সুপ্রিয় শিক্ষার্থী, বিগত দুটি সেশনে তোমরা পবিত্র বাইবেল থেকে এবং একজন উনিশ শতকের মিশনারির সেবা করার জন্য কষ্টভোগ ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে সেবা করার বেশ ভালো ধারণা পেয়েছ। এই দুটি সেশনেও তোমরা বাইবেল ও একজন মিশনারির জীবনী থেকে সমবায় উন্নয়নে ত্যাগের মাধ্যমে সেবা দান করে সমাজের কল্যাণ কীভাবে সাধন করা যায় তার উজ্জ্বল ধারণা পাবে। শিক্ষক তোমাকে নির্দিষ্ট পাঠ থেকে পবিত্র বাইবেল পড়তে বলবেন। তাই আগে থেকে নিচের দেওয়া বাইবেল পাঠের অংশটুকু পড়ে প্রস্তুত থেকো।
শিক্ষক তোমাদের মধ্যে একজনকে পবিত্র বাইবেল থেকে প্রেরিত/শিষ্যচরিত ৪:৩২-৩৭ পদ এবং মথি ৭:১২ পদ পড়তে বলবেন। প্রস্তুত থেকো বা তুমি বাইবেল পাঠ করতে চাইলে শিক্ষককে অনুরোধ করতে পারো।
"খ্রীষ্টে বিশ্বাসীরা সবাই মনেপ্রাণে এক ছিল। কোন কিছুই তারা নিজের বলে দাবি করত না বরং সব কিছুই যার যার দরকার মত ব্যবহার করত। প্রেরিতেরা মহাশক্তিতে সাক্ষ্য দিতে থাকলেন যে, প্রভু যীশু মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠেছেন, আর তাদের সকলের উপর ঈশ্বরের অশেষ দয়া ছিল। তাদের মধ্যে কোন অভাবী লোক ছিল না, কারণ যাদের জমি কিম্বা বাড়ী ছিল তারা সেগুলো বিক্রি করে টাকা-পয়সা এনে প্রেরিতদের পায়ের কাছে রাখত। পরে যার যেমন দরকার সেইভাবে তাকে দেওয়া হত। যোষেফ নামে লেবির বংশের একজন লোক ছিলেন। সাইপ্রাস দ্বীপে তাঁর বাড়ী ছিল। তাঁকে প্রেরিতেরা বার্ণবা, অর্থাৎ উৎসাহদাতা বলে ডাকতেন। তাঁর এক খণ্ড জমি ছিল; তিনি সেটা বিক্রি করে টাকা এনে প্রেরিতদের পায়ের কাছে রাখলেন।"
"তোমরা অন্য লোকদের কাছ থেকে যেরকম ব্যবহার পেতে চাও তোমরাও তাদের সংগে সেইরকম ব্যবহার কোরো। এটাই হল মোশির আইন-কানুন ও নবীদের শিক্ষার মূল কথা।"
তোমাকে একটু সহজভাবে বলি
যীশুকে যারা বিশ্বাস এবং গ্রহণ করেছিল তারা প্রত্যেকে ধনী বা স্বচ্ছল ছিল না, অনেকেই ছিল দীনহীন। খ্রীষ্টের শিক্ষা এবং যীশুখ্রীষ্টকে অনুসরণ করতে হলে দুনিয়ার ধনসম্পদ ত্যাগ করে অনুসরণ করতে হবে। এই শিক্ষা তাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছিল। যারা ধনী ছিল প্রত্যেকে তাদের ধনসম্পদ এনে এক জায়গায় রাখত। দীনহীন বা ধনী সকলে যার যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু সেখান থেকে নিত। এ যেন কিছুটা সমবায় সমিতির মতো, সকলে সমানভাবে জীবন যাপন করত। যীশুখ্রীষ্ট যেভাবে ত্যাগের মহিমায় নিজেকে সমর্পণ করেছেন, তেমনি তাঁর অনুসারীরা তাদের নিজেদের সম্পত্তির মায়া ত্যাগ করে তাদের খ্রীষ্টিয়ান ভাইবোনদের জন্য দিয়েছিল। এ কারণে প্রত্যেকে তাদের জীবন মান উন্নত করে দারিদ্রদ্র্য থেকে মুক্ত হয়েছিল। আমরাও এভাবে আমাদের যা কিছু আছে তা দিয়ে যারা অভাবে আছে তাদেরকে সাহায্য করতে পারি। আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা যেমন নিজেদের জন্য অন্যের কাছ থেকে আশা করি ঠিক একই রকমভাবে অন্যরাও আশা করে। অতএব, শুধু নিজের জন্য চিন্তা না করে অন্যের দুঃখ-দুর্দশার দিনে তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। ঈশ্বর আমাদের কাছে থেকে এমন সেবাই আশা করেন।
আজ আমরা এমন একজন ব্যক্তির সম্পর্কে জানব যিনি নিজের জন্য চিন্তা না করে অন্যের দুঃখ-দুর্দশার দিনে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি হলেন শ্রদ্ধেয় ফাদার চার্লস জে. ইয়াং, সিএসসি।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
