বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪৬০ কোটি বছর। নানা পরিবর্তন ও বিবর্তনের ভেতর দিয়ে প্রায় ৩০০ কোটি বছর আগে এক সময় পৃথিবীতে সৃষ্টি হয় প্রথম জীব কোষের। এই ক্রমবিবর্তন প্রক্রিয়ার এক পর্যায়ে মানুষের উদ্ভব ঘটেছে। সাম্প্রতিককালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে মানুষ আরো দ্রুত গতিতে তার চার পাশের প্রকৃতিকে প্রভাবিত, নিয়ন্ত্রিত ও রূপান্তরিত করে চলেছে। পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে এই পরিবর্তনের ধারাও হচ্ছে দ্রুততর। জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃষিতে এর প্রভাব বর্তমান সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত বিষয়, যা উপেক্ষা করারও সুযাগ নাই। জলবায়ুর উপাদানগুলোর অন্যতম হচ্ছে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা, বাতাসের আর্দ্রতা, চাপ ও এর প্রবাহ এবং বৃষ্টিপাত। পরিবেশের উপাদানগুলো হচ্ছে জীব বৈচিত্র, মাটি, পানি, ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ুর অবস্থার সমষ্টি। দীর্ঘদিন জলবায়ু ও পরিবেশের পারস্পরিক সম্পর্কের কারণে আমাদের এ অঞ্চলে পরিবেশ ও কৃষিতে একটি সুন্দর ধারার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ দূষণের কারণে প্রতিনিয়ত জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে এবং কৃষিতে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হচ্ছে।
জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে অকাল বা অসময়ে বন্যায় নিত্য প্রয়োজনীয় অনেক ফসল বিশেষত সবজি দ্রুত বিনষ্ট হচ্ছে। কেননা সবজি ফসল জলবায়ুর প্রতি বেশি সংবেদনশীল। অসময়ের বন্যায় নিচু এলাকার সবজি সাধারণত সম্পূর্ণভাবেই নষ্ট হয়ে যায়। বর্ষা মৌসুমে নদীর তীরবর্তী এলাকায় বর্ষার প্রভাব বেশি পড়ে এবং নদী তীরবর্তী ও চর এলাকার সবজি তলিয়ে গিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। অস্বাভাবিক জলোচ্ছ্বাসের ফলে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় বন্যার পানি প্রবেশ করে ফসলসহ সবজির ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়ে থাকে। সামদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের ফলে লবণাক্ত পানি উক্ত এলাকার মাটিকেও লবণাক্ত করে ফেলে সবজি উৎপাদনে দীর্ঘস্থায়ী বাধা সৃষ্টি করে থাকে
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত দিন দিন কমে যাওয়ায় কোন কোন অঞ্চলে মরুকরণ অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। এতে সবজি উৎপাদন ও ফলনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত কমায় শীতকালে ও খারিফ-২ মৌসুমে খরার প্রভাব সবজিতে প্রকট হতে পারে। খরা দীর্ঘমেয়াদি হলে সবজি পানির অভাবে কঠিন চাপের মধ্যে পড়ে। খরাতে গাছের শিকড় এলাকার মাটিতে গাছের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান ঠিকমত ছড়িয়ে পড়তে পারে না। ফলে গাছের অপুষ্টিজনিত কারণে বৃদ্ধি ও ফলনের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে এবং ফলন কমে যায়।
গ্রীষ্মকালে খরার জন্য ফলজাতীয় সবজির বোঁটায় এ্যাবসিসিক এসিডের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ও এ্যাবসিসিক স্তর তৈরি করে। এতে ফলজাতীয় সবজি ঝরে পড়ে এবং ফলন কম হয়।
ফসলে তাপমাত্রার প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট। ফসলের বৃদ্ধি, ফুল ফোটা, ফল ধারণ, ফলের বৃদ্ধি ইত্যাদির জন্য তাপমাত্রার প্রয়োজন হয় বলেই তাপামাত্রা ক্রান্তি মাত্রার নিচে বা উপরে হলে সবজি উৎপাদন বাধাগ্রস্থ হয়। আবহাওয়ার অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে সবজিতে নানা ধরনের পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের প্রকোপ দেখা দিতে পারে। যেমন কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় আলুতে আর্লি ও লেট বাইট রোগ, শিমে জাব পোকা, লতাজাতীয় সবজিতে মিলডিউ রোগের প্রকোপ বেড়ে যেতে পারে।। কলকারখানার ও ইটের ভাটার সৃষ্ট বিষাক্ত সালফার, ক্লোরিন ও অন্যান্য গ্যাসের কারণে তার পাশ্ববর্তী এলাকার সবজির ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়ে থাকে।
সবজি চাষে জলবায়ুগত সমস্যা
জলবায়ু বিভিন্ন উপাদান নিয়ে গঠিত। যথা- কোনো স্থানের তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, সূর্যের আলো, বায়ুর প্রবাহ ও আর্দ্রতা। উদ্ভিদের জীবনচক্র কয়েকটি সুনির্দিষ্ট পর্যায়ে বিভক্ত, যেমন বীজের অঙ্কুরোদগম, দৈহিক বৃদ্ধি, ফুল ও ফল ধারণ ও ফলের পরিপক্কতা লাভ ইত্যাদি। জীবনচক্রের এসব পর্যায়ে উপরেল্লিখিত উপাদানের প্রভাব নিম্নরূপ। এর অন্যথা হলে পুরো উৎপাদন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ হয় ।
তাপমাত্রা : বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকায় ১০° থেকে ৪০° সে:-এর মধ্যে উঠা নামা করে। বাংলাদেশে মাসিক গড় (সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা (ডিগ্রি সেঃ) নিচে উল্লেখ করা হলো
তাপমাত্রার আঞ্চলিক ব্যবধান অপেক্ষা ঋতুকালীন ব্যবধান অনেক বেশি। এপ্রিল-মে মাসে তাপমাত্রার উর্ধ্বসীমা সবচেয়ে উপরে উঠে এবং জুন-অক্টোবর মাসে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ব্যবধান কমে আসে। মাঝে মাঝে তাপমাত্রা ৪২° সে. পর্যন্ত উঠে এবং ৭° সে. পর্যন্ত নেমে আসে।
তাপমাত্রার প্রভাব ও উদ্ভিদের জীবনচক্র নিচের তিনটি মৌলিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। যথা-
১) সালোকসংশ্লেষণঃ সালোকসংশ্লেষণের সাহায্যে উদ্ভিদ খাদ্যোপাদান থেকে আলোর সাহায্যে যৌগিক পদার্থ তৈরি করে ।
