প্রতিটি জীবদেহে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের জৈবনিক প্রক্রিয়ার জন্য শক্তি প্রয়োজন। এই শক্তি কিন্তু আসে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সূর্যের আলো থেকে। আমাদের খাবারের মধ্যে থাকা শর্করা, প্রোটিন ও লিপিড অণুতে শক্তি সঞ্চিত থাকে। শরীরে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে খাদ্যের মধ্যে থাকা এই শক্তিকে গতিশক্তি ও তাপশক্তিতে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়া হচ্ছে শ্বসন। এই গতিশক্তি ও তাপশক্তির দ্বারা জীব খাদ্য গ্রহণ, চলন, রেচন, বৃদ্ধি, জনন প্রভৃতি শারীরবৃত্তীয় কাজ সম্পন্ন করে থাকে।
শ্বসন একটি বিপাকীয় ক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া চলাকালে বেশিরভাগ জীব পরিবেশ থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে। তবে সরল শ্রেণির কিছু উদ্ভিদ ও প্রাণী অক্সিজেন ছাড়া শ্বসনক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে। অক্সিজেনের উপস্থিতিতে যে শ্বসন সম্পন্ন হয়, তাকে সবাত শ্বসন (Aerobic respiration) বলে। অপরদিকে অক্সিজেনের অনুপস্থিতে সম্পন্ন শ্বসন প্রক্রিয়াকে অবাত শ্বসন (Anaerobic respiration) বলে।
উভয় প্রকার শ্বসনের ক্ষেত্রেই কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপন্ন হয়। উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রতিটি সজীব কোষে দিন রাত সব সময় শ্বসন কার্য ঘটে চলে। আমরা মানুষ যে অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে পারি না, তার মূল কারণ আমাদের শক্তি উৎপাদন অক্সিজেন ছাড়া সম্ভব নয়। অক্সিজেনের উপস্থিতিতে আমাদের গ্রহণ করা খাবার জারিত (খাবারের রাসায়নিক উপাদানের সঙ্গে অক্সিজেনের বিক্রিয়া) হয়ে শক্তি উৎপন্ন হয় এবং একই সঙ্গে কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হয়।
উপরের আলোচনা থেকে বলা যায়, যে জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জীবকোষে থাকা খাদ্যবস্তু অক্সিজেনের উপস্থিতি (বা অনুপস্থিতিতে) জারিত হয়ে খাদ্যে থাকা রাসায়নিক শক্তিকে গতিশক্তি ও তাপশক্তিতে রূপান্তরিত ও মুক্ত করে। ফলশ্রুতিতে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও পানি উৎপন্ন হয় তাকে শ্বসন বলে।
উদ্ভিদ ও প্রাণীদেহের বিভিন্ন সজীব কোষে শ্বসন প্রক্রিয়াটি মূলত একই। কিন্তু বিভিন্ন জীবের অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমন পদ্ধতিটি ভিন্নরূপ। উদ্ভিদ দেহে শ্বসনকালে অক্সিজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের বিনিময় প্রক্রিয়াটি অপেক্ষাকৃত সরল। উদ্ভিদের কোনো নির্দিষ্ট শ্বসন অঙ্গ নেই। পাতার পত্ররন্ধ্র, কাণ্ডের ছিদ্রপথ এবং অন্তঃকোষের মাধ্যমে বায়ু উদ্ভিদ দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।
প্রাণীর দেহেও শ্বসন, বিভিন্ন অঙ্গের মাধ্যমে নানাভাবে সম্পন্ন হয়। সরল প্রাণীতে প্রধানত ত্বক ও শ্বাসনালির মাধ্যমে শ্বসন হয়। উন্নত প্রাণীর শ্বসনে অক্সিজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের বিনিময়ের জন্য বিশেষ ধরনের শ্বসন অঙ্গ আছে। যেমন মাছ ও ব্যাঙাচি ফুলকার সাহায্যে এবং স্থলজ মেরুদণ্ডী প্রাণী ফুসফুসের সাহায্যে শ্বসন সম্পন্ন করে।
শ্বসনকালে শক্তি উৎপন্ন হওয়ার প্রমাণ শ্বসনে যে শক্তি উৎপন্ন হয়, তা পরের পৃষ্ঠায় বর্ণিত পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণ করা যায়।
পরীক্ষার উপকরণ: দুটি থার্মোফ্লাস্ক, দুটি থার্মোমিটার, অঙ্কুরিত ছোলাবীজ, পানিতে সিদ্ধ ছোলাবীজ ও ছিদ্রযুক্ত রাবারের ছিপি।
পরীক্ষণ পদ্ধতি: অঙ্কুরিত ছোলাবীজগুলাকে একটি থার্মোফ্লাক্সের মধ্যে রেখে একটি ছিদ্রযুক্ত ছিপি দিয়ে মুখটি বন্ধ করতে হবে। এরপর ছিপির ছিদ্রের মধ্য দিয়ে একটি থার্মোমিটার এমনভাবে প্রবেশ করতে হবে, যেন থার্মোমিটারের নিচের প্রান্তটি অঙ্কুরিত ছোলাবীজগুলোর মধ্যে প্রবেশ করে থাকে। অনুরূপভাবে অপর থার্মোফ্লাস্কটিতে সিদ্ধ ছোলাবীজগুলোকে রাখতে হবে এবং অপর থার্মোমিটারটি স্থাপন করতে হবে। প্রতিটি থার্মোমিটারের পারদ তাপমাত্রার অবস্থান চিহ্নিত করে রাখতে হবে।
থার্মোমিটার পর্যবেক্ষণ:
