মানুষের পতনের ফল

অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - খ্রিষ্টান ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা - | NCTB BOOK
2

চতুর্থ অধ্যায়

মানুষের পতনের ফল

যে কোন মানুষের মধ্যে আমরা দুই দিকে অকর্ষণ দেখতে পাই ভালোর জন্য আকাঙ্ক্ষা এবং

মন্দের দিকে আকর্ষণ। স্রষ্টা তো মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছা দিয়েই সৃষ্টি করেছেন এবং ভালোবাসার আদেশ দিয়েছেন মানুষ যখন তার স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগ করে ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করে মন্দকে বেছে নেয় তখন তার অমঙ্গলই হয়। সৃষ্টির আদিতে মানুষ স্বেচ্ছায় ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করেছে বলে তার পতন ঘটলো এই অবাধ্যতার পাপই হচ্ছে মানুষের মৌলিক পাপ অর্থাৎ স্বেচ্ছায় মঙ্গলময় ঈশ্বরের বিরোধিতা করা। আদম হবার পতনের কাহিনী আদি পুস্তকে নাটকীয় ভাবে বর্ণিত হয়েছে। মানুষের পতনের ফল, বিভিন্ন রকমের পাপ ও পাপের ফল সম্পর্কে আমরা ইতিমধ্যেই জ্ঞান লাভ করেছি। মানুষের অর্থাৎ আমাদের আদি পিতা-মাতার পাপের কথা জানার মধ্য দিয়ে আমরা আদি পাপের বিষয়েও জেনেছি। এই অধ্যায়ে আমরা মানুষের পতনের ফল নিয়ে একটু গভীর আলোচনা করব । আমরা জানি, মানুষ পাপ করে শাস্তি পেয়েছে বটে, কিন্তু ঈশ্বর তাকে ধ্বংস করে। ফেলেন নি বা পরিত্যাগও করেন নি। তাকে এখন থাকতে হচ্ছে কঠিন সংগ্রামের মধ্যে, কিন্তু ঈশ্বরকে লাভ করার জন্য তার মধ্যে রয়েছে গভীর আকাঙ্ক্ষা। একদিকে পাপের প্রতি মানুষের একটা আকর্ষণ আছে, কিন্তু অন্যদিকে পাপের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার গভীর আগ্রহ এবং প্রচেষ্টাও কম শক্তিশালী নয়। এই অধ্যায়ের পাঠগুলো নিয়ে চিন্তা করার মাধ্যমে আমরা ঈশ্বরের উপর আমাদের আস্থা আরও দৃঢ় করে তোলার চেষ্টা করব।

এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা

পতনের ফলে মানুষের কঠিন সংগ্রামপূর্ণ জীবনের বর্ণনা দিতে পারব;

মানুষকে উদ্ধারের উদ্দেশ্যে ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি ও পরিকল্পনার কথা বর্ণনা করতে পারব;

মানুষের ঈশ্বর অন্বেষণ ব্যাখ্যা করতে পারব;

পাপ থেকে পরিত্রাণ লাভের উপায় বর্ণনা করতে পারব; জীবনের সর্বাবস্থায় ঈশ্বরের উপর আস্থা রাখব ।

পাঠ ১ পাপে পতন ও কঠিন সংগ্রাম

মানুষের পাপে পতন

নিজের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্ট মানুষকে ঈশ্বর স্বাধীন ইচ্ছা দিয়েছিলেন। মানুষের সামনে রেখেছিলেন মঙ্গল-অমঙ্গল জ্ঞানবৃক্ষের ফল ঈশ্বর মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, মানুষ স্বেচ্ছায় সেই পাপ থেকে বিরত থাকুক। কিন্তু মানুষ শয়তানের দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে ঈশ্বরের অবাধ্য হলো । তার উপর ঈশ্বরের আস্থা মানুষ নষ্ট করে ফেলল। এভাবে মানুষ যে পাপ করল তাই মানুষের মানুষের পতনের ফল

