জমি ও মাটি নির্বাচন
শাক সবজি চাষের জন্য যথেষ্ট আলো বাতাসের সুবিধা আছে এমন উঁচু দোঁআশ মাটির জমি নির্বাচন করা উচিত। বিশেষ করে ফল জাতীয় সবজির (বেগুন, ঢেঁড়শ, কুমড়া, শশা, পেঁপে, মরিচ, চিচিঙ্গা, ধুন্দল, করলা, কাঁকরোল, বরবটি, শিম ইত্যাদি) জন্য বেশি আলোর দরকার হয়। শাক ও মূলজাতীয় সবজি (ডাঁটা, পুঁইশাক, কলমিশাক, সিলারি, লেটুস, বিট, গাজর, মূলা, শালগম) কিছু কম আলোতে এবং কচু, মেটে আলু, গাছ আলু ইত্যাদি সবজি ছায়াতেও ভালভাবে জন্মিতে পারে।
সারা বছর শাক সবজি চাষাবাদের জন্য উঁচু সেচ নিকাশযুক্ত জমি সুবিধাজনক। পানি সেচ ও নিকাশের জন্য জমি মোটামুটি সমতল ও একদিকে কিছুটা চালু থাকলে ভালো হয়। তাই সবজি বাগান এমনস্থানে হওয়া উচিত যেখানে। সহজেই পানি সেচ ও নিকাশ করা যায়। সবজি বাগানে গাছের বা বাড়ি ঘরের ছায়া যত কম পড়বে ততই ভালো, যদিও শাক সবজির বাগান সাধারণত বাড়ির আশে পাশেই হওয়া উচিত, তাতে সহজে দেখাশানো করা যায়। তবে সবজির চাহিদা ও উৎপাদনের উদ্দেশের ওপর ভিত্তি করে জমির স্থান নির্বাচন করতে হয়। যেমন-পারিবারিক সবজি বাগান, বিক্রয়মূলক সবজি বাগান ও বিশেষ সবজি বাগান ।
পারিবারিক সবজি বাগান- এ ধরণের সবজি বাগান সাধারণত ছোট আকারের হয়ে থাকে। যতদূর সম্ভব বাড়ির আশে পাশে পতিত বা ফাঁকা স্থানগুলোতে এ বাগান করা হয়। এক্ষেত্রে পরিবারের চাহিদা পূরণের জন্য স্বল্প সময়ে বেশি পরিমাণে জন্মে এমন ধরনের সবজি চাষ করা হয়। এ বাগানে কী কী শাক সবজি জন্মানো হবে তা পরিবারের লোকজনদের পছন্দের ওপর নির্ভর করে অনেক সময় চাষ করা হয়। বাড়ির আশে পাশের জমিতে বাগান করা হয় বলে পরিবারের মেয়েরা এ ধরনের বাগানের কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে। এছাড়া সবজি সংগ্রহ মহিলারাই করতে পারে। শাক সবজি টাটকা অবস্থায় খাওয়া উচিত। তাই গার্হস্থ্য সবজি বাগান হতে বেশি ফলপ্রসূভাবে টাটকা অবস্থায় শাক সবজি সহজে সংগ্রহ করা যায়।
বিক্রয়মূলক সবজি বাগান- বাজারের চাহিদা এবং বেশি মূল্য পাওয়ার ওপর ভিত্তি করে এ ধরনের বাগান করা হয়। আগেকার দিনে বিক্রয়মূলক সবজি বাগান শহরের আশে পাশে সীমাবদ্ধ থাকতো। কিনতু বর্তমানে বিভিন্ন কারণে শহর বা বাজার হতে অনেক দূরবর্তী স্থানেও বাণিজ্যিকভাবে শাক সবজি চাষাবাদ করা হচ্ছে। কেননা রাস্তা ঘাট ও যানবাহনের সুবিধা বৃদ্ধি পাচ্ছে, জনগণের রুচি ও চাহিদা বাড়ছে, অধিক লাভজনক ও নতুন নতুন আকর্ষণীয় সবজি প্রবর্তন হচ্ছে ইত্যাদি।
জমি মাটি দ্বারা গঠিত। গাছপালা মাটি হতে খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। মাটি একটি জীবিত ও পরিবর্তনশীল পদার্থ। মাটিকে সাধারণত বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে। যথা- (ক) ভৌতিক (খ) রাসায়নিক ও (গ) জৈবিক ।
(ক) ভৌতিক- মাটি বিভিন্ন প্রকার কণার সমন্বয়ে গঠিত। এর বিভিন্ন প্রকার কণার আকার ও পরিমাণের ওপর নির্ভর করে মাটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা
১। পাথুরে মাটি ২। বেলে মাটি ৩ । পলি মাটি ৪। কাদা মাটি ও ৫। দোঁআশ মাটি।
১। পাথুরে মাটি- পাথর, পুঁড়ি, কাঁকর ও বালির সমন্বয়ে এ মাটি গঠিত। এ মাটি চাষ করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও সবজি চাষের জন্য অনুপযোগী।
২। বেলে মাটি- শতকরা ৭০ ভাগ বা তার অধিক বালিকণাযুক্ত মাটি। নদীর চর, চরাভূমি, মরুঅঞ্চল এবং বৃষ্টিবহুল এলাকায় এরূপ মাটি দেখা যায়। এ মাটি সহজে কর্ষণ করা যায়; কিন্তু অনুর্বর ও পানি ধারণ ক্ষমতা খুবই কম। এ মাটিতে আগাম শীতকালীন সবজি ও মূলজাতীয় ফসল ভাল জন্মে। এ মাটি সব ধরনের সবজি চাষের জন্য খুব উপযুক্ত নয়।
৩। পলি মাটি- নদীর তীরবর্তী ও পাবিত অঞ্চলে এ ধরনের মাটি বেশি পাওয়া যায়। এ মাটি উর্বর, তাই সব ধরনের সবজিই জন্মানোর উপযোগী।
৪। কাঁদা মাটি শতকরা ৪০-৫০ ভাগ কর্দম কণাযুক্ত মাটি। এ মাটিতে পলিকণার পরিমাণ বেশি থাকে এবং পানি ধারণ ক্ষমতা বেশি । ভিজা অবস্থায় খুবই নরম ও আঁঠালো প্রকৃতির হয়, কিন্তু শুকালে খুবই শক্ত হয়। সাধারণভাবে সবজি চাষের জন্য এ মাটি খুব বেশি সুবিধাজনক নয়। কিন্তু কচুজাতীয়, কলমিজাতীয় সবজি চাষের জন্য বেশ উপযোগী।
৫। দোঁআশ মাটি শতকরা ৭০ ভাগের কম ও ২০ ভাগের বেশি বালিকণা বিশিষ্ট মাটি। কোন কোন ক্ষেত্রে বালিকণার পরিমাণ শতকরা ২০ ভাগ পর্যন্ত নেমে গেলেও মাটি দোঁআশ হতে পারে। তবে আদর্শ দোঁআশ মাটিতে প্রায় অর্ধেক পরিমাণ বালিকণা এবং অর্ধেক পরিমাণ পলি ও কদমকণার মিশ্রণ থাকে। দোঁআশ মাটিতে বালি ও কদম কণার কম বেশির অনুপাত অনুসারে এ মাটিকে আবার দু'ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- (ক) বেলে দোঁআশ ও (খ) এঁটেল দোঁআশ ।
ক) বেলে দোঁআশ- বেলে দোঁআশ মাটিতে শতকরা প্রায় ৪৫ ভাগ হতে ৬৫ ভাগ পর্যন্ত বালি কণা থাকতে পারে ।
(খ) এটেল দোঁআশ- এঁটেল দোঁআশ মাটিতে শতকরা প্রায় ৩৫ ভাগ কর্দমকণা এবং একই পরিমাণ পলিকণা থাকতে পারে। এছাড়া পলি কণার তারতম্য অনুসারে দোঁআশ মাটিকে আবার দু'ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- (১) পলি দোঁআশ ও (২) পলি এঁটেল দোঁআশ ।
(১) পলি দোঁআশ মাটিতে শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ পলি ও ২০ ভাগ কর্দম কণা এবং
(২) পলি এঁটেল দোঁআশ মাটিতে শতকরা প্রায় ৫৫ ভাগ বালি এবং ৩০ ভাগ কদম কণা থাকে ।
দোঁআশ মাটির পানি শোষণ ক্ষমতা বেশি এবং এর অভ্যন্তরে বেশি পরিমাণে বায়ু চলাচল করতে পারে। তাই এ মাটি গভীর স্তর পর্যন্ত রসালো থাকে। এ মাটি ঝুরঝুরে প্রকৃতির ও উর্বর হয়ে থাকে এবং যেকোন ফসল ভালোভাবে জন্মানো যায়। মাটিতে রসের কম বেশি বা জলাবদ্ধতা হলে কী অবস্থা হয় তা পরবর্তী চিত্রে দেখানো হলো।
(খ) রাসায়নিক- রাসায়নিক বিশ্লেষণ দ্বারা মাটির উর্বরতা এবং মাটিতে পুষ্টির অভাব আছে কি না তা জানা যায় । সাধারণত দুই ধরনের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করা হয়। যথা- মাটিতে মোট পুষ্টির পরিমাণ এবং যে সকল পুষ্টি গাছের খাদ্য হিসেবে প্রয়োজন হয়। মাটির রাসায়নিক উপাদান তথা গাছের পুষ্টি উপাদানগুলো যথা- নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার, কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, বোরণ, কপার, জিংক, আয়োডিন, মলিবডেনাম ইত্যাদি। এগুলো মাটির মধ্যে উপযুক্ত পরিমাণে থাকা দরকার যেহেতু শাক-সবজি স্বাভাবিকভাবে জন্মানোর জন্য এগুলোর প্রয়োজন ।
এই উপাদানগুলো উপযুক্ত পরিমাণে না থাকলে গাছের বৃদ্ধিতে নানা ধরনের অসুবিধা হয়। উল্লিখিত উপাদানগুলোর মধ্যে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম ও জিংক গাছের জন্য বেশি পরিমাণে দরকার হয়। তাই সুষ্ঠুভাবে ফসল ফলানোর জন্য এগুলো জমিতে প্রয়োগ করতে হয়। তবে অন্যান্য উপাদানগুলো খুব অল্প পরিমাণে দরকার হয় এবং মাটিতে যে পরিমাণে আছে তাতেই ফসলের প্রয়োজন মিটে যায়। সারা বছর বার বার ফসল চাষের ফলে অন্যান্য উপাদানগুলোর ঘাটতিও মাঝে মাঝে দেখা যায় ।
মাটিতে বিভিন্ন উপাদানের তারতম্যের ওপর নির্ভর করে মাটি অম্ল বা ক্ষার ধর্মীয় হয়। সফলভাবে শস্য উৎপাদন এই অম্লত্ব বা ক্ষারত্বের (পি.এইচ মানাঙ্ক) ওপর নির্ভর করে। এই অম্লত্ব বা ক্ষারত্বকে পিএইচ মানাঙ্ক দ্বারা প্রকাশ করা হয়। পি,এইচ-এর নিরপেক্ষ মানাঙ্ক হলো ৭-এর নিচের মানাঙ্ক অশীয় এবং উপরের মানাঙ্ক ক্ষারীয়। নিরপেক্ষ মানাঙ্ক হতে হাইড্রোজেন আয়নের মান যত দূরে হবে মাটি ততবেশি অশ্লীয় বা ক্ষারীয় হয়। বিভিন্ন শাক সবজির চাষ উপযোগী পিএইচ মানাঙ্ক পরের পাতায় সারণিতে দেখানো হলো।
অম্লীয় মাটি- যে মাটির পি.এইচ মানাঙ্ক ৭ এর চেয়ে কম থাকে তাকে অম্লীয় মাটি বলে। মাটিতে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম বা চুনের অভাব হলে বা জৈব পদার্থ বেশি হলে মাটি অম্লীয় ভাবাপন্ন হয়। উষ্ণ ও আর্দ্র অঞ্চলে বেশি বৃষ্টিপাত হলে বৃষ্টির পানির সাথে চুন মাটির অভ্যন্তরে চুইয়ে যায়। এর ফলেও মাটিতে অম্লীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া এমোনিয়াম সালফেটজাতীয় সার বেশি ব্যবহার করলে মাটিতে অম্লত্ব সৃষ্টি হয়। শাকসবজি সাধারণত অম্লীয় মাটিতে ভালো জন্মে।
