সাধারণত গদ্যরচনার অন্তর্নিহিত বক্তব্যকে সংক্ষেপে লেখার নাম সারাংশ, আর কাব্যভাষায় লেখা কোনো রচনার মূলভাবকে সংক্ষেপে লেখার নাম সারমর্ম। সারাংশকে সারসংক্ষেপ এবং সারমর্মকে মর্মার্থও বলা হয়ে থাকে। একটি বিষয় সম্পর্কে সংক্ষেপে ধারণা পেতে সারাংশ ও সারমর্ম বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সারাংশ ও সারমর্ম লেখা শিখতে নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীগণ নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অনুসরণ করতে পারে:
ক. প্রদত্ত রচনার বিবরণ ও ভাবকে অনুসরণ করে সারাংশ ও সারমর্ম লিখতে হয়।
খ. অনধিক চার বাক্য বা চল্লিশ শব্দের মধ্যে সারাংশ ও সারমর্ম সীমিত রাখা দরকার।
গ. প্রদত্ত রচনার মূল কথা যাতে সারাংশ ও সারমর্মে বাদ না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়।
ঘ. সারমর্ম বা সারাংশ লেখার সময়ে উদাহরণ, উদ্ধৃতি, পরিসংখ্যান, তথ্য-উপাত্ত ইত্যাদি পুরোপুরি বাদ দিতে হয়।
ঙ. সারাংশ ও সারমর্মের ভাষায় কোনো ধরনের কাব্যধর্মিতা রাখা যায় না। ভাষা হতে হয় দ্ব্যর্থহীন ও আবেগবর্জিত।
চ. সারাংশ ও সারমর্মে পুনরাবৃত্তি পুরোপুরি বর্জনীয়।
ছ. সারাংশ বা সারমর্ম লেখার সময়ে নিজস্ব বক্তব্য, মন্তব্য বা মত প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই।
নিচে সারাংশ ও সারমর্ম রচনার কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করা হলোঃ
১
এ কথা নিশ্চিত যে, জনসংখ্যার ঊর্ধ্বগতি জাতীয় জীবনে উন্নয়নের গতিকে শ্লথ করে। সমাজ ও পরিবারের জীবনেও তা নানা প্রতিকূল প্রভাব বিস্তার করে। অধিক জনসংখ্যার ভারে ন্যুজ সমাজ তার সদস্যদের সামাজিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। যেমন, শিক্ষালাভের অধিকার একটি সামাজিক অধিকার। কিন্তু দারিদ্র্যপীড়িত সমাজে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার অত্যন্ত কঠিন। বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যা এখনও শিক্ষালাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এই বিপুল জনসংখ্যার জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারলে দেশের অগ্রগতি স্থবির হয়ে পড়তে বাধ্য। দেশের নতুন প্রজন্মকে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা মানে হলো সম্ভাবনাময় বিশাল জনশক্তির অপচয় ঘটানো।
সারাংশ: জনসংখ্যার অধিক বৃদ্ধি দেশের উন্নতির অন্তরায়। এতে সমাজ ও পারিবারিক জীবনে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মানুষ শিক্ষার মতো সামাজিক অধিকার পায় না। ফলে দেশের বিপুল জনশক্তির অপচয় ঘটে।
২