(২) শ্বসনঃ শ্বসনের মাধ্যমে উদ্ভিদ কর্তৃক সংশ্লেষিত যৌগিক পদার্থ নিজের কাজে লাগায়
(৩) খাদ্য সংগ্রহঃ মাটি ও বায়ুমন্ডল থেকে খাদ্যোপাদান শোষণ এবং বিভিন্ন অঙ্গে ব্যবহার করে। উপরোল্লিখিত প্রক্রিয়াসমূহ তাপমাত্রা নির্ভর। ফলে জীবনচক্রের প্রতিটি পর্যায়েই তাপমাত্রার প্রভাব রয়েছে। উদ্ভিদের দৈহিক বৃদ্ধি প্রধানত সালোকসংশ্লেষণ ও শ্বসনের ভারসাম্যের উপর নির্ভরশীল। শ্বসনের হার তাপমাত্রার সাথে সমানুপাতিক কিন্তু সালোকসংশ্লেষণ হার একটি বিশেষ তাপমাত্রার উপরে গেলেও বাড়ে না। অধিকাংশ উদ্ভিদ জন্মে থাকে ৩০° সেঃ এর কাছাকাছি তাপমাত্রায়। শীতপ্রধান অঞ্চলের অধিকাংশ সবজি ফসলে ফুল ধরার জন্য নির্দিষ্ট নিম্ন তাপমাত্রা আবশ্যক। ফল ধরার ওপর শৈত্যের প্রভাবকে হিমাবেশন ( vernalization) বলা হয়। কপি গোত্রের সব সবজি যথা- শালগম, মুলা, সরিষা, চীনাকপি এবং গাজর, বিট, পালংশাক, পেঁয়াজ, লেটুস ও মটর ইত্যাদি দ্বিবর্ষজীবী সবজি। এগুলোর চাষাবাদ শীত মৌসুম ছাড়া অন্য মৌসুমে ভালভাবে করা যায় না।
কেননা (১) শারীরবৃত্তীয় ও জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার উপর তাপমাত্রার মারাত্মক প্রভাব আছে ।
(ক) গোল আলুর ২০° সেঃ সালোকসংশ্লেষণ সর্বোচ্চ হয়;
(খ) শিকড় কর্তৃক আহরিত খাদ্য উপাদানের সঞ্চালন ১৮-২২° সে. তাপমাত্রায় সঠিকভাবে সম্পন্ন হয় ।
(২) বীজের অঙ্কুরোদগমে তাপমাত্রার প্রভাব আছে? অঙ্কুরোদগমের জন্য শাক-সবজি বীজের একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। উক্ত তাপমাত্রায় বীজের সহজে ও দ্রুত অঙ্কুরোদগম ঘটে। তাপমাত্রা উপরে বা নিচে থাকলে অঙ্কুরোদগম প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয় এবং এক পর্যায়ে অঙ্কুরোদগম হয় না। যেমন-টমেটো বীজ ২৫° সে. তাপমাত্রায় ৬-৭ দিনের মধ্যে অঙ্কুরোদগম করে। কিন্তু তাপমাত্রা নিচে নেমে ১২-১৩° সে. পৌছলে অঙ্কুরোদগম হতে ১২ দিন সময় লাগে ৷
(৩) শাক-সবজি চারার উপর তাপমাত্রার প্রভাব আছে? অঙ্কুরোদগমের পর বিশেষ করে ৯-১২ দিনের মধ্যে অনেক শাক-সবজির চারাকে অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রায় (১১-১২° সে.) জন্মানো উচিত। এ সময়ের নিম্ন তাপমাত্রা চারাকে তেজস্বী শিকড় গুচ্ছ তৈরি করতে সাহায্য করে। ফলে মাঠে রোপণের পর পরিবর্তিত পারিপার্শ্বিক অবস্থা সহ্য করে চারা সহজেই বেঁচে উঠতে পারে। তাপমাত্রা শাক সবজির ফুল ধারণকেও প্রভাবান্বিত করে। যেমন- টমেটো। শীতকালীন সবজির ক্ষেত্রে চারা রোপণের সময় পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত একটু বেশি হওয়া উচিত (১৫-২০° সে.)।
(৪) অঙ্গজ বৃদ্ধিতে তাপমাত্রার প্রভাব আছে ও শাক সবজির অঙ্গজ বৃদ্ধিতে তাপমাত্রার প্রভাব অপরিসীম । বিভিন্ন শাক-সবজির তাপমাত্রার চাহিদা বিভিন্ন রকম ।
(১) পাতাজাতীয় শাক-সবজি : ১২-১৭° সে. (দিবসকালীন তাপমাত্রা) (২) টমেটো, শিম, বেগুন, পেঁয়াজ : ২০-২৫° (৩) ফলজাতীয় সবজি : ২৫-৩০° (৪) মূলজাতীয় সবজি : ১৫-২২° (৫) পালংশাক, লেটুস, বাঁধাকপি : ৭-১৩° (৬) বেগুন : ১৩-১৮° (৭) টমেটো, মিষ্টি আলু, ঢেঁড়শ : ১৮-২৪° |
৫। ফলোৎপাদনে তাপমাত্রার প্রভাব আছে ও শাক-সবজির ফুল ও ফল উৎপাদনকালে তাপমাত্রা তুলনামূলক কিছুটা কম থাকা উচিত । তাতে গাছে শ্বসনের চেয়ে সালোকসংশ্লেষণের হার বৃদ্ধি পায় এবং ফলে সঞ্চিত শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায় । টমেটো গাছের ফুলের পরাগায়নে তাপমাত্রার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। যথা-অধিক তাপমাত্রায় টমেটো ফুলের গর্ভকেশর অতিরিক্ত লম্বা হয়ে যায়। উচ্চ তাপমাত্রায় গর্ভমুণ্ড শুকিয়ে যায়। নিম্ন তাপমাত্রায় পরাগরেণু নষ্ট হয়ে যায়- যা স্ব-পরাগায়নকে বিঘ্নিত করে।
অত্যাধিক নিম্ন তাপমাত্রায় কীট পতঙ্গের তৎপরতা তুলনামূলকভাবে কমে যায়। বিধায় শীতকালে জন্মানো Cucurbitaceae গোত্রের সবজি যেমন- লাউ এবং কুমড়ার পর পরাগায়নের হার কমে যায়। ফলের গুণাগুণকেও তাপমাত্রা প্রভাবিত করে।
লেটুসঃ ২১° সে. তাপমাত্রায় ভাল হয়।
গাঁজরঃ ১২-২১° সে. তাপমাত্রায় ভাল হয়।
বিটঃ ঠান্ডা আবহাওয়ায় ভাল হয়
টমেটোঃ ১৮-২৪° সে. থাকলে উত্তম হয়।
২৭° সেঃ -এর চেয়ে বেশি তাপমাত্রায় টমেটোতে হলুদ রঙের ভাব বাড়তে থাকে ।
(৬) সংগৃহীত ফসলের ওপর তাপমাত্রার প্রভাব : যেসব সবজি ফসলে সাধারণত অধিক পরিমাণে শর্করা থাকে, সংগ্রহের পর সেগুলোতে প্রধানত নিম্নলিখিত বিক্রিয়া ঘটে থাকে।
১। চিনি → শর্করা ২। শর্করা → চিনি ৩। চিনি → (Co2+H2O+ Heat + শক্তি) নিম্নতাপমাত্রায়ঃ ১ম ও ৩য় বিক্রিয়া অপেক্ষাকৃত কম হারে চলে। এজন্য নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষিত সবজি ফসলে চিনি বেশি পরিমাণে সঞ্চিত হয়। উদাহরণ- আলু ০-৪° সেঃ তাপমাত্রায় সঞ্চিত করলে মিষ্টি হয়ে যায়। উচ্চ তাপমাত্রায় তিন ধরনের বিক্রিয়াই বেশি হারে চলে । তবে তৃতীয় বিক্রিয়া তুলনামূলকভাবে বেশি মাত্রায় হয়। এমতাবস্থায় চিনির পরিমাণ কমে আসে। অতিরিক্ত নিম্ন তাপমাত্রায় বেশিদিন গুদামজাত করা হলে সবজি ৩০-৭০% ভিটামিন সি বাড়ায়।
(৭) শাক-সবজির সর্বোত্তম, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ও তাপমাত্রা এরূপ হওয়া উচিত যাতে গাছের সালোকসংশ্লেষণ অধিক হয়, কিন্তু শ্বসন স্বাভাবিক হারে চলে। ফলে গাছে অঙ্গজ বৃদ্ধি এবং ফলোৎপাদনের জন্য অধিক পরিমাণে শর্করা সঞ্চিত হয়।
ক. সর্বোত্তম তাপমাত্রাঃ যে তাপমাত্রায় গাছ যথেষ্ট পরিমাণ শর্করা সঞ্চয়ের মাধ্যমে তার স্বাভাবিক অঙ্গজ বৃদ্ধি অব্যাহত রেখে অধিক ফলন দেয় তাকেই সে গাছের কাঙ্খিত তাপমাত্রা বলে।
