আমরা আগেই জেনেছি, আল্লাহ তায়ালা মানুষের হিদায়াতের জন্য যুগে যুগে নবি-রাসুল পাঠিয়েছেন। তাঁরা নিজেরা আল্লাহর হুকুম পালন করে মানুষদের হাতে-কলমে শিক্ষা দিতেন। তাঁরা ছিলেন মানুষের মহান ও আদর্শ শিক্ষক। নবি-রাসুলগণ ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী। তাঁরা ছিলেন সত্যবাদী, নির্লোভ ও নিষ্পাপ। তাঁরা ছিলেন দয়ালু ও মানব-দরদী। তাঁরা আজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। তাঁরা আল্লাহ তায়ালার দীন প্রচারে সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করেছেন। পৃথিবীতে অনেক নবি-রাসুল এসেছেন। তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম নবি হযরত আদম (আ) আর সর্বশেষ নবি হযরত মুহাম্মদ (স)। এ অধ্যায়ে আমরা মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স) এর জীবনাদর্শ, কুরআন মজিদে উল্লিখিত ২৫ জন নবির নাম এবং কয়েকজন নবির পরিচয় জানবো।
মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২০ এপ্রিল এবং রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল্লাহ, মাতার নাম আমিনা। তাঁর দাদার নাম ছিল আব্দুল মুত্তালিব। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় মুহাম্মদ এবং আহমাদ। তাঁর জন্মের পূর্বেই পিতা আব্দুল্লাহ মারা যান।
মহানবি (স)-এর জন্মের সময় আরবের লোকেরা নানা পাপের কাজে লিপ্ত ছিল। মারামারি, কাটাকাটি, ঝগড়া-ফেসাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, লুণ্ঠন, মদ, জুয়া ইত্যাদি নিয়েই তারা মেতে ছিল। এক আল্লাহকে ভুলে তারা নানা দেব-দেবীর মূর্তি বানিয়ে পূজা করত। পবিত্র কাবা তারা মূর্তিতে ভরে রেখে ছিল। কাবা প্রাঙ্গণে তারা ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করেছিল। তখন বাজারে পণ্যের মতো মানুষ বেচাকেনা হতো। মনিবরা দাস-দাসীদের প্রতি অমানবিক নির্যাতন করত। পরিবারে ও সমাজে নারীদের কোনো মান-সম্মান বা অধিকার ছিল না। সে সময় কন্যা শিশু জন্মগ্রহণ করা পিতা— মাতার জন্য খুবই অপমানের বিষয় ছিল। মেয়ে শিশুদের নিষ্ঠুরভাবে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে রাখা হতো। তাদের আচার-আচরণ ছিল বর্বর ও মানবতাবিরোধী। এ সময়ে মানুষের জানমালের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। মদপান, জুয়াখেলা, সুদ, ব্যভিচার ছিল তখনকার লোকদের নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। কুসংস্কার ও পাপ-পঙ্কিলতার অতলতলে নিমজ্জিত ছিল তারা। সে সময়কে বলা হয় ‘আইয়ামে জাহিলিয়া' বা মূর্খতার যুগ। মানবতার এ চরম দুর্দিনে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বন্ধু সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মদ (স) কে পাঠালেন বিশ্বমানবতার শান্তিদূত হিসেবে। পথহারা মানুষকে সত্য, সুন্দর, ধর্ম ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করার জন্য ।
হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্মের পর চাচা আবু লাহাবের দাসী সোয়েবা তাঁকে মাতৃস্নেহে লালন-পালন করেন। তারপর তখনকার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশের প্রথা অনুসারে বানু সাদ গোত্রের বেদুঈন মহিলা হালিমার হাতে তাঁর লালনপালনের ভার দেওয়া হয়। সোয়েবা যদিও তাঁকে অল্পদিন লালন-পালন করেছেন, তবুও তিনি প্রথম দুধমাতা ও তাঁর পরিবারের প্রতি খুব কৃতজ্ঞ ছিলেন। অনেকদিন পরেও তাঁদের খোঁজ-খবর নিয়েছেন এবং উপহার উপঢৌকন দিয়েছেন। পাঁচ বছর পর্যন্ত বিবি হালিমা নিজের সন্তানের মতো শিশু মুহাম্মদ (স) কে লালনপালন করেন। এ সময় শিশু মুহাম্মদ (স)-এর চরিত্রে ইনসাফ ও ত্যাগের একটি অনুপম দৃষ্টান্ত ফুটে ওঠে। তিনি হালিমার একটি স্তন থেকে দুধ পান করতেন, অন্যটি দুধ ভাই আবদুল্লাহর জন্য রেখে দিতেন। তিনি বেদুঈন পরিবারে থেকে বিশুদ্ধ আরবি ভাষা শিখেন ও মরুভূমির মুক্ত পরিবেশে সু— স্বাস্থ্যের অধিকারী হন।
পাঁচ বছর বয়সে তিনি মা আমিনার কোলে ফিরে আসেন। আদর-সোহাগে মা তাঁকে লালনপালন করতে থাকেন। কিন্তু মায়ের আদর তাঁর কপালে বেশি দিন স্থায়ী হলো না। তাঁর ছয় বছর বয়সে মাও ইন্তিকাল করেন। এবার তিনি পিতা-মাতা দুজনকেই হারিয়ে এতিম হয়ে যান। এরপর তিনি দাদা আব্দুল মুত্তালিবের আদর-স্নেহে লালিত-পালিত হতে থাকেন। কিন্তু আট বছর বয়সের সময় তাঁর দাদাও মারা যান। এরপর তিনি চাচা আবু তালিবের আশ্রয়ে বড় হতে থাকেন ৷
আবু তালিবের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না। কিশোর মুহাম্মদ (স) ছিলেন কর্মঠ। কারও গলগ্রহ হয়ে থাকা তিনি পছন্দ করতেন না। তিনি চাচার অসচ্ছল পরিবারে নানাভাবে সাহায্য করতেন। বাড়তি আয়ের জন্য রাখালদের সাথে ছাগল-মেষ চরাতেন । রাখাল বালকদের জন্য তিনি ছিলেন আদর্শ। তাদের সাথে তিনি সৌহার্দ্য সম্প্রীতি বজায় রাখতেন। রাখালদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ হলে তিনি বিচারকের ভূমিকা পালন করতেন। তিনি চাচার ব্যবসা-বাণিজ্যেও সাহায্য করতেন। একবার চাচার সাথে ব্যবসা উপলক্ষে সিরিয়ায়ও গিয়েছিলেন। এ সময় বহিরা নামক এক পাদ্রির সাথে তাঁর দেখা হয়। বহিরা তাঁকে অসাধারণ বালক বলে মন্তব্য করেন এবং শেষ নবি বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। তিনি আবু তালিবকে তাঁর ব্যাপারে সাবধানও করেন। কারণ শত্রুরা তাঁর অনিষ্ট করতে পারে।
সিরিয়া থেকে ফেরার পর বালক মুহাম্মদ (স) ফিজার যুদ্ধের বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করে আঁতকে ওঠেন। ওকায মেলায় জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে এ যুদ্ধ হয়েছিল । কায়স গোত্র অন্যায়ভাবে এ যুদ্ধ কুরাইশদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। এজন্য একে ‘হারবুল ফিজার’ বা অন্যায় সমর বলা হয়। এ যুদ্ধ চলে একটানা পাঁচ বছর। অনেক মানুষ আহত-নিহত হলো। যুদ্ধের বিভীষিকাময় করুণ দৃশ্য দেখে, আহতদের করুণ আর্তনাদে তাঁর কোমল হৃদয় কেঁদে উঠল। তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন ।
তিনি শান্তিকামী উৎসাহী যুবক বন্ধুদের নিয়ে ‘হিলফুল ফুযূল' নামে একটি শান্তি সংঘ গঠন করলেন। এ সংঘের উদ্দেশ্য ছিল আর্তের সেবা করা, অত্যাচারীকে প্রতিরোধ করা, অত্যাচারিতকে সাহায্য করা, শান্তি – শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা এবং গোত্রে গোত্রে সম্প্রীতি বজায় রাখা ইত্যাদি। তিনি তাঁর প্রচেষ্টায় অনেক সফলতা লাভ করেন। সেদিনকার শান্তি সংঘের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আজও আমাদের কিশোর ও যুব সমাজ নিজেদের এ ধরনের মহৎ কাজে নিয়োজিত করতে পারে ।
ইতোমধ্যেই সত্যবাদী, বিশ্বাসী, আমানতদার, বিচক্ষণ, পরোপকারী, শান্তিকামী যুবক হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আপন-পর সকলেই তাঁকে “আস সাদিক’ মানে সত্যবাদী, ‘আল-আমীন' মানে বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত করল। তাঁর কাছে ধন-সম্পদ আমানত রাখতে লাগল ।