৩৩

মৌলিক পাপ। সেই পাপ দ্বারা মানুষ ঈশ্বরের বদলে নিজের ইচ্ছাকেই বেছে নিল । ঈশ্বর মানুষকে নিজের প্রতিমূর্তিতেই সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু মানুষ তা বুঝল না। শয়তানের প্রলোভনে পড়ে মানুষ অন্যভাবে ‘ঈশ্বরের মতো বা সমকক্ষ হতে চাইল। সে নিজেই ঈশ্বর হতে চাইল। তার এই অতি উচ্চ আকাঙ্ক্ষাই তার পতনের মূল কারণ হলো।

পাপের পরিণাম

পাপে পতিত হওয়ার ফলে আদম ও হবা তৎক্ষণাৎ আদি পবিত্রতার কৃপা হারিয়ে ফেলল । সাধু পল বলেন, “ইহুদি অনিহুদি, সকলেই পাপ করেছে, সকলেই ঐশ মহিমা থেকে বঞ্চিত।" (রোমীয় ৩:২৩)। পাপের ফলে আদি পিতামাতা ঈশ্বরকে ভয় পেতে শুরু করে।

পাপের পূর্বে মানুষের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। তার দেহ, মন ও আত্মার সুসম্পর্ক ছিল। সুসম্পর্ক ছিল নারী ও পুরুষের মধ্যেও। কিন্তু পাপের ফলে এই সম্পর্ক নষ্ট হলো ।

১। মানুষের দেহ ও মনের উপর আত্মার একটা প্রভাব ছিল। তার মধ্যে আধ্যাত্মিক শক্তি প্রবল

ছিল। কিন্তু এখন সেই আধ্যাত্মিকতা নষ্ট হয়ে গেল। দেহ ও মন এখন আর আত্মার নির্দেশ

সেভাবে মানছে না।

২। নারী-পুরুষের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা দেখা দিল। নারী ও পুরুষ সেই পাপময় অবস্থার কারণে পরস্পরকে কাম-লালসার দৃষ্টিতে দেখে এবং একে অপরের উপর কর্তৃত্ব করার প্রচেষ্টা চালায়।

৩। সৃষ্টির সাথেও তাদের ঐক্য নষ্ট হয়ে গেল। প্রকৃতি এখন তার সাথে আর বন্ধুসুলভ আচরণ করবে না। পৃথিবীর মাটি তার জন্য অভিশপ্ত হয়ে থাকছে। তাকে বহু কষ্ট করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, পৃথিবীর বুক থেকে খাবার জোগাড় করতে হয়। ওই মাটি খাদ্যের পাশাপাশি তার জন্যে এখন ফলায় যত রকমের আগাছা ও কাঁটাগাছ

৪। মানুষকে যে ধুলা থেকে সৃষ্টি করা হয়েছিল সেই ধুলাতেই তাকে আবার ফিরে যেতে হবে। অর্থাৎ মানব ইতিহাসে মৃত্যু প্রবেশ করল

৫। আদিপাপের পর পৃথিবীর মানুষের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটল। তারা পরস্পরকে ঈর্ষা করতে শুরু করল। কাইন তার আপন ভাই আবেলকে হত্যা করল।

কঠিন সংগ্রামে পতিত মানুষ

মানুষ স্বাধীন হলেও আদি পিতামাতার পাপের কারণে তার উপর শয়তানের শক্তির প্রভাব সব সময় বিদ্যমান। আদি পাপের ফল হলো, “শয়তানের দাসত্ব যার ক্ষমতা রয়েছে মৃত্যুর উপর।" মানুষের

৩৪

খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

ভিতরে মন্দতার প্রতি একটা আসক্তি আছে; সে না চাইলেও তার ভিতর থেকে তা উৎসারিত হয়। মন্দতার প্রতি এই আসক্তির কারণে মানুষের মধ্যে বোধশক্তির অভাব দেখা দেয়। এই অভাবের কারণে নৈতিক ক্ষেত্রে মানুষ নানারকম মারাত্মক ভুল করে থাকে। এই ভুলের কারণে মানুষের জীবন ক্রমান্বয়ে হতে থাকে জটিল ও কষ্টকর, তার অশান্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। নিজের মধ্যে ও বাইরের জগতের সাথে তার সংগ্রামও এভাবে বেড়ে উঠতে থাকে ।