ক্ষারীয় মাটি- যে মাটির পিএইচ মানাঙ্ক ৭ -এর উপরে থাকে তাকে ক্ষারীয় মাটি বলে। কোন মাটিতে পানি নিকাশের ব্যবস্থা না থাকলে এবং দীর্ঘদিন ধরে বাষ্পীবতন হলে সেখানে লবণাক্ততা ও ক্ষারীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ ধরনের মাটিতে লৌহের অভাব দেখা দেয় এবং ক্ষার সহিষ্ণু ফসল ছাড়া অন্য ফসল ভালভাবে জন্মে না। মাটির পিএইচ মানাঙ্ক নিরপেক্ষ করার জন্য চুন প্রয়োগের পরিমাণ নিচের সারণিতে দেখানো হলো।
(গ) জৈবিক- মাটিতে অনেক প্রকার সুক্ষ্ম জীবাণু আছে। যথা- ব্যাকটেরিয়া, মোল্ড, ইষ্ট, প্রটোজোয়া এবং ফানজাই। এই সমস্ত জীবাণুসমূহের রাসায়নিক কার্যাবলির ফলে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ অংশ পঁচে সারে রূপান্তরিত হয়। কতকগুলো ব্যাকটেরিয়া শিম বা ডালজাতীয় শস্যের শিকড়ে বাতাস হতে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে জমা করে। কতকগুলো ব্যাকটেরিয়া এমোনিয়া এসিডকে এমোনিয়াতে রূপান্তরিত করতে সাহায্য করে। কিছু কিছু গাছপালা কেবল নাইট্রোজেন এমোনিয়া রূপে থাকলে তা গ্রহণ করতে পারে।
জমি তৈরিকরণ
জমি কর্ষণঃ সবজি চাষের জমি সমতল হওয়া বাঞ্চনীয়, যাতে পানি সেচ ও নিষ্কাশনের সুবিধা হয়। চাষের পুর্বে অসমতল ভূমি ও পূর্ববর্তী ফসলের আইল, কেয়ারী, মাদা ইত্যাদি কেটে সমতল করে নিতে হয়। জো অবস্থায় পুনঃ পুনঃ চাষ ও মই দিয়ে ১৫-২০ সে.মি. গভীরতা পর্যন্ত মাটি ঢেলামুক্ত ও ঝুর ঝুরে করে তৈরি করতে হয়। এ কাজ কোদাল, মোল্ড বোর্ড প্লাউ বা রোটোভেটরের সাহায্যে সহজে করা যায়। জমি যত ভালোভাবে তৈরি হয়, গাছের শেকড় তত সহজে বিস্তার লাভ করে, অধিক খাদ্যোপাদান গ্রহণ করতে পারে এবং মাটির পানি ধারণ ও বায়ু চলাচল ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া মাটিতে স্বাভাবিক তাপ ও উষ্ণতা বজায় থাকে। অনিষ্টকারী কীট ও রোগ জীবাণু, আগাছা বিনষ্ট হয় এবং জীবাণুসমূহের বিশেষত নাইট্রোজেনযুক্তকারী ব্যাকটেরিয়ার কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। সর্বোপরি উত্তমরূপে তৈরি করা জমিতে বীজ সহজে অঙ্কুরিত হয়। রোপণকৃত চারার শেকড় সহজে লেগে যায়।
ভেজা অবস্থায় জমি চাষ দেয়া ঠিক নয়। বিশেষ করে এঁটেল মাটি ভেজা অবস্থায় চাষ করলে এর ঢেলা ভাঙ্গা দূরুহ হয়ে পড়ে। দোঁ-আশ মাটি কিছু ভেজা অবস্থায় চাষ করা গেলেও মাটি শুকানোর পূর্বে মই দেয়া উচিত নয়। উল্লেখ্য যে, যেখানে চাষ করা জমি থেকে বৃষ্টি বা সেচের পর প্রায় ১৪% পানি বাষ্পীভূত হয়, সেখানে চাষহীন জমি হতে প্রায় ৮০% পানি বাষ্পীভূত হয়ে যায়। সুতরাং জমি তৈরির সাথে মাটির রস তাপ সংরক্ষণ ও সবজি আবাদের সাফল্য ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। জমি তৈরিকরণের সময় অর্থাৎ শেষ চাষের পূর্বে মৌল সার জমিতে ছিটিয়ে দিয়ে বীজ বপন বা চারা রোপণের জন্য জমি প্রস্তুত করতে হয়।
পানি সেচ ও নিকাশন নালা তৈরি- সবজির রকম, মৌসুম, প্রকৃতি ও আবাদ পদ্ধতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে জমিতে প্রয়োজনীয় আইল ও নালা এমনভাবে তৈরি করতে হয় যেন পানি সেচ ও নিষ্কাশন সুবিধা হয় ।
কেয়ারী তৈরি- আধুনিক প্রথায় জমিতে কেয়ারী তৈরি করে সবজির চাষ করতে সুবিধা হয়। জমি চাষ করার পর রোপণ দূরত্বের সাথে সংগতি রেখে ১৫-২৫ সে.মি. চওড়া অগভীর নালা কেটে একে সরু লম্বা ফালিতে বিভক্ত করে কেয়ারী তৈরি করতে হয়। নালার মাটি দিয়ে দু'পাশের কেয়ারীগুলোকে ১০-১৫ সে.মি. উঁচু করা হয়। পরে কেয়ারীর মাটি পরিপাটি করে তাতে নিদৃষ্ট দূরত্বে বীজ বপন বা চারা রোপণ করা হয় এবং নালাগুলো পানি সেচ, নিষ্কাশন বা ফসলের পরিচর্যামূলক কাজের সুবিধার্থে ব্যবহৃত হয়। কেয়ারীতে দুই বা ততোধিক সারিতে সবজি আবাদ করা যায়। বর্ষা মৌসুমে কেয়ারী কিছুটা বেশি উঁচু হলে জলাবদ্ধতাজনিত কারণে শস্য বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।
মাদা তৈরি- শিম ও কুমড়া পরিবারের সবজির শেকড় এবং কাণ্ডের শাখা প্রশাখা চারিদিকে বেশি ছড়ায়। তাই সেগুলো আবাদের জন্য জমিতে যথেষ্ট ফাঁক ফাঁক করে গর্ত বা মাদা তৈরি করে বীজ বা চারা রোপণ করতে হয়। মাদা তৈরির জন্য সাধারণত: ৫০-৬০ সেমি. ব্যাস ও ৪০-৫০ সেমি. গভীর করে গর্ত খুঁড়তে হয় এবং এর মাটির সাথে মৌল সারের অর্ধেক পরিমাণ মিশিয়ে গর্ত ভর্তি করতে হয়। সার দেয়ার ৫-৭ দিন পরে গর্তের মাটি কুপিয়ে পরিপাটি করে বীজ বপন বা চারা রোপণের জন্য তৈরি করতে হয়। বর্ষাকালে মাদার উপরিভাগ আশপাশের মাটি থেকে কিছুটা উঁচু রাখতে হয়। অন্য সময়ে পানি সেচের সুবিধার্থে মাদার চারিদিকে জুলিকাটা ও জমিতে নালা করা আবশ্যক। জমি তৈরির সময়ে মৌল সারের অর্ধেক জমিতে ছিটিয়ে দিতে হয়।
জুলি তৈরি- বেডের বা মাদার চারিদিকে সেচ কাজের সুবিধার্থে যে অগভীর খাদ বা নালা কাটা হয় সেগুলোকে জুলি বলে। হাত কোদাল, পুরাতন লাঙ্গল বা অন্য কোন যন্ত্রের সাহায্যে জুলী কাটা যায় ।
জমিতে সরাসরি বীজ বপন- অনেক রকমের সবজি যেমন- শাক, মূলা, সীম ও কুমড়া জাতীয় সবজির বীজ সরাসরি জমিতে বপন করে জন্মানো যায়। সরাসরি বীজ বপন করা সহজতর ও কম ব্যয়বহুল। এ প্রথায় জন্মানো গাছের শিকড় খাড়াভাবে মাটির গভীরে প্রবেশ করে। ফলে গাছের বৃদ্ধি ও জীবনকাল কিছুটা ত্বরান্বিত হয় এবং অপেক্ষাকৃত অধিক খরা সহ্য করতে পারে। তবে এ পদ্ধতিতে বীজ বেশি লাগে ও মূল জমি অধিক সময় আবদ্ধ থাকে। চারা অধিক এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকে বলে প্রতিকূল অবস্থায় বিশেষ যত্নের ব্যাবস্থা করা বা অসময়ে আবাদের পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না।
বীজ বপনের সময়- স্থানীয় ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থা, বাজারের চাহিদা এবং জাতের বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে বপনের সময় নির্ধারণ করতে হয় যেন সবজি জন্মানো এবং বিপণনে অসুবিধা না হয়। এক্ষেত্রে অধিক ফলনের চেয়ে অধিক মুনাফা লাভের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। কেননা ভরা মৌসুমে ফলন বেশি হলেও দর কম থাকে বলে অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্থ হতে হয়। পক্ষান্তরে অসময়ে অর্থাৎ আগাম বা নাবি মৌসুমে ফলন কম পাওয়া সত্ত্বেও বাজার দর ভাল পাওয়া যায় ও অধিক মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হয়।
বীজ বপন পদ্ধতি- সবজির ধরন, ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থা, আবহাওয়া ও আর্থ-সামাজিক পরিবেশের ওপর নির্ভর করে সবজি বীজ রোপণ বা বপন পদ্ধতিসমূহকে ৪টি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়।
ক) ছিটিয়ে বীজ বপন- মাটির উপরে বীজ ছিটিয়ে দিয়ে লাংগলের বা আঁচড়ার সাহায্যে হাল্কা চাষ বা কোদালে কোপানো বা অন্য কোন উপায়ে তা মাটির সহিত মিশিয়ে দেওয়ার পদ্ধতিকে ছিটিয়ে বীজ বপন বলে। বাংলাদেশের সর্বত্র এ পদ্ধতি ব্যাপকভাবে অনুসরণ করা হয়ে থাকে। আসলে এ পদ্ধতি ভালো নয়। এতে জমির
সর্বত্র একই গভীরতায় ও সমান ঘনত্বে বীজ বপন করা যায় না। ফলে বীজের অঙ্কুরণ, গাছের বৃদ্ধি ও পরিপুষ্টিতে অসমতার সৃষ্টি হয় ও ফলন হ্রাস পায়। এ প্রথার বীজ বেশি লাগে ও পরবর্তী পরিচর্যার বা যাত্রিক প্রযুক্তি অনুসরণে অসুবিধা হয়।
খ) সারিতে বীজ বপন- জমি ও কেয়ারীর উপরে হুলি তৈরি করে লাইনে বীজ বপনের পদ্ধতিকে সারিতে বীজ বপন বলে। সীড ড্রিল বা অন্যান্য আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে সহজে সারিতে বীজ বপন করা যায়। বাংলাদেশে এ পদ্ধতি আছে আছে বৃদ্ধি লাভ করছে। ছিটিয়ে বপন পদ্ধতির চেয়ে এ পদ্ধতি বহুগুণে শ্রের ও ফলন বৃদ্ধির সহায়ক। এ প্রথায় ছিটিয়ে বোনার অর্ধেক বা এক তৃতীয়াংশ বীজ লাগে, সমাজীরতায় বীজ বপন হয় ও সমদূরত্বে। গাছ রাখা হয়। পরবর্তী পরিচর্যা ও যান্ত্রিক চাষাবাদে বিশেষ সুবিধা হয় ও খরচ কম লাগে। তবে কারিক শ্রমে বীজ বপন করতে সময় ও খরচ বেশি লাগে এবং দক্ষতার সাথে তা অনুশীলন করতে হয়। জমিতে বা কেয়ারীর উপরে এক সারি, জোড়া সারি বা বহু সারি প্রথায় বীজ বপন করা চলে। মূলা, ঢেঁড়শ, গাজর, বরবটি, ফ্রেঞ্চবীন ইত্যাদি জোড়া সারি প্রথায় আর শাকজাতীয় শস্য এক সারি বা বহুসারি প্রথায় আবাদ করা উত্তম। তাছাড়া সারিতে বীজ হতে বীজের মধ্যে দূরত্ব না রেখে শাকজাতীয় সবজি এবং সুনির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ঢেঁড়স, বরবটি, মূলা ইত্যাদির বীজ বপন করা উচিত।