বহুদিন পূর্বের নির্মিত পুরাতন কাবাঘর সংস্কারের কাজ হাতে নিল কুরাইশরা। যথারীতি কাবাঘর সংস্কার করল তারা। কিন্তু পবিত্র হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর স্থাপন নিয়ে বিবাদ লেগে গেল। প্রত্যেক গোত্রই এ পাথর কাবাঘরের দেয়ালে স্থাপনের সম্মান নিতে চাইল । যুদ্ধের সাজ সাজ রব পড়ে গেল। অবশেষে প্রবীণতম গোত্ৰ প্ৰধান উমাইয়া বিন মুগীরার প্রস্তাব অনুসারে সিদ্ধান্ত হলো, আগামীকাল প্রত্যুষে যে ব্যক্তি সবার আগে কাবাঘরে আসবেন তাঁর ওপরই বিবাদ মীমাংসার ভার অর্পিত হবে। তাঁর সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নিবে। প্রত্যুষে দেখা গেল – হযরত মুহাম্মদ (স) কাবাঘরে প্রবেশ করছেন। সবাই আনন্দে চিৎকার করে বলল – ‘আল-আমীন' আসছেন, আমরা তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট । সঠিক মীমাংসাই হবে। মুহাম্মদ (স) একখানা চাদর বিছিয়ে দিলেন। তারপর চাদরে নিজ হাতে পাথরখানা রাখলেন। গোত্র সরদারগণকে ডেকে চাদর ধরতে বললেন। তারা ধরে তা যথাস্থানে বহন করে নিয়ে গেল। ‘আল-আমীন' নিজের হাতে পাথরখানা কাবাঘরের দেয়ালে বসিয়ে দিলেন। একটি অনিবার্য যুদ্ধ থেকে সবাই বেঁচে গেল। পাথর উঠাবার সম্মান পেয়ে সবাই খুশিও হলো। বিচার ফয়সালায় বিচক্ষণতা ও নিরপেক্ষতা অবলম্বন করলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। অনেক অনিবার্য সংঘাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
তখনকার দিনে আরবে একজন বিখ্যাত ধনী ও বিদুষী মহিলা ছিলেন। তাঁর নাম খাদিজা । তিনি তাঁর বিশাল বাণিজ্য দেখাশোনা করার জন্য একজন বিশ্বাসী বিচক্ষণ লোক খুঁজছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সুন্দর চরিত্রের সুনাম শুনে তিনি তাঁর ওপর ব্যবসায়ের দায়িত্ব অর্পণ করেন। মুহাম্মদ (স) খাদিজার ব্যবসায়ের দায়িত্ব নিয়ে সিরিয়া যান। সাথে খাদিজার বিশ্বস্ত কর্মচারী মাইসারাও ছিলেন। ব্যবসায়ে আশাতীত লাভ করে তিনি মক্কায় ফিরে আসেন। মাইসারার কাছে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সততা, বিচক্ষণতা ও কর্মদক্ষতার কথা শুনে খাদিজা অত্যন্ত মুগ্ধ হন। তিনি তাঁর সাথে নিজের বিয়ের প্রস্তাব দেন। মুহাম্মদ (স)-এর চাচা আবু তালিব হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাথে খাদিজার বিয়ের সকল ব্যবস্থা করে দেন। শুভ বিবাহ সম্পন্ন হলো, তখন মুহাম্মদ (স)- এর বয়স পঁচিশ বছর। আর খাদিজার বয়স চল্লিশ বছর। তাঁদের দাম্পত্য জীবন অত্যন্ত সুখের হয়েছিল। হযরত খাদিজা বেঁচে থাকতে তিনি অন্য কোনো বিয়ে করেন নি। বিয়ের পরে খাদিজার আন্তরিকতায় তিনি প্রচুর সম্পদের মালিক হন। কিন্তু তিনি এ সম্পদ ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশে ব্যয় না করে গরিব-দুঃখী ও আর্ত-পীড়িতদের সেবায় অকাতরে ব্যয় করেন।
হযরত মুহাম্মদ (স) শিশু বয়স থেকেই মানুষের মুক্তির জন্য, শান্তির জন্য ভাবতেন। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তাঁর এ ভাবনা আরও গভীর হয়। মূর্তি পূজা ও কুসংস্কারে লিপ্ত এবং নানা দুঃখকষ্টে জর্জরিত মানুষের মুক্তির জন্য তাঁর সব ভাবনা। মানুষ তাঁর স্রষ্টাকে ভুলে যাবে, হাতে বানানো মূর্তির সামনে মাথা নত করবে, এটা হয় না। কী করা যায়, কীভাবে মানুষের হৃদয়ে এক আল্লাহর ভাবনা জাগানো যায়। কী করে কৃষ্ণর শিরক থেকে তাদের মুক্ত করা যায়। এ সকল বিষয়ের চিন্তা-ভাবনায় তিনি মগ্ন। বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে নির্জন হেরা পর্বতের গুহায় নির্জনে ধ্যান করতেন। কখনো কখনো একাধারে দুই-তিন দিনও সেখানে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। এভাবে দীর্ঘদিন ধ্যানমগ্ন থাকার পর অবশেষে চল্লিশ বছর বয়সে রমযান মাসের কদরের রাতে আঁধার গুহা আলোকিত হয়ে উঠল ।
আল্লাহর ফেরেশতা জিবরাঈল (আ) আল্লাহর মহান বাণী ওহি নিয়ে আসলেন। মহানবি (স) কে লক্ষ্য করে বললেন—'ইকরা' (পড়ুন)। তিনি মহানবি (স) কে সূরা আলাক-এর প্রথম পাঁচটি আয়াত পাঠ করে শোনালেন -
বাংলা উচ্চারণ :
ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাযী খালাক। খালাকাল ইনসানা মিন আলাক। ইকরা ওয়া রাব্বুকাল আকরাম। আখি আল্লামা বিল কালাম। আল্লামাল ইনসানা মা- লাম ইয়ালাম ।
অর্থ :
১. পাঠ করুন আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।
২. যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে আলাক (এঁটে থাকা বস্তু ) থেকে।
৩. পাঠ করুন, আপনার প্রতিপালক তো মহিমান্বিত।
৪. যিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলমের সাহায্যে।
৫. শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না। (সূরা আলাক, আয়াত: ১-৫)
নবিজি ঘরে ফিরে খাদিজার কাছে সব ঘটনা প্রকাশ করলেন এবং বললেন, “আমাকে বস্ত্রাবৃত করো, আমি আমার জীবনের আশঙ্কা করছি।” তখন খাদিজা নবিজিকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “না, কখনও না। আল্লাহর কসম। তিনি কখনও আপনার অনিষ্ট করবেন না। কারণ আপনি আত্মীয়- স্বজনের সাথে ভালো ব্যবহার করেন, আর্ত-পীড়িত ও দুস্থদের সাহায্য করেন, মেহমানদের সেবা-যত্ন করেন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাহায্য করেন।” হযরত খাদিজার এই উক্তি দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, নবুয়ত লাভের আগেও মহানবি (স) নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে মানবিক মহৎ গুণাবলির অনুশীলন করতেন, মানবতার সেবায় নিয়োজিত থাকতেন। বর্বর আরবদের মধ্যে থেকেও তিনি নির্মল ও সুন্দর জীবনযাপন করতেন। তিনি ছিলেন সমগ্র মানবজাতির জন্য আদর্শ।
নবুয়ত লাভের পর হযরত মুহাম্মদ (স) আল্লাহর নির্দেশে প্রথমে নিকট আত্মীয়- স্বজনের কাছে গোপনে ইমানের দাওয়াত দিতে থাকেন। তাঁর দাওয়াতে সর্ব প্রথমে ইসলাম গ্রহণ করেন তাঁর সুখ-দুঃখের অংশীদার সতী-সাধবী স্ত্রী হযরত খাদিজা (রা)। এরপর তাঁদের পরিবারভুক্ত হযরত আলী (রা) ও হযরত যায়দ ইবন হারিসা (রা) ইসলাম গ্রহণ করেন। পরিবারের বাইরে এবং বয়ঃপ্রাপ্ত পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন হযরত আবুবকর (রা)। তিনি ছিলেন রাসুল(স)-এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এরপর আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ পেয়ে তিনি প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করেন। এতে মূর্তি পূজারিরা তাঁর ঘোর বিরোধিতা শুরু করে। মহানবি(স) ও তাঁর সাহাবিদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাতে থাকে। তারা মহানবি (স) কে নানা রকম প্রলোভনও দেখাতে থাকে । নেতৃত্ব ও ধন-সম্পদ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। রাসুল (স) স্পষ্টভাবে তাদেরকে জানিয়ে দেন, “আমার এক হাতে সূর্য, আর এক হাতে চাঁদ এনে দিলেও আমি এ সত্য প্রচার থেকে বিরত হব না।”
তিনি বললেন, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। ইবাদত করতে হবে একমাত্র তাঁরই। তিনি এক, অদ্বিতীয়। তাঁর কোনো শরিক নেই। তিনি আরও বললেন, তোমাদের হাতে বানানো দেবদেবীর ও প্রতিমার কোনো ক্ষমতা নেই। এদের ভালোমন্দ করার কোনো শক্তিই নেই। আসমান-জমিন, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র সবকিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ। তিনিই সবকিছুর স্রষ্টা, পালনকারী ও রিজিকদাতা। তিনিই আমাদের জীবন- ন-মৃত্যুর মালিক। সুতরাং দাসত্ব, আনুগত্য ও ইবাদত করতে হবে একমাত্র তাঁরই।
তিনি আরও বললেন, তোমরা সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের পথে ফিরে এসো। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, জুয়া, ব্যভিচার, মিথ্যা, প্রতারণা এসবই পাপের কাজ। সুতরাং এগুলো পরিহার করো। কারো প্রতি অন্যায়-অবিচার করবে না। অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করবে না। অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ হরণ করবে না। কারো প্রতি জুলুম করবে না ৷
মহানবি (স) আরও বোঝালেন, তোমাদের দুনিয়ার জীবনই শেষ নয়। মৃত্যুর পরে আরও এক জীবন আছে,তাকে বলে পরকাল । সে জীবন অনন্তকালের। পরকালে আল্লাহর দরবারে দুনিয়ার ভালোমন্দ সব কাজের জন্য হিসাব দিতে হবে।
দুনিয়ার জীবনে যারা আল্লাহ ও রাসুলের কথা মানবে, ভালো কাজ করবে, পরকালে তারা মুক্তি পাবে। চিরসুখের স্থান জান্নাত লাভ করবে। আর যারা আল্লাহ ও রাসুলের কথা মানবে না, মন্দ কাজ করবে, তারা চরম শাস্তির স্থান জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।