ফাদার চার্লস যোসেফ ইয়াং, সিএসসি ১৯০৪ খ্রীষ্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা মেরী ও বাবা ডানিয়েল ইয়াং মিলে একটি সুখী পরিবার। পরিবারে চার সন্তানের মধ্যে চার্লস ছিলেন তৃতীয়। চতুর্থ সন্তান জন্ম দেয়ার সময় চার্লসের মা মারা যান। দানিয়েল ইয়াং সন্তানদের দেখাশোনা ও চাকুরি একসঙ্গে সামলাতে না পেরে চার্লসকে একটি অনাথ আশ্রমে দিয়ে দেন। সেখান থেকে চার্লস একটি সেমিনারিতে দারোয়ানের চাকরি করা শুরু করেন। প্রাথমিক স্কুল পার হয়ে তিনি নিউইয়কের দ্যা মোস্ট হলি রোজারিও হাই স্কুলে ভর্তি হন। সেখানেই ঐ ধর্মপল্লীর যাজক পূর্ব বাংলায় বা বর্তমানে বাংলাদেশে মিশনারি হিসেবে যোগ দিতে উৎসাহিত করেন। ১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দে ১৯ বছর বয়সে চার্লস নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পবিত্র ক্রুশ সেমিনারিতে যোগ দেন। পড়াশোনা শেষ করে ঐ একই বিশ্ববিদ্যালয়ে নভিশিয়েটে যোগ দেন।
আহ্বান
ফাদার চার্লস ১৯২৫ খ্রীষ্টাব্দের ২রা জুলাই প্রথম ব্রত গ্রহণ করেন। তিনি চারটি ব্রত গ্রহণ করেছিলেন: দরিদ্রতা, কৌমার্য, বাধ্যতা এবং বিদেশে বাণী প্রচার। তার সব সময় স্বপ্ন ছিল, তিনি একজন বিদেশি মিশনারি হবেন। ১৯৩৩ খ্রীষ্টাব্দের ২৪শে জুন তিনি যাজক পদ লাভ করেন এবং ঐ বছরের অক্টোবর মাসে ফাদার চার্লস পূর্ববঙ্গের (বর্তমানে বাংলাদেশ) উদ্দেশে রওনা দেন। ২৫শে নভেম্বর ১৯৩৩ খ্রীষ্টাব্দে ঢাকায় এসে পৌঁছেন।
সমবায় ঋণদান সমিতির বিষয়ে প্রাথমিক চিন্তা
ফাদার চার্লস, ময়মনসিংহ এলাকায় দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। মানুষের প্রচন্ড দারিদ্র্য কাছে থেকে দেখেছেন এবং উপলব্ধি করেছেন যে অর্থ দান করে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা অসম্ভব। তিনি এই দারিদ্রদ্র্য থেকে মুক্ত করার নানাবিধ পন্থা অবলম্বন করেন। অবশেষে তিনি বুঝতে পারেন যে, সমবায় ঋণদান সমিতি দ্বারাই মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা সম্ভব। এ বিষয়ে তিনি তখন তৎকালীন আর্চবিশপ লরেন্স গ্রেনারের সঙ্গে দেখা করেন এবং দারিদ্র্য বিমোচনের এই ধারণা বুঝিয়ে বলেন। আর্চবিশপ মহোদয় ফাদার চার্লসের মাঝে বিপুল উৎসাহ দেখে কানাডায় অবস্থিত নোভা স্কটিয়ারি অ্যান্টিহোনিশ-এর কোডি ইনস্টিটিউটে সমবায় ঋণদান সমিতির উপর পড়াশোনা করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। ১৯৫৩ খ্রীষ্টাব্দে পরবর্তী দুই বছর পড়াশোনা করে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন।
ক্রেডিট ইউনিয়নের জন্ম
১৯৫৪ সালে ঢাকায় এসে তিনি এক মিশন থেকে অন্য মিশনের যাজকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। ১৯৫৫ খ্রীষ্টাব্দের ৩রা জুলাই পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার চার্চে প্রথম সমবায় ঋণদান সমিতির সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই সভা হলো বাংলাদেশের প্রথম সমবায় ঋণদান সমিতির সভা। তারই ধারাবাহিকতায় ১৩ই মার্চ ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে, ১৯৪০-এর বেঙ্গল সোসাইটি অ্যাক্টের অধীনে 'দি খ্রিষ্টান কো- অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিমিটেড' নামে নিবন্ধন করা হয়।
দারিদ্র্য দূরীকরণে অবদান
মানুষের দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু করেন। ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশ মরিয়মনগর, বিড়ইডাকুনী, বারমারী, রাণীখং অঞ্চলে তিনি দীর্ঘদিন মানুষকে সমবায় ঋণদান সমিতির বিষয়ে সংগঠিত ও উদ্বুদ্ধ করেছেন। ঐ সমস্ত অঞ্চলে দরিদ্রদের জন্য "ধান ব্যাংক" পরিচালনা করেছিলেন। ঠিক যেমন যীশুর শিষ্যরা ও বিশ্বাসীরা সমস্ত সম্পত্তি এক জায়গায় জমা করতো এবং যার যতটুকু দরকার হতো ততটুকু নিতো; কেউ দীনহীন ছিলো না (প্রেরিত/শিষ্যচরিত ৪:৩২-৩৭ পদ)।