গ) মাদার বীজ বপন- মাদা তৈরি করে বীজ বপন করার পদ্ধতিকে মাদায় বীজ বপন বলে। সাধারণত: বিভিন্ন প্রকার কুমড়া, শিম ইত্যাদির বীজ এ প্রথায় রোপণ করা হয়। মাদায় বপনের বীজ আকারে বড় ও গাছ লতানো প্রকৃতির হয়ে থাকে। প্রতি মাদায় পরস্পর বীজ থেকে ৮-১০ সে.মি. দূরত্বে ৫-৬টি বীজ বপন করতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত প্রতি মাদার ২-৩ টি সুস্থ ও বলিষ্ঠ চারা রেখে বাকীগুলো কেটে ফেলতে হয়।
(ঘ) খুবরীতে বীজ বপন- অনেকটা মাদায় বীজ বপনের মত। তবে এখানে যাদা তৈরি করে নেওয়া হয় না। জমিতে বীজ বপনের সমরে মাটিতে খুবরী বা গর্ত করা হয় ও সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সবজি/শস্যের বীজ ঐ খুবরীতে দেয়া হয়। পাহাড়ি অঞ্চলের জুম প্রথা অনেকটা এর অনুরূপ। এতে বীজ কম লাগে, পরিচর্যা করতে সুবিধা হয় এবং কম রসে চারা গজাতে পারে ও ফসলের সমরূপতা বজায় থাকে।
বীজ বপনের গভীরতা- সরাসরি মাটির বেশি গভীরে বীজ বুনলে গজাতে অসুবিধা হয় ও বেশি সময় লাগে । পক্ষান্তরে গভীরতা কম হলে রসের অভাবে বীজ গজাতে পারে না বা চারা অবস্থায় বেশি বৃষ্টিতে গোড়ার মাটি সরে গিয়ে চারা মরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মোটামুটিভাবে ক্ষুদ্রাকৃতির বীজ বীজতলায় ১-১.৫ সে.মি. ও মূল জমিতে ১.৫-২ সে.মি. এবং বৃহদাকৃতির বীজ ৩-৫ সে.মি. গভীরে বপন করা উচিত। বীজের নিজ পুরুত্বের ৩-৪ গুণ গভীরে বপন করলেও সমভাবে গজাতে পারে ও ফসলে সমরূপতা বজায় থাকে।
বীজের অঙ্কুরণ- অঙ্কুরণের জন্য সব ধরনের বীজের উপযোগী তাপমাত্রা ও পারিপার্শ্বিকতা এক রকম নয়। যে সব সবজি উচ্চ তাপমাত্রায় জন্মে সাধারণত সেগুলোর বীজ অপেক্ষাকৃত উচ্চ তাপমাত্রায় অঙ্কুরিত হয়। তাই শশা, তরমুজ, ঢেঁড়স, পুঁইশাক ইত্যাদি সবজির বীজ নিম্ন তাপমাত্রায় সহজে অঙ্কুরিত হয় না। অপরদিকে যে সব বীজের বীজত্বক পুরু সেগুলোর ত্বক ফাটানোর উপযাগী ব্যবস্থা না নিলে বীজ সহজে অঙ্কুরিত হয় না। মাটিতে রসের আধিক্যে অর্থাৎ প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অভাবেও বীজ অঙ্কুরিত হয় না।
সবজি চাষে সারের চাহিদা নিরূপণ- চাষের পূর্বে সবজির সারের চাহিদা নিরূপণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সবজির চাহিদা মোতাবেক সঠিক পরিমাণ অপেক্ষা কম সার ব্যবহার করলে ফলন কমে যাবে। অন্যদিকে বেশি সার ব্যবহারে সারের অপচয় হবে, খরচ বেড়ে যাবে, ফসলের গুণাবলি ও জমির উর্বরতা নষ্ট হবে। সবজির সারের চাহিদা সঠিকভাবে জানতে হলে চাষাবাদের পূর্বে মাটিতে কতটুকু খাদ্যোপাদান আছে পরীক্ষা করা উচিত। মাটিতে স্বাভাবিকের চেয়ে কম উপাদান থাকলে তা প্রয়োগের মাধ্যমে পূরণ করে দিতে হবে। ফসল সংগ্রহের পর আবার পরীক্ষা করে জানা যাবে যে উক্ত ফসল জমি হতে কতটুকু বিভিন্ন খাদ্যোপাদান শোষণ করেছে। শোষণকৃত পরিমাণই হলো উক্ত ফসলের সারের চাহিদা। তবে সারের পরিমাণ নির্ধারণ করতে কতগুলো বিষয় বিবেচনা করতে হয়। যেমন- (১) ফসলের খাদ্যোপাদান চাহিদা ও পরিশোষণ ক্ষমতা (২) ভূমির উর্বরতা (৩) মাটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক অবস্থা (৪) আবাদ পদ্ধতি ও মৌসুম (৫) সারের গুণাবলি এবং (৬) সার ও ফসলের মূল্যের অনুপাত। মাটিতে কোন একটি খাদ্যোপাদানের ঘাটতি থাকলে এবং অন্যান্য খাদ্যোপাদানের পরিমাণ বেশি থাকলেও গাছ সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারে না। তাই ফসলের প্রকৃত চাহিদা নিরূপণ করে কৃত্রিম উপায়ে সার ব্যবহার করা প্রয়োজন হয়। কোন ফসলের প্রয়োজনীয় সব খাদ্যোপাদানের উপযুক্ত মাত্রাকে একত্রে সুষম মাত্রা বলে। যেখানে মাটি পরীক্ষার সুযোগ নেই সেখানে সবজির সারের চাহিদা নিরূপণ করতে হয় এর আহারাপেযোগী অংশ বিবেচনা করে। যেমন, পাতাজাতীয় সবজি প্রধানত নাইট্রোজেন, ফুল ও ফলজাতীয় সবজি ফসফরাস এবং মূলজাতীয় সবজি পটাশ সার বেশি পরিমাণে গ্রহণ করে থাকে। তাই আহারপযোগী অংশের কথা খেয়াল রেখে সবজির সারের চাহিদা ঠিক করতে হবে। এছাড়া সবজি চাষের মেয়াদ বিবেচনা করেও সারের চাহিদা ঠিক করা যেতে পারে। স্বল্প মেয়াদি সবজির বেলায় বেশি মেয়াদি সবজির চেয়ে কম পরিমাণ সারের প্রয়োজন হবে।
সারের চাহিদা পূরণের জন্য রাসায়নিক সারের ওপর পুরোপণরি নির্ভর না করে জৈব সার ব্যবহার করতে হবে। সবজির প্রধান খাদ্যোপাদানগুলোর মোট চাহিদার অন্তত ১০-২৫ ভাগ জৈব সার হতে আসা উচিত। বিভিন্ন সবজির খাদ্যোপাদান চাহিদা সারণিতে দেয়া হলো।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি— সবজি চাষে সার প্রয়োগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সারের প্রয়োগ পদ্ধতি নিম্নোক্ত কারণে বিভিন্ন রকম হতে পারে। যথা- (১) মাটির ভৌত ও রাসায়নিক অবস্থা ২) আবহাওয়া ৩) সারের প্রকার গুণাবলি ৫) ফসলের প্রকার পাতা, দানা বা ফুলজাতীয় ইত্যাদি) ৬) শেকড়ের প্রকৃতি ও খাদ্যোপাদান গ্রহণ ক্ষমতা ৭) ফসলের সময়কাল ৮) সারের ধরন ইত্যাদি। সারের প্রয়োগ পদ্ধতির ওপর সারের কার্যকারিতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। সুষ্ঠুভাবে উপযুক্ত পরিবেশে শেকড়ের নাগালের মধ্যে সার প্রয়োগ করা হলে ফসল পুরোপরি তা গ্রহণ করতে পারে। তাছাড়া সার মাটিতে আবদ্ধ হয়ে পানিতে ধুয়ে বা বাতাসে উড়ে বিনষ্ট হতে পারে। সার প্রয়োগের পদ্ধতি ও সময়কে বিবেচনা করে সার প্রয়োগ কার্যক্রমকে চারভাগে ভাগ করা হলো। যথা- (ক) মৌল (খ) উপরি (গ) পাতায় ও (ঘ) বিশেষ প্রয়োগ ।
ক) মৌল প্রয়োগ- জমিতে বীজ বপন বা চারা রোপণের পূর্বে সার প্রয়োগ করাকে মৌল প্রয়োগ বলা হয় । যে সব সার ধীরে ধীরে দ্রবণীয় বা গাছের গ্রহণ উপযোগী হয় এবং সহজে বিনষ্ট হয় না সেগুলো মৌল হিসেবে প্রয়োগ করা হয়। বিভিন্ন জৈব সার, চুন, ফসফরাস, জিপসাম ইত্যাদি প্রায় পুরোপরি মৌল হিসেবে প্রয়োগ করা হয়। আবার পটাশ, জিংক, নাইট্রোজেন ইত্যাদি মাটির ও ফসলের প্রকারভেদে ২৫-৫০ ভাগ মৌল প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে দ্রবণীয় সার আগাম প্রয়োগ করা হলে ফসলের প্রয়োজনের সময়ে পরিশোষণের উপযোগী সারের রাসায়নিক বিক্রিয়ার প্রভাবে বীজ বা চারার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না ।
(১) ছিটিয়ে প্রয়োগ- এ ক্ষেত্রে জমি চাষের পর সমস্ত জমিতে সার ছিটিয়ে মই দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। এ পদ্ধতি খুবই সহজ, কম শ্রম ও স্বল্প ব্যয় সাপেক্ষ এবং সময়ও কম লাগে। গাছের অঙ্গন্ধ বৃদ্ধিকালীন সময়ে উপরি প্রয়োগ বা পার্শ্ব প্রয়োগের মাধ্যমেও সার ছিটিয়ে দেয়া হয়। ছিটিয়ে দেয়া পদ্ধতিতে সার গাছের নাগালের বাইরে চলে যায় এতে অপচয় হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ঝড়ো বাতাসের সময় বিশেষ করে গুড়ো সার প্রয়োগ করা অসুবিধাজনক এবং অপচয় হয়। অনুর্বর, সেচবিহীন এবং পাতলা চারা সম্পন্ন ফসলের জমিতে এ পদ্ধতি একবারেই উপযোগী নয়। ফসলের অঙ্গভঙ্গ বৃদ্ধির সময় সার ছিটিয়ে উপরি প্রয়োগ করা হলে গাছের পাতা জ্বলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
স্বল্প মেয়াদি ও ঘন করে ছিটিয়ে বোনা শাক সবজির জমিতে দ্রুত দ্রবণীয় ও পরিচালনশীল সার ছিটিয়ে মৌল হিসেবে প্রয়োগ করতে হয়।
(২) স্থানীয় প্রয়োগ- অনুর্বর জমিতে এ পদ্ধতি বিশেষ উপযোগী এবং কম সার ব্যবহার করে বেশি ফলন পাওয়া যায়। বীজের কাছাকাছি সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে পাশে ও গভীরতায় যথাক্রমে ৮ সে.মি. দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। আর গাছের বেলায় শেকড়ের বিস্তৃতি লক্ষ করে সার প্রয়োগ করা উচিত। মৌল সারের অর্ধেক ছিটিয়ে এবং বাকী অর্ধেক সারি বা নেকড়ের কাছে প্রয়োগ করা উত্তম। নিচে সার প্ররোগের করেকটি পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো।
(১) চারার গর্তে প্রয়োগ- সবজির চারা রোপণের পূর্বে নির্দিষ্ট স্থানে গর্ত করে মাটির সাথে মৌল সারের অর্ধেক মিশিয়ে দিতে হয়। যথা- ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকোলী, টমেটো, বেগুন ইত্যাদি ।
(২) মাদায় প্রয়োগ- ফলজাতীয় সবজির বীজ বা চারার জমিতে নির্দিষ্ট স্থানে মাদা বা থালা তৈরি করে লাগানো হয়। চারা লাগানোর পূর্বে মাদার মৌল সার প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। যথা-কুমড়াজাতীর, লাউ, শশা, চিচিঙ্গা, পেঁপে, কলা ইত্যাদি ।