খ. সর্বোচ্চ তাপমাত্রাঃ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বলতে সেই তাপমাত্রাকে বোঝায় যাতে গাছ সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে তৈরি শর্করার প্রায় সবটাই অতিরিক্ত শ্বসন কাজে ব্যবহার করে। যার ফলে স্বাভাবিক অঙ্গজ বৃদ্ধি আর অব্যাহত থাকে না ।
গ. সর্বনিম্ন তাপমাত্রাঃ সর্বনিম্ন তাপমাত্রায় গাছে সালোক সংশ্লেষণ ও শ্বসনের হার কমে যায় এবং গাছে। শর্করার সঞ্চয় আর হয় না। পরিণতিতে অঙ্গজ বৃদ্ধি থেমে থাকে।
৮. গাছের উপর বিভিন্ন তাপমাত্রার প্রভাব আছে।
আলোর প্রভাব ও উদ্ভিদের উপর আলোর প্রভাব দু'ধরনের। যথা
(১) সালোকসংশ্লেষণের জন্য আলো প্রয়োজন ।
(২) দিবস দৈর্ঘ্য দ্বারা উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও উন্নয়ন প্রভাবিত হয়। দিবস দৈর্ঘ্যের প্রভাব ২ ধরনের অর্থাৎ দৈর্ঘ্য কমবেশি হওয়ার সাথে সাথে সালোকসংশেষণের জন্য প্রান্ত মোট সময়ের ভিন্নতা ঘটে । কিছুসংখ্যক উদ্ভিদের ফুল ধারণ সম্পূর্ণভাবে দিবস দৈর্ঘ্যের উপর নির্ভরশীল। শীতপ্রধান অঞ্চলের অনেক সবজির ফুল ধরার জন্য দীর্ঘ দিবস আবশ্যক, নিরীয় এলাকার অনেক সবজির কেবল খাটো দিবসে ফুল ধারণ করে। অবস্থান অনুযায়ী বাংলাদেশে দিবাভাগের দৈর্ঘ্য ১০.২ থাকে ১৩.৮ ঘন্টার মধ্যে। তবে মেঘের কারণে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত দৈনিক গড়ে সর্বোচ্চ ৯ ঘন্টা আলো দিনে পাওয়া যায়। জুন-সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ণ আলো দিনে গড়ে ৫ ঘন্টারও কম হয়। বাংলাদেশে প্রতি মাসের গড় দৈনিক আলোকিত সময় ।
আলোর প্রখরতা : আলোর প্রখরতার ভিত্তিতে শাক-সবজির প্রকারভেদ-
(১) আলো পছন্দকারী শাক-সবজি : যেমন : বেগুন, আলু, টমেটো।
(২) মধ্যম আলো পছন্দকারী শাক-সবজি : যেমন-ডাটাশাক, নটেশাক, পুঁইশাক ।
(৩) ছায়া পছন্দকারী শাক-সবজিঃ যেমন-কচু (মৌলভী কচু), ওলকচু, গাছ আলু।
আলোর স্থিতিকালঃ শিমের বীজ যখনই বপন করা হোক না কেন কেবল ছোট দিবসেই এ গাছে ফুল আসে। পুষ্প উৎপাদন আলোর স্থিতিকালের ওপর নির্ভর করে। শাক-সবজিকে আলোর স্থিতিকালের ওপর ভিত্তি করে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১. ছোট দিবস উদ্ভিদঃ যেমনঃ শিম;
২. দীর্ঘ দিবস উদ্ভিদঃ যেমন- পেঁয়াজ, গাঁজর;
৩. দিবস নিরপেক্ষ উদ্ভিদ : যেমন-টমেটো, মরিচ, বেগুন।
(৯) বৃষ্টিপাতের প্রভাব আছেঃ উদ্ভিদের উপর বৃষ্টিপাতের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। মাটি ও বাতাসের আর্দ্রতা প্রধানত বৃষ্টিপাত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অতিবৃষ্টির কারণে সবজি ফসল নষ্ট হওয়া বাংলাদেশে একটি সাধারণ ঘটনা। বাতাসে আর্দ্রতার আধিক্য সবজিতে রোগ ও পোকার উপদ্রব বাড়ায়। বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের সাথে ঝড়-তুফানের ঘনিষ্ট যোগ রয়েছে। ঝড় তুফান ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে।
(১০) বায়ুর প্রভাব আছে ও শাক-সবজি উৎপাদনে বাতাসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বাতাস একদিকে তার উপাদান এবং অন্যদিকে তার প্রবাহের গতিবেগ দিয়ে শাক-সবজি উৎপাদনকে প্রভাবিত করে। বাতাসে প্রায় ০.৮ ভাগ নাইট্রোজেন, ০.২ ভাগ O2, ০.০৩ ভাগ CO, আছে। এছাড়াও বায়ু পরাগায়নে সহায়তা করে ।
(১১) বাতাসের আর্দ্রতাঃ বাংলাদেশে প্রায় সারা বছরই বাতাস যথেষ্ট আর্দ্র থাকে। তবে ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল বছরের শুষ্কতম মাস। এ সময় সর্বোচ্চ আর্দ্রতা ৭৫% ও ৮৫% এবং সর্বনিম্ন আর্দ্রতা ৪০%-৬৫% এর মধ্যে অবস্থান করে।
(১২) ঝড় তুফানঃ বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে ঝড় তুফান বয়ে যাওয়া বাংলাদেশের জলবায়ুর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মার্চ-মে মাসে প্রতিবছরই ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় হয়। কোনো কোনো সময় এর সাথে শিলাবৃষ্টিও হয়ে থাকে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসেও কিছু ঝড় হয়ে থাকে। এসব উপাদানসমূহ শাক-সবজি উৎপাদনে ভীষণভাবে প্রভাব ও সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে । সবজি চাষে উৎপাদন উপকরণ সমস্যা শাক-সবজি চাষে বিভিন্ন ধরনের উপকরণের প্রয়োজন হয়। সেগুলো সঠিক সময়ে প্রাপ্যতা, উপকরণের মূল্য, উপকরণের উপযুক্ততা ও তার গুণাগুণ সবজি চাষকে অনেকাংশে প্রভাবিত করে। যেমন: বীজ, জাত, সার, কীটনাশক, সেচের পানি ও কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি।
(ক) বীজঃ বাংলাদেশের জাত ও মান সম্পন্ন সবজি বীজের অভাব খুবই প্রকট এবং অধিকাংশ চাষী উন্নত জাতের বীজ সম্পর্কে অজ্ঞ। ফলে তারা হাতের কাছে যে বীজ পায় সেগুলো উন্নত কী না বা ভাল জাত কীনা তা বিবেচনা না করেই চাষ করে থাকে। অনুন্নত জাত ও নিম্ন গুণাগুণ সম্পন্ন বীজ বপন বা রোপণ করে তারা আশানুরূপ ফসল পায় না। বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে বেশি তাপমাত্রা ও অনিয়ন্ত্রিত বৃষ্টিপাত এবং শীতকালে স্বল্পমেয়াদী ঠান্ডা আবহাওয়া বিরাজ করে, যা উন্নতমানের বীজ উৎপাদনের অন্তরায়। তথাপিও প্রতিকূলতার মধ্যে যেটুকু বীজ উৎপাদিত হয় তা আবার সঠিকভাবে শোধন ও সংরক্ষণের অভাবে গুনাগুণ বজায় থাকে না। তবে মানুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রণযোগ্য এ সমস্যা দূরীকরণে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমনঃ
১। বিভিন্ন সবজির জাত বাছাই করে সেখান হতে উন্নতজাতগুলো নির্বাচন করা ।
২। আবাদযোগ্য পুষ্টিকর সবজির জাত উদ্ভাবন বা সংগ্রহপূর্বক পরীক্ষা করে তা প্রবর্তন করা।
৩। বীজের আমদানী নির্ভরতা কমায়ে স্থানীয় উৎপাদন ব্যবস্থাকে জোরদারকরণে সহায়তা করা ।