মানুষের জীবনে পাপের প্রভাব এবং পাপের কারণে মানুষের জীবনে বিদ্যমান দ্বিধাদ্বন্দ্ব বা টানাটানিটাই হলো তার কঠিন সংগ্রাম। এই সংগ্রাম হলো মন্দ বা পাপকে পরাজিত করে সত্য ও ভালোকে প্রতিষ্ঠা করার বিরামহীন প্রচেষ্টা। সব মানুষের মধ্যেই ভালো বা শুভশক্তি বিরাজমান। মানুষ ভালো ও সৎ থাকতে চায় সত্য ও সুন্দরকে সব মানুষই ভালোবাসে। কিন্তু সত্য ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করা সব সময় সকলের পক্ষে সম্ভব হয় না ।

মানবজাতির গোটা ইতিহাসই মন্দ শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামের কাহিনী। প্রভু যীশুর কথা অনুযায়ী তা ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে জগতের শেষদিন পর্যন্ত স্থায়ী হবে। এই দ্বন্দ্বমুখর জগতে মানুষকে সংগ্রাম করেই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে এবং ঈশ্বরের কৃপার উপর নির্ভর করে মানুষ তার অন্তরে ও নিজ জীবনে পরিত্রাণ লাভ করতে সক্ষম হয়। মানুষের এই অসহায় অবস্থাকে সাধু পল এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন: আমি যা করতে চাই, তা করি না বরং আমি যা করতে চাই না, তাই করি। তবে আমরা বিশ্বাস করি এই নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আমাদের মুক্তির পথে এগিয়ে যেতে হবে। এই সংগ্রাম খ্রিষ্টবিশ্বাসীর বিশ্বাসের পরীক্ষা ও পরিত্রাণের সংগ্রাম। প্রতিদিনের জীবন যাপন ও প্রচেষ্টায় পাপ শক্তিকে পরাজিত করে শুভশক্তির জয়ের মাধ্যমেই আমরা পুনরুত্থিত খ্রিষ্টকে অভিজ্ঞতা করি। মৃত্যু বিজয়ের আনন্দ লাভ করি

কাজ : প্রতিদিনের জীবনে শুভশক্তি ও পাপশক্তির দ্বন্দ্ব তুমি কীভাবে অভিজ্ঞতা কর তা অনুধ্যান কর ও দলে সহভাগিতা কর।

পাঠ ২ : পতিত মানবজাতিকে উদ্ধারের জন্য ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি ও পরিকল্পনা

ঈশ্বর অসীমরূপে মঙ্গলময় ও ভালোবাসাপূর্ণ। তাঁর সকল কাজ উত্তম। মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসাও সীমাহীন। পাপ করে মানবজাতি পতিত হলেও ঈশ্বর কিন্তু তাদের একেবারে বিনাশ করলেন না। তাদেরকে চিরতরে দূরেও ঠেলে দিলেন না। মানব ইতিহাসে পাপ বিদ্যমান। তা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। তাই মানুষকে রক্ষা করার জন্য ঈশ্বর একটি মহান পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন । পাপে পতিত হবার পর ঈশ্বর মানবজাতির কাছে একটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তিনি মানবজাতির পরিত্রাণ করবেন। পাপ থেকে মানুষকে মুক্ত করবেন। পবিত্র বাইবেলের আদিপুস্তকের (আদি: ৩:৯, ১৫) এই অংশকে বলা হয় 'প্রথম মঙ্গলসমাচার। কারণ এখানে রয়েছে মশীহের বা ত্রাণকর্তার সম্বদ্ধে প্রথম ঘোষণা, সর্প ও নারীর মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং নারীর বংশধরদের চূড়ান্ত বিজয় সম্পর্কিত ঘোষণা মানুষের পতনের ফল

