সচরাচর আমরা আমাদের বাবা মায়ের সাথেই থাকি। আমাদের বাবা মায়েরা অনেক সময় তাদের কর্মস্থলের কারণে নিজ গ্রাম বা জেলা ছেড়ে অন্য শহর অথবা জেলায় আমাদের নিয়ে বসবাস করেন। তবে আমরা সবাই কোনো না কোনো অঞ্চলে বসবাস করি। আমরা বিভিন্ন ছুটিতে কিংবা উৎসবে দাদাবাড়ি/নানাবাড়ি/অন্য কোথাও বেড়াতে যাই। সেখানে থাকা আমাদের আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশী ও স্থানীয় লোকজন বেশিরভাগ বাংলা ভাষাতেই কথা বলেন, তবে সে ভাষার বেশ কিছু শব্দ ও কথা বলার ধরন অনেকটাই আলাদা।
আবার আমাদের ক্লাসে আমরা অনেক ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করি। সেখানে একেকজন একেক জেলা বা অঞ্চল থেকে এসে একই ক্লাসে পড়ছি। এই একই ক্লাসে আমরা অনেকেই বইয়ের ভাষার বাইরেও একটু আধটু নিজ জেলার ভাষায় কথা বলি। আর এই ভাষাটিই হল আঞ্চলিক ভাষা। যাকে আবার উপভাষাও বলা হয়। আমরা জানি যে আমাদের দেশে বাঙালিসহ আরও অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে, সেই সমস্ত নৃগোষ্ঠীর আছে নিজস্ব ভাষা। যেমন চাকমা ভাষা, মারমা ভাষা, গারো ভাষা, ম্রো ভাষা ইত্যাদি। কোনো কোনো উপভাষার আছে নিজস্ব বর্ণমালা। ভাষা হল সংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ।
আমরা বেশির ভাগ মানুষই সর্ব প্রথম এই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলি। কারন ঐটিই আমাদের মায়ের মুখে শোনা প্রথম বুলি। আমাদের প্রথম ভাবের আদান-প্রদান এই ভাষাতেই। তাই এই ভাষাকে আমরা মায়ের ভাষা বলি। হয়তো এই কারনেই এই আঞ্চলিক ভাষা আমাদের কাছে এতোই মধুর। আমরা অনেকেই ঘরের বাইরে শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বললেও নিজের ঘরে, নিজেদের আত্মীয়দের সাথে এই ভাষাতেই কথা বলি। আঞ্চলিকতার মাঝে বেড়ে ওঠা আমরা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেই প্রশান্তি অনুভব করি।
এবার চলো, আমরা জেনে নেই আমাদের শ্রেণিতে কে কোন জেলা থেকে এসেছে এবং কোন জায়গার ভাষা কেমন। নিজেরা যদি নিজের আঞ্চলিক ভাষা না জানি তাহলে তা আমরা মা-বাবা, দাদা-দাদির কাছ থেকে জেনে নিব। যত রকমের আঞ্চলিক ভাষা আমরা পেলাম তা বন্ধু খাতায় লিখে রাখতে যেন ভুল না হয়।
আমরা কি জানি, আমাদের বাংলা বর্ণমালা লেখার জন্য রয়েছে নানা রকমের বাংলা লিপি বা ফন্ট (font) আবার তাদেরও রয়েছে হরেক রকমের নাম। হাতে লেখার যুগ থেকে শুরু করে কম্পিউটারের এই যুগ পর্যন্ত বাংলা লিপি বা ফন্টের (font) রয়েছে বিশাল জগত, তার রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনাতার সংগ্রামসহ সকল আন্দোলন সংগ্রামে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, পোষ্টার, দেয়ালিকা লিখতে গিয়ে কত রকমের বাংলা লিপির সৃষ্টি তা এক কথায় বলে শেষ করা যাবেনা। এ যেন শিল্পের আরেক সাম্রাজ্য। বাংলা লিপি বা ফন্ট (font) বৈচিত্র্য সম্পর্কে আমরা পরে আরও বিস্তারিত জানব।
চলো এবার আমরা নিজের মতো করে সহজে কি ভাবে বাংলা বর্ণমালা লেখা যায় তা অনুশীলন করি। সাথে সাথে আমাদের মধ্যে যার যার মাতৃভাষার বর্ণমালা আছে তারা তা লেখার জন্য অনুসন্ধান করি।
ছবির মত করে লেখা তো শেখা হলো, এবার বাংলা অথবা নিজ নিজ মাতৃভাষায় আমরা ‘মায়ের মুখের মধুর ভাষা' বাক্যটি দিয়ে নিজস্ব ডিজাইনে একটি পোষ্টার তৈরি করব। এই পোস্টার গুলো আমরা ২১শে ফেব্রুয়ারিতে প্রদর্শন করব।
ভাষা মুখ থেকে কলমে আসে, মানে হলো ভাষা মুখে মুখেই প্রচলিত হয় বেশি পরে তা লেখা হয়। সাধারনত প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ভৌগলিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে এই ভাষার সৃষ্টি। তাই একেক অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা একেক ধরনের হয়ে থাকে।