(৩) লাঙ্গল স্তরে প্রয়োগ - জমি তৈরি শেষে লাঙ্গলের সাহায্যে অগভীর জলি বা নালা তৈরি করে তাতে মৌল সার প্রয়োগ করা হয়। পরে মই দিয়ে জমি সমান করে দিয়ে বীজ বপন বা চারা রোপণ করা হয়। বীজ বা চারার শেকড় বাড়ার পর প্ররোগকৃত সার শেকড়ের সাহায্যে পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারে।
(৪) বীজ বপন যন্ত্রের সাহায্যে প্রয়োগ- এ পদ্ধতিতে বীজ ও সার একত্রে বীজ বপননেত্রর সাহায্যে প্রয়োগ করা হয়। এ প্রথায় বীজের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। তাই একরে বীজ ও সার ছিল বা বপন না করাই ভালো।
(খ) উপরি প্রয়োগ- জমিতে বীজ বপন বা চারা রোপণের পরে সার প্রয়োগ করা হলে তাকে উপরি প্রয়োগ বলে । সাধারণত নাইট্রোজেন, পটাশ, ছাই, লক্ষা, তরুণ গোবর ইত্যাদি সার জমিতে উপরি প্রয়োগ করা হয়। সারের মাত্রা বেশি হলে গাছের পাতায়, কাজে বা মূলে সরাসরি লেগে ফসলের ক্ষতি হয়। তবে শস্যের অবস্থা বুঝে সার প্রয়োগ করা হলে সারের অপচয় কম হবে। সবজি চাষে এ পদ্ধতি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। নিচে উপরি প্রয়োগের কয়েকটি পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো।
১। ছিটিয়ে উপরি প্রয়োগ- ছিটিয়ে বোনা সবজির জন্য নাইট্রোজেন ও পটাশজাতীর সার ছিটিয়ে প্রয়োগ করা বেশ সহজ। মাটিতে রসের অভাব থাকলে উপরি প্রয়োগে সারের সুফল কম পাওয়া যায়। মূলা, ডাটা, লালশাক, পালংশাক ইত্যাদি সবজিতে উপরি প্রয়োগ হিসেবে সার ছিটিয়ে দেয়া হয়।
২। পার্শ্বপ্রয়োগ- সারি পদ্ধতিতে আবাদ করা সবজির পাশে লাইন টেনে তাতে সার প্রয়োগ করা যায় । যথা : ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, মরিচ, গোলআলু, টমেটো, শশা, যুখীকছু। কোন কোন ক্ষেত্রে মুলা, পালংশাক ইত্যাদি সার প্রয়োগের পর ফসলের চাহিদানুযায়ী গোড়ার মাটি তুলে সার ঢেকে সেরা হয়। এ পদ্ধতি সবজি চাষের জন্য উপযোগী। ফসলের সারির দুদিকে একবারে সার না দিয়ে পর্যায়ক্রমে দু'দিকে দু'ধারে সার দেয়া উত্তম। একে ব্যান্ড প্রয়োগ পদ্ধতিও বলা হয়।
৩। চারার/ গাছের চারপাশে প্রয়োগ- মাদায় লাগানো গাছের চারপাশে শিকড় থেকে নিরাপদ দূরত্বে রিং করে নালা কাটা হয়। এক্ষেত্রে নালার সার প্রয়োগ করে মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। যথা-লাউ, শিম, কুমড়াজাতীয়, শসা, কলা, পেঁপে ইত্যাদি।
৪। কাদার গোলক প্রয়োগ- এ পদ্ধতিতে কাদামাটি দিয়ে দলা বা গোলক তৈরি করা হয়। মাটির গোলকের কেন্দ্রে সামান্য পরিমাণ ফাঁকা করে নাইট্রোজেন সার দিয়ে গোলকটি স্ফটিকে ভালোভাবে গুকানো হয়। সাধারণত ১৪১০ অনুপাত নাইট্রোজন সার ও কাদামাটি দিয়ে গোলক তৈরি করা উত্তম। এ পদ্ধতিতে প্রয়োগকৃত সার অন্যান্য পদ্ধতির চেয়ে দেড়গুণ বেশি পরিমাণে গাছ গ্রহণ করতে পারে।
৬। প্রবিষ্টকরণ- এ পদ্ধতিতে তরুণ বা দানাজাতীয় সার সিরিজের মত যত্রে চাপ প্রয়োগ করে মাটির অভ্যন্তরে দেয়া হয়। এতে মাটির বিভিন্নস্তরে এবং গাছের শিকড়ের কাছাকাছি সার প্রয়োগ করা সম্ভব হয়। এ পদ্ধতিতে সারের অপচয় হয় না। উন্নত দেশে এ পদ্ধতি বহু বছর আগে হতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
(গ) পাতায় প্রয়োগ বিশেষ ক্ষেত্রে সারের দ্রবণ তৈরি করে সিঞ্চনের মাধ্যমে গাছের পাতায় প্রয়োগ করা হয়। এতে নির্দিষ্ট অনুপাতে দ্রবীভূত সার সিঞ্চন যন্ত্রে বা হেলিকপ্টারের সাহায্যে পাছের পাতার প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। প্রবণকৃত সার সব সময় পাতার কোষের রসের ঘনত্বের চেয়ে কম হওয়া দরকার। অন্যথা পাতা পুড়ে যাবে। এ পদ্ধতিতে যে কোন মূখ্য উপাদানের অর্ধেক ও গৌণ উপাদানের প্রায় সবটুকু সার পাতার প্রয়োগ করা চলে। নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশ জাতীয় সার অধিক পরিমাণে লাগে বিধায় শুধু পাতায় প্রয়োগ করে গাছের চাহিদা মেটানা েখুব দুরূহ। তবে গৌণ উপাদানের প্রকৃতি অনুপাতে দ্রবণ তৈরি করে পাতায় স্প্রে করে গাছের চাহিদা পূরণ করা যায়। সারের প্রবণ তৈরির নিয়ম নিচে দেয়া হলো।
সারণি ও বিভিন্ন সারের দ্রবণ তৈরির বিবরণ
উপাদান | কী আকারে পাওয়া যায় | প্রতি লিটার পানিতে মেশানোর পরিমাণ (গ্রাম) | |
লৌহ | ফেরাস সালফেট | ২.৫ | ৩.৫ |
ম্যাংগ্যানিজ | ম্যাংগানিজ সালফেট | ২.৫ | ৫.০ |
কপার | কপার সালফেট | ২.৫ | ৫.০ |
জিংক | জিংক সালফেট | ২.৫ | ৫.০ |
বোরন | সোডিয়াম বোরেট | ২.৫ | ৬.০ |
মলবডিনাম | এমোনিয়াম মলিবডেট, সোডিয়াম মলিবডেট | ০.৩ | ০.৮ |
এছাড়া ১-১.৫ ভাগ ইউরিয়া সারের দ্রবণ তৈরি করে সবজি ও অন্যান্য ফসলের পাতায় বিকালে প্রয়োগ করা যায়। পাতাজাতীয় সবজিতে পাতায় প্রয়োগে সবজি তাড়াতাড়ি সবুজ ও সতের হয়। বন্ধ পাতা ও পাতার বাহিরের গিঠের পরিশাধেন ক্ষমতা বেশি। চারার বয়স ৩০-৩৫ দিন হলেই প্রথমে পাতায় সার সিক্ষন করা যায়। বর্ষজীবি ফসলে তার জীবনকালে ৩-৪ বার সিঞ্চন করা চলে। গোবর, খৈল ইত্যাদি জৈব সার ভালভাবে পচায়ে তরলাকারে পাতায় প্রয়োগ করা যায়। এ পদ্ধতিতে অপচয় কম হয় ও গাছে দ্রুত পরিশোষিত হয়। ফসলের জমিতে পানি পরিপূর্ণ থাকলে এবং মাটিতে কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা থাকলেও এ পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ করা যায় । তবে মুখ্য খাদ্যোপাদানের চাহিদা সম্পূর্ণ পূরণ করা যায় না। সার প্রয়োগের পর পরই বৃষ্টি হলে সার ধুয়ে যায়। তাই মেঘলা আবহাওয়ায় বা বৃষ্টির পূর্বে সার দেওয়া উচিত নয়। যে সব ফসলের পাতা মোমযুক্ত সেক্ষেত্রে পাতায় সার প্রয়োগে কোন সুফল পাওয়া যায় না। এরপক্ষেত্রে ফসলে দ্রবণের সাথে আঠালো পদার্থ (টুইন-২০) মিশিয়ে স্প্রে করা উত্তম।
(ঘ) বিশেষ প্রয়োগ
(১) সেচের পানির সাথে- এ পদ্ধতিতে সেচের পানির সাথে সার মিশিয়ে জমিতে প্রয়োগ করা । সমতল জমিতে সমস্ত জমিতে সমভাবে ও সম উচ্চতায় পানি পৌঁছালে সবগাছ সমানভাবে সার পরিশোষণ করতে পারে।
২) বুস্টার বা স্টার্টার দ্রবণ প্রয়োগ- চারার চাহিদা পূরণ ও বৃদ্ধি দ্রুত করার জন্য মূখ্য উপাদানসমূহের দ্রবণ চারার গোড়ায় সিঞ্চন করা হয়। মূখ্য উপাদান ৩টি যথা-নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশ। এগুলোকে একত্রে বা পৃথকভাবে পানিতে গুলিয়ে ১ঃ৫৪২ অনুপাতে চারার গাড়ায় সিঞ্চন করাকে স্টার্টার প্রয়োগ বলে। সাধারণত এন.পি.কে ১৪৫ঃ২ অনুপাতের দ্রবণ তৈরির জন্য ডাই এমোনিয়াম ফসফেট ও মনোপটাশিয়াম মিশ্রণ সমানুপাতিকভাবে গুলিয়ে নিতে হয়। প্রতি গ্যালন পানিতে এক আউন্স বা প্রতি লিটার পানিতে ৬ গ্রাম দ্রবীভূত করলে এই দ্রবণ (এনপিকে) তৈরি হয়।
(৩) বায়বীয় আকারে প্রয়োগ- বায়ুতে সাধারণত ০.০৩ ভাগ কার্বন ডাই অক্সাইড বিদ্যমান। বাতাসে এর পরিমাণ বাড়ানো গেলে গাছের সালাকেসংশ্লেষণের পরিমাণ বেড়ে যাবে। ফলে ফসলের ফলন ও গুণগতমাণ বৃদ্ধি পাবে এবং গাছের জীবনকাল কমে যাবে। তাই ফলন বাড়ানোর জন্য অনেক দেশে গ্রীণ হাউজে ও খোলা মাঠেও কার্বন ডাই অক্সাইড বা এমোনিয়াম প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
সার প্রয়োগের সময়- ফসলের দৈহিক বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়ে খাদ্যোপাদানের চাহিদা বিভিন্ন রকম হয়। চারা অবস্থায় খাদ্যোপাদানের চাহিদা কম এবং বৃদ্ধির সাথে সাথে ক্রমান্বয়ে চাহিদা বাড়তে থাকে। গাছের দৈহিক বৃদ্ধি, শাখা প্রশাখা, মূল ইত্যাদি অপেক্ষা ফুল ও ফল ধারণকালে চাহিদা সবচেয়ে বেশি হয় এবং সময়ে চাহিদা কমে যায়। সার ভালোভাবে কাজে লাগার জন্য নিচের বিষয়গুলো বিশেষভাবে দায়ী। যথা-
১। গাছের বিভিন্ন খাদ্যোপাদান মাটিতে ধরে রাখার ক্ষমতা। ২। সারের মাত্রা। ৩। সারের দ্রবীভূত ক্ষমতা । ৪। সারের গুণাবলি। ৫। মাটিতে তাপমাত্রা, সারের প্রয়োগ পদ্ধতি ইত্যাদি। ৬। মাটিতে রসের পরিমাণ।
সার ব্যবহারের কয়েকটি সাধারণ নিয়মাবলি নিচে দেয়া হলো। যথা-
(১) সব ধরনের জৈব (গোবর, আবর্জনা পঁচা ও সবুজ সার), ফসফরাস পুরোপুরি এবং পটাশ সারের অর্ধেক মাত্রা জমি তৈরির সময় দিতে হয়। সার প্রয়োগ করে মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হয়।
(২) সেচবিহীন ও শুকনো জমিতে সব ধরনের জৈব ও অজৈব সার পূর্ণমাত্রায় বীজ বপনের পূর্বে প্রয়োগ করতে হয়।
(৩) মাদায় রোপণযোগ্য (লাউ, কুমড়াজাতীয়, শিম, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা ইত্যাদি) সবজির জন্য ফসফরাস ও জৈব সার পুরোপুরি বীজ বপন বা চারা রোপণের পূর্বে মাদায় মৌল হিসেবে প্রয়োগ করতে হয়। পটাশ ও নাইট্রোজেনযুক্ত সার পরবর্তীতে বারে বারে উপরি প্রয়োগ করতে হয়।