৩৫

এই প্রতিশ্রুতিতে ঈশ্বরের পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা 'নতুন আদম' অর্থাৎ মুক্তিদাতা যীশুর আগমন সংবাদ জানতে পারি যিনি ক্রুশীয় মৃত্যু পর্যন্ত বাধ্য ছিলেন। প্রথম আদমের অবাধ্যতা ও পাপের ক্ষতিপূরণ তিনি পরিপূর্ণভাবেই করেছেন। যে নারীর কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে তিনি হলেন যীশুর মা মারীয়া, 'নতুন হবা'। যীশুর পুণ্য ফলে এবং ঈশ্বরের বিশেষ কৃপায় তিনি ছিলেন নিষ্কলঙ্কা বা পাপমুক্ত

আমাদের মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে ঈশ্বর কেন আদি মানবকে পাপ করা থেকে রক্ষা করেন নি? মহাপ্রাণ সাধু লিও বলেছেন, “আমাদের জন্য খ্রিষ্টের দেওয়া অবর্ণনীয় কৃপা-আশীর্বাদ সেই হিংসুটে শয়তানের কেড়ে নেওয়া আশীর্বাদের চেয়ে উত্তম।” সাধু টমাস আকুইনাস লিখেছেন, “মহত্তর কোনো কিছুর দিকে মানব স্বভাবের উন্নীত হবার পথে বাধা দেওয়ার মতো কোনো কিছু নেই, এমনকি পাপ করার পরও। ঈশ্বর মন্দতাকে ঘটতে দেন যেন তা থেকে আরও উত্তম কিছু বেরিয়ে আসতে পারে।” সাধু পল বলেন, “যেখানে পাপ বৃদ্ধি পেল, সেখানে অনুগ্রহ অধিক উপচে পড়ল" এবং পুণ্য শনিবার রাতের নিস্তার বন্দনায় গাওয়া হয়, “ধন্য সেই অপরাধ... যার জন্য আমরা এমন মহান এক ত্রাণকর্তাকে পেয়েছি।”

খ্রিষ্টভক্তরা সবসময় বিশ্বাস করে, “এই জগৎ সৃষ্টিকর্তার ভালোবাসা দিয়ে গড়া এবং এই ভালোবাসাই

সৃষ্টিকে টিকিয়ে রেখেছে।"

কাজ : ব্যর্থতা বা মন্দ ঘটনা থেকে পরবর্তীতে ভালো কিছু অর্জিত হয়েছে এমন ঘটনা তোমার বেলায় ঘটে থাকলে বা তোমার জানা থাকলে তা সহভাগিতা কর।

পাঠ ৩ ঈশ্বর-অন্বেষণে মানুষ

মানুষের জীবনের কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন হলো : আমি কে? আমি কোথা থেকে এসেছি? আমি কোথায় যাব? কে আমাকে সৃষ্টি করেছেন? কেন তিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন? এই প্রশ্নগুলোকে মহামানবেরা জীবন জিজ্ঞাসা বলে উল্লেখ করেছেন। জীবন জিজ্ঞাসা থেকেই শুরু হয় মানুষের ঈশ্বর-অন্বেষণ। মানুষ তার আপন স্রষ্টাকে খুঁজে পেতে চায়। তাঁর সাথে একাত্ম হতে চায়। তাঁর আপন স্রষ্টার মাহাত্ম্য মানুষ নিজ জীবনে উপলব্ধি করতে চায়। ঈশ্বরকে সে আস্বাদন করতে চায়, তিনি কত মঙ্গলময়। ঈশ্বরকে লাভ করা মানুষের অনন্ত পিপাসা। সামসংগীতেও আমরা মানুষের ঈশ্বর অন্বেষণের বর্ণনা দেখতে পাই। সামসংগীত ৬৩তে বলা হয়েছে :