নবুয়তের দশম বছরে মহানবি (স)-এর প্রিয়তমা সহধর্মিনী হযরত খাদিজা (রা) ও তাঁর স্নেহপরায়ণ চাচা আবু তালিব ইন্তিকাল করেন। এতে তিনি শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। সীমাহীন শোক ও কাফেরদের অকথ্য অত্যাচারের মুখেও তিনি দীন প্রচার করতে থাকেন। তিনি মক্কাবাসীদের থেকে এক রকম নিরাশ হয়েই দীন প্রচারের জন্য তায়েফ গমন করেন। সেখানকার লোকেরা ইসলাম গ্রহণতো করলই না, বরং তারা প্রস্তরাঘাতে মহানবি (স)-এর পবিত্র শরীর ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত করে ছাড়ল। মহানবি (স) এমন সময়ও তায়েফবাসীদের জন্য বদদোয়া করলেন না। বরং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলেন। ইতিহাসে এমন ক্ষমার দৃষ্টান্ত বিরল।
মক্কার কাফেরদের সীমাহীন অত্যাচার ও তায়েফবাসীর দুর্ব্যবহারে মহানবি (স) অত্যন্ত মর্মাহত ও ব্যথিত হলেন। তখন আল্লাহ্ তায়ালা তাঁকে নিজের সান্নিধ্যে নিয়ে গেলেন। তিনি মিরাজে গমন করলেন। তিনি আল্লাহ পাকের দিদারে ধন্য হলেন। নবুয়তের একাদশ সনে রজব মাসের ২৭ তারিখে আল্লাহ তায়ালা মহানবি (স)-কে মসজিদে হারাম থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস এবং সেখান থেকে ঊর্ধ্বলোকে ভ্রমণ করিয়ে আনেন। একেই বলে মিরাজ।
এই ভ্রমণে বায়তুল মুকাদ্দাসে তিনি পূর্ববর্তী নবিগণের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং তাঁদের ইমাম হয়ে সালাত আদায় করেন। সেখান থেকে সাত আসমান অতিক্রম করে আল্লাহ তায়ালার দিদার লাভ করেন। তিনি আল্লাহর নিকট থেকে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের নির্দেশ পান। মিরাজ মহানবি (স)-এর জীবনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এতে তিনি নতুন প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে পূর্ণ উদ্যমে দীন প্রচার করতে থাকেন। এই সফরে জান্নাত- জাহান্নাম দর্শন করে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করেন।
৬২১ খ্রিস্টাব্দে হজের মৌসুমে মদিনা থেকে ১২ জন লোকের একটি দল মক্কায় আসেন এবং গোপনে মহানবি (স)-এর সাথে সাক্ষাৎকরে ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তী বছর ঐ সময় মদিনা থেকে ২ জন মহিলাসহ ৭৫ জনের একটি দল মক্কায় আসেন এবং আকাবায় মহানবি (স)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁরা মহানবি (স) ও সাহাবিদের মদিনায় হিজরতের আহ্বান জানান এবং সব রকম সাহায্য সহযোগিতা দেওয়ার অঙ্গীকার করেন।
মক্কার কাফিরদের বিরোধিতা ও নির্যাতনের মাত্রা যখন বেড়ে গেল এবং মক্কায় ইসলাম প্রচার বাঁধাগ্রস্ত হলো, তখন মহানবি (স) সাহাবিগণকে মদিনায় হিজরতের নির্দেশ দিলেন এবং নিজে আল্লাহর আদেশের অপেক্ষায় রইলেন ৷
কাফেররা দেখল যে, মুসলমানরা মক্কা ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাচ্ছে। নবি করিম (স) হয়তো এক ফাঁকে দেশ ছেড়ে চলে যাবেন, তাদের শিকার হাত ছাড়া হয়ে যাবে। সকল গোত্র সম্মিলিতভাবে মহানবি (স) কে হত্যার সিদ্ধান্ত নিল। এক রাতে তারা নবি করিম (স) -এর ঘর অবরোধ করল এবং প্রত্যুষে তাঁকে হত্যা করার অপেক্ষায় থাকল । আল্লাহ তায়ালা নবিকে কাফেরদের চক্রান্তের কথা জানিয়ে দিলেন এবং মদিনায় হিজরতের নির্দেশ দিলেন। হিজরত অর্থ ‘দেশ ত্যাগ’। মহানবি (স) হযরত আবু বকর (রা) কে সঙ্গে নিয়ে মদিনায় রওয়ানা হলেন। গচ্ছিত সম্পদ মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য মহানবি (স) হযরত আলী (রা) কে তাঁর ঘরে রেখে যান। কাফেররা ঘরে ঢুকে নবি করিম (স)কে না পেয়ে এবং তাঁর বিছানায় আলীকে দেখতে পেয়ে ক্রোধে অধীর হলো। কিন্তু নবি করিম (স)-এর আমানতদারি দেখে তারা মনে মনে লজ্জিত হলো। মহানবি (স) ও আবু বকর সিদ্দীক (রা) কিছুদূর অগ্রসর হয়ে মক্কার সাওর পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিলেন। কাফেররা তাঁদের খুঁজতে খুঁজতে একেবারে গুহার মুখে হাজির হলো। আবু বকর (রা) গুহার মুখে কাফেরদের গতিবিধি লক্ষ্য করে বিচলিত হলেন। মহানবি (স) বললেন, “আবু বকর! চিন্তা করো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন”।
তিনদিন গুহায় অবস্থানের পর মহানবি (স) ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর মদিনায় পৌঁছান। মদিনার আবাল বৃদ্ধ বনিতা পরম আগ্রহ ও ভালোবাসায় মহানবি (স) কে গ্রহণ করলেন, মদিনার ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। নবিজির হিজরত ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর মাধ্যমে ইসলাম নতুন গতি ও নতুন শক্তি লাভ করে।
মহানবি (স) মুহাজির ও আনসারদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করেন। মুহাজির মানে- হিজরতকারী। মক্কা থেকে হিজরত করে যাঁরা মদিনায় যান তাঁদেরকে বলা হয় মুহাজির। আর মুহাজিরদের মদিনায় যারা আশ্রয় ও সাহায্য সহযোগিতা দিলেন, তাঁরা হলেন আনসার। আনসার মানে—সাহায্যকারী।
মহানবি (স) মদিনায় হিজরত করে একটি আদর্শ সমাজ ও আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হলেন। এখানে মুহাজির, আনসারসহ সকল মুসলমান এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী-ইহুদি, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য মতাদর্শের লোক একত্রে মিলেমিশে সুখে-শান্তিতে নিরাপদে বাস করবে। তাদের মধ্যে শান্তি, সম্প্রীতি বজায় থাকবে এবং স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্মকর্ম পালন করতে পারবে। সঙ্গে সঙ্গে মদিনার নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে এই উদ্দেশ্যে, তিনি সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি লিখিত চুক্তি সম্পাদন করেন। এটিই মদিনা সনদ নামে খ্যাত এবং এটিই পৃথিবীর সর্বপ্রথম লিখিত সনদ। এই সনদে ৪৭টি ধারা ছিল। যেমন-
১. সকল সম্প্রদায় স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। ধর্মীয় ব্যাপারে কেউ কারও ওপর হস্তক্ষেপ করবে না।
২. সনদে স্বাক্ষরকারী সকল সম্প্রদায়কে নিয়ে একটি সাধারণ জাতি গঠিত হবে এবং সকলে সমান নাগরিক সুবিধা ভোগ করবে।
৩. কেউ অপরাধ করলে তা তার ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে; সে জন্য গোত্র বা সম্প্রদায় দায়ী হবে না।
৪. হত্যা, রক্তারক্তি, ব্যভিচার ইত্যাদি পাপকর্ম নিষিদ্ধ করা হলো, মদিনা শহরকে পবিত্র বলে ঘোষণা করা হলো।
৫. হযরত মুহাম্মদ (স)-এর পূর্ব অনুমতি ব্যতীত কেউ কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না ।
৬. সম্পদ্রায়গুলোর মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে মহানবি (স) তা মীমাংসা করে দিবেন ইত্যাদি।
মদিনার সনদ হযরত মুহাম্মদ (স)-এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, কুটনৈতিক দূরদর্শিতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং সুন্দর সমাজ গঠনের এক জ্বলন্ত স্বাক্ষর বহন করে। এতে বিভিন্ন জাতির ধর্মীয় স্বাধীনতা ও আর্থ-সামাজিক অধিকার নিশ্চিত হয়।
মক্কার কাফির-মুশরিকরা চেয়েছিল ইসলাম ও মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে। মদিনায় ইসলামের উত্তরোত্তর উন্নতি দেখে তারা হিংসায় জ্বলে ওঠে। মদিনার ইহুদিরা তাদের প্ররোচিত করছিল। আবার আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলা মুসলমানদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার গুজব উঠেছিল।