(৪) বহুবর্ষজীবি ফসলে বর্ষা মৌসুমের শুরুতে ও বর্ষার শেষ দিকে মোট ২ বারে সার প্রয়োগ করতে হয়।
(৫) স্বল্পমেয়াদী শাকসবজিতে নাইট্রোজেন ব্যতিত সব সারই মৌল হিসেবে এবং নাইট্রোজেন সার কয়েক কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হয়
বিভিন্ন শাক-সবজি যেমন- ফুলকপি, বাঁধাকপি, শশা, মূলা, বেগুন, মরিচ, টমেটো, গাজর ইত্যাদি বৃদ্ধির কোন পর্যায়ে কী পরিমাণ খাদ্যোপাদান প্রয়োজন তা সারণিতে ইতিপূর্বে দেয়া হয়েছে। ২-৩ বারে সারের উপরি প্রয়োগ করলে বেশি সুফল পাওয়া যায় এবং অপচয়ও কম হয়।
সার প্রয়োগের সাবধানতা- সার প্রয়োগের জন্য নিচের সাবধানতাগুলো মেনে চলা উচিত। যেমন-
(১) ঝড়ো বাতাসের সময় বা ফসলের পাতা ভেজা অবস্থায় সার উপরি প্রয়োগ করা উচিত নয়। এতে ফসলের ক্ষতি হতে পারে।
(২) কাঁচা গোবর, খৈল, চুন, হাঁড়ের গুড়ো ইত্যাদি দন্ডায়মান ফসলে প্রয়োগ করা উচিত নয়। কাঁচা সার জমিতে প্রয়োগ করা হলে তার প্রায় একমাস পরে বীজ বপন বা চারা রোপণ করা উচিত।
(৩) জমিতে শুধু রাসায়নিক সার ব্যবহার করে তেমন সুফল পাওয়া যায় না। তাই রাসায়নিক সার ও জৈব সার সুষম মাত্রায় প্রয়োগের মাধ্যমে জমির উর্বরতা বজায় রাখতে হবে।
(৪) সমতল জমিতে সমভাবে সার প্রয়োগ করতে হবে ।
(৫) জমির অম্লত্ব বা ক্ষারত্বের সাথে মিল রেখে সার প্রয়োগ করা উচিত।
(৬) বিভিন্ন ধরনের সার একত্রে মেশানোর পুর্বে সেগুলোর রাসায়নিক বিক্রিয়া জেনে তারপর মেশাতে হবে ।
(৭) বৃষ্টি ঠিক পূর্ব মুহূর্তে বা জমিতে পাবন পদ্ধতিতে সেচ দিলে হলে সে সময় সার প্রয়োগ করা উচিত নয় ।
(৮) প্রখর রোদের সময় বিশেষ করে নাইট্রোজেনযুক্ত সার ছিটালে বেশির ভাগই নষ্ট হতে পারে।
পানির অপর নাম জীবন। এ কথাটি প্রাণি ও উদ্ভিদ জগতের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। পানি মাটির খাদ্যোপাদানসমূহকে দ্রবীভূত করে গাছের বিভিন্ন অংশে সরবরাহ করে থাকে। গাছের অঙ্গার আত্মীকরণ, শস্যের সজীবতা রক্ষা, প্রয়োজনীয় হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন সরবরাহ প্রভৃতি কাজে পানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাটিতে পর্যাপ্ত রসের অভাবে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। আবার জলাবদ্ধতা ঘটলে উদ্ভিদের শ্বাস প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং যথেষ্ট ক্ষতি হয়। সুতরাং সবজি চাষে সাফল্য লাভের জন্য পানি সেচ ও নিকাশের প্রতি বিশেষ যত্ন নেয়া প্রয়োজন ।
বাংলাদেশে বার্ষিক গড় বৃষ্টি অত্যধিক হলেও বারো মাসে সমানভাবে হয় না। বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত অতিবৃষ্টি, আর কার্তিক থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত অনাবৃষ্টির কারণে সবজি চাষে অসুবিধা হয়। তাই সেচ ও নিকাশ সুবিধাযুক্ত জমি সবজি চাষের জন্য নির্বাচন করা উচিত। পানি সেচ ও নিকাশ সুবিধার জন্য জমি কয়েকটি সুবিধাজনক খন্ডে বিভক্ত করে নিতে হয়। এরপর সবজির ধরন, মৌসুম ও আবাদ পদ্ধতির ওপর লক্ষ রেখে জমিতে প্রয়োজনীয় আইল ও নালা তৈরি করতে হয়।
বিভিন্ন সবজির পানির চাহিদাসব ধরনের সবজির পানির চাহিদা এক রকম নয়। তাছাড়া একই সবজির জীবন- চক্রের বিভিন্ন স্তরে পানির চাহিদাও বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। নিচের সারণিতে সবজির জীবনচক্রের বিভিন্ন স্তরে পানির চাহিদার তারতম্য দেখানো হলো।
সারণিঃ সাধারণভাবে সবজির জীবনচক্রের বিভিন্ন তুরে পানির চাহিদা
জীবনচক্রের স্তর | প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণ |
বীজের অঙ্কুরোদগম | বীজের ওজনের ৬০-১০০% |
অঙ্কুরোদগমের অব্যবহিত পর | মাটির ধারণ ক্ষমতার ৯০% |
চারা অবস্থায় | মাটির ধারণ ক্ষমতার ৮০-৯০% |
চারা স্থানান্তরের পূর্বে কিছুদিন | মাটির ধারণ ক্ষমতার ৬০-৭০% |
চারা রোপণের পর | মাটির ধারণ ক্ষমতার ৮০% |
অঙ্গবৃদ্ধি ও ফুল ফল ধারণকালে | মাটির ধারণ ক্ষমতার ৫০-৮০% |
মূল জাতীয় সবজি সংগ্রহের কিছুদিন পূর্বে | মাটির ধারণ ক্ষমতার ৪০-৫০% |
বীজ পরিপক্কতা লাভের শেষ পর্যায়ে | মাটির ধারণ ক্ষমতার ৫০-৬০% |
এই তথ্যের ভিত্তিতে জমিতে সেচ নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। পাতাজাতীয় সবজি (লেটুস, পালংশাক, পুঁই শাক) ও কপি গোত্রের সবজির পানির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এগুলোর শেকড় মাটির বেশি গভীরে প্রবেশ করে না বিধায় বেশি পরিমাণে ও ঘন ঘন সেচ দিতে হয়। পেঁয়াজ, মরিচ, বেগুন, শশা এবং টমেটোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ পানি প্রয়োজন । গোল আলু, মূলা প্রভৃতির জন্য প্রচুর পানির প্রয়োজন থাকলেও নিয়ন্ত্রিতভাবে সেচ দিতে হয়। সেচের দ্বারা বা বৃষ্টির কারণে পানিবদ্ধতা ঘটলে সেঁকড় ও ফসল পচে বিনষ্ট হতে পারে। অপরদিকে শিমজাতীয়, কুমড়া ও অন্যান্য বহুবর্ষজীবি সবজি পরিমিত ও নিয়ন্ত্রিত সেচে ভাল ফলন দেয়।
সবজি চাষে সেচের মাধ্যমে কী ধরনের পানি দিতে হবে তাও জানা দরকার। কেননা সেচের পানির সাথে ফসলের ক্ষতিকর রোগ জীবাণু বা উপাদান যেতে পারে । বীজতলায় বীজ গজানোর বা সবজি রোপণের পর পরই যে সেচ দেওয়া হয় তা লবণমুক্ত হতে হবে। পুকুর, নদী বা খালের পানিতে নানা ধরনের আগাছা ও কলকারখানার বর্জ্য মিশে সেচের অনুপযোগী হতে পারে। তাই সেচের পানিতে সেচের ফসলের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
১। পুকুর, নদী বা খালের পানি সেচ দেওয়ার সময় ছেঁকে নিতে পারলে ভালো।
২। পানির উৎসের পাশে ট্যাঙ্ক স্থাপন করে বালির ফিল্টার করে তা সেচে ব্যবহার করা।
৩। সবজির চারা অবস্থায় ০.৫ মিলিগ্রাম ক্লোরিন প্রতি এক লিটার পানিতে মেশায়ে সেচ দেয়া যায়। তাতে অনেক রোগের জীবাণু মারা যায় ও শেওলা দমন হয়।
৪। গভীর বা অগভীর নলকুপের পানি কোন পুকুর বা ট্যাংকে জমা রেখে তারপর সেচে দেওয়া ভালো। বর্তমানে খাল, নালা, ডোবা ইত্যাদি জলাশয়ের পানি যেভাবে দূষিত হচ্ছে তাতে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা ।
সেচের সঠিক সময় নির্ণয়- সেচ দেওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য হলো মাটিকে সরস রাখা, যাতে ফসলের ভালো ফলন নিশ্চিত হয়। শাক সবজির (পানি কচু ব্যতিত) বেলায় জমির সরস অবস্থার (FC) একটু নিচেই পানির মাত্রা গিয়ে যখন পৌঁছে তখনই সেচের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এ অবস্থা কখন হবে তা খালি চোখে দেখে বোঝা যায় না । এজন্যে মাটির রস মেপে দেখতে হয়। হাতের সাহায্যে মাটির রস মাপার সহজ পদ্ধতি নিচে ছবিতে দেখানো হলো । সবজি চাষে সেচ সময় নির্ধারণের সাধারণ বিবেচ্য বিষয়গুলো। যথা-
চারা গজানোর পর থেকে ফুল ধরা পর্যন্ত সবজির পানির চাহিদা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। তাই গাছের বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে কখন এবং কতবার সেচ দিতে হবে তা ঠিক করে নিতে হয়। সাধারণত বৃষ্টি না হলে সবজির ফুল আসা অবধি প্রতি ১০ দিন অন্তর অন্তর সেচ দেওয়া যেতে পারে। (১) বেলে মাটির পানি ধারণক্ষমতা খুব কম। এ জাতীয় মাটিতে ঘন ঘন সেচ দিতে হবে।
(২) জমিতে পানির অভাব হলে মাটির রং হালকা ধরনের হয়। তাই মাটি হালকা রং ধারণ করলে সেচ দিতে হয়।
(৩) পানির অভাবে গাছের পাতা নেতিয়ে পড়ে। এ অবস্থা দেখা দেওয়ামাত্র পানি সেচ দিতে হয়।
(৪) স্বল্প গভীর শেকড় বিশিষ্ট সবজির জমিতে মাটির পানি ধারণ ক্ষমতার শতকরা ৭০ ভাগের কম হলেও সেচ দিতে হয়।
(৫) নিচের সূত্র দ্বারা মাটিতে পানির পরিমাণ জেনে নিয়ে সবজির জমিতে সেচ দেয়া যেতে পারে।
ধরা যাক শুকনো মাটির ওজন ৬০০ গ্রাম, তাহলে রসের পরিমাণ = ১০০০- ৬০০ = ৪০০ গ্রাম ।
অতএব, রসের %
সূত্র মোতাবেক মাটিতে পানি শতকরা ৫০% ভাগের নিচে এলেই সবজির জমিতে সেচ দেয়া উচিত। সবজি চাষে সবজির নাজুক অবস্থা দেখে সেচ দিতে হয়। সবজির পানির নাজুক অবস্থা সারণিতে দেয়া হলো-
হাতের সাহায্যে মাটির রস মাপার কৌশল
এ পদ্ধতি খুব কার্যকরি এবং এভাবে জমিতে রসের অবস্থা দেখে সেচ দেওয়া যেতে পারে। নিচের পদ্ধতি অনুসারে মাটিতে পানির ধারণ ক্ষমতা নির্ণয় করা এবং সারণির বর্ণনা মোতাবেক মাটিতে সেচ দেয়া উচিত।
