ্যে জেনেছ যে লিথোস্ফিয়ার বেশ কয়েকটি ছোট-বড় টেকটনিক প্লেটে বিভক্ত এবং সেগুলো বিভিন্ন দিকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। তোমরা তাপের তিনটি প্রবাহ সম্পর্কে পড়ার সময় ‘পরিচলন তাপের প্রবাহ' পড়েছ, ম্যান্টলের ভেতরেও সে ব্যাপারটি ঘটে। ম্যান্টলের মধ্যে যে পরিচলন স্রোত কাজ করে, তার কারণে তার উপরে ভাসমান টেকটোনিক প্লেটগুলো বিভিন্ন দিকে গতিশীল হয়। যে সকল এলাকায় দুটি টেকটোনিক প্লেট পাশাপাশি অবস্থান করে, সেখানে সেগুলোর মধ্যে নিচের তিন ধরনের যেকোনো এক প্রকার স্থানান্তর দেখা যায়।
অভিসারী (Subduction): প্লেটগুলো একটি অপরটির দিকে এসে সংঘর্ষ ঘটতে পারে । তখন তুলনামূলকভাবে ভারী প্লেটটি অন্য প্লেটের নিচে ঢুকে যায়। সংঘর্ষের সীমানায় যেটি উপরে থাকে, সেটি উপরে ওঠার সময় পর্বতমালা তৈরি করে। ভারতীয় টেকটোনিক প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষে এভাবে হিমালয় পর্বতমালা তৈরি হয়েছে। সংঘর্ষের সীমানায় ভারতীয় প্লেট ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে ঢুকে গেছে। অভিসারী গতির কারণে বিভিন্ন প্রকার আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি হয় এবং সঙ্গে বিভিন্ন মাত্রার ভূমিকম্পও হয়ে থাকে।
অপসারী (Spreading): টেকটোনিক প্লেটগুলো যখন একটি অপরটি থেকে দূরে সরে যেতে থাকে তখন সেগুলোর সীমানাকে বলে অপসারী প্লেট সীমানা। অপসারী প্লেট সীমানার সবচেয়ে চমকপ্রদ উদাহরণ হচ্ছে আটলান্টিক মহাসাগরের ঠিক মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া মিড আটলান্টিক রিজ। সমুদ্রের তলদেশ থেকে বের হয়ে যখন এটি আইসল্যান্ডের ভেতর দিয়ে গেছে তখন স্থলভাগেও এটি দেখা যায়। অপসারী গতির কারণে সাধারণত সমুদ্রের তলদেশের বিভিন্ন প্রকার আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হয়।
নিরপেক্ষ (Lateral): একটি প্লেট অপরটির সঙ্গে পাশাপাশি পিছলে যেতে পারে তখন দুটো প্লেটের সংযোগস্থলকে বলে নিরপেক্ষ প্লেট সীমানা। এই ধরনের স্থানান্তরের কারণে সেই প্লেটের সীমানাতে প্রচুর শক্তি সঞ্চিত হয় এবং যখন সেই শক্তি সীমানার ধারণক্ষমতার বেশি হয়ে যায়, তখন ভূমিকম্পের মাধ্যমে সেই শক্তি নির্গত হয়। একটি অত্যন্ত পরিচিত নিরপেক্ষ প্লেট সীমানা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া সান এন্ড্রিয়াজ ফল্ট লাইন। এই সীমানায় অচিন্তনীয় পরিমাণ শক্তি জমা হয়ে আছে বলে অনুমান করা হয় এবং যে কোনো সময়ে একটি বড় ভূমিকম্পের মাধ্যমে শক্তি নির্গত হবে বলে আশঙ্কা করা হয়।
আরও দেখুন...