কাফেররা মদিনা আক্রমণের জন্য রওয়ানা হলো। সংবাদ পেরে রাসুল (স) ৩১৩ জন সাহাবিসহ মদিনা থেকে প্রায় ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বদর নামক স্থানে উপস্থিত হন । দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমযান (৬২৪ খ্রিস্টাব্দ) বদর প্রান্তরে দুই পক্ষ পরস্পর মুখোমুখী হলো। কুরাইশ বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা এক হাজার। অস্ত্রশস্ত্র বেশুমার। মুসলিমদের সংখ্যা নগণ্য। অস্ত্রশস্ত্র তেমন কিছু নেই। কিন্তু তাঁরা ইমানের বলে বলীয়ান। তাদের আল্লাহর ওপর অকৃত্রিম বিশ্বাস ও ভরসা। তুমুল যুদ্ধ হলো। মুসলিম বাহিনী বিজয়ী হলো।
বদর যুদ্ধে কুরাইশ নেতা আবু জাহেল, ওলীদ, উৎবা ও শায়বাসহ ৭০ জন মারা যায় এবং ৭০ জন বন্দি হয়। মুসলিম পক্ষে ১৪ জন শহিদ হন, কেউ বন্দি হন নি। রাসুল (স) মুসলিমগণ যুদ্ধ বন্দিদের সাথে উদার ও মানবিক আচরণ করেছিলেন। নিজেরা না খেয়ে বন্দিদের খাওয়াতেন। নিজেরা পায়ে হেঁটে বন্দিদের বাহনের ব্যবস্থা করতেন। বদি যুক্তির চমৎকার ব্যবস্থা করেছিলেন। শিক্ষিত বন্দিদের মুক্তিপণ নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০ জন করে নিরক্ষর মুসলিম বালক-বালিকাদের শিক্ষিত করা। এটি শিক্ষাবিস্তারে রসুল (স)-এর প্রচেষ্টারই অংশ। এ যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। স্বল্পসংখ্যক মুসলিম বাহিনীর হাতে কাফেরদের বিরাট বাহিনী পরাজিত হয়। এতে কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার হয়।
বদর যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পরেও কাফেররা দমে গেল না। তারা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে বারবার আক্রমণ চালাতে লাগল । এরমধ্যে ওহুদ ও খন্দকের যুদ্ধ ছিল ভয়াবহ। এসব যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় হলেও ওহুদ যুদ্ধে সামান্য ভুলের জন্য মুসলমানদের অনেক ক্ষতি হয়েছিল। ৭০ জন সাহাবা শাহাদত বরণ করেন। মহানবি (স)-এর পবিত্র দাঁত ভেঙে যায় ।
হিজরী ৬ সনে (৬২৮ খ্রিস্টাব্দে) রাসুল (স) উমরা পালনের উদ্দেশ্যে ১৪০০ জন সাহাবিসহ মক্কা যাত্রা করেন এবং মক্কার ৯ মাইল দূরে হুদাইবিয়া নামক স্থানে উপনীত হন। কুরাইশরা উমরা পালনে বাধা দেয়। রাসুল (স) জানালেন আমরা যুদ্ধের জন্য আসিনি, শুধু উমরা করেই চলে যাব। কিন্তু কুরাইশরা তাতেও রাজি হলো না। রাসুল (স) মক্কাবাসীদের কাছে উসমান (রা) কে দূত হিসেবে পাঠান। তাঁর ফিরে আসতে বিলম্ব হওয়ায় তিনি শহিদ হয়েছেন বলে রব ওঠে। রাসুল (স) মুসলমানদের থেকে এই হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ নেন। কাফেররা ভীত হয়ে উসমান (রা) কে ফেরত দেয় এবং সুহাইল আমরকে সন্ধির প্রস্তাবসহ পাঠায়। দশ বছরের জন্য সন্ধি হয়। এটিই হুদাইবিয়ার সন্ধি নামে খ্যাত ৷
সন্ধির শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম শর্ত ছিল:
১. মুসলমানগণ এ বছর উমরা না করেই ফিরে যাবেন, আগামী বছর নিরস্ত্রভাবে ৩ দিনের জন্য আসবেন,
২. কোনো মক্কাবাসী মদিনায় আশ্রয় নিলে তাকে মক্কায় ফেরত দিতে বাধ্য থাকবেন, কিন্তু কেউ মদিনা থেকে মক্কায় আসলে তাকে ফেরত দেওয়া হবে না। আরবের যে কোনো গোত্র দুপক্ষের যে কারো সাথে মিত্রতা করতে পারবে ইত্যাদি।
আপাতদৃষ্টিতে এই সন্ধির শর্তগুলো মুসলমানদের জন্য অপমানজনক মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে সুফল বয়ে এনেছিল । এতে কাফেররা মুসলমানদের একটি শক্তিধর স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে মেনে নেয়। দেশ-বিদেশে ইসলাম প্রচারের সুযোগ হয়। দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। একে কুরআনে ‘প্রকাশ্য বিজয়' বলা হয়েছে।
কুরাইশ ও তাদের মিত্র বনু বকর হুদাইবিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করে মুসলমানদের মিত্র খুবআ গোত্রকে আক্রমণ করে, তাদের মালামাল লুট করে এবং অনেককে আহত ও নিহত করে। রাসুল (স)-এর শান্তি প্রস্তাব গ্রহণ না করে তারা সন্ধি বাতিল করে।
৮ম হিজরির রমযান মাসে মহানবি (স) দশ হাজার সাহাবি নিয়ে মক্কা বিজয়ের জন্য যাত্ৰা করেন। হঠাৎ এতো বড় মুসলিম বাহিনী দেখে কুরাইশরা ভয় পেয়ে গেল। অবস্থা বেগতিক দেখে কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান মহানবি (স) কে মক্কায় স্বাগত জানায়। মহানবি (স) প্রায় বিনাবাধায় একেবারে বিনা রক্তপাতে মক্কা জয় করেন।
যে মক্কাবাসী একদিন মহানবি (স) ও মুসলমানদের নির্মম নির্যাতন করেছিল, মহানবি (স) কে হত্যা করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল, যাঁকে জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল, মদিনায়ও তাকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। সেই মক্কায় তিনি বিজয়ীর বেশে হাজির হন। তিনি এখন মক্কার একচ্ছত্র অধিপতি। আর মক্কাবাসী তাঁর সামনে অপরাধীর বেশে দণ্ডায়মান ৷
মহানবি (স) জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা আমার কাছে কেমন ব্যবহার প্রত্যাশা করছ?”
তারা বলল, “আজ আপনি আমাদের যে কোনো শাস্তি দিতে পারেন, তবে আপনি তো আমাদের দয়ালু ভাই ও দয়ালু ভাইয়ের পুত্র, আপনার কাছে আমরা দয়াপূর্ণ ব্যবহারই প্রত্যাশা করছি।”
রাসুল (স) বললেন, “আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই, যাও তোমরা মুক্ত, স্বাধীন।”
মহানবি (স) সবাইকে ক্ষমা করেছিলেন। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানকেও ক্ষমা করেছিলেন। এই আবু সুফিয়ান উহুদ যুদ্ধে কাফেরদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এতে মহানবি (স)-এর দাঁত শহিদ হয়েছিল। তাঁর প্রিয় চাচা হযরত হামযা (রা) শহিদ হয়েছিলেন। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তাঁর কলিজা চর্বন করেছিল। তিনি তাকেও ক্ষমা করেছিলেন। ক্ষমার এ এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত ৷
মহানবি (স) দশম হিজরিতে হজ পালনের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। এটা ছিল তাঁর জীবনের শেষ হজ। তিনি এরপর আর হজ করার সুযোগ পাননি। তাই একে বিদায় হজ বলে।
মহানবি (স) লক্ষাধিক সাহাবি নিয়ে হজ আদায় করেন। এই হজেই তিনি আরাফাত ময়দানে জাবালে রহমতে দাঁড়িয়ে উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে এক মর্মস্পর্শী ভাষণ দেন। এটিই ইসলামের ইতিহাসে বিদায় হজের ভাষণ নামে খ্যাত।
এই ভাষণে মহানবি (স) সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে অনেক মূল্যবান কথা বলেছেন। যেমন—
১. সকল মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই।
২. আজকের এদিন, এস্থান, এমাস যেমন পবিত্র, তেমনি তোমাদের পরস্পরের জানমাল ও ইজ্জত-আবরু পরস্পরের নিকট পবিত্র ।
৩. অধীনস্থদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে। তোমরা যা খাবে, তাদেরও তা খাওয়াবে। তোমরা যা পরবে তাদেরও তাই পরাবে।
৪. একের অপরাধে অন্যকে শাস্তি দেবে না ।
৫. ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সর্বপ্রকার সুদ হারাম করা হলো। সকল সুদের পাওনা বাতিল করা হলো।
৬. নারীর ওপর পুরুষের যেমন অধিকার আছে, পুরুষের ওপর নারীরও তেমন অধিকার আছে।
৭. জাহেলি যুগের সকল কুসংস্কার ও হত্যার প্রতিশোধ বাতিল করা হলো
৮. আমানতের খিয়ানত করবে না, গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকবে। মনে রাখবে একদিন সকলকে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে হবে এবং তাঁর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
৯. আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর বাণী (আল কুরআন) এবং তাঁর রাসুলের আদর্শ (হাদিস) রেখে যাচ্ছি,তোমরা এই দুইটি যতদিন আঁকড়ে থাকবে, ততোদিন তোমরা বিপথগামী হবে না।
তিনি আরও অনেক মূল্যবান কথা বললেন।
এরপর মহানবি (স) আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “হে আল্লাহ! তোমার বাণীকে আমি যথাযথভাবে মানুষের নিকট পৌঁছাতে পেরেছি?”