৪। চাষীদের উদ্বুদ্ধ করা ও সময়মত উন্নত বীজ সহজলভ্য করা।
৫। বীজ প্রাপ্তির জন্য তথ্য সরবরাহ জোরদার করা ।
৬। বীজ উৎপাদনে কৃষকদের কারিগরি সহায়তা প্রদান করা ।
৭। বীজ উৎপাদনে ভর্তুকী প্রদান করা।
৮। বীজ উৎপাদিত চাষীদের পৃথক পরিচিতির ব্যবস্থা করা।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১০০টি ফসলের চাষ হচ্ছে। এ সমস্ত ফসল চাষাবাদের জন্য বছরে প্রায় ১০ লক্ষ মে. টন বীজের প্রয়োজন হয়। এ পরিমাণ বীজের নূন্যতম মূল্য প্রায় ১৪-১৫ কোটি টাকা। প্রায় ১০০টি ফসলের মধ্যে মাত্র ধান, গম, পাট, আলু এবং কিছুসংখ্যক সবজি, ডাল ও তৈলবীজ সরকারি ব্যবস্থাপনায় সরবরাহের ব্যবস্থা করা ধান-১.২%, গম-১.৬%, আলু-৩.৫৫%, পাট-১০%। এবং অন্যান্য বীজ অতি সামান্য যা পরিসংখ্যানে আনা কঠিন। অথচ উন্নত দেশে শতকরা ১০০ ভাগ ভাল জাতের ও মান সম্পন্ন বীজ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সরকারিভাবে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ভাল বীজ উৎপাদনে খরচ বেশি হয়। যার ফলে কৃষকদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় রাখা বীজ অপেক্ষা মূল্য বেশি হওয়ায় কৃষকরা ভাল বীজ কিনতে আগ্রহী হয় না।
১৯৮০-৮১ সাল থেকে বি.এ.ডি.সি সবজি বীজ প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব দুটি খামার বীজ উৎপাদন শুরু করেছে। বর্তমানে সবজি বীজ উৎপাদন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ১০০ টন বিভিন্ন জাতের সবজি বীজ উৎপাদন প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া বেসরকারি সংস্থা বীজ উৎপাদন বাস্তবায়নের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে ।
সারণিঃ বিএডিসি কর্তৃক বিভিন্ন ফসলের বীজ সরবরাহের পরিমাণ (মেট্রিক টন)।
সার : সার দু'ভাগে বিভক্ত, যথা-জৈব ও অজৈব। জৈব সারের মধ্যে গোবর সার উত্তম। গোবর সার কোন গর্তে সংরক্ষণ করে চালা দিয়ে দিয়ে রাদে বৃষ্টি ইত্যাদি হতে রক্ষা করে পচায়ে ব্যবহার করা ভালো। এতে সারের গুণাগুণ নষ্ট হয় না বরং উপযুক্ত পরিমাণে থাকে। কৃষকদের অজ্ঞতার কারণে গোবর সার সংরক্ষণ ঠিকমত করা হয় না এবং তাদের সারে প্রায় সকল পুষ্টি উপাদান নষ্ট হয়ে যায়। জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য শিম জাতীয় ফসল যেমন ধৈঞ্চা, বরবটি, শনপাট, মাসকালাই, গামেটরশুটি ইত্যাদি সবুজ সার হিসেবে চাষ করা যায়। তবে ফুল আসার পর্যায়ে এগুলো চাষ করে মাটিতে মিশায়ে দিলে জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যায়। বাসাবাড়ির ঝাড়ু দেওয়া ময়লা আবর্জনা, ঘাস, কচুরিপানা, তরকারি ও ফলমূলের পরিত্যক্ত অংশ হাঁস মুরগির বিষ্ঠা ইত্যাদি পঁচায়ে কম্পোষ্ট বা আবর্জনা পচা সার তৈরি করা যায়। এর গুণাগুণও গোবর সারের অনুরূপ। জ্বালানী সংকটের কারণে গ্রামাঞ্চলে গোবর থেকে জ্বালানী তৈরি করে থাকে। এ কারণে গোবর সারের অপ্রতুলতা রয়েছে। খাদ্য চাহিদা ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় সবুজ সার করা সম্ভব হচ্ছে না। জনগণের সচেতনতার অভাবেও কম্পোষ্ট বা আবর্জনা পচা সারও সংরক্ষণ করা হয় না। জমির অত্যধিক ব্যবহার পাশাপাশি জৈব সারের ব্যবহার অপর্যাপ্ত হওয়ায় দিন দিন জমির জৈব পদার্থের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। যারফলে জমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে এবং উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
কোন সবজি চাষে কী পরিমাণ ও কী ধরনের সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। আবার কখন এবং কীভাবে সার প্রয়োগ করতে হবে সে সম্পর্কে যথোপযুক্ত জ্ঞানের অভাবে পরিমিত পরিমাণ সার ব্যবহার করা হয় না। ফলে ফসলের ফলন কমে যায় ও গুণগত মান বজায় থাকে না। তবে সমস্যা দূরীকরণার্থে কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন-
১. সবজির বৈশিষ্ট্য ও চাহিদা নিরূপণ।
২. মাটির বুনট, জমির অবস্থান ও মৌসুমভিত্তিক ফসলের সারের সুষমমাত্রা নিরূপণ। এছাড়া সারের প্রয়োগ পদ্ধতি ও ফসলের বয়সের সাথে সাথে প্রয়োগ সময় নির্ণয়পূর্বক সুপারিশ করা।
৩. সারের ধরণ অনুযায়ী উপযুক্ত সময়ে ও উপযুক্ত পদ্ধতিতে সার প্রয়োগে উদ্বুদ্ধ করা।
৪. প্রদর্শনী প্লট স্থাপন, কৃষকদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান, সার সহজলভ্য করা ও অন্যান্য প্রচারণার মাধ্যমে সার ব্যবহারের সুফল প্রদর্শন করা ।
৫. একক উপাদানের সার প্রস্তুত না করে যৌগিক উপাদানের সার প্রস্তুত করা, গুণাগুণ বজায় রেখে সার সংরক্ষণ করা।
৬. আগ্রহী ও ভাল কৃষকদেরকে পুরস্কৃত করা।
রোগ ও পোকামাকড় দমনে বালাইনাশক
কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই সবজি ফসলের প্রধান শত্রু। এদের আক্রমণে কেবল ফলনই কমে যায় না, সবজির গুণগত মানও নষ্ট হয়। ফলে সেগুলো বাজারে বিক্রি, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও অনেক সময় আহারের অনুপযোগী হয়ে যায় । শাকসবজি রোগবালাইয়ের হাত হতে রক্ষার জন্য বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। কীটনাশকের কার্যপদ্ধতি সাধারণত ৬ (ছয়) ভাগে বিভক্ত। যথা-পাকস্থলীর বিষ, স্পর্শ বিষ, অবশেষ বিষ সিষ্টেমিক বিষ, ধূপণ বিষ ও বিতাড়নকারী বিষ। আমাদের দেশে সকল বিষই রাসায়নিক বা সিনথেটিক বিষ যা মাটি পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।