ফাদার চার্লসও সেইভাবে ধান ব্যাংকের মাধ্যমে হতদরিদ্রদের অভাব ঘুচাতেন। তিনি ফসলের বীজ, গৃহপালিত পশুপাখি ও অর্থ দিয়ে অভাবী মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এছাড়াও বিদেশি সাহায্যের উপর ভরসা না করে, স্থানীয় জনগণকে অর্থ সাহায্য দেওয়ায় অনুপ্রাণিত করতেন। সেই অর্থ দিয়ে দেশের দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় ত্রাণ সহায়তা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি অন্যান্য যাজকদের সমন্বয়ে 'কোর' নামক একটি ত্রাণ ও পুনর্বাসন সংস্থা স্থাপন করেন। ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত লক্ষাধিক মানুষের পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এই 'কোর' পরবর্তীকালে 'কারিতাস বাংলাদেশ' নামে প্রতিষ্ঠিত হয়, যে সংস্থা বর্তমানে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করে যাচ্ছে।
মৃত্যু
ফাদার চার্লস জে. ইয়াং, সিএসসি, ১৯৮৮ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ই নভেম্বর পরলোকে গমন করেন। বর্তমান খ্রীষ্টান সমাজের উন্নয়নে তাঁর যে অবদান তা কেউ ভুলে যায়নি। কারণ 'দি খ্রিষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিমিটেড' এবং 'কারিতাস বাংলাদেশে'র বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে তিনি অমর হয়ে আছেন।
তথ্যসূত্র: স্মিতা ইমেন্ডা রোজারিও, ব্রেডিট ইউনিয়ন আন্দোলনের পথিকৃৎ ফাদার চার্লস জে ইয়ং, সিএসসি (সমবার্তা, প্রকাশনার ৩৬ বছর, বর্ষ: ৩৬ সংখ্যা ২, ২০২২ খ্রীষ্টাব্দ)। ২৬-২৮
প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করি
তোমার প্রিয় শিক্ষক তোমাদের এখন একটা সাদা কাগজে প্রত্যেকের প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে বলবেন। তোমরা প্রত্যেকের প্রতিক্রিয়ায় যে সমস্ত বিষয় নিয়ে লিখবে তা হলো:
১. পবিত্র বাইবেলের ব্যাখ্যা থেকে এবং দুইজন মহান ব্যক্তির ত্যাগ ও সেবাদান থেকে কী অভিজ্ঞতা অর্জন করেছ?
২. সমাজের কল্যাণে কীভাবে এই ধরনের সেবাকাজ তোমরা করতে পারো?
লেখা শেষ হয়ে গেলে কাগজগুলো শিক্ষকের নিকট জমা দাও।।
শিক্ষক তোমাদের শ্রেণিকক্ষে তোমাদের সংখ্যা অনুসারে ২/৩ দলে ভাগ করে দিবেন। এরপর প্রতিটি দল একটি সেবামূলক সংগঠন তৈরি করবে। তোমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী সংগঠনের নাম দিতে পারো (যেমন- সবুজ সেবা সংঘ, আনন্দ মুখ, পাশে থাকি সংঘ, এলাকার নামে সেবা সংঘ ইত্যাদি)। তোমাদেরকে সংগঠিত হয়ে সমাজের উন্নয়নের লক্ষ্যে যে কোনো সেবামূলক কাজ করতে হবে। এর জন্য শিক্ষক তোমাদের এক সপ্তাহ সময় বা আরও বেশি সময় দিতে পারেন। এই সময়ের মধ্যে তোমরা নিজেদের এলাকায় দলগতভাবে সেবামূলক কাজ করবে এবং এই সেবাকাজ করতে গিয়ে যা তোমাদের ত্যাগ করতে হয়েছে (যেমন- সময়, অর্থ, খাবার, স্বাস্থ্য ইত্যাদি) সেই সকল বিষয় লিখে রাখবে। সংগঠনের যে কোনো একজন প্রতিদিন জার্নাল/দিনলিপি লিখবে। সেবামূলক কাজগুলোর চিত্র ধারণ করবে। যদি সম্ভব হয় সেবা গ্রহণকারীর মন্তব্য সংগ্রহ করবে। এরপর তোমরা সাংগঠনিকভাবে একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন তৈরি করবে। আগামী সেশনে তোমার সংগঠনের ত্যাগের মাধ্যমে যে সেবামূলক কাজ করেছ তার সবকিছু যুক্ত করে একটি পোর্টফোলিও তৈরি করে নিয়ে আসবে।
একটি ফাইলের মধ্যে সংগঠনের প্রতিদিনের সেবা কাজের জার্নাল/দিনলিপি, ছবি, সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন ও সেবা গ্রহণকারীর মন্তব্য ইত্যাদি তারিখ অনুসারে সংরক্ষণ করা।
সেশন শেষে তোমার শিক্ষককে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানাও।
আরও দেখুন...