কিছুক্ষণ পর দেখা যাবে জীবন্ত অঙ্কুরিত ছোলাবীজযুক্ত থার্মোফ্লাস্কের উষ্ণতার বৃদ্ধি ঘটায় থার্মোমিটারের তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটেছে। সিদ্ধ বীজযুক্ত থার্মোফ্লাস্কের উষ্ণতার বৃদ্ধি হয়নি অর্থাৎ এই থার্মোফ্লাস্কে রাখা থার্মোমিটারের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত আছে।
সিদ্ধ ছোলাগুলোর কোষগুলো জীবিত নয়। ফলে সেখানে শ্বসন প্রক্রিয়া চলছে না। অপরদিকে জীবিত ছোলাগুলোতে জীবন্ত কোষে শ্বসন প্রক্রিয়া চলছে। সেখানে উৎপন্ন তাপশক্তি তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, জীবন্ত কোষে শ্বসন প্রক্রিয়ার ফলে তাপশক্তি উৎপন্ন হয়।
তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ যে, শীতকালে যখন আমাদের নাক ও মুখ থেকে শ্বাস ছেড়ে দেই, তখন আমরা হালকা ধোঁয়ার মতো বাতাস বের হতে দেখি। আমরা যখন শ্বাস ছাড়ি তার সাথে আমাদের ফুসফুস থেকে জলীয় বাষ্প যোগ হয়। শীতের সময়ে এই শ্বাসের সাথে বের হয়ে আসা জলীয় বাষ্প বাইরের কম তাপমাত্রায় ছোট ছোট পানির কনায় পরিণত হয়, যা আমরা ধোঁয়ার মতো দেখি। আমরা সাধারণত নাক দিয়ে বাতাস নিই, আবার ছেড়ে দিই। আমাদের বুক হাঁপরের মতো অবিরত সংকুচিত ও প্রসারিত হয়। এতে ফুসফুসের আয়তন বাড়ে ও কমে৷ বুকে হাত দিলেই বিষয়টি টের পাবে। গভীরভাবে শ্বাস নাও আবার ছেড়ে দাও। এটিই মূলত তোমার শ্বসন প্রক্রিয়ার একটি দৃশ্যমান ধাপ। তবে কোষের ভেতরে সংঘটিত শ্বসন প্রক্রিয়ার অংশটুকু কিন্তু আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। কেবল পরীক্ষণের মাধ্যমে আমরা তা বুঝতে পারি।
ফুসফুস অবিরত সংকুচিত ও প্রসারিত হয়ে অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বন ডাইঅক্সাইড পরিত্যাগ করে। এভাবে অবিরত অক্সিজেন নেওয়া ও কার্বন ডাইঅক্সাইড পরিত্যাগ করা শ্বাসক্রিয়া নামে পরিচিত। এটা শ্বসনের একটি ধাপ। শ্বসন প্রক্রিয়াকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যথা ১. বহিঃশ্বসন ও ২. অন্তঃশ্বসন।
১. বহিঃশ্বসন: যে প্রক্রিয়ায় ফুসফুসের মধ্যে গ্যাসীয় আদান-প্রদান ঘটে, তাকে বহিঃশ্বসন বলে৷ এ পর্যায়ে ফুসফুস ও রক্তের মধ্যে অক্সিজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের বিনিময় ঘটে। বহিঃশ্বসন দুই পর্যায়ে সম্পন্ন হয়। যথা (i) প্রশ্বাস বা শ্বাস গ্রহণ: পরিবেশ থেকে আমরা যে অক্সিজেনযুক্ত বায়ু গ্রহণ করি, একে শ্বাস গ্রহণ বা প্রশ্বাস বলে। (ii) নিশ্বাস: প্রশ্বাসের পর পরই নিঃশ্বাস পর্যায় শুরু হয়। এ পর্যায়ে আমাদের ফুসফুস আয়তনে ছোট ও সংকুচিত হয়। ফলে বায়ুথলির ভিতরের বায়ু, কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস ফুসফুস থেকে পরিবাহিত হয়ে নাক দিয়ে বাইরে নির্গত হয়।
২. অন্তঃশ্বসন: অন্তঃশ্বসন প্রক্রিয়ায় দেহের কোষের মধ্যকার খাদ্য অক্সিজেনের সাহায্যে জারিত (Oxidized) হয়ে গতিশক্তি ও তাপশক্তিতে পরিণত হয়। ফুসফুসের রক্তে যে অক্সিজেন প্রবেশ করে, তা রক্তের মাধ্যমে বাহিত হয়ে প্রতিটি কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। তারপর এটি কোষের ভিতরের খাদ্যের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে শক্তি উৎপন্ন করে। এর ফলে তাপশক্তি ও কার্বন ডাইঅক্সাইড তৈরি হয়। এই কার্বন ডাইঅক্সাইড আবার রক্ত দ্বারা বাহিত হয়ে ফুসফুসে ফেরত আসে।
শ্বসনের গুরুত্ব
শ্বসন প্রক্রিয়াটি জীবের শক্তি ব্যবহারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ৷ প্রতিটি জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া সচল রাখার জন্য একটি জীবের শক্তি প্রয়োজন এবং ওই শক্তি শ্বসন থেকে আসে। শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় অপসারিত কার্বন ডাইঅক্সাইড সালোকসংশ্লেষণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্যবহৃত হয় এবং কার্বোহাইড্রেট তৈরি হয়। এই প্রস্তুত খাদ্য সমগ্র জীবজগতের জীবন রক্ষা করে। শ্বসন প্রক্রিয়া আমাদের কোষের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রক্রিয়ায় কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে আমাদের শরীরের ভারমাস্য নষ্ট হয় এবং বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে আমরা আক্রান্ত হয়ে পড়ি।
আরও দেখুন...