পাকস্থলী বিষ- এই বিষ পৌষ্টিক নালীর উপর ক্রিয়া করে। দর্শন-চর্বণ, চোষণকারী ও লেহনকারী পোকা-মাকড়ের জন্য এ জাতীয় কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। ঔষধ প্রয়োগকৃত গাছের অংশবিশেষ খাওয়ার পরে পাকস্থলীতে বিষ প্রবেশ করে পোকামাকড় আক্রান্ত হয়। যেমন-ঘাসফড়িং, শুয়াপোকা, বিটল, আঁঠালো পাকা ইত্যাদি। লেড, আরসেনেট গ্রুপের ঔষধ, প্যারিস গ্রীণ ইত্যাদি পাকস্থলীতে ক্রিয়া করে।
স্পর্শ বিষ- এই বিষ কীটপতঙ্গ স্পর্শের মাধ্যমে শরীরের ভিতর প্রবেশ করে বিনাশ সাধন করে। এরা সাধারণত ত্বকের বিশেষ স্থান দিয়ে দেহের ভিতর প্রবেশ করে। এই কীটনাশক ঔষধ সরাসরি কীটপতঙ্গের ওপর প্রয়োগ করা যায়। কিছু বিষ আছে যা কীটের ডিমের উপর কার্যকরী এবং ডিমকে নষ্ট করে। এরকম বিষ স্পর্শ বিষের শ্রেণিভুক্ত । সুমিথিয়ন, নেক্সিয়ন, ডিডিটি ইত্যাদি স্পর্শ ক্রিয়াকারী ঔষধ।
অবশেষ স্পর্শ বিষ- কতকগুলো কীটনাশক আছে যেগুলো ব্যবহার করার পর দীর্ঘসময় ধরে মাটিতে ক্রীড়ার ক্রিয়া থাকে। ইহা সাধারণত মাটিতে বসবাসকারী পোকামাকড় মারার জন্য ব্যবহার করা হয়। যেমন- সেভিন ক্যালথেন, ইত্যাদি।
সিস্টেমিক বিধ- এ বিষ কীটনাশক গাছের শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রয়োগের পর পাতা, কান্ড শিকড় ইত্যাদিতে প্রবেশ করে সর্বাংশ বিষাক্ত করে। পরে কোন পোকামাকড় যেমন, ছাতরা পোকা, মাজরা পোকা, ফড়িং গাছের রস চুষে খেলে বা চর্বণ করলে বিষক্রিয়ায় মারা যায়। যে কোন সিস্টেমিক ঔষধ ব্যবহার করা যায়।
ধুপণ বা ধোঁয়াকারী বিষ- এই বিষ বাষ্প হিসেবে কীটপতঙ্গের শরীরে, শ্বাসযন্ত্রের ভিতর ও শ্বাসনালীতে প্রবেশ করে কীটের মৃত্যু ঘটায়। এ ঔষধ সাধারণত গর্তে বা বদ্ধ কক্ষে প্রয়োগ করা হয়। কাটুই পোকা, গুদামজাত শস্যের পোকা ইত্যাদি মারার জন্য ধোঁয়া উৎপাদনকারী বিষ ব্যবহার করা হয়। মিথাইল ব্রোমাইড, ফসটকসিন, ইডিসিটি ইত্যাদি ধোঁয়াকারী ঔষধ।
বিতাড়নকারী বিষ- এই জাতীয় কীটনাশক বইপুস্তক, কাপড়-চোপড় সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয়। ফসল ক্ষেতের চারপাশে বিতাড়নকারী বিষের দ্রবণ তৈরি করে ছিটালে গন্ধে পোকামাকড় দূরে সরে যায়। এ বিষে পোকা মরে না, তবে দূরে সরে যায়। তেলাপোকা, উই, ঘুগরি পোকা, পামরি ইত্যাদি পোকা ফসলের জমি হতে দুরে সরায়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়। ডীট, সাইট্রোনেলা, ন্যাপথলিন, কেরোসিন ইত্যাদি বিতাড়নকারী ঔষধ।
ফসলে পোকা- পোকামাকড়ের আক্রমণের ধরন এবং ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণ করে পরিমিত পরিমাণ বালাইনাশক ব্যবহার করতে হয়। তাছাড়া বালাইনাশকের একদিকে অপচয় হবে, অপরদিকে মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতি হবে। এতে আস্তে আস্তে পোকামাকড়ের বংশ পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে সহায়তা করা হবে। তাই এ ব্যাপারে কৃষকদের সম্যক জ্ঞান না থাকলে বালাইনাশকের সফল প্রয়োগ সম্ভব নয়। বালাইনাশকের বিষক্রিয়া ও পোকামাকড়ের আক্রমণ মৌসুম পোকামাকড়ের ধরন বিবেচনা করে বালাইনাশক বাজারজাত করা হয় না বলে কৃষকরা নানাবিধ সমস্যায় পড়ে থাকে। বালাইনাশকের বাজারমূল্যও অনেক বেশি, যার ফলে কৃষকরা সময়মত ও উপযুক্ত পরিমাণে বালাইনাশক ব্যবহারে আগ্রহী হয় না। বাজারে যে সমস্ত বালাইনাশক বিক্রি হচ্ছে তার মধ্যে অধিকাংশ ভেজাল বা নিম্নমানের এবং কিছু কিছু নিষিদ্ধ ।
সেচ সুবিধার অপ্রতুলতা- সেচ সুবিধা ব্যতীত শীতকালীন ও আগাম গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষ করে আশানুরুপ ফল পাওয়া সম্ভব না। এদেশে সবজি চাষে ব্যবহার উপযোগী সেচ সুবিধা খুবই অপ্রতুল। বর্তমানে বিদ্যমান সেচ সুবিধাদি শুধু দানাজাতীয় শস্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে সবজি চাষ জোরদারকরণের জন্য নিম্নোক্ত প্রচেষ্টা দরকার।
১. আবাদ মৌসুম ও চাষ পদ্ধতি বিন্যাস করে বর্ষার স্বাভাবিক আর্দ্রতায় সবজি চাষ বাড়ানো ।
২. বসতবাড়ি, পুকুর, ডোবা ও নালার আশেপাশে ও অন্যান্য ফসলের আইলে বেশি করে সবজির চাষ করা।
৩. খরা সহিষ্ণু সবজির চাষ বৃদ্ধি ও পরিচর্যার মাধ্যমে জমির রস সংরক্ষণ করে বেশি করে চাষ করা।
৪. সবজি চাষোপযোগী জমিতে শুধু দানা শস্য চাষের মানসিকতা পরিবর্তন করে সবজি চাষ করা।
৫. ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমায়ে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার করা। এজন্য বিভিন্ন স্থানে পানির আঁধার সৃষ্টি করা
৬. বৃষ্টির পানি ব্যবহারের সুবিধা তৈরি করা।
৭. হেক্টরপ্রতি ফলন কম
সবজির অনিশ্চিত বাজার মূল্যের কারণ
সবজি বিক্রয়ে বাংলাদেশে বাজার ব্যবস্থায় চরম নৈরাজ্য বিরাজমান। এ যাবৎ সবজি বিক্রয়ের কোন কাঠামো গড়ে উঠেনি, যেখানে কৃষকরা তার পণ্য বিক্রির বা উপযুক্ত বাজারমূল্য প্রাপ্তির জন্য সহায়তা পেতে পারে।
(১) কৃষক তার উৎপাদিত সবজি ভোক্তার নিকট বিক্রয় করে স্থানীয় বাজারসমূহে। এক্ষেত্রে বাজারের চাহিদা বা সরবরাহ সম্পর্কে কৃষকের নিকট আগাম কোন তথ্য থাকে না। যার ফলে বাজারে গিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে সবজি নিয়ে বসে থাকতে হয় এবং ক্রেতার সমাগম হলে বিক্রি হয়, নতুবা অনেক সময় ফেরৎ নিয়ে আসতে হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে কোন কোন সময় শুধু পরিবহণ ব্যয় নির্বাহের জন্যও খুব কম দামে বিক্রি করতে হয়।
(২) কৃষককে অনেক সময় সবজি বাজারে নিয়ে গিয়ে বাজার জমে উঠার আগেই ফড়িয়ার কাছে বিক্রয় করতে হয়। এক্ষেত্রে আশানুরুপ দাম সে পায় না। এমনকি ফড়িয়ার নিকট বিক্রি না করলে অনেক চাপের মুখে পড়তে হয়।
(৩) সবজি দূরবর্তী বাজারে প্রেরণ করতে হলে পরিবহণ ও বিক্রয় প্রতিনিধি প্রেরণের কারণে অল্প পরিমাণ সবজিতে বেশি খরচ হয়ে যায়। এতে কৃষক তার উৎপাদিত সবজির উপযুক্ত মূল্য প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হয়।