ওগো, ঈশ্বর, তুমি তো আমার আপন ঈশ্বর, তোমাকেই খুঁজে ফিরি আমি:

তোমারই জন্যে ভূষিত আমার প্রাণ;

আমার এই দেহ তোমারই জন্যে ব্যাকুল, যেন শুষ্ক তৃষাতুর জলহীন কোনো ভূমির মতো।

 

৩৬

খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

তাই তো এখন পুণ্য ধামের দিকে ওগো, তোমারই দিকে তাকিয়ে রয়েছি আমি; তোমার শক্তি, তোমার মহিমা দেখতেই চাই আমি।

সামসংগীত ৪২-এ উল্লেখ করা হয়েছে জলস্রোতের জন্যে ব্যাকুল যেন হরিণীর মতো, ওগো ঈশ্বর, তোমারই জন্যে ব্যাকুল আমার প্রাণ।

পরমেশ্বর, আহা, জীবনেশ্বর-

তাঁরই জন্যে ভূষিত আমার প্রাণ

ঈশ্বরের কাছে, আহা, কবে যাব আমি, কবে পাব তাঁর শ্রীমুখের দর্শন?

মানুষ কেন ঈশ্বরকে অন্বেষণ করে? ঈশ্বর যিনি আমাদের স্রষ্টা তিনি নিজেই আমাদের সাথে মিলিত হতে চান। আমরাও যেন তাঁর সাথে মিলিত হতে চাই সেজন্য তিনি সেই ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে দিয়েছেন। তিনি আমাদের মধ্যে এমন একটা অপূর্ণতা দিয়েছেন, যা একমাত্র তিনি নিজেই পূর্ণ করতে পারেন। নদীর জলের উৎস হলো সাগর এবং তার পরিণতিও হলো সাগর। মানুষের জীবনও তেমনি। আমাদের উৎস হলেন ঈশ্বর, আমাদের শেষ পরিণতিও তিনিই । আমরা তাঁর থেকে এসেছি, আমরা ফিরেও যাব তাঁর কাছে। যতদিন আমরা এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকি, তাঁরই গৌরবের জন্যেই বেঁচে থাকি । তাই মানুষ আমরা আমাদের জীবনের সব অবস্থায়, সব কাজে ঈশ্বরের উপস্থিতি উপলব্ধি করতে চাই। আমাদের জীবনে ঈশ্বরকে দেখতে চাই। আমাদের সব কাজের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের ইচ্ছা পূর্ণ করতে চাই। ঈশ্বরকে লাভ করে আমরা পরিতৃপ্ত হতে চাই। ঈশ্বরকে পেয়ে আমরা পূর্ণ হতে চাই

যুগ যুগ ধরে মানুষ নানাভাবে নানাস্থানে ঈশ্বরকে খুঁজেছে। সব ধর্মের মানুষের মধ্যেই আমরা দেখি যে মানুষ ঈশ্বর বা তাঁর আপন স্রষ্টাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। মানুষের ধ্যান, প্রার্থনা, ধর্মগ্রন্থ পাঠ, পুণ্যকাজ, মানবসেবা, জ্ঞান অর্জন, ভীর্থযাত্রা কিংবা সন্ন্যাসজীবন গ্রহণ এসব কিছুর মধ্য দিয়েই মানুষ তাঁর আপন স্রষ্টাকে খুঁজে বেড়ায়। সৃষ্টজীবের প্রতি ভালোবাসা ও নিজ অন্তরের পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে মানুষ স্রষ্টাকে ভালোবাসে ও তাঁকে নিজ জীবনে অভিজ্ঞতা করে। কিন্তু অসীম ঈশ্বর আমার মধ্যেই আছেন। এই খুঁজে পাবার অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম তাই তো লিখেছেন:

অন্তরে তুমি আছো চিরদিন, ওগো অন্তরযামী। বাহিরে বৃদ্ধাই যত খুঁজি তাই পাই না তোমারে আমি প্রাণের মতন আত্মার সম আমাতে আছো হে অন্তরতম । ...