উপস্থিত লক্ষ জনতা সমস্বরে জবাব দিলেন, “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।”
মহানবি (স) বললেন, “হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো । ”
এরপর অবতীর্ণ হলো “আমি আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম । ইসলামকে তোমাদের জন্য একমাত্র জীবন ব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম।” (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত : ৩)
বিদায় হজ থেকে ফেরার পর মহানবি (স) অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে হিজরি একাদশ সালের ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসুল (স) ইন্তিকাল করেন।
মদিনা শরিফে মসজিদে নববির এক পাশে তাঁকে কবর দেওয়া হয়। বিশ্বের মুসলমানগণ ভক্তিভরে নবির রওজা জিয়ারত করেন।
মহানবি (স) ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের মানুষ। ক্ষমা, উদারতা, ধৈর্য-সহিষ্ণুতা, সততা, সত্যবাদিতা, দয়া, দানে, কাজে-কর্মে, আচার-আচরণে, মানবতা ও মহত্ত্বে তিনি ছিলেন সর্বকালের সকল মানুষের জন্য উত্তম আদর্শ। আল্লাহ তায়ালা বলেন :
বাংলা উচ্চারণ: লাকাদ কানা লাকুম ফী রাসুলিল্লাহি উসওয়াতুন হাসানাতুন। অর্থ ‘রাসুলুল্লাহ (স)-এর জীবনে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ রয়েছে।' (সূরা আহযাব, আয়াত : ২১) আমরা মহানবি (স)-এর জীবনাদর্শ মেনে চলব ।
কুরআন মজিদে উল্লিখিত নবি-রাসুলগণের নাম:
১. হযরত আদম (আ) ১৪. হযরত সুলাইমান (আ)
২. হযরত নূহ (আ) ১৫. হযরত মূসা (আ)
৩. হযরত সালিহ (আ) ১৬. হযরত হারুন (আ)
8. হযরত লূত (আ) ১৭. হযরত ইলিয়াস (আ)
৫. হযরত ইদরীস (আ) ১৮. হযরত আইয়ুব (আ)
৬ হযরত হূদ (আ) ১৯. হযরত ইউনুস (আ)
৭. হযরত ইবরাহীম (আ) ২০. হযরত জাকারিয়া (আ)
৮. হযরত ইসমাঈল (আ) ২১. হযরত ইয়াহিয়া (আ)
৯. হযরত ইসহাক (আ) ২২. হযরত যুলকিফল (আ)
১০. হযরত ইয়াকুব (আ) ২৩. হযরত আলা ইয়াসাআ (আ)
১১. হযরত ইউসুফ (আ) ২৪. হযরত ঈসা (আ)
১২. হযরত শুআইব (আ.) ২৫. হযরত মুহাম্মদ (স)
১৩. হযরত দাউদ (আ)
পরিকল্পিত কাজ :
১ কুরআন মজিদে উল্লিখিত নবি-রাসুলের নামের তালিকা তৈরি করবে।
২. মহানবি (স)-এর একটি সংক্ষিপ্ত জীবন বিবরণী তৈরি করবে।
আল্লাহ তায়ালা মাটি দিয়ে মানবদেহ তৈরি করলেন। তাতে আত্মা দিলেন। এরপর এই দেহ প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। ইনিই হলেন পৃথিবীর আদি মানব হযরত আদম (আ)।
আল্লাহ ফেরেশতাদের আদেশ দিলেন: “আদম তোমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তোমরা তাঁকে সম্মান জানাও। তাঁর সম্মানে তাঁকে সিজদাহ্ কর।” সবাই তাঁকে সম্মান দেখাল। তাঁকে সিজদাহ্ করল। তবে এই ফেরেশতাদের সাথে ছিল এক জিন। নাম তার আজাজিল। সে আদমকে সিজদাহ্ করল না। সে বলল: আমি আগুনের তৈরি। আদম মাটির তৈরি। আমি আদম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আমি তাকে সম্মান করব না। সিজদাহ্ করব না। সে আদমকে সিজদাহ্ করল না।
আজাজিল ছিল অহংকারী। আল্লাহ অহংকারীকে ভালোবাসেন না। আল্লাহ আজাজিলের ওপর অসন্তুষ্ট হলেন। আজাজিল হয়ে গেল শয়তান। নাম হলো তার ইবলিস। ইবলিস আল্লাহর আদেশ অমান্য করার দরুন অভিশপ্ত শয়তান হয়ে গেল ৷
আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (আ) কে জান্নাতের মধ্যে থাকতে দিলেন। আদম জান্নাতে আরাম-আয়েশ ও সুখ-শান্তিতে থাকতে লাগলেন। কিন্তু এই অফুরন্ত আরাম- আয়েশের মধ্যেও তিনি নিঃসঙ্গ অনুভব করছিলেন। তাই দয়াময় আল্লাহ হযরত আদম (আ)-এর এক সঙ্গিনী বানালেন। নাম তাঁর হাওয়া (আ)।
আল্লাহ তাঁদের বললেন : “তোমরা উভয়ে জান্নাতে থাক। খুশিমতো পানাহার করো, আরাম-আয়েশ ও আনন্দ উপভোগ করো। কিন্তু সাবধান! কখনও এ গাছটির কাছে যেও না। যদি যাও তাহলে খুবই অন্যায় হবে। দারুণ ক্ষতি হবে।”
হযরত আদম (আ) এবং হযরত হাওয়া (আ) আল্লাহর হুকুম মেনে জান্নাতের মধ্যে মনের সুখে দিন কাটাতে লাগলেন। কিন্তু শয়তান ইবলিস অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পথ খুঁজতে লাগল। সে জান্নাতে প্রবেশ করে তাঁদের ক্ষতি করার ফন্দি আঁটল। অবশেষে একদিন তাঁদের ধোঁকা দিল। ঐ নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়াতে সক্ষম হলো। তাঁরা ইবলিসের প্ররোচনায় ঐ ফল খেয়ে আল্লাহর আদেশ অমান্য করলেন।
আল্লাহর আদেশ অমান্য করায় আল্লাহ তাঁদের ওপর ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেন। তিনি তাঁদের জান্নাত থেকে বের করে দিলেন। তাঁদের দুজনকে পৃথিবীতে নামিয়ে দিলেন। তাঁরা পৃথিবীতে এসে নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেন। অনেক দিন যাবৎ সবসময় কাঁদতে থাকলেন। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে লাগলেন। তওবা করতে থাকলেন ।
অবশেষে আল্লাহ তায়ালা তাঁদের দোয়া কবুল করলেন। তাঁদেরকে ক্ষমা করে দিলেন। তাঁদের তওবা কবুল করলেন। তাঁরা পৃথিবীতে নতুন জীবন শুরু করলেন। সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে থাকলেন। তাঁদের সন্তান হলো। পৃথিবী মানুষে ভরে উঠল। শুরু হলো মানবজাতির পথযাত্রা ।
হযরত আদম (আ) আল্লাহর তাওহিদে বিশ্বাস করতেন। তিনি তাঁর সন্তানদের বললেন : “তোমাদের ও সারা বিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ। তিনি এক। তাঁর কোনো শরিক নেই। তোমরা শুধু তাঁরই ইবাদত করবে। তাঁরই কাছে মাথা নত করবে। তাঁরই কাছে সাহায্য চাইবে। তাহলে আল্লাহ তোমাদের শান্তি দেবেন। তোমরা জান্নাত লাভ করবে।
আর যদি তোমরা আল্লাহকে বিশ্বাস না কর। তাঁকে না মান। তাহলে দুঃখ পাবে। কষ্ট পাবে। আল্লাহ তোমাদের ওপর অসন্তুষ্ট হবে। তোমরা জাহান্নামের কঠিন শাস্তি ভোগ করবে।”
হযরত আদম (আ) ছিলেন প্রথম মানুষ এবং প্রথম নবি। আমরা সবাই তাঁর বংশধর। আমরা সবাই তাঁর জীবনাদর্শে উৎসাহিত হবো। আমরা ভুল বা অন্যায় করলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইব। তওবা করব। আমাদের সন্তানদের ইসলাম শিক্ষায় গড়ে তুলব । আল্লাহর ইবাদত করব। সর্বদা আল্লাহকে খুশি রাখব। তাহলে পৃথিবীতে আমরা সুখ পাব। শান্তি পাব। মৃত্যুর পরও শান্তি পাব। জান্নাত লাভ করব। জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাব।
পরিকল্পিত কাজ:
হযরত আদম (আ) তাঁর সন্তানদের যে উপদেশ বাণী দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা তা খাতায় সুন্দর করে লিখবে।
হযরত আদম (আ)-এর ইন্তিকালের পর কেটে গেল অনেক বছর। বেড়ে গেল অনেক মানুষ। আস্তে আস্তে মানুষ ভুলে গেল আল্লাহকে। লিপ্ত হলো তারা মূর্তি পূজায় । পৃথিবীতে অন্যায়-অত্যাচার বেড়ে গেল। বৃদ্ধি পেল ঝগড়া-মারামারি। অশান্তি আর অশান্তি। তখন আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির হিদায়াতের জন্য এক নবি পাঠালেন ৷ এই নবির নাম হযরত নূহ (আ) ৷
হযরত নূহ (আ) আল্লাহর আদেশে দীর্ঘ সাড়ে নয়শ বছর পৃথিবীতে আল্লাহর দীনের দাওয়াত দেন। তিনি মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকলেন। ভালো কাজ করতে বললেন। মন্দ ও খারাপ কাজ বর্জন করার উপদেশ দিলেন।
তিনি মানুষকে বললেন: “তোমরা আল্লাহর প্রতি ইমান আন। এক আল্লাহর ইবাদত কর, মূর্তিপূজা ত্যাগ কর। ভালো কাজ কর। মন্দ কাজ থেকে বিরত থাক। আখিরাতের জীবনের ওপর বিশ্বাস রাখ।” তাঁর এই দাওয়াতে মাত্র আশি জন নারী-পুরুষ সায় দিল। ইমান আনল। বাকি লোকজন তাঁর কথার গুরুত্ব দিল না। তাঁকে পাগল বলে উপহাস করল। কষ্ট দিতে লাগল। তারা কাফেরই থেকে গেল ।
হযরত নূহ (আ) দীর্ঘদিন তাদের অত্যাচারে অতিষ্ট হলেন। অবশেষে হতাশ ও বিরক্ত হয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, 'হে আল্লাহ! আমি তাদেরকে তোমার দীনের পথে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, কিন্তু তারা আমার কথায় সাড়া দেয় নি। আপনি আমাকে সাহায্য করুন। আপনি তাদের ধ্বংস করে দিন।’
আল্লাহ তায়ালা হযরত নূহ (আ)-এর দোয়া কবুল করলেন। আল্লাহ তাঁকে জানিয়ে দিলেন “কিছুদিনের মধ্যে তাদের ওপর আমার গজব নাজিল হবে। মহাপ্লাবন হবে। আল্লাহ তাঁকে একটি নৌকা তৈরি করতে বললেন। বলে দিলেন, গজবের আভাস দেখা দিলেই ইমানদার লোকজনদের নিয়ে নৌকায় উঠে যাবে। সাথে দরকারি আসবাবপত্রও নেবে।
হযরত নূহ (আ) আল্লাহর নির্দেশে এক বিরাট নৌকা তৈরি করলেন। আর সবাইকে শোনালেন: আল্লাহর কথা না মানার কারণে ভীষণ আজাব আসবে। সবাইকে হুঁশিয়ার করলেন। কিন্তু লোকজন তাঁর কথা শুনল না। সৎপথে এলো না। তারা হযরত নূহ (আ) কে আরও বেশি বেশি ঠাট্টা উপহাস করতে লাগল। তারা বলতে থাকল: “এ মরুভূমিতে কীভাবে নৌকা ভাসবে ?”