(৪) কৃষকদেরকে সবজি উৎপাদন করে অনেক ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট বাড়ি, হোটেল, রেস্তোরা, নির্দিষ্ট বাজার, বিশেষ এলাকার খুচরা বিক্রেতাদের নিকট বিক্রয় করতে হয়। এরূপ অবস্থায় ভোক্তা কখনো কখনো ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতই হোক সবজি ক্রয়ে অনাগ্রহ দেখায়। সেক্ষেত্রে বিক্রয় এবং বিক্রয়মূল্য অনিশ্চিত হয়ে যায়।
(৫) ফড়িয়া বা চুক্তিবদ্ধ সরবরাহকারী মাঝে মাঝে এলাকায় সবজি ক্রয় করতে যাওয়া বন্ধ করে দেয় বা হঠাৎ করে দুই চারদিন সবজি ক্রয় করে না এতে সবজি বিক্রেতা কৃষকরা দুর্বিপাকে পড়ে।
(৬) কৃষকদের উৎপাদিত সবজির উৎপাদনের পরিমাণ যাই হোক না কেন তা ক্রয়ের জন্য বিধিবদ্ধ বা সমবায়ভিত্তিক কোন বাজার ব্যবস্থা নাই। যার ফলে কৃষকদের সবজি বিক্রয়ের নিশ্চিত ব্যবস্থাও তৈরি হয়নি।
(৭) সবজি উৎপাদনে ব্যয়ের নির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই। কেননা হঠাৎ করে উৎপাদন উপকরণের ঘাটতি দেখা দেয়, মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যায়, উপকরণ ভেজাল হয় ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যয়ের নির্দিষ্ট মান নির্ধারণ ব্যবস্থা নাই বা কোন সংস্থা নাই, যার মাধ্যমে বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করার যৌক্তিক সমর্থন পাবে। তাই সবজির বাজার ব্যবস্থায় কোন প্রকার নিশ্চয়তা নাই।
(৮) কৃষকরা দরিদ্র হওয়ায় তাদের উৎপাদিত সবজি বিক্রয়ের জন্য হিমাগারে সংরক্ষণ বা ভাল প্যাকিং ব্যবস্থায় সুপার মার্কেটে প্রেরণ বা সংরক্ষণযোগ্য সবজি বেশিদিন ধরে রাখতে পারে না।
(৯) স্বল্প সুদে বা বিনা সুদে ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ না থাকায় কৃষকরা তাদের সবজি উৎপাদনের জন্য স্থানীয় লগ্নীকারীদের নিকট ফসল উঠার আগেই নামমাত্র মূল্যে আগাম বিক্রি করে থাকে। এমনকি অত্যন্ত চড়াসুদেও ঋণ নিতে হয়, এতে উৎপাদন খরচ খুব বেশি হয়ে যায়।
(১০) কৃষকরা অ-সংগঠিত হওয়ায় বিক্ষিতভাবে পণ্য মাঠ হতে উঠায় এবং বিক্ষিপ্তভাবে বিক্রি করে থাকে। এমনকি কৃষকদেরকে সবজি বিক্রির জন্য সরকারিভাবে কোন সহায়তা দেওয়া হয় না, বিক্রির জন্য আইনগত কোন সমর্থন দেওয়া হয় না, সরাসরি বিক্রির জন্য কৃষকদের নির্দিষ্ট স্থান বা কোটা ব্যবস্থা করা হয়নি। যার ফলে কৃষকরা সবজি বিক্রি করে ভাল দাম পায় না।
(১১) বাজার সম্পর্কীত তথ্য-সবজি উৎপাদনকারীদের নিকট পৌছানোর দায়িত্ব পালনের জন্য কোন সংস্থা সরকার গড়ে তোলেনি। বাজার তথ্য না জানার কারণে সবজি কোনদিন উঠাবে বা কোন বাজারে পাঠাবে তা তারা ঠিক করতে না পারায় সবজির উপযুক্ত মূল্য পায় না ।
(১২) ওজনের বাটখারার জালিয়াতির কারণে ফড়িয়া বা মধ্যস্বত্বভোগী বা আড়তদারদের কাছে সবজি সরবরাহ করে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এছাড়াও সবজির মাপ অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নিয়মে অনুসরণ করার কারণেও কৃষকরা ঠকে থাকে। এভাবে কৃষকরা উপযুক্ত বাজারমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়।
(১৩) সবজি শ্রেণিবিভাগকরণ ব্যবস্থা গড়ে না উঠার কারণে বড়, ছোট, কচি, পরিপুষ্ট, জৈব উৎপাদন, অজৈব উৎপাদন ইত্যাদি সবই একই বাজারে একই দামে একই নিয়মে বিক্রি হয়। সবজি শ্রেণীবিভক্তকরণ সংস্কৃতি গড়ে উঠলে কৃষকদের পক্ষে ভাল বাজার মূল্য পাওয়ার সুযোগ তৈরি হতো। কিন্তু এ যাবৎ সরকারিভাবে এমন কোন উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।
(১৪) অপর্যাপ্ত ও অদক্ষ পরিবহণ ব্যবস্থার কারণে সবজি উঠায়ে স্থানান্তরে যথেষ্ট সময় লাগে, প্রচুর ব্যয় হয়, পথে পরিবহণে পণ্য নষ্ট হয়ে যায় । আর এর সমস্ত ক্ষতির অংশটুকু সবজি উৎপাদকের ওপর ন্যস্ত হয় । যারফলে কৃষক বা উৎপাদক সঠিক বাজারমূল্য পায় না।
বাংলাদেশে সবজি চাষের সমস্যা সমাধানের উপায়
বাংলাদেশে সবজি উৎপাদনের সমস্যা সম্বন্ধে আলোচনা করা হলো ।
(১) জলবায়ুগত সমস্যাঃ বাংলাদেশে বিরাজমান জলবায়ুর কারণে বছরের সবসময় সব ধরনের শাক-সবজির উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। ফলে ঠান্ডা আবহাওয়ায় ভালো জন্মে এমন সবজিগুলো কেবল রবি মৌসুমে এবং গরম আবহাওয়ার উপযোগী সবজিগুলোকে খারিফ মৌসুমে উৎপাদন করা সম্ভব। তদুপরি বর্ষাকালে অত্যাধিক বৃষ্টিপাতের দরুণ সবজি উৎপাদন বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তাছাড়া বর্ষাকালে গড় তাপমাত্রা ৩০° সে. হয় এবং আর্দ্রতা অনেক বেড়ে যায়। মার্চ-মে মাসে বৃষ্টিপাত অনিশ্চিত ও অনিয়মিত হলেও এ সময়ে বারবার প্রবল ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়, যা সবজির জন্য নিরাপদ নয়।
(২) নিম্নমানের ফলনঃ বাংলাদেশে সবজির গড় ফলন অন্যান্য দেশের তুলনায় খুবই কম। যদিও অন্যান্য দেশের তুলনায় জমির গুণাগুণ এত খারাপ নয়। উচ্চ ফলনশীল জাত ব্যবহার না করার ফলে অর্থাৎ অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ এর প্রধান কারণ।
(৩) বীজের সমস্যাঃ বীজ সমস্যার কারণে এদেশের সবজি উৎপাদন ভীষণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। সবজি উৎপাদনের পরিকল্পনা ও লক্ষ্যমাত্রা প্রায়ই বীজের অভাবে অবাস্তবায়িত থেকে যায়। সবজি বীজ সমস্যার মধ্যে অনেক সবজির বীজ আমাদের দেশে উৎপাদিত না হওয়া, উৎপাদিত বীজের নিম্নমান এবং বিদেশ থেকে বীজ আমদানিতে উদ্ভুত সমস্যা উল্লেখযোগ্য। বিদেশ থেকে যে বীজগুলো আমদানি করা হয় তা আমাদের দেশের জলবায়ুতে হয় না। যেমন-বাঁধাকপি, ফুলকপি।