৩৬

খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

তাই তো এখন পুণ্য ধামের দিকে ওগো, তোমারই দিকে তাকিয়ে রয়েছি আমি; তোমার শক্তি, তোমার মহিমা দেখতেই চাই আমি।

সামসংগীত ৪২-এ উল্লেখ করা হয়েছে জলস্রোতের জন্যে ব্যাকুল যেন হরিণীর মতো, ওগো ঈশ্বর, তোমারই জন্যে ব্যাকুল আমার প্রাণ।

পরমেশ্বর, আহা, জীবনেশ্বর-

তাঁরই জন্যে ভূষিত আমার প্রাণ

ঈশ্বরের কাছে, আহা, কবে যাব আমি, কবে পাব তাঁর শ্রীমুখের দর্শন?

মানুষ কেন ঈশ্বরকে অন্বেষণ করে? ঈশ্বর যিনি আমাদের স্রষ্টা তিনি নিজেই আমাদের সাথে মিলিত হতে চান। আমরাও যেন তাঁর সাথে মিলিত হতে চাই সেজন্য তিনি সেই ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে দিয়েছেন। তিনি আমাদের মধ্যে এমন একটা অপূর্ণতা দিয়েছেন, যা একমাত্র তিনি নিজেই পূর্ণ করতে পারেন। নদীর জলের উৎস হলো সাগর এবং তার পরিণতিও হলো সাগর। মানুষের জীবনও তেমনি। আমাদের উৎস হলেন ঈশ্বর, আমাদের শেষ পরিণতিও তিনিই । আমরা তাঁর থেকে এসেছি, আমরা ফিরেও যাব তাঁর কাছে। যতদিন আমরা এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকি, তাঁরই গৌরবের জন্যেই বেঁচে থাকি । তাই মানুষ আমরা আমাদের জীবনের সব অবস্থায়, সব কাজে ঈশ্বরের উপস্থিতি উপলব্ধি করতে চাই। আমাদের জীবনে ঈশ্বরকে দেখতে চাই। আমাদের সব কাজের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের ইচ্ছা পূর্ণ করতে চাই। ঈশ্বরকে লাভ করে আমরা পরিতৃপ্ত হতে চাই। ঈশ্বরকে পেয়ে আমরা পূর্ণ হতে চাই

যুগ যুগ ধরে মানুষ নানাভাবে নানাস্থানে ঈশ্বরকে খুঁজেছে। সব ধর্মের মানুষের মধ্যেই আমরা দেখি যে মানুষ ঈশ্বর বা তাঁর আপন স্রষ্টাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। মানুষের ধ্যান, প্রার্থনা, ধর্মগ্রন্থ পাঠ, পুণ্যকাজ, মানবসেবা, জ্ঞান অর্জন, ভীর্থযাত্রা কিংবা সন্ন্যাসজীবন গ্রহণ এসব কিছুর মধ্য দিয়েই মানুষ তাঁর আপন স্রষ্টাকে খুঁজে বেড়ায়। সৃষ্টজীবের প্রতি ভালোবাসা ও নিজ অন্তরের পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে মানুষ স্রষ্টাকে ভালোবাসে ও তাঁকে নিজ জীবনে অভিজ্ঞতা করে। কিন্তু অসীম ঈশ্বর আমার মধ্যেই আছেন। এই খুঁজে পাবার অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম তাই তো লিখেছেন:

অন্তরে তুমি আছো চিরদিন, ওগো অন্তরযামী। বাহিরে বৃদ্ধাই যত খুঁজি তাই পাই না তোমারে আমি প্রাণের মতন আত্মার সম আমাতে আছো হে অন্তরতম । ...

মানুষের পতনের ফল

०१

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গেয়েছেন

তোমারে পেয়েছি হৃদয় মাঝে

আরও কিছু নাহি চাই গো...