অবশেষে সত্যি সত্যি তুফানের আলামত দেখা দিল। মাটি ফুঁড়ে পানি বের হলো। শুরু হলো প্রবল ঝড় ও বৃষ্টি। বন্যা আসল। হযরত নূহ (আ) তাঁর ইমানদার লোকজনসহ নৌকায় আরোহণ করলেন। আরও নিলেন প্রতিটি জীবজন্তুর এক এক জোড়া এবং প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র। তিনি নৌকা ছাড়ার আগে নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়লেন :
অর্থ : আল্লাহর নামে এটি চলবে এবং আল্লাহর নামে এটি থামবে। আমার প্রতিপালক অবশ্যই ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।
পানি বেড়েই চলল,আরও প্রবল হলো ঝড় ও বৃষ্টি। নৌকা সবকিছু নিয়ে পাহাড়ের মতো ঢেউয়ের মধ্যেও চলতে লাগল। চল্লিশ দিন পর্যন্ত মুষলধারে বৃষ্টি হলো। মাটি থেকেও প্রবল বেগে পানি উঠল। সবকিছু পানিতে ডুবে গেল। কাফেররা পানিতে ডুবে যাওয়ার ভয়ে পাহাড়ের ওপর আরোহণ করল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সকল পাহাড় ডুবে গেল। তখন কাফেররা আর যাবে কোথায়? সকলে পানিতে ডুবে মারা গেল। কাফেররা ধ্বংস হলো। এমনকি হযরত নূহ (আ)-এর ছেলে কেনান আল্লাহ ও নবির কথা অমান্য করায় পানিতে ডুবে মারা গেল। কেউ বাঁচতে পারল না।
এদিকে হযরত নূহ (আ) তাঁর দলবলসহ আল্লাহর রহমতে পানির ওপরে নৌকাতে ভাসতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর আদেশে পানি আস্তে আস্তে কমে গেল। নৌকা জুদি পাহাড়ে এসে থামল। হযরত নূহ (আ) লোকজন, জীবজন্তু ও অন্যান্য সবকিছু নিয়ে নৌকা থেকে নেমে আসলেন। পৃথিবী আগের মতো আবার সবুজ শ্যামল হয়ে উঠল। তাঁরা পৃথিবীতে আবার নতুন জীবন শুরু করলেন।
হযরত নূহ (আ) ছিলেন সত্য ও ন্যায় প্রচারে আপোষহীন। প্রচুর বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও তিনি সত্য প্রচার থেকে একটুও পিছু হটেননি। আল্লাহর দীন প্রচারের জন্য তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন।
আমরা তাঁর জীবনাদর্শ অনুকরণ ও অনুসরণ করব। আল্লাহর দীন প্রচারের জন্য আমরা সারাজীবন পরিশ্রম করব। আল্লাহর দীন প্রচারের জন্য শত বাধাবিপত্তি আসলেও আমরা পিছু হটব না। আমরা আল্লাহর ইবাদত করব। আর সকলকে আল্লাহর দীন মানার জন্য উৎসাহিত করব। যদি আমরা আল্লাহর আদেশ অমান্য করি তাহলে ধ্বংস হয়ে যাব । আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হব।
পরিকল্পিত কাজ:
হযরত নূহ (আ)-এর জীবনাদর্শ শিক্ষার্থীরা খাতায় সুন্দর করে লিখবে।
প্রায় চার হাজার বছর আগের কথা। ইরাক দেশের বাবেল শহরে এক পুরোহিত পরিবারে হযরত ইবরাহীম (আ) জন্মগ্রহণ করেন। সেখানকার লোকেরা মূর্তিপূজা করত। মানুষকে প্রতারিত করত। পুরোহিতগণ রাজা-বাদশাহের সহযোগিতায় জনগণের ওপর অত্যাচার করত। তারা ভাগ্যের ভালোমন্দ জানার জন্য গণকদের শরণাপন্ন হত। গণকদের প্রতি ছিল তাদের অগাধ বিশ্বাস। তারা চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদি সবকিছুর পূজা করত ।
হযরত ইবরাহীম (আ) বাল্যকাল থেকেই মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি দেখলেন, চন্দ্র-সূর্য প্রতিদিন একই দিকে উদয় হয় এবং অস্ত যায়। মূর্তিতো নিজেদের হাতে গড়া। দেশের বাদশাহ আমাদের মতো একজন সাধারণ মানুষ। মানুষ কেন এদের পূজা করবে? এদের কাছে মাথা নত করবে? আমাদের জীবন-মৃত্যু, সুখ-দুঃখ এদের কারো হাতে নেই। আমরা এদেরকে 'রব' বলে স্বীকার করব কেন? বস্তুত আমাদের ‘রব’ একমাত্র আল্লাহ, যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তাঁর হাতেই সকলের জীবন-মৃত্যু। আমরা একমাত্র সেই আল্লাহরই ইবাদত করি।
হযরত ইবরাহীম (আ)-এর আমলে সেখানকার বাদশাহ ছিল নমরুদ। নমরুদ ছিল নির্মম অত্যাচারী বাদশাহ। হযরত ইবরাহীম (আ)-এর পিতার নাম ছিল আজর। আজর ছিলেন মূর্তি উপাসক। হযরত ইবরাহীম (আ) স্বীয় পিতা ও অন্য সবাইকে বোঝালেন মূর্তি পূজা করা ঠিক নয়। কিন্তু তারা মানল না। তারা তাঁর বিরুদ্ধে বাদশাহ নমরুদের কাছে নালিশ করল। বাদশাহ নমরূদের দরবার থেকে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো – হযরত ইবরাহীম (আ) কে আগুনে পুড়িয়ে মারা হবে। তাদের এ ভয়াবহ সিদ্ধান্তে তিনি একটুও বিচলিত হলেন না। আল্লাহর ওপর তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল।
নমরূদ হযরত ইবরাহীম (আ) কে মেরে ফেলার জন্য বিশাল অগ্নিকুণ্ড তৈরি করল। আর সেই জ্বলন্ত আগুনে তাকে ফেলে দেওয়া হলো। কিন্তু আল্লাহর আদেশে আগুন ঠাণ্ডা হয়ে গেল। হযরত ইবরাহীম (আ) অগ্নিদগ্ধ হওয়া থেকে রেহাই পেলেন। তাঁর কোনো ক্ষতি হলো না। কোনো কষ্ট হলো না। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে বাঁচালেন। তাঁকে রক্ষা করলেন। রাখে আল্লাহ মারে কে! আল্লাহ বললেন :
”হে আগুন। ইবরাহীমের জন্য তুমি ঠাণ্ডা হয়ে যাও। আরামদায়ক হয়ে যাও।”
হযরত ইবরাহীম (আ) মানুষকে আবার আল্লাহর পথে ডাকা শুরু করলেন। এবারেও তাঁর কথা কেউ শুনল না। বরং তাঁর ওপর অত্যাচার শুরু করল। শেষ পর্যন্ত তিনি স্বদেশ ইরাক ত্যাগ করে সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনে চলে গেলেন। সেখানে তিনি আল্লাহর দীন প্রচার করতে থাকেন। তিনি বলতে থাকেন, এক আল্লাহ ছাড়া কোনো ‘রব’ নেই, মাবুদ নেই। তোমরা সকলে আল্লাহর ইবাদত কর। এভাবেই তাঁর যৌবনকাল অতিবাহিত হলো।
হযরত ইবরাহীম (আ)-এর জীবনের শেষ ভাগ। ৮৬ বছর বয়স। আল্লাহর রহমতে তাঁর পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর দুই পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ) এবং হযরত ইসহাক (আ) নবি ছিলেন। একদা হযরত ইবরাহীম (আ) আল্লাহর আদেশে শিশু ইসমাইল ও তাঁর মা হাজেরাকে মক্কায় নির্বাসন দিয়ে আসলেন। জনমানবহীন পাহাড় ঘেরা মরু উপত্যকা মক্কা। আল্লাহর কুদরতে সেখানে পাথর ফেটে পানি বের হলো। সৃষ্টি হলো জমজম কূপ। পানির খবর পেয়ে সেখানে মানুষ বসবাস করতে লাগল। গড়ে উঠল জনবসতি। স্থাপিত হলো মক্কানগরী ।