(৪) বাজারজাতকরণ সমস্যাঃ বাংলাদেশে সবজির বাজারজাতকরণের সমস্যা অত্যন্ত প্রকট। মূলত জলবায়ুর কারণে বছরের কোনো কোনো সময়ে সবজির সরবরাহ খুব কম, এসময় ক্রেতাদেরকে অধিক মূল্যে সবজি কীনতে হয়, যার দরুণ সবজির ব্যবহার কমে আসে। উৎপাদনে মৌসুমে চাহিদা আছে এমন স্থানে শাক-সবজির যথেষ্ট মূল্য থাকলেও উৎপাদন এলাকায় এর মূল্য থাকে খুবই কম। এতে কৃষক তার নায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয় । বাংলাদেশে সবজি কেনা-বেচায় মধ্যস্বত্বভোগীরা সবজির পচনশীলতা ও কৃষকদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে অধিক মুনাফা অর্জন করে।
(৫) শাক-সবজির উচ্চ উৎপাদন খরচ ও নিম্নমূল্যঃ সবজি চাষের উপকরণের মধ্যে বীজ, সার, ফসল সংরক্ষণের ওষুধ ও সিঞ্চন যন্ত্র প্রধান। এসব উপকরণের প্রাপ্যতা, গুণাগুণ ও দাম খুব বেশি, কিন্তু এগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে সবজি উৎপাদন করে যে আয় হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
(৬) শাক-সবজি উৎপাদনে যথাযথ ও সমন্বিত প্রচেষ্টার অভাবঃ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট অনেক জাতের সবজির জাত উদ্ভাবন করেছে কিন্তু এগুলো অনেক অঞ্চলের কৃষকদের দ্বার পর্যন্ত পৌঁছায়নি। কারণ সম্প্রসারণ ও অন্যান্য বিভাগের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় ব্যবস্থা নেই।
(৭) অন্যান্য সমস্যাঃ বৈজ্ঞানিক উপায়ে সবজি উৎপাদন করতে প্রচুর কারিগরি দক্ষতার প্রয়োজন। বাংলাদেশে কৃষিকাজের বেশিরভাগ কর্মকাণ্ড নিরক্ষর কৃষকদের হাতেই রয়ে গেছে। ফলে অনেক উন্নত প্রযুক্তি থাকলেও সেগুলোর ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে না।
শাক-সবজির বর্তমান অবস্থা উন্নয়নের অগ্রগতি
শাক-সবজির উৎপাদন ব্যবহার সার্বিক উন্নয়নে নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে।
(১) ঘাটতি মৌসুমে শাক-সবজির উৎপাদন বৃদ্ধিঃ জলবায়ুগত কারণে বছরের সব সময় সবজির উৎপাদন সমান থাকে না। যথাযথ উৎপাদন কৌশল ও উপযোগী জাতের ব্যবহারের মাধ্যমে ঘাটতি মৌসুমগুলোতে সবজি সরবরাহ বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
(২) শাক-সবজি উৎপাদনে জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করেঃ শীতকালীন শাক-সবজির চাষ অনেকাংশে পানিসেচ সুবিধার ওপর নির্ভরশীল। সেচের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে সবজি চাষাধীন জমি বাড়ানো সম্ভব। একটি সুপরিকল্পিত গ্রামভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে অনায়াসে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন সবজি উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
(৩) শাক-সবজির ফলন বৃদ্ধিঃ উন্নত ও উপযোগী জাত দ্বারা সবজির ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব। সকল কৃষকই যদি উন্নত জাতের সবজি চাষ করে তাহলে সবজির ফলন অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে।
(৪) বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করেঃ আমাদের দেশে কৃষকেরা খুবই কম পরিমাণে সবজি উৎপাদন করে এবং কম জমিতে সবজি চাষ করে। সবজি যদি বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয় তবে সবজি উৎপাদন বেড়ে যাবে।
(৫) সবজি বীজ উৎপাদনের মাধ্যমেঃ বাংলাদেশের সব জায়গা বীজ উৎপাদনের জন্য উপযোগী নয়। তাই যে অঞ্চলে বীজ উৎপাদন ভালো হয়, সেই এলাকায় বীজ উৎপাদন কার্য সম্পাদন করে আমরা ভালো বীজ পেতে পারি। সবজি বীজ উৎপাদনের মাধ্যমে বীজ সরবরাহ নিশ্চিত করে সবজি উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়।
(৬) গবেষণা জোরদারকরণঃ সবজি গবেষণার জাত উন্নয়ন এবং প্রতিকূল আবহাওয়ায় ফসল রক্ষার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে প্রতিটি সবজির উন্নত জাত উদ্ভাবন করতে হবে। রোগ ও পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন জাত বের করা খুবই প্রয়োজন ।
(৭) উৎপাদন উপকরণের সরবরাহ নিশ্চিতকরণঃ উন্নতমানের বীজ, নির্ভেজাল ওষুধ ও অন্যান্য উৎপাদন উপকরণ কৃষকেরা যাতে সময়মত এবং যুক্তিসঙ্গত দামে ক্রয় করতে পারে, তার ব্যবস্থা করা ।
এদেশে সবজি উৎপাদনে জলবায়ুর প্রভাব থাকার কারণে বছরের সবসময় সবজির উৎপাদন ও সরবরাহ একই থাকে না। ফলে বছরের কোনো কোনো সময় বিশেষ করে সেপ্টেম্বর-নভেম্বর ও এপ্রিল-মে মাসে সবজির সরবরাহ অনেক কমে আসে । গ্রীষ্মকালীন সময়ে শাক-সবজির উৎপাদন বৃদ্ধি করতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়।
ক. উৎপাদন কলোকৗশল ও উপযোগী জাতের ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রীষ্মকালীন সবজির উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। বর্তমানে এমন অনেক সবজি আছে যেগুলো উভয় ঋতুতে জন্মানোর উপযোগী জাত রয়েছে। যেমন-বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, বেগুন এগুলো গ্রীষ্মকালে চাষ করা যায়।
খ. সুপরিকল্পিত গ্রামভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে অনায়াসে গ্রীষ্মকালীন সবজি উৎপাদনবৃদ্ধি করা সম্ভব।
গ. নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হেক্টর প্রতি ফলনে শাক-সবজির স্থান উঁচুতে। যেখানে টমেটো ও বাঁধাকপির হেক্টর প্রতি ফলন যথাক্রমে ৫০-৬০ টন, সেখানে চাল ও গমের ফলনের বিশ্বগড় ২-৩ টন। ক্যালোরিতে রুপান্তরিত করলেও বহু সবজি গম ও চাল অপেক্ষা অধিক উৎপাদনশীল।
ঘ. যে দেশে প্রচুর পরিমাণে শাক-সবজি খাওয়া হয়, সেখানে চাল, গম কিংবা ভূট্টা তথা প্রধান খাদ্য শস্যের চাহিদা কম ।