ধাপ ১- জমির মাঝখানে একটি ছোট গর্ত করতে হবে। গতটির মাপ হবে জমিতে যে ফসল আছে সে ফসলের শিকড়ের গভীরতার ৩ ভাগের ২ ভাগ।
ধাপ ২- গর্তের তলা থেকে মাটি নিয়ে হাতের মুঠোর চাপ দিয়ে গোলাকার করে দলা বা বল তৈরি করতে হবে। শেকড় অঞ্চলের গভীরতার ৩ ভাগের ২ ভাগ গভীরতার মাটি।
ধাপ ৩- সারণির বর্ণনার সাথে এ মাটির দলার মিল করে জমির মাটিতে গাছের উপযোগী কতটুকু রস আছে তা বোঝা যাবে।
ধাপ-৪- মাটির অবস্থা দেখে কোন মাটিতে কতভাগ রস আছে তা বোঝা যাবে এবং কোন মাটিতে কখন সেচ দিতে হবে তা সারণিতে দেয়া হল।
জমির পানি ধারণ ক্ষমতা ৫০% -এ পৌঁছালে এবং ফসলের বাড়বাড়তি ব্যাহত হলে সেচ দিতে হবে ।
সবজি চাষে ভাল ফলনের জন্য যেমন সেচের প্রয়োজন তেমনই ভালো নিকাশ ব্যবস্থার অভাবে ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।
নিকাশের উপকারিতা
(১) মাটির মধ্যে বায়ু চলাচলের সুবিধা হয়। গাছের শেকড় ভালোভাবে বাড়ে ও প্রয়োজনীয় খাদ্য সহজে গ্রহণ করতে পারে।
(২) মাটিতে বায়ু চলাচলের ফলে উপকারী জীবাণুর সংখ্যা বৃদ্ধি পায় যা জৈব পদার্থ থেকে নাইট্রোজেনকে গাছের গ্রহণপোযোগী করে তোলে ।
(৩) মাটির ভিতরের তাপ ঠিক রাখে। তাতে গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বজায় থাকে ।
(৪) মাটিতে অক্সিজেন প্রবাহ বাড়ে। তাতে গাছ সকল প্রকার খাদ্য উপাদান সহজে নিতে পারে ।
(৫) গাছের শেকড় অনেক নিচে যেতে পারে। অনেকদিন বৃষ্টি না হলে মাটির অনেক গভীর হতে রস সংগ্রহ করতে পারে।
নিকাশ না করার অপকারিতা
১. মাটির ভেতরে বায়ু চলাচল কম হয় বা বন্ধ হয়ে যায়। তাতে গাছের শেকড়ে অক্সিজেন না পেয়ে গাছ দূর্বল হয়ে মরে যেতে পারে ।
২. বায়ু চলাচল কম হলে মাটিতে উপকারী জীবাণুর সংখ্যা কমে যায়। ফলে জৈব পদার্থ হতে গাছের খাদ্য উপাদান সহজে বের হতে পারে না।
৩. মাটির ভিতরের তাপ কমে যায়, যা গাছের জন্য ক্ষতিকর।
৪. মাটিতে অক্সিজেনের অভাব হলে গাছের পুষ্টি উপাদান যেমন গন্ধক, লৌহ, নাইট্রোজেনের অভাব দেখা দেয়।
৫. গাছের গোড়ায় ও শিকড়ে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর রোগজীবাণুর ও পরজীবির আক্রমণ দেখা দেয়।
সেচ পদ্ধতি
জমিতে সেচের পানি সরবরাহের নানা পদ্ধতি প্রচলিত আছে। তন্মধ্যে প্লাবন পদ্ধতি, নালা পদ্ধতি, থাল পদ্ধতি, বর্ষণ পদ্ধতি ও ঝাঝরি পদ্ধতি উল্লেখযাগ্যে। বর্ষণ পদ্ধতি সকল প্রকার সবজি চাষের জন্য উত্তম। এ পদ্ধতি ব্যয়সাপেক্ষ। পারিবারিক সবজি বাগানে ঝাঁঝরি পদ্ধতিতে দেওয়া হয়। জমির পরিমাণ বেশি হলে সুনিয়মিতভাবে সারি ও কেয়ারির মাঝখান দিয়ে নালা পদ্ধতিতে সেচ দেওয়া সুবিধাজনক। তাছাড়া মাদায় রোপণকৃত ফল সবজির জন্য থানা পদ্ধতিতে সেচ দেওয়া ভালো।
সেচের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে প্রধানত তিনটি পদ্ধতিতে সবজি ক্ষেতে সেচ দেওয়া হয়ে থাকে। পদ্ধতিগুলোর বর্ণনা নিচে দেয়া হলো
(ক) পৃষ্ঠদেশ পদ্ধতি- প্লাবন, নালা, থালা পদ্ধতিগুলো পৃষ্ঠদেশ পদ্ধতির আওতাভুক্ত। সেচের অন্যান্য পদ্ধতির চেয়ে এ পদ্ধতি সহজতর। এর মাধ্যমে সবজি ক্ষেতে সেচ দিতে তুলনামূলকভাবে কম খরচ পড়ে। প্লাবন বা নালা পদ্ধতিতে পানির অপচয় হয় না এবং সেচের পর মাটি সহজেই কর্দমাক্ত হয়ে পড়ে। জমি সমতল না হলে প্লাবন পদ্ধতিতে সেচ দেওয়া কষ্টসাধ্য। নালা করে সেচ দেওয়ার সময় জমি একদিকে অল্প ঢাল করে তৈরি করে নিলে পানির অপচয় কম হয় । আবার বেশি ঢালু হলে সেচের পানির সাথে মাটি ও গাছের খাদ্য উপাদান ধুয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
সবজির দুই সারি বা কেয়ারির মাঝখান দিয়ে নালা করে পানি দেওয়া যায়। এতে সবজি গাছের গোড়ার মাটি রসালো হয়, মাটি ঝুরঝুরে থাকে এবং কর্দমাক্ত হয় না। দোন, সেউতি, কপিকল, পার্সিয়ান হুইল ইত্যাদির সাহায্যে পুকুর, খাল বিল, নদী, কুপ হতে পানি উঠানো যায়। তারপর নালা দিয়ে সবজি ক্ষেতে সেচ দেওয়া হয়ে থাকে। এছাড়া গভীর ও অগভীর নলকুপ বা পাওয়ার পাম্পের সাহেয্যে ভূ-নিম্নস্থ বা ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি দিয়েও এ পদ্ধতিতে সেচ দেয়া হয়ে থাকে।
সমতল জমিতে সেচ নালা হতে সেচ উপনালা তৈরি করতে হয়। সেচ উপনালার সাথে জমির প্রতিটি খণ্ডের জোড়া রাখতে হয়। সবচেয়ে দূরের খণ্ডে আগে সেচ দিতে হয়। দূরের খণ্ডের মুখ বন্ধ করে দ্বিতীয় খণ্ডের মুখ খুলে দিতে হয়। এভাবে দূরেরগুলো পর পর বন্ধ করে কাছেরগুলো পর পর খুলে দিতে হয়। এতে পানির অপচয় কম হয়। কেলি করে লাগানো সবজিতে এ পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর।
সমতল জমিতে কেলি করে চাষ করা হলে প্রথম কেলির একদিকের মুখ সেচের নালার সাথে খোলা রাখতে হয়। অপর মুখ দ্বিতীয় কেলির সাথে খোলা হয়। দ্বিতীয় কেলির যে মুখ প্রথম কেলির সাথে খোলা, তার অপরদিকের মুখ তৃতীয় কেলির সাথে খোলা রাখতে হয়। এভাবে সমস্ত কেলিগুলো একটির সাথে আরেকটির সংযোগ তৈরি হবে। এতে প্রথম কেলিতে সেচ দিলে পানি বাধা পেয়ে ঘুরে ঘুরে সমস্ত কেলিতে প্রবেশ করবে। কেলিগুলো সমানভাবে তৈরি করা না হলে সমস্ত কেলিতে সমভাবে পানি প্রবেশ করবে না। ঢাল জমিতে সেচ দিতে হলে ঢালের অনুকুলে কেলি তৈরি করতে হয়। আর ঢালের উপরের দিকে একটি লম্বা লম্বি প্রধান নালা তৈরি করতে হয়। চাপের অনুকূলের প্রতিটি কেলির মধ্যবর্তী নালাগুলোর উপরের মুখ প্রধান নালার সাথে খোলা থাকবে। কিন্তু নিচের দিকের মুখ বন্ধ থাকবে। এ সমস্ত জমিতে নালা তৈরির সময় অত্যন্ত সতকর্তার সাথে নানার তলদেশ সমান করে নিতে হয়। সেচ দেয়ার সময় নিয়ন্ত্রিতভাবে সেচ দিতে হয়। নইলে পানির অপচয় হয়।
(খ) নিম্ন পৃষ্ঠদেশ পদ্ধতি- এ পদ্ধতিতে মাটির ভিতর দিয়ে সবজি পাছের শেকড়ের কাছাকাছি পানি পৌঁছাে দেওয়া হয়। এজন্য সুখ সুখ ছিত্রদযুক্ত পাইপ ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে সেচের জন্য সবজি সারি করে রোপণ করতে হয়। এ পদ্ধতি ব্যয়বহুল বলে আমাদের দেশে সাধারণত ব্যবহার করা হয় না বললেই চলে। তবে এ পদ্ধতির কতকগুলো সুবিধা আছে। কথা- ১) মাটি কর্দমাক্ত হয় না, ২) মাটি একস্থান হতে অন্য স্থানে ধুয়ে যায়, ৩) পানির অপচয় হয় না, ৪) মাটিতে বায়ু চলাচলের কোন অসুবিধা হয় না, ৫) গাছ খুব তাড়াতাড়ি রস গ্রহণ করতে পারে ও ৬) খাদ্য উপাদান চুইয়ে যেতে পারে না।
(গ) ধারণা সেচ- এ পদ্ধতিতে মাটির উপর দিয়ে বা খুঁটির সাহায্যে পাইপ স্থাপন করা হয়। পাইপের বিভিন্ন স্থান দিয়ে পানি বের হয়ে বৃষ্টির বা ঝরণার আকারে পড়ার জন্য ঘূর্ণায়মান ভালু লাগানো থাকে। এর মাধ্যমে পানি বৃষ্টির আকারে জমির চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এটি পানি সেচের অন্যতম উৎকৃষ্ট পদ্ধতি। কিন্তু অত্যন্ত ব্যববহুল বলে সাধারণ কৃষকের পক্ষে অনুসরণ করা সম্ভব নয় না। স্বল্প পরিসরে সবজি চাষে এ পদ্ধতি অবশ্য অনুসরণ করা যায়। এর সুবিধা হলো। যথা-
১) পানি বৃষ্টিপাতের মতো এবং সমভাবে বন্টন করা সম্ভব হয়
২) মাটি ক্ষয়ের সম্ভাবনা থাকে না
৩) মাটিতে বায়ু চলাচলের অসুবিধা হয় না।
৪) মাটি শক্ত হরে যায় না।
চারা ছোট বা লিকলিকে অবস্থায় এবং চারা রোপণের পর পরই ঝরণ পদ্ধতিতে সেচ দেওয়া উচিত নয়। তাতে চাৱা মাটিতে শুয়ে পড়ে যেতে পারে। চারার কটি কাণ্ডে ও পাতার মাটি লেগে ক্ষতি হতে পারে। গাছে ফুল ধরা অবস্থায় এ পদ্ধতিতে সেচ দিলে পরাগায়নে ব্যাঘাত ঘটে এবং ফলন কমে যায় ।
জলাবদ্ধতা
জমিতে অতিরিক্ত সেচের ফলে বা অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর উপরে উঠে আসে। এতে গাছের শিকড়ের কাছাকাছি স্থান ভেজা থাকে এবং মাটির ভিতরে বায়ু চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তবে জমিতে শস্যের গোড়ায় পানি জমে থাকা হলো জলাবদ্ধতা। জমিতে জলাবদ্ধতা দেখা দিলে উর্বরা শক্তি হ্রাস পায়, শিকড়ের বৃদ্ধি বাহত হয় এবং শস্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ভূ-গর্ভস্থ ও ভূ-পৃষ্ঠস্থ কৃত্রিম ড্রেন বা নর্দমা তৈরি করতে হয়। এসব ড্রেন জমির উপরিভাগ হতে কমপক্ষে দেড় মিটার নিচে বা সবজি ফসলের শেকড়ের গভীরতার নিচে নামাতে হয়। এর ফলে খোলা নর্দমা বা জমির উপরিভাগের পানি এই ড্রেনের সাহায্যে বের করে সেচ এলাকার বাইরে নদী, খাল ইত্যাদিতে ফেলে দিতে হয়।
অন্তবর্তী পরিচর্যা