আল্লাহ তায়ালা হযরত ইবরাহীম (আ) কে আদেশ দিলেন : 'তোমার প্রিয় বস্তুকে আমার নামে কুরবানি দাও।' তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আল্লাহকে খুশি করার জন্য তিনি তাঁর প্রিয়তম পুত্র ইসমাঈল (আ) কে কুরবানি দেবেন। তিনি পুত্রের গলায় ছুরি চালালেন। ঠিক এ সময় আল্লাহ খুশি হয়ে জান্নাত থেকে এক দুম্বা পাঠালেন। ইসমাঈল (আ)-এর পরিবর্তে দুম্বা কুরবানি হয়ে গেল । আল্লাহ এই কুরবানি প্রথা কিয়ামত পর্যন্ত চালু রাখলেন। হযরত ইবরাহীম (আ) এবং পুত্র ইসমাঈল (আ) মিলে এখানেই কাবাগৃহ নিৰ্মাণ করেন। তিনি আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও নবি। তাঁকে খলিলুল্লাহ বা আল্লাহর বন্ধু বলা হয়।
হযরত ইবরাহীম (আ) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যেসব ত্যাগ স্বীকার করেছেন, আমরাও আমাদের জীবনে সেগুলো বাস্তবায়িত করব।
পরিকল্পিত কাজ :
শিক্ষার্থীরা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর সময়ের লোকদের কার্যকলাপ খাতায় লিখবে।
হযরত দাউদ (আ) বনি ইসরাইল বংশে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তিনি মেষ চরাতেন । তিনি ছিলেন অসীম সাহসী এবং অসাধারণ বীরত্বের অধিকারী। তিনি বাদশাহ তালুতের সেনাপতি ছিলেন। তাঁর যুদ্ধ কৌশল ছিল অসাধারণ। তিনি সেনাপতি থাকাকালে আল্লাহদ্রোহী ও অত্যাচারী শাসক জালুতকে যুদ্ধে পরাজিত ও হত্যা করেছিলেন। বাদশাহ তাঁর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে স্বীয় কন্যাকে তাঁর সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। বাদশাহর মৃত্যুর পর তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তিনি অধিকাংশ সময় আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতেন। তিনি রাতে খুব কম ঘুমাতেন । প্রায় সারা রাত আল্লাহর ইবাদত করতেন। সালাত আদায় করতেন। আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করতেন। তিনি একদিন পর একদিন আল্লাহর উদ্দেশ্যে সাওম পালন করতেন।
তিনি একজন নবি ও রাসুল ছিলেন। তাঁর ওপর প্রসিদ্ধ আসমানি কিতাব ‘যাবুর' নাজিল হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন : “দাউদ (আ)-কে আমি যাবুর দান করেছি।”
তিনি আল্লাহর নির্দেশে দীনের দাওয়াত দিতে থাকেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল সুমধুর। তিনি যাবুর কিতাব তিলাওয়াত করতেন। তাঁর সুমধুর তিলাওয়াত বনের পশু-পাখিরাও শুনত। এমনকি নদী ও সাগরের মাছগুলোও তাঁর তিলাওয়াত শুনে মুগ্ধ হতো। তিনি এবং তাঁর পুত্র সুলায়মান (আ) পুশপাখিদের ভাষা বুঝতেন। তাদের সাথে কথাবার্তাও বলতে পারতেন।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ। তিনি ছিলেন সুশাসক ও সুবিচারক। জনগণ সব সময় তাঁর কাছ থেকে ন্যায় ও সুবিচার পেত। তাঁর বিচারব্যবস্থা ছিল নিখুঁত ও নিরপেক্ষ। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মানবদরদী। জনগণের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য তিনি ছদ্মবেশে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। অলিতে গলিতে ও বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে ঘুরে দেখতেন। তিনি রাজকোষ থেকে কোনো অর্থসম্পদ গ্রহণ করতেন না। তিনি আল্লাহর কুদরতে স্বহস্তে ইস্পাতের বর্ম বানাতেন। আর তা বিক্রি করে যা উপার্জন হতো তা দিয়ে নিজের সংসার চালাতেন। তিনি সত্তর বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন।
আমরা হযরত দাউদ (আ)-এর মত আল্লাহর ইবাদত করব এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করব। সুশাসক হব, জনগণের দুঃখ দুর্দশা মোচন করব। কারো কোনো ক্ষতি করব না। শুদ্ধ উচ্চারণে কুরআন তিলাওয়াত করব। সালাত আদায় করব। সাওম পালন করব। আল্লাহকে খুশি রাখব।
পরিকল্পিত কাজ : শিক্ষার্থীরা হযরত দাউদ (আ)-এর ন্যায়বিচার ও সুশাসনের বর্ণনা খাতায় সুন্দর করে লিখবে।
হযরত সুলায়মান (আ) ছিলেন হযরত দাউদ (আ)-এর পুত্র। তিনি নবি ও বাদশাহ ছিলেন। প্যালেস্টাইনে তাঁর রাজত্ব ছিল। ইসরাইলি বাদশাহগণের মধ্যে ক্ষমতায় ও শান শওকতে তিনিই ছিলেন শ্রেষ্ঠ।
তিনি জিন-পরী, পশু-পাখি, গাছপালার ভাষা বুঝতে পারতেন। আল্লাহর আদেশে এসব তাঁর অধীনে ছিল। এমনকি বাতাসও তাঁর অধীনে ছিল। আর আল্লাহর হুকুমে এসব কিছুই তাঁর নির্দেশ মেনে চলত। আল্লাহর রহমতে যাকে যা নির্দেশ দিতেন সে তা পালন করত। এত বড় বাদশাহ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মধ্যে কোনো অহংকার ছিল না।
তিনি আল্লাহর ইবাদত করতেন। তিনি অনেক ক্ষমতা ও শান-শওকতের মধ্যে থেকে ও আল্লাহকে ভুলে যাননি। তিনি বলতেন: “আল্লাহ এক। তাঁর কোন শরিক নেই। তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। কারো ওপর অন্যায়-অত্যাচার করো না। আল্লাহর শাস্তির ভয় করো।” তিনি সুশাসক ও সুবিচারক ছিলেন।
একটি ঘটনা
একদা দুইজন স্ত্রীলোকের প্রত্যেকেই একটি শিশুকে তার নিজের বলে দাবি করেন। তারা দুইজনে ঝগড়া করতে করতে মীমাংসা করার জন্য হযরত দাউদ (আ)-এর দরবারে উপস্থিত হন। হযরত দাউদ (আ) তাদের দুইজনের বক্তব্য শুনলেন। অতঃপর স্বীয় পুত্র হযরত সুলায়মান (আ) কে এর সুবিচার করে দিতে বললেন। হযরত সুলায়মান (আ) সব কথা শুনে বললেন যে, দুইজনই যখন শিশুটিকে তার নিজের বলে দাবি করছে, তখন এই শিশুটিকে দুখণ্ড করে উভয়ের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া উচিৎ। অতঃপর তিনি শিশুটিকে মাটিতে শুইয়ে দুখণ্ড করার জন্য তলোয়ারটি উঁচু করলেন। এমন সময় একজন মহিলা চিৎকার দিয়ে বললেন, “আমি শিশুটির মা নই। ঐ মহিলাটি শিশুর মা। আপনি তাকেই শিশুটি দিয়ে দিন। দয়া করে শিশুটিকে কাটবেন না।” তখন সুলায়মান (আ) বিচারের রায়ে বললেন: যে মহিলাটি আমাকে হত্যা করতে বাধা দিয়েছেন, তিনিই সত্যিকারের মা। সন্তানের জীবন রক্ষার জন্য তিনি মিথ্যা কথা বলেছেন। তিনি শিশুটিকে তার আসল মাকে দিয়ে দিলেন। আর নকল মাকে শাস্তি দেওয়া হলো। এটি সুবিচারের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
হযরত সুলায়মান (আ) আল্লাহর হুকুমে বৃদ্ধ বয়সে বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করেন। তিনি লাঠিতে ভর করে বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ কাজ তদারকি করেন। এ অবস্থায় তাঁর ইন্তিকাল হয়। বায়তুল মুকাদ্দাসের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তাঁর মৃতদেহটি জীবিত অবস্থায় যেভাবে ছিল সেভাবেই থাকে। নির্মাণ কাজ শেষ হলে তাঁর হাতের লাঠিটা ভেঙে যায়। আর তিনি মাটিতে পড়ে যান। তখন সকলে অবাক হয়। এভাবে আল্লাহর হুকুমে তিনি ইন্তিকাল করেন। আমরা আল্লাহর ইবাদত করব। ন্যায়পরায়ণ ও সৎ হব। আমরা অহংকারী হব না ।