এভাবেই যুগের পর যুগ ধরে চলছে মানুষের বিরামহীন ঈশ্বর-অন্বেষণ

কাজ : তুমি কীভাবে ঈশ্বরের অনুসন্ধান কর? তার একটি তালিকা কর। ঈশ্বরকে খুঁজে পাবার অভিজ্ঞতা ও আনন্দ দলে সহভাগিতা কর।

পাঠ ৪ : পরিত্রাণের উপায়

ঈশ্বরকে জানতে, তাঁর আজ্ঞাগুলো মেনে চলতে এবং এই পৃথিবী ও পরকালে পরম সুখে বাস করার জন্য ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু মানুষ পাপ করে সেই সুখ থেকে বঞ্চিত হয়েছে ঈশ্বরের সাথে তাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। কিন্তু ঈশ্বর নিজেই উদ্যোগ নিয়ে মানুষকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন তিনি মানুষকে পরিত্রাণ দিতে চান। পাপের কবল থেকে রক্ষা পাবার জন্য মানুষের প্রয়োজন ঈশ্বরের পরিত্রাণ। ঈশ্বরের কৃপা পেয়ে মানুষ পরিত্রাণের পথে এগিয়ে চলতে পারে। এই কৃপা ঈশ্বর মানুষকে দান করেন তাঁর একমাত্র পুত্র যীশুখ্রিষ্টের মধ্য দিয়ে। তাছাড়াও তিনি

মানুষের জন্য দিয়েছেন বিধি-বিধান। এই বিধানের দ্বারা পরিচালিত হয়ে মানুষ লাভ করবে ঐশ অনুগ্রহ ও পরিত্রাণ। এবার আমরা জানব কীভাবে পরিত্রাণ লাভ করা যায়।

১. প্রভু যীশুকে মুক্তিদাতারূপে গ্রহণ করা : মুক্তি পরিকল্পনায় ঈশ্বর নিজেই মানুষকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি মানবজাতিকে পাপের হাত থেকে রক্ষা করবেন সেই প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হয়েছে তাঁর একমাত্র পুত্র যীশুখ্রিষ্টের মধ্য দিয়ে। যীশু মানুষ হয়ে পৃথিবীতে এসেছেন, পরিত্রাণ সম্পর্কে কথা ও কাজ দ্বারা মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যন্ত্রণাভোগ এবং ক্রুশমৃত্যু বরণ করেছেন ও পুনরুত্থিত হয়ে মানুষকে পরিত্রাণের পথ দেখিয়েছেন। তাহলে মানুষের পরিত্রাণের প্রধান উপায় হলো যীশুখ্রিষ্টকে মুক্তিদাতারূপে গ্রহণ করা। যীশু নিজেই বলেছেন, “আমিই পথ, আমিই সত্য, আমিই জীবন। আমাকে পথ করে না গেলে কেউই পিতার কাছে যেতে পারে না।” (যোহন ১৪:৬)।

২. নৈতিক বিধান পালন করা : পরিত্রাণ লাভের পথে ঈশ্বরের দেওয়া বিধি-বিধান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকা পালন করে থাকে পুরাতন নিয়মের দশ আজ্ঞা, প্রভু যীশুর দেওয়া ভালোবাসার আজ্ঞা মানুষের পরিত্রাণের পথ নির্ণয় করে। একদিন একটি যুবক যীশুর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “গুরু, বলুন তো শাশ্বত জীবন লাভ করতে হলে আমাকে কোন্ সৎ কাজ করতে হবে? ... যীশু উত্তর দিলেন ..... জীবন রাজ্যে যদি প্রবেশ করতে চাও, তাহলে তুমি ঐশ আজ্ঞাগুলি পালন করে চল।” ঐশ. 