ঙ. বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যা সমাধানের বিকল্প খাদ্য হিসেবে উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলের পুষ্টি সমস্যা সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে চেতনা সৃষ্টি করলে পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি কমিয়ে আনা সম্ভব। ফসল উৎপাদন পরিকল্পনা এমনভাবে সাজানো উচিত যাতে পুষ্টি উপাদানসমূহ অধিক পরিমাণে উৎপাদন করা যায়। এসব ব্যবস্থার সাহায্যে পুষ্টি সমস্যার ব্যাপকতা কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব ।
মানুষের বয়স ও ওজনভিত্তিতে সবজি খাওয়া উচিত। তবে দেশের প্রায় ১৫ কোটি লোকের জন্য প্রায় ১০-১২ মিলিয়ন টন সবজির প্রয়োজন। অথচ এখানকার সবজি (আলুসহ) বর্তমানে বার্ষিক উৎপাদন ৩.৫ মিলিয়ন টনের মতো। সুতরাং দেশের বর্তমান উৎপাদন চার গুণে পৌঁছানো প্রয়োজন।
উল্লেখযোগ্য যে, যেখানে বাংলাদেশে দৈনিক মাথাপিছু মোটামুটি প্রায় ৫০০ গ্রাম দানা শস্য এবং ১০০ গ্রাম সবজি ও মূলজাতীয় খাদ্য খাওয়া হয়, সেক্ষেত্রে জাপানে ২০০ গ্রাম দানা শস্য ও ৪০০ গ্রাম সবজি ও মূল, যুক্তরাজ্যে ২০০ গ্রাম দানা শস্য ও ৪৫০ গ্রাম সবজি ও মূল এবং যুক্তরাষ্ট্রে ১৮০ গ্রাম দানা শস্য ও ৪০০ গ্রাম সবজি ও মূল খাওয়া হয়।
সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির উপায়ঃ সবজি উৎপাদন বৃদ্ধিতে করণীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে সবজি উৎপাদনের বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। এজন্য বাংলাদেশে সবজি চাষকৃত জমির পরিমাণ, সবজি উৎপাদন ও বিশ্বে সবজি উৎপাদন পরিস্থিতি সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত তথ্য উপস্থাপন করা হলো। সবজির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নিম্নরূপ ব্যবস্থা অবলম্বন করা যেতে পারে ।
(১) সবজির উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন।
(২) পতিত জমিকে অধিক পরিমাণে শাক-সবজি উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা।
(৩) সবজির প্রকারগত বহুমুখীকরণ।
(৪) প্লাবনমুক্ত পাহাড়ি এবং টেরেস এলাকায় সবজি উৎপাদন বাড়ানো ।
(৫) হিমাগারের সংখ্যা ও আয়তন বৃদ্ধি করে বীজ-আলু সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন
(৬) বর্ষাকালে অধিক সবজি উৎপাদনের উদ্দেশে দেশের উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম এলাকায় বিশেষ প্রকল্প প্রণয়ন
(৭) বাড়ি-ঘর, অফিস, স্কুল-কলেজ এবং রাস্তার পার্শ্ববর্তী পতিত জমিতে শাক-সবজি উৎপাদন ।
(৮) সুষম সার ব্যবহার নিশ্চিতকরণ।
(৯) কীট-পতঙ্গ শত্রু ও রোগ দমনের ব্যবস্থা গ্রহণ।
(১০) শিম, মিষ্টি আলু, শাক ও কচুজাতীয় সবজি উৎপাদন বাড়ানো।
(১১) লবণাক্ত অঞ্চলে চাষাবাদের জন্যে বিভিন্ন সবজির জাত উদ্ভাবন ।
(ক) বাংলাদেশে সবজি চাষে জমির পরিমাণ ও উৎপাদন
এক কথায় উত্তর
১. পৃথিবীর বয়স কত বছর?
২. মাঝে মাঝে তাপমাত্রা কত ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে ?
৩. মাঝে মাঝে তাপমাত্রা কত ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত নামে?
৪. অধিকাংশ উদ্ভিদ কত ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় জন্মে ?
৫. গোল আলুর সালোক সংশ্লেষণ কত ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বেশি হয় ?
৬. টমেটো বীজ কত ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গজাতে ১২ দিন পর্যন্ত সময় লাগে ?
৭. কত ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা গাজরের গুণাগুণের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করে ?
৮. আলু কত ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করলে মিষ্টি হয়ে যায়
৯. বাংলাদেশের দিবাভাগের দৈর্ঘ্য কত ঘন্টা থেকে কত ঘন্টা বিরাজ করে ?
১০. বাতাসে কত ভাগ নাইট্রোজেন থাকে ?
১১. বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় কত লক্ষ মে. টন বীজ লাগে ?
১২. সার কয়ভাগে বিভক্ত?
১৩. কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই কিসের প্রধান শত্রু?
১৪. কীটনাশকের কার্যপদ্ধতি সাধারণত কয় ভাগে বিভক্ত ?
১৫. একটি সিস্টেমিক বিষের নাম লেখ।
১৬. একটি বিতাড়নকারী বিষের নাম লেখ।
১৭. বিদেশ থেকে কোন ফুল জাতীয় সবজির বীজ আমদানি করতে হয় ?
১৮. টমেটো ও বাঁধাকপির হেক্টর প্রতি ফলন কত টন হতে পারে ?
১৯. মার্চ-মে মাসে বৃষ্টিপাত অনিশ্চিত হলেও এসময় কী বয়ে যায় ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. জলবায়ু ও পরিবেশের উপাদানগুলো কী কী তা উল্লেখ কর।
২. বাংলাদেশের মাসওয়ারি গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কত ?
৩. সবজির অঙ্গজ বৃদ্ধিতে তাপমাত্রার প্রভাব সম্পর্কে বর্ণনা কর।
৪. সবজি সংগ্রহোত্তর তাপমাত্রার প্রভাব তার ওপর কী ধরনের তা বর্ণনা কর।
৫. বাংলাদেশে ভাল মানের বীজ সরবরাহ পরিস্থিতি উল্লেখ কর ।
৬. জমির উর্বরতা বৃদ্ধি কীভাবে করা যায় ?
৭. মানসম্পন্ন সবজি বীজের চাহিদা কীভাবে দূর করা যায়?
৮. ফসলের রোগ ও পোকামাকড় দমনে কীটনাশকের কার্যপদ্ধতিগুলো উল্লেখ করাসহ যে কোন একটির বর্ণনা দাও।
৯. সেচ সুবিধা বৃদ্ধি করে কীভাবে সবজি চাষ বাড়ানো যায় ?
১০. শাক-সবজির বর্তমান অবস্থা উন্নয়নের জন্য কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে ?
১১. মানুষের জন্য কী পরিমাণ সবজির প্রয়োজন তা আলোচনা কর ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১. শাক-সবজি উৎপাদনে জলবায়ুগত সমস্যা কীভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তা ব্যাখ্যা কর।
২. সবজি চাষে উৎপাদন উপকরণের কী ধরনের সমস্যা হয় তা বর্ণনা কর ।
৩. বাংলাদেশে সবজি চাষের সমস্যা সমাধানের উপায়সমূহ বর্ণনা কর।
আরও দেখুন...