পরিকল্পিত কাজ : শিক্ষার্থীরা হযরত সুলায়মান (আ)-এর সুবিচারের কাহিনীটি খাতায় লিখবে।
হযরত ঈসা (আ) ফিলিস্তিনের ‘বায়তুল লাহাম' নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। ‘বায়তুল লাহাম' স্থানটি বর্তমানে বেথেলহাম নামে পরিচিত। তাঁর আম্মার নাম হযরত মরিয়ম (আ)। আল্লাহর অসীম কুদরতে পিতা ছাড়াই হযরত মরিয়ম (আ)-এর গর্ভে হযরত ঈসা (আ) জন্মগ্রহণ করেন।
মহান আল্লাহর বিশেষ কুদরতে তিনি দোলনায় থাকাকালেই শিশু অবস্থায় কথাবার্তা বলার অলৌকিক শক্তি লাভ করেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে কিছু মোজেযা বা অলৌকিক ক্ষমতা দিয়েছিলেন। যেমন— তিনি আল্লাহর হুকুমে মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করতেন। জন্মান্ধকে চোখের দৃষ্টিশক্তি দান করতেন। ধবল, শ্বেত ও কুষ্ঠ রোগীদের তিনি আল্লাহর রহমতে রোগমুক্ত করে দিতেন।
হযরত ঈসা (আ) ছিলেন আসমানি কিতাব প্রাপ্ত একজন নবি ও রাসুল। আল্লাহ তায়ালা তাঁর ওপর ‘ইনজিল' কিতাব নাজিল করেন। সে সময়ে সেখানকার লোকেরা আল্লাহকে ভুলে গিয়ে নানা দেব-দেবীর পূজা করত। হযরত ঈসা (আ) তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহ্বান জানালেন। শিরক থেকে বিরত থাকতে বললেন। সকল দুর্নীতি ও খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকতে বললেন।
সেখানকার লোকজন হযরত ঈসা (আ)-এর কথা মানল না। তারা আল্লাহর ইবাদত করল না। তারা তাঁর ঘোর শত্রুতে পরিণত হলো। তারা তাঁকে আরো নিষ্ঠুর কষ্ট দিতে থাকল। এমনকি তারা তাঁকে হত্যা করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করল। একদিন তারা তাঁকে হত্যা করার জন্য এক ব্যক্তিকে ঘরের মধ্যে পাঠাল। কিন্তু রাখে আল্লাহ, মারে কে। মহান আল্লাহ তাঁর অসীম কুদরতে তাঁকে জীবিত অবস্থায় আসমানে তুলে নিলেন। আর ঘরের মধ্যে যে লোকটি তাঁকে হত্যা করার জন্য প্রবেশ করেছিল, তার আকৃতি হযরত ঈসা (আ)-এর আকৃতির মতো হয়ে গেল। সে ঘর থেকে বের হতেই তার সাথীরা তাকে ঈসা (আ) ভেবে ক্রুশ বিদ্ধ করে হত্যা করল ।
এভাবে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় রাসুল ও বান্দা হযরত ঈসা (আ) কে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে আসমানে নিরাপদে রাখলেন। শেষ জামানায় কিয়ামতের পূর্বে তিনি পুনরায় পৃথিবীতে আসবেন। মিথ্যাবাদী দাজ্জালকে তিনি হত্যা করবেন। ৪০ বছর পৃথিবীতে অবস্থান করবেন। তিনি পৃথিবীতে এসে আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর উম্মত হিসেবে দীন প্রচার করবেন। তিনি স্বাভাবিকভাবে ইন্তিকাল করবেন। আমাদের মহানবি (স)-এর রওজা মুবারকের পাশে তাঁকে দাফন করা হবে।
আমরা হযরত ঈসা (আ) কে নবি-রাসুল বলে স্বীকার করব। আল্লাহর ইবাদত করব। হযরত ঈসা (আ)-এর মোজেযাসমূহ বিশ্বাস করব।
পরিকল্পিত কাজ : শিক্ষার্থীরা হযরত ঈসা (আ)-এর মোজেযাগুলো খাতায় লিখবে।
১. হযরত মুহাম্মদ (স) ___ বংশে জন্মগ্রহণ করেন।
২. ফিজার ___ গ্রোত্র কুরাইশদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল।
৩. ___ পর্বতের গুহায় হযরত মুহাম্মদ (স) ধ্যান মগ্ন থাকতেন ৷
৪. হিজরতের সময় মহানবি (স) ___ পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেন ৷
৫. মদিনা সনদে ___ টি ধারা ছিল।
৬. আল্লাহর কোন ___ নেই ৷
৭. হযরত নূহ (আ) আল্লাহর নির্দেশে এক বিরাট ___ তৈরি করলেন।
৮. হযরত ইবরাহীম (আ)-এর আমলে সেখানকার বাদশাহ ছিলেন ___।
৯. হযরত দাউদ (আ) শৈশবে ___ চরাতেন।
১০. হযরত ঈসা (আ) আল্লাহর হুকুমে মৃত ব্যক্তিকে ___ করতেন।
বাম পাশ ডান পাশ
মহানবি (স)-এর পিতা আব্দুল মুত্তালিব
মহানবি (স)- এর মাতা হালিমা
মহানবি (স) –এর দাদা আবু তালিব
মহানবি (স) –এর চাচা আব্দুল্লাহ
মহানবি (স)-এর দুধমা আমিনা
হযরত আদম (আ)-এর সঙ্গীর নাম থামল
নৌকা জুদি পাহাড়ে এসে হযরত মরিয়ম (আ)
হযরত দাউদ (আ) বাদশাহ তালুতের হযরত হাওয়া (আ)
হযরত ঈসা (আ) এর আম্মার নাম সেনাপতি ছিলেন
১. পাদ্রি বহিরা হযরত মুহাম্মদ (স) সম্বদ্ধে কী মন্তব্য করেছিলেন?
২. হযরত মুহাম্মদ(স)-এর গঠিত সংঘের নাম কী ?
৩. হাজরে আসওয়াদ কোথায় স্থাপন করা হয়েছিল?
৪. মহানবি (স) প্রথমে কাদের মধ্যে ইসলাম প্রচার করেন?
৫. আনসার কারা?
৬. মুহাজির কাদের বলে?
৭. বদর যুদ্ধের কারণ কী?
৮. মদিনা সনদ কী?
৯. হুদাইবিয়ার সন্ধি কী ?
১০. বিদায় হজ কাকে বলে?
১১. পৃথিবীর আদি মানব কে ছিলেন ?
১২. হযরত নূহ (আ)-এর সময় কী আজাব এসেছিল?
১৩. ইবরাহীম (আ) কোথায় জন্মগ্রহণ করেন ?
১৪. হযরত দাউদ (আ)-এর ওপর কোন কিতাব নাজিল হয় ?
১৫. হযরত দাউদ (আ)-এর বীরত্বের উদাহরণ দাও ।
১৬. হযরত ঈসা (আ)-এর মোজেযা উল্লেখ কর।
১৭. হযরত ঈসা (আ) বর্তমানে কোথায় জীবিত আছেন?
১৮. আল্লাহর হুকুমে হযরত সুলায়মান (আ)-এর অধীনে কী কী ছিল ?
১. হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্ম ও বংশ পরিচয় দাও।
২. হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্মের সময় আরবের অবস্থা কেমন ছিল ?
৩. শান্তি সংঘের উদ্দেশ্যগুলো কী কী?
৪. হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নবুয়ত লাভের ঘটনা সংক্ষেপে লেখ ।
৫. নবুয়ত লাভের পর মহানবি (স) কী কী শিক্ষা দিলেন?
৬. মদিনা সনদ কী? এর কয়েকটি ধারা উল্লেখ কর।
৭. বদর যুদ্ধের ফলাফল বর্ণনা কর।
৮. মক্কা বিজয় ও রাসুল (স)-এর অপূর্ব ক্ষমার দৃষ্টান্ত বর্ণনা কর।
৯. বিদায় হজে মহানবি (স) যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা সংক্ষেপে লেখ ৷
১০. কুরআন মজিদে উল্লিখিত ১০ জন নবির নাম লেখ ৷
১১. আল্লাহ ফেরেশতাদের কী আদেশ দিলেন?
১২. হযরত নূহ (আ) মানুষকে কী কী বললেন ?
১৩. হযরত ইবরাহীম (আ) অগ্নিকুণ্ডে কীভাবে অক্ষত থাকেন ?
১৪. হযরত দাউদ (আ)-এর ন্যায়পরায়ণতা ও সুশাসন সম্পর্কে লেখ ।
১৫. হযরত ঈসা (আ) সেখানকার লোকদের কী কী উপদেশ দিলেন?
আরও দেখুন...