রাষ্ট্রের ধারণা ব্যাখ্যা করলে আমরা রাষ্ট্রের চারটি উপাদান দেখতে পাই, যথা: জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সরকার ও সার্বভৌমত্ব । প্রত্যেক রাষ্ট্রই এ চারটি উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত।
জনসমষ্টি রাষ্ট্রের প্রাথমিক উপাদান হচ্ছে জনসমষ্টি। জনসমষ্টি কাতে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত জনগণকে বোঝায়। রাষ্ট্র গঠনের জন্য জনসমষ্টি একান্ত অপরিহার্য। জনসমষ্টির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ইচ্ছা এবং পারস্পরিক সম্পর্ক হতে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। তবে রাষ্ট্র গঠনের জন্য জনসংখ্যা কত হবে তার কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই। রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রের জনসংখ্যা কয়েক কোটি হতে পারে। আবার কয়েক হাজারও হতে পারে। গণচীন ও ভারতে জনসংখ্যা একশ' কোটির উপরে। অন্যদিকে স্যানম্যারিনো ও মোনাকো এ দুটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জনসংখ্যা যথাক্রমে ৩৮,৩০০ ও ৩৮,৯৬৩ (২০১৯ সালে বিশ্ব জনসংখ্যার প্রতিবেদন অনুযায়ী)।
নির্দিষ্ট খণ্ড নির্দিষ্ট ভূখন্ড হচ্ছে রাষ্ট্রের অপরিহার্য দ্বিতীয় উপাদান। প্রত্যেক রাষ্ট্রই একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখা দ্বারা পরিবেষ্টিত। তৃষ্ণ বলতে স্বলভাগ, সমুদ্রসীমা, আকাশসীমাও বোঝায়। রাষ্ট্রের জনগণের বসবাসের জন্য নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। জনসমষ্টি ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, সপ্তগ্রাম ও যুদ্ধের মাধ্যমে অথবা সাংবিধানিকভাবে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিটি রাষ্ট্রই ভূখণ্ডের সীমানাকেন্দ্রিক নিরাপত্তা বেষ্টনি গড়ে তোলে। ভূখণ্ড বড় হলো- দারুস সালাম, সুইজারল্যান্ড, ব্রুনাই ইত্যাদি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভূখণ্ডটি পৃথিবীর মানচিত্রে সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্থান পায়। অনেক সময় রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বেশ কয়েকটি দ্বীপের সমষ্টিও হতে পারে, যেমন- জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি ।
বা ছোট হতে পারে, যেমন- রাশিয়ার আয়তন অনেক বড় আর ছোট আয়তনের রাষ্ট্র।
সরকার রাষ্ট্রের অপরিহার্য তৃতীয় উপাদানটি হলো সরকার। সরকার গঠনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন আশিকভাবে সম্পন্ন হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তিনটি বিভাগ থাকে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও কর বিভাগ। এ তিন বিভাগের সমন্বয়ে সরকার গঠিত হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণতঃ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের সরকার গঠন করে। সরকার পদ্ধতি বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভিন্ন হতে পারে। সরকার বলতে ব্যাপক অর্থে শাসকগোষ্ঠীর সকলকে বোঝায়, যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের ক্ষমতা সরকার কর্তৃক পরিচালিত হয়। অধ্যাপক পার্লারের মতে, 'রাষ্ট্র যদি হয় জীবদেহ তবে সরকার হলো এর মস্তিক্যরূপ।
সার্বভৌমত্ব । রাষ্ট্র গঠনের মুখ্য উপাদান সার্বভৌমত্ব বা সার্বভৌমিকতা। সার্বভৌম শব্দ দ্বারা চরম ও চূড়ান্ত ক্ষমতাকে বোঝায়। সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্রের গঠন পূর্ণতা পায়। এ ক্ষমতা রাষ্ট্রকে অন্যান্য সংস্থা থেকে পৃথক করে। সার্বভৌমত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের ঐ বৈশিষ্ট্য যার ফলে নিজের ইচ্ছা ছাড়া অন্য কোনো প্রকার ইচ্ছার যারা রাষ্ট্র আইনসঙ্গতভাবে আবদ্ধ নয়। প্রত্যেক সমাজ ব্যবস্থায় চূড়ান্ত ক্ষমতা কার্যকর করার জন্যে একটি মাত্র কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ থাকবে। আর এ ক্ষমতাই হলো সার্বভৌম ক্ষমতা। সার্বভৌমের আদেশই হলো আইন। সার্বভৌমের আদর্শ বা আইন মানতে সকলেই বাধ্য। সার্বভৌম ক্ষমতার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক দুইটি দিক রয়েছে। অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের মধ্যকার সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। এই সার্বভৌম
রাষ্ট্র, নাগরিকতা ও আইন
ক্ষমতার ঊর্ধ্বে কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। বাহ্যিক সার্বভৌমত্বের অর্থ হলো রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহির্শক্তির নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকবে। কেবল জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ও সরকার থাকা সত্ত্বেও একটি দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষমতা না থাকলে তা রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হবে না। যতদিন রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব বিদ্যমান থাকে ততদিন সার্বভৌমত্বের স্থায়িত্ব থাকবে। সরকারের পরিবর্তন সার্বভৌমত্বের স্থায়িত্বকে নষ্ট করে না।
সুতরাং, জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড সরকার এবং সার্বভৌমত্ব এ চারটি উপাদান নিয়েই রাষ্ট্র গঠিত হয়। এর যে কোনো একটি উপাদান না হলে রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না।
আরও দেখুন...