জমিতে বীজ চারা লাগানোর পর হতে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত গাছের বৃদ্ধি ও ফলায়নের জন্য পরিচর্যা করতে হয়। এই পরিচর্যাগুলোকে অন্তবর্তী পরিচর্যা বলে। নিচে বিভিন্ন ধরনের পরিচর্যার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো। আঁচড়া, কোদাল, নিড়ানী, বা সময়ে সময়ে হাল্কা চাষের মাধ্যমে সবজি মাঠের আন্তঃকর্ষণ কাজগুলো সম্পন্ন করা হয়। এ কাজের উদ্দেশ্য মাটিকে ঝরঝরে ও মোলায়েম রাখা। মাটির অভ্যন্তরে অনায়াসে পানি ও বায় চলাচলে সাহায্য করা। ফলশ্রুতিতে মাটিতে বসবাসকারী উপকারী কীট ও জীবাণুসমূহের কার্যকারীতা বৃদ্ধি পায় ও গাছের খাদ্যোপাদান গ্রহণে সুবিধা হয়। কর্ষণ করলে মাটির স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় থাকে এবং পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বৃষ্টিপাত বা সেচের পর মাটি শুকালে উপরিভাগে শক্ত আবরণ পড়ে। এতে মাটির অভ্যন্তরে বাতাস ও পানি চলাচলে অসুবিধা হয়। তাই আন্তঃকর্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন। আকর্ষণের ফলে আগাছাও দমন হয়ে যায়।
আন্তরণ বা মালচিং
শস্য চাষকালে মাটিতে রস সংরক্ষণ, আগাছা দমন, মাটির চটা ভাঙা ইত্যাদি উদ্দেশে যে সব কাজগুলো সম্পন্ন করা হয় সেগুলোকে আন্তরণ বা মালচিং বলে।
মালচিং তিন প্রকার। যথা-
(১) মাটি মালচিং,
(২) খড়কুটা ও আবর্জনা মালচিং
(৩) কাগজ/পলিথিন মালচিং ।
(১) মাটি মালটিং- জমি চাষ করলে বা জমির চটা ভেঙে দিলে জমির রস সংরক্ষণ এবং আগাছা নিধণ হয়।
(২) খড়কুটা ও আবর্জনা মালচিং-বিভিন্ন সবজির জমিতে ফসলের বৃদ্ধিকালে খড়কুটা/আবর্জনা নিয়ে জমি ঢেকে রাখলে রস সংরক্ষণসহ আগাছা নিয়ন্ত্রণ হয় ।
(৬) কাগজ/পলিথিন মালচিং- অনেক সবজির জমিতে আগাছা নিয়ন্ত্রণের জন্য ফসলের স্থান ব্যতিত অন্যান্য স্থান পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এতে আগাছা নিয়াণসহ রস সংরক্ষণ হয়।
সবজি চাষে আগাছা ও পোকা মাকড় দমন
ছোট আকারের গাছ যা জমিতে জন্মে ফসলের সাথে পুষ্টি উপাদান, স্থান, পানি, আলো ইত্যাদির জন্য প্রতিযোগিতা তৈরি করে এবং ফসলের সবকিছুতে ভাগ বসার সে সমস্ত উদ্ভিদকে আগাছা বলা হয়। যেমন- মুখা, দূর্বা, শ্যামা, উলু, চাপড়া, বন্ধুরা ইত্যাদি। কোন কোন সময় আগাছার কারণে শতকরা ১০০% ফসল নষ্ট হতে পারে। সাধারণত ফসলের প্রথম অবস্থা হতে আগাছা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে দেরিতে আর নিয়ন্ত্রণ করা যায় না এবং ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়। আগাছা যেভাবে শস্যের ক্ষতি করে তা হলো-
(১) ফসলের সাথে খাদ্য পুষ্টির প্রতিযোগিতা তৈরি করে থাকে। আগাছা এক হেক্টর জমি থেকে রবি মৌসুমে ২০ কেজি ও আমন মৌসুমে ৫৬.৩০ কেজি নাইট্রোজেন অপসারণ করে।
(২) পানির জন্য ফসলের সাথে প্রতিযোগিতা তৈরি করে থাকে। আগাছা ফসলের তুলনায় মাটি হতে অনেক বেশি পরিমাণ পানি চুষে নিয়ে থাকে।
(৩) ফসলের সাথে আলো বাতাসের জন্য প্রতিযোগিতা তৈরি করে থাকে। আগাছার বৃদ্ধি দ্রুত, তাই ফসল আপাহার নিচে পড়ে আলো বাতাসের অভাবে সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়া কম হওয়ার ফলন দূর্বা হয়ে পড়ে।
(৪) আগাছা ফসলের রোগে পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। অধিকাংশ আগাছাই ফসলের বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড়ের বিকল্প আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। সবুজ সতেজ আগাছা ধানের মাজরা পোকা ও ভাইরাস বহনকারীর বিকল্প আশ্রয় স্থল হিসেবে কাজ করে। জলী রাইগাছ থেকে “আরাট” রোগ আসে কাশী রাই গাছে। বারবেরি গাছ থেকে ব্লাক স্টেম রাস্ট রোগ আসে গমে। এমনিভাবে বিভিন্ন আগাছা থেকে এসে শাকসবজির রোগ ও পোকামাকড় আক্রমণ করে।
(৫) পরজীবী ক্রিয়াশীল অনেক আগাছা আছে যারা ফসলের গাছের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে। আরোবাঞ্চি আগাছা বেগুন গাছের শেকড় হতে রস চুষে নিয়ে বেঁচে থাকে। তাতে বেগুন গাছ দূর্বল হয়ে যায়। সর্ণলতা গাছের লতা শিম, বেগুন গাছের ওপর লতিয়ে গেলে ফসলী গাছ হতে রস চুষে নিয়ে ফসলের ক্ষতি করে থাকে।
(৬) আগাছার কারণে ফসলের ফলন হ্রাস পায়। অনেক কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে আগাছা ফসলের ১০-৩০% ক্ষতি করে থাকে। যদি আগাছা ফসলী জমিতে প্রথম অবস্থা হতে নিয়ন্ত্রণ না করা হয় তাহলে ৫০%-এর ওপরে এমনকি ১০০% ফসল বিনষ্ট করতে পারে ।
(৭) ফসলের ওপর আগাছা বিষাক্ত ক্রিয়া আগাছা করে থাকে। কোন কোন আগাছা তার বৃদ্ধিকালে শেঁকড়ে বিষাক্ত রস সৃষ্টি করে যা মাটিতে ছেড়ে দিয়ে ফসলী গাছের ক্ষতি করে থাকে। দূর্বা, মুখজাতীয় আগাছা এরূপ প্রক্রিয়া করে ফসলের ক্ষতি করে থাকে ।
(৮) আগাছা ফসল উৎপাদনে খরচ বাড়ায় এবং ফলন কমায়। আগাছা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নিড়ানি, আঁচড়া, কোপানো, হাতে টেনে তোলা, রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার ইত্যাদি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। এজন্য যথেষ্ট খরচ হয় এবং আগাছা বিভিন্নভাবে ফলন কমিয়ে দেয়। যার ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় অথচ ফলনও কমে যায়।
(৯) ফসলের মান এবং বীজের গুণাগুণ খারাপ করে। আগাছার বীজ ফসলের সাথে মিশে ফসলের মান খারাপসহ অনেক সময় খাদ্যে বিষাক্ততা সৃষ্টি করে। আগাছার বীজ ফসলের বীজের সাথে মিশে বীজের মান খারাপ করে থাকে। যা পরবর্তীতে ফসলের ফলন ও মান উভয়ই কমিয়ে দেয়।
ফসলের জমিতে আগাছা জন্মাতে না দেওয়া বা আগাছাকে বিনষ্ট করাকে আগাছা দমন বুঝায় । আগাছা প্রাতরোধ এবং নিধন করে আগাছাকে দমন করা যায় ।
ক) আগাছা প্রতিরোধ- ফসল জন্মানোর আগে জমিতে বারবার চাষ, মই ও আঁচড়া দিয়ে পরিচ্ছন্ন করতে হয়। রোদে জমি শুকাতে হয়, জমিতে পানি আটকিয়ে আগাছা পচাতে হয়। এতে আগাছার বংশ বৃদ্ধি ব্যাহত হয়ে আগাছার উপদ্রব কমবে।
খ) ভাল মানের বীজ ব্যবহার- বীজ রাখার জন্য ফসল কাটার আগেই জমি হতে পরিচ্ছন্ন চাষ থেকে ফসল কাটা এবং মাড়াই করার স্থান পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। এতে বীজে আগাছার বীজ মিশ্রণের সুযোগ থাকে না।
গ) গোবর/কম্পোস্ট আবর্জনা সারের ব্যবহার-জৈব সার তৈরির সময় ভালোভাবে পচায়ে দিলে আগাছার বীজ থাকার সুযোগ থাকে না ।
ঘ) সেচের পানি প্রবাহের সময় নিয়ন্ত্রণ-ফসলের সেচের আগে নালা পরিষ্কার করে নিলে আগাছার বীজ পানিতে মেশার সুযোগ থাকে না। এক জমি হতে অন্য জমিতে পানি প্রবাহের সময় আইল ও পানি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
ঙ) কৃষি কাজে ব্যবহারের যন্ত্রপাতি পরিচ্ছন্ন রাখা- আঁচড়া, লাঙ্গল, মই, কোদাল, নিড়ানি ইত্যাদি ফসলের মাঠে ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে এক জমি হতে অন্য জমিতে নিতে হয়।
চ) পশুপাখির চলাচল নিয়ন্ত্রণ গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগি ইত্যাদি এক জমি হতে অন্য জমিতে চলাচলের সময় তাদের গায়ে পায়ে লেগে আগাছার বীজ ছড়িয়ে পড়ে। তাই পশুপাখির চলাচল নিয়ন্ত্রণ করলে আগাছা দমন হতে পারে ।
ছ) আগাছা নিয়ন্ত্রণ আইন প্রবর্তন- ফসল উৎপাদনকারীকে তার জমি এবং ফসলের আশপাশ আগাছামুক্ত রাখতে হবে। এ ব্যাপারে অনেক দেশে আইন আছে এবং সেখানে ভালো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে। আগাছা নিধনের কতগুলো কার্যকরি পদ্ধতি আছে। যেমন- যান্ত্রিক দমন, পরিচর্য্যাগত, রাসায়নিক ও জৈবিক দমন পদ্ধতি ।
(ক) যান্ত্রিক পদ্ধতিতে আগাছা দমন- আঁচড়া, কোদাল, নিড়ানি, লাঙল, রোটারি, হ্যারো ও ডিস্ক প্লাউ ইত্যাদির সাহায্যে জমি হতে আগাছা নষ্ট করা হয়। চাষের ফলে মাটি ওলটপালট হয়ে আগাছা চাপা পড়ে মারা যায়। নিড়ানি দিয়ে আগাছা উঠায়ে ফেলা হয়, চাষের কারণে আগাছা কেটে টুকরো টুকরো হয় এবং রোদে শুকিয়ে মারা যায়।
খ) পরিচর্যাগত পদ্ধতিতে আগাছা দমন- শস্য পর্যায়, খড়কুটা বা মাটির বা পলিথিনের মালচিং ব্যবহার করলে আগাছা নিধন হয়। বেগুন, কপি, আলুর জমিতে মালচিং করে সহজেই আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায় । তাছাড়াও দ্রুত বর্ধনশীল, ঝোপালো ও আবরণ সৃষ্টিকারী ফসলের চাষ, প্লাবন পদ্ধতিতে সেচ দিয়ে জলাবদ্ধতা তৈরি, সবুজ সার উৎপাদন, হাতে টেনে উঠায়ে এবং আন্তক্রিয়া সৃষ্টিকারী ফসল (তিল, ছোলা) চাষ করেও আগাছা দমন করা যায়