৩৮

খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

আজ্ঞাগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ আজ্ঞা হলো ঈশ্বরকে ভালোবাসা ও প্রতিবেশীকে নিজের মতো করে ভালোবাসা। এই ভালোবাসার বিধান পালন করেই আমরা পরিত্রাণ পেতে পারি।

৩. ঐশ অনুগ্রহ ও ধর্মময়তা : ঐশ অনুগ্রহ ও ধর্মময়তা আসে পবিত্র আত্মা থেকে। পবিত্র আত্মার ক্ষমতাবলে আমরা পাপের দিক থেকে মরে গিয়ে নতুন জীবন অর্থাৎ পরিত্রাণ লাভ করি। পবিত্র আত্মার অনুগ্রহের প্রথম ফল হলো মন পরিবর্তন। মন পরিবর্তন বলতে আমরা বুঝি পাপের পথ থেকে মন ফিরিয়ে যীশুর পথ গ্রহণ করা, পরিত্রাণ লাভের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করা, পবিত্রতা লাভ করা ও বিশ্বাস নবীকরণ করা। এই ঐশ অনুগ্রহ সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে ঈশ্বরের দয়ার উপর। ঈশ্বরের নিজের জীবন থেকে তিনি তা আমাদের দিয়ে থাকেন।

৪. খ্রিষ্টমগুলীর সদস্য হওয়া : খ্রিষ্টভক্তদের পরিত্রাণ সাধন করার জন্য প্রভু যীশু খ্রিষ্টমণ্ডলী প্রতিষ্ঠা করেছেন। মণ্ডলীতে স্বয়ং পবিত্র আত্মা বিরাজমান। মণ্ডলীর সহায়তায় সংস্কার প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। এই সংস্কারগুলো হলো পরিত্রাণ লাভের পাথেয় স্বরূপ। যেমন দীক্ষায়ান সংস্কার লাভের মধ্য দিয়ে ভক্তজনেরা আদি পাপের ক্ষমা লাভ করে, পুনর্মিলন সংস্কারের মধ্য দিয়ে পাপের ক্ষমা লাভ করে। এবং খ্রিষ্টপ্রসাদ লাভের মধ্য দিয়ে অন্তরে প্রভু যীশুকে গ্রহণ করে এছাড়াও মণ্ডলীর প্রার্থনা, উপাসনা ও অন্যান্য ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মানুষ পরিত্রাণদায়ী কৃপা লাভ করে। খ্রিষ্টভক্তের জীবনে মণ্ডলী হলো খ্রিষ্টের পরিত্রাণদায়ী বাস্তব উপস্থিতির প্রমাণ। মণ্ডলীর পরিচালনা ও খ্রিষ্টীয় দিক নির্দেশনার মাধ্যমে ভক্তজন পরিত্রাণের পথে এগিয়ে চলে।

৫. সেবাকাজ সাধু যাকোব তাঁর ধর্মপত্রে বলেছেন, “কেউ যদি দাবি করে যে, ঈশ্বরে তার বিশ্বাস আছে, অথচ সে যদি সেইমতো কোনো সৎকর্ম না করে থাকে, তাহলে কীই বা লাভ তাতে? তেমন বিশ্বাস কি তাকে পরিত্রাণ এনে দিতে পারবে?” (যাকোব: ২:১৪)। সৎকর্মহীন বিশ্বাস নিষ্ফল, নিষ্প্রাণ। তাই আমাদের পরিত্রাণের জন্য যথাসাধ্য সেবাকাজ করতে হবে। সেবাকাজ করা খ্রিষ্টীয় দায়িত্ব। শেষ ভোজে শিষ্যদের পা ধুয়ে দিয়ে যীশু সে আদর্শ আমাদের জন্য রেখে গেছেন। সেবা কাজের মধ্য দিয়ে আমরা অন্তরের ধার্মিকতা ফিরে পাই।

কাজ ১ পরিত্রাণ লাভের জন্য তুমি যা যা কর তার একটি তালিকা প্রস্তুত কর।

কাজ ২ : কী কী ভাবে মানুষ ঈশ্বরের অন্বেষণ করে দলে ভাগ হয়ে তার একটি তালিকা তৈরি করে তা উপস্থাপন কর।

Content added || updated By
Promotion