লোকসংগীত, লোকসাহিত্য, লোকনাট্য, লোককাহিনী, লোকগাথা, ছড়া, প্রবাদ-প্রবচন ইত্যাদি গড়ে উঠেছে এই আঞ্চলিক ভাষার উপর নির্ভর করে। বাংলার লোকসংস্কৃতি তথা লোক সংগীতের একটি জনপ্রিয় ধারা হল কবিগান।
কবি গান যারা করেন তারা হন একাধারে কবি ও গায়ক। তাৎক্ষনিকভাবে গান রচনা করে সেটা গেয়ে প্রতিপক্ষের জবাব দেয়াটা কবি গানের প্রধান ধরন। বাংলার কবিগানের জগতে রমেশ শীল একজন কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব। আমরা এবার কবিয়াল রমেশ শীল সম্পর্কে জানব ।
রমেশ শীলের জন্ম চট্টগ্রাম জেলার গোমদন্ডী গ্রামে ১৮৭৭ সালে। তিনি ছিলেন অভিবক্ত বাংলার শ্রেষ্ঠ কবিয়াল । তিনি এই শিল্পের জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করেছেন। উনিশ শতকের শেষার্ধ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধকে সাধারণত কবিগানের স্বর্ণযুগ হিসেবে গণ্য করা হয়। কবিগান ঐতিহ্যগতভাবে পৌরাণিক এবং অন্যান্য লোককথা থেকে এর বিষয়বস্তু নির্বাচন করত । জনপ্রিয় বিষয় ছিল- রাম-রাবন, রাধা-কৃষ্ণ, হানিফা- সোনাবানু ইত্যাদি। রমেশ শীলকে যা আলাদা করে তা হল যে তিনি এই ছাঁচ থেকে বেরিয়ে এসে নিজের বিষয় বেছে নিয়েছিলেন; সত্য-মিথ্যা, গুরু-শিষ্য, পুরুষ-নারী, ধনী-গরিব, ধন-জ্ঞান।
সময়ের সাথে সাথে তাঁর গান আরও বেশি সমাজ-সচেতন হয়ে ওঠে। তখনকার বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল সম্পদ- বিজ্ঞান, যুদ্ধ-শান্তি, কৃষক-জমিদার, স্বৈরাচার-গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ-সমাজতন্ত্র ইত্যাদি। কবিগানের ২০০ বছরের পুরনো ইতিহাসে এটি ছিল একটি মৌলিক পরিবর্তন।
কোনও ধরনের আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ বা শিক্ষা ছাড়াই, কবিয়াল রমেশ শীল তাঁর মহাকাব্য ‘জাতীয় আন্দোলন’ এর মতো অসাধারণ রচনাগুলো তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনসহ নানা আন্দোলন সংগ্রাম নিয়ে গান রচনা করার ফলে তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। তিনি কবিগানকে সামাজিক সচেতনতার মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন ।
রমেশ শীলের আরেকটি বড় অবদান হল মাইজভান্ডারী গান রচনা। তার রচিত মাইজভান্ডারী গান আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন। তার রচিত মাইজভান্ডারী গানের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশ। যা আশেকেমালা, শান্তিভান্ডার, মুক্তির দরবার,নূরে দুনিয়া, জীবনসাথী, সত্যদর্পণ, ভান্ডারে মওলা, মানববন্ধু, এস্কে সিরাজিয়া এই নয়টি বইয়ে প্রকাশিত হয়। তার রচিত
‘ইসকুল খুইলাসে রে মওলা, ইস্কুল খুইলাসে’
গানটি মাইজভাণ্ডারীর আধ্যাত্মিক দর্শনের সাথে ঘনিষ্ঠ একটি জনপ্রিয় গান। তার রচিত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার গান আমাদের লোকসংগীতের অনন্য সম্পদ।
যা করব—
■ নিয়ম মেনে বিভিন্ন বাংলা font লিখে রাখব বন্ধুখাতায়।
■ নিজের ভাষায় পছন্দমত font-এ ‘মায়ের মুখের মধুর ভাষা' লেখা পোস্টার বানাব। পোস্টারটি ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করব।
■ এইবার নিজ এলাকার যে কোনো সহজ, বয়সোপযোগী একটি আঞ্চলিক গান বাছাই করব (স্থানীয়)।
■ একটি দল উক্ত গানটিকে সমবেতভাবে গাওয়ার চেষ্টা করব।
■ আরেকটি দল সে গানটিকে ভঙ্গির মাধ্যমে প্রকাশ করব। এইক্ষেত্রে আমরা আগে দেখব আমাদের অঞ্চলে স্থানীয় কোন লোকজ নৃত্য ধারা আছে কিনা। থাকলে সেই নৃত্যভঙ্গি গুলো এই গানটির সাথে বা তালে তালে চর্চা করব।
■ চাইলে আমরা একটি দল সেই গানটির বিষয় বুঝে ছোট একটি নাটিকাও করে ফেলতে পারি।
■ আমরা কবি রমেশ শীলের শিল্পকর্ম সম্পর্কে আরও জানার চেষ্টা করব।
আরও দেখুন...