গ) রাসায়নিক পদ্ধতিতে আগাছা দমন- ফসলের জমিতে জন্মানো আগাছাকে বিভিন্ন ধরনের আগাছানাশক ব্যবহার করে নিধন করা যায়। যেমন- ২-৪ ডি, প্যারাকুয়াট, গামাক্সোন, প্রাপোনিল, এমসিপিএ ইত্যাদি।
ঘ) জৈবিক পদ্ধতিতে আগাছা দমন ও ফসলী জমির আগাছা অনেক ধরনের পোকামাকড়, জীব, রোগ জীবাণু দিয়ে নিধন করা হয়।
সমন্বিত পোকামাড়ক ও রোগবালাই দমন ব্যবস্থাপনা
রোগবালাই, পোকামাকড় ও ইঁদুর প্রভৃতি ফসলের চরম শত্রু। এসব শত্রুকে সময়মতো দমন না করলে ফসলের সুষ্ঠু বাড় বাড়তি ও ফলন কম হবে। শুধু একটি শত্রুকে দমন করে ভালো ফসল আশা করা যায় না। ভালো ফসল পেতে হলে সম্মিলিতভাবে সবগুলো শত্রু অর্থাৎ পোকামাকড়, রোগবালাই, আগাছা, ইঁদুর প্রভৃতি দমন করতে হবে। স্থানীয় জাতের ফসলে কম সার ও পানি ব্যবহারের প্রেক্ষিতে পোকা ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ সাধারণত কম হয়। তাছাড়া এসব জাতের রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ শক্তি বেশি। এদের ফলন কম বলে উচ্চ ফলনশীল (উফশী) ফসলের চাষ করা হচ্ছে। যার ফলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার উদ্দেশে এসব স্থানীয় জাতের চাষ কমিয়ে উন্নত জাতের চাষ বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আনুমানিকভাবে সার পানি ব্যবহার করলে উফশী ফসলে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়ে যায় এবং ফসলের ক্ষতিও বেশি হয়।
সাধারণভাবে রোগবালাই বা পোকামাকড় দমনের জন্য কৃষকগণ বিষাক্ত রাসায়নিক ঔষধের ওপর নির্ভরশীল। এসব বালাইনাশক ঔষধ যেন তেনভাবে ব্যবহার করে কৃষকগণ তাৎক্ষণিক ফল কিছুটা পায়, কিন্তু এসব ঔষধের অপপ্রয়োগের কারণে অনিষ্টকারী কীটপতঙ্গাগুলোর শরীরে ঐসব ঔষধের প্রতি সহনশীলতা জন্মে। পরবর্তীতে এসব পোকামাকড় আর ঐসব ঔষধ দিয়ে দমন করা যায় না। ফলশ্রুতিতে নতুন ও আরও বিষাক্ত ঔষধ আরও বেশি ব্যবহার করতে হয়। এসব ঔষধ থেকে আবহাওয়া, ফসল ও মাটির মধ্যে বিষক্রিয়া থেকে যায় যা মানুষ ও গৃহপালিত পশুর ক্ষতি করে। তাছাড়া ঢালাওভাবে বিষাক্ত ঔষধ ব্যবহারের ফলে মানুষের অনেক উপকারি পোকামাকড় ধ্বংস হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কীটনাশক ঔষধ ব্যবহারের ফলে মৌমাছি, বোলতা প্রভৃতি ধ্বংস হচ্ছে। এর ফলে অনেক ফসলেরই পরাগায়নের ক্ষতি হয় এবং স্বাভাবিকভাবেই ফলন কমে যায়। আবার অন্যদিকে যেনতেনভাবে বালাইনাশক ঔষধ ব্যবহারের ফলে পরিবেশের দূষণ হচ্ছে যা দূষণ বা অন্যান্য জীবকুলের জন্য ক্ষতিকর। এসব কথা বিবেচনা করেই সমন্বিত বালাইনাশক ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে। ফসল সংরক্ষণ ও ভালো ফলনের জন্য এটি একটি আধুনিক ও উপকারী কলাকৌশল। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো অবস্থাভেদে পোকা দমনে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা। বিষাক্ত ঔষধ কম ব্যবহার করলে শাক সবজিতে বিষাক্ত ঔষধের বিষক্রিয়া তেমন থাকতে পারে না এবং ক্ষতি হয় না। বালাই দমনের বিভিন্ন ব্যবস্থা অবলম্বন করার পরও পোকার বা রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেশি হয়ে আর্থিক ক্ষতির পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। এরূপ অবস্থা হলে রাসায়নিক ঔষধ ব্যবহার করতে হবে। এতে করে ক্ষতিকারক বালাইনাশক ঔষধের ব্যবহার সীমিত হবে, পরিবেশ নির্মল থাকবে। অপরদিকে উপকারি পোকামাকড় ও জীবজন্তুর জীবন ঝুঁকিমুক্ত থাকবে এবং কৃষকের আর্থিক ক্ষতি কম হবে। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা বলতে ফসলের পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনের জন্য প্রয়োজনে একাধিক দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা বোঝায়। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার উপকারী দিকগুলো নিচে দেয়া হলো।
১। উপকারী পোকামাকড়, মাছ, ব্যাঙ, পশুপাখী (চিল, পেচা, শালিক ইত্যাদি) ও গুইসাপ প্রভৃতি রক্ষা করা যায়।
২। বালাইনাশক ব্যবহারের জন্য যুক্তিসংগত কারণ খুঁজে পাওয়া যায় ৷
৩ । বালাইনাশকের দূর্ঘটনা এড়ানো যায় এবং পরবর্তী কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
৪। অপকারী পোকামাকড় বালাইনাশক সহনশীলতা অর্জন করার সুযোগ পায় না ।
৫। বালাইয়ের পুনরায় আক্রমণের সম্ভাবনা কম হয়।
৬। দূষণমুক্ত পরিবেশের নিশ্চয়তা থাকে।
সমন্বিত বালাইনাশক ব্যবস্থাপনাকে প্রথমে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছেঃ
১। প্রাকৃতিক দমন পদ্ধতি ২। সরাসরি বালাই দমন পদ্ধতি। ৩। জৈব প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনা ৪। কৃষিতাত্ত্বিক বা কৃষি পরিচর্যা পদ্ধতি ও ৫। রাসায়নিক পদ্ধতি।
ক) প্রাকৃতিক দমন পদ্ধতি ফসলের সুষ্ঠু বাড় বাড়তি এবং ভালো ফলনের জন্য এ পদ্ধতিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিকভাবে স্বাভাবিক আবহাওয়ায় পোকামাকড় ও রোগজীবাণু বেঁচে থাকে এবং বংশ বিস্তার লাভ করে। স্বাভাবিক আবহাওয়ায় বেশি তারতম্য হলে এসবের বংশ বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। যেমন- গ্রীষ্ণকালে যখন আবহাওয়া উষ্ণ থাকে তখন পোকামাকড়ের উপদ্রব বেশি দেখা যায়। শীতকালে তাপমাত্রা কমার ফলে এসবের আক্রমণ তুলনামূলকভাবে কমে যায়। আবার স্যাঁতসেঁতে, কম আলোবাতাস ও ছায়াযুক্ত স্থানে এদের আক্রমণ বেশি হয় । বেশি বৃষ্টি, ঝড়, টাইফুন, বন্যা প্রভৃতি ইঁদুর এবং অন্যান্য অনিষ্টকারী পোকার প্রাকৃতিক শত্রু নষ্ট করে দেয় ।
এক কথায় উত্তর
১. সবজি বাগান কত ধরনের হয় ?
২. বৈশিষ্ট্য অনুসারে মাটি কয়ভাগে বিভক্ত ?
৩. পলিকণার অনুপাতের ভিত্তিতে দোঁআশ মাটি কয়ভাগে বিভক্ত?
৪. পিএইচ-এর নিরপেক্ষ মান কত ?
৫. মাটির প্রধান রাসায়নিক বিক্রিয়ার কতটি শ্রেণি আছে ?
৬. বাংলাদেশে সবজি চাষের অধীন জমির সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া সম্ভব কি না ?
৭. মোট আবাদি জমির কত % জমিতে সবজি চাষ হয়?
৮. সার প্রয়োগ পদ্ধতি কতভাগে বিভক্ত ?
৯. বীজ অঙ্কুরোদগমের সময় বীজের ওজনের কত% পানির প্রয়োজন ?
১০. জমির পানি ধারণ ক্ষমতা কত %-এ পৌঁছলে অবশ্যই সেচ দিতে হবে?
১১. মাটিতে বসবাসকারী ১টি পোকার নাম লেখ ।
১২. গুদামে বীজ সংরক্ষণে কীটনাশকের পরিবর্তে কী ব্যবহার করা যায়?
১৩. মালচিং কত ধরনের হয় ?
১৪. আগাছা দমন পদ্ধতি কত ধরনের ?
১৫. সবজিতে প্রধানত কয়টি পদ্ধতিতে সেচ দেয়া হয় ?
১৬. আগাছার কারণে সর্বোচ্চ কত % ফসল নষ্ট হতে পারে?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. গার্হস্থ্য ও বিক্রয়মূলক সবজি বাগান বলতে কী বোঝায় ?
২. মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব বলতে কী বোঝায় ?
৩. সবজি চাষে সারের চাহিদা কীভাবে নিরূপণ করা যায় ?
৪. সবজি চাষে সার প্রয়োগ পদ্ধতিগুলো কী কী এবং বিভিন্ন প্রয়োগ পদ্ধতি কেন অবলম্বন করা হয় ?
৫. ৫টি সবজির খাদ্যোপাদান পরিশোষণ এর পরিমাণ, কখন বেশি পরিশোষণ করে এবং তার হেক্টর প্রতি ফলন উল্লেখ কর।
৬. সারের কার্যকারিতা কোন কোন বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল?
৭. সবজির জীবনচক্রের বিভিন্ন স্তরে পানির চাহিদা কখন তা উল্লেখ কর।
৮. পানি নিকাশের উপকারিতা বর্ণনা কর।
৯. সবজিতে সেচের প্রধান প্রধান পদ্ধতিগুলো কী কী এবং যে কোন একটি পদ্ধতির বর্ণনা কর ।
১০. সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার উপাদানগুলো কী কী ?
১১. বালাই ব্যবস্থাপনায় জৈবিক দমন বলতে কী বোঝায় ?
রচনামূলক প্রশ্ন
১. সবজি চাষের উপযোগী মাটি কোনগুলো? মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব কী এবং কীভাবে তা সংশোধন করা যায় তা বর্ণনা কর।
২. বাংলাদেশে সবজি চাষের বর্তমান অবস্থা হালনাগাদ (২০০৬-০৭, ২০০৭-০৮) পরিসংখ্যানসহ উল্লেখ কর ।
৩. আগাছা কীভাবে শস্যের ক্ষতি করে তা বর্ণনা কর ।
৪. সবজিতে সেচের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে পৃষ্ঠদেশ পদ্ধতির বর্ণনাসহ মুক্ত প্লাবন পদ্ধতির ছবি অঙ্কন কর ।
৫. ফল, মূল, কন্দ ও পাতাজাতীয় সবজির মধ্যে প্রতিটির অন্তত ৩টি করে সবজিতে কোন সময় পানির নাজুক অবস্থা হয় তা বর্ণনা কর ।
টীকা লেখ
১) অম্ল ও ক্ষার মাটি
২) মাটিতে পানির পরিমাণ নির্ণয়ের সূত্রটি উদাহরণসহ বোঝাও
৩) পরিচর্যাগত পদ্ধতিতে আগাছা দমন
৪) সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা ।
Read more