বিদ্যা মানুষের মূল্যবান সম্পদ, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু চরিত্র তদপেক্ষাও অধিকতর মূল্যবান। অতএব কেবল বিদ্বান বলিয়াই কোনো লোক সমাদর লাভের যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে না। চরিত্রহীন ব্যক্তি যদি নানা বিদ্যায় আপনার জ্ঞানভাণ্ডার পূর্ণ করিয়াও থাকে, তথাপি তাহার সঙ্গ পরিত্যাগ করা শ্রেয়। প্রবাদ আছে যে, কোনো কোনো বিষধর সর্পের মস্তকে মণি থাকে। মণি মূল্যবান পদার্থ বটে। কিন্তু তাই বলিয়া যেমন মণি লাভের নিমিত্ত বিষধর সর্পের সাহচর্য করা বুদ্ধিমানের কার্য নহে, সেইরূপ বিদ্যা আদরণীয় বিষয় হইলেও বিদ্যালাভের নিমিত্ত বিদ্বান দুর্জনের নিকট গমন বিধেয় নহে।
সারাংশ: বিদ্যা মূল্যবান বটে, তবে চরিত্রের মূল্য আরো বেশি। যার চরিত্র ভালো নয়, তার জ্ঞান দিয়ে কোনো ভালো ফল আশা করা যায় না। সাপের মাথায় মণি থাকলেও তা ভয়ংকর; চরিত্রহীন বিদ্বান হলেও তার সঙ্গ পরিত্যাগ করা উচিত।
৩
সমাজের কাজ কেবল মানুষকে টিকে থাকার সুবিধা দেওয়া নয়, মানুষকে বড় করে তোলা, বিকশিত জীবনের জন্য মানুষের জীবনে আগ্রহ জাগিয়ে দেওয়া। স্বল্পপ্রাণ ভুলবুদ্ধি ও জবরদস্তিপ্রিয় মানুষে সংসার পরিপূর্ণ। তাদের কাজ নিজের জীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে তোলা নয়, অপরের সার্থকতার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করা। প্রেম ও সৌন্দর্যের স্পর্শ লাভ করেনি বলে এরা নিষ্ঠুর ও বিকৃতবুদ্ধি। এদের একমাত্র দেবতা অহংকার। তারই চরণে তারা নিবেদিতপ্রাণ। ব্যক্তিগত অহংকার, পারিবারিক অহংকার, জাতির অহংকার ও ধর্মগত অহংকার এ সবের লাল নিশান ওড়ানোই এদের কাজ। মাঝে মাঝে মানব-প্রেমের কথাও তারা বলে। কিন্তু তাতে নেশা ধরে না, মনে হয় তা আন্তরিকতাহীন ও উপলব্ধিহীন বুলি মাত্র।
সারাংশ: সমাজ একটি সামবায়িক সংগঠন। সমাজ গঠনের উদ্দেশ্য মহৎ হলেও এখানে ভালো-মন্দ উভয় শ্রেণির মানুষের উপস্থিতি থাকে। অহংকারী ও স্বার্থপর মানুষ সমাজে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে না, বরং অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
8
মাতৃস্নেহের তুলনা নাই; কিন্তু অতি স্নেহ অনেক সময়ে অমঙ্গল আনয়ন করে। যে স্নেহের উত্তাপে সন্তানের পরিপুষ্টি, তাহারই আধিক্যে সে অসহায় হইয়া পড়ে। মাতৃস্নেহের মমতার প্রাবল্যে মানুষ আপনাকে হারাইয়া আসল শক্তির মর্যাদা বুঝিতে পারে না। নিয়ত মাতৃস্নেহের অন্তরালে অবস্থান করিয়া আত্মশক্তির সন্ধান সে পায় না - দুর্বল, অসহায় পক্ষিশাবকের মতো চিরদিন স্নেহাতিশয্যে আপনাকে সে একান্ত নির্ভরশীল মনে করে। ক্রমে জননীর পরম সম্পদ সন্তান অলস, ভীরু, দুর্বল ও পরনির্ভরশীল হইয়া মনুষ্যত্ব বিকাশের পথ হইতে দূরে সরিয়া যায়। অন্ধ মাতৃস্নেহ সে কথা বোঝে না দুর্বলের প্রতি সে স্থিরলক্ষ্য, অসহায় সন্তানের প্রতি মমতার অন্ত নাই- অলসকে সে প্রাণপাত করিয়া সেবা করে ভীরুতার দুর্দশার কল্পনা করিয়া বিপদের আক্রমণ হইতে ভীরুকে রক্ষা করিতে ব্যস্ত হয়।
সারাংশ: অতিরিক্ত মাতৃস্নেহ সন্তানের জন্য মঙ্গলজনক নাও হতে পারে। অধিক স্নেহে সন্তানের মধ্যে স্বনির্ভরতা আসে না; সে অসহায় হয়ে পড়ে। অন্ধ মাতৃস্নেহ দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেয়।
৫
অভ্যাস ভয়ানক জিনিস একে হঠাৎ স্বভাব থেকে তুলে ফেলা কঠিন; মানুষ হবার সাধনাতেও তোমাকে ধীর ও সহিষ্ণু হতে হবে। সত্যবাদী হতে চাও? তাহলে ঠিক কর সপ্তাহে অন্তত একদিন তুমি মিথ্যা বলবে না। ছয় মাস ধরে এমনি করে নিজে সত্য কথা বলতে অভ্যাস কর। তারপর এক শুভ দিনে আর একবার প্রতিজ্ঞা কর, সপ্তাহে তুমি দুইদিন মিথ্যা বলবে না। এক বছর পরে দেখবে সত্য কথা বলা তোমার কাছে অনেকটা সহজ হয়ে পড়েছে। সাধনা করতে করতে এমন একদিন আসবে তখন ইচ্ছা করলেও মিথ্যা বলতে পারবে না। নিজেকে মানুষ করার চেষ্টায় পাপ ও প্রবৃত্তির সঙ্গে সংগ্রামে তুমি হঠাৎ জয়ী হতে কখনও ইচ্ছা কোরো না। তাহলে সব পণ্ড হবে।
সারাংশ: মানুষ অভ্যাসের দাস। কোনো অভ্যাসকে একদিনে বদলানো যায় না। অভ্যাস বদলানোর জন্য নিয়মিত চেষ্টা করতে হয়। নিজেকে চরিত্রবান করতে চাইলে ধীরে ধীরে মিথ্যাচার ত্যাগ করার চেষ্টা করতে হবে।
৬
মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। ইহারা সহসা যদি বিদ্রোহী হইয়া উঠে, নিস্তব্ধতা ভাঙিয়া ফেলে, অক্ষরের বেড়া দগ্ধ করিয়া একেবারে বাহির হইয়া আসে! হিমালয়ের মাথার উপরে কঠিন বরফের মধ্যে যেমন কত কত বন্যা বাঁধা আছে, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে মানবহৃদয়ের বন্যা কে বাঁধিয়া রাখিয়াছে!
সারাংশ: লাইব্রেরির সঙ্গে নীরব মহাসাগরের তুলনা করা যায়। যুগ যুগ ধরে অগণিত জ্ঞানী-গুণী মানুষের চিন্তা- ভাবনা বইয়ের পাতায় স্থায়িত্ব লাভ করে। মানুষের অর্জিত জ্ঞান এই বইয়ের মাধ্যমে লাইব্রেরিতে সঞ্চিত হয়ে আছে।
৭
মানুষের মূল্য কোথায়? চরিত্র, মনুষ্যত্ব, জ্ঞান ও কর্মে। বস্তুত চরিত্রবলেই মানুষের যা-কিছু শ্রেষ্ঠ তা বুঝতে হবে। চরিত্র ছাড়া মানুষের গৌরব করার আর কিছুই নেই। মানুষের শ্রদ্ধা যদি মানুষের প্রাপ্য হয়, সে শুধু চরিত্রের জন্য। অন্য কোনো কারণে মানুষের মাথা মানুষের সামনে নত হবার দরকার নেই। জগতে যে সকল মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁদের গৌরবের মূলে এই চরিত্রশক্তি। তুমি চরিত্রবান লোক - এ কথার অর্থ এই নয় যে, তুমি লম্পট নও। তুমি সত্যবাদী, বিনয়ী এবং জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করো, তুমি পরদুঃখকাতর ন্যায়বান এবং মানুষের ন্যায় স্বাধীনতাপ্রিয় চরিত্রবান মানে এই।
সারাংশ: চরিত্র, মনুষ্যত্ব, জ্ঞান ও কর্ম মানুষের মর্যাদা নির্ধারণ করে। চরিত্রগুণেই মানুষ অন্যের শ্রদ্ধা লাভ করতে পারে। যিনি সত্যবাদী, বিনয়ী, জ্ঞানী, পরোপকারী, ন্যায়পরায়ণ, স্বাধীনতাপ্রিয় ও সজ্জন তিনিই চরিত্রবান।
৮
আজকাল বিজ্ঞানের দ্বারা যেসব অসাধ্য সাধন হইতেছে, তাহাও বহু লোকের ক্ষুদ্র চেষ্টার ফলে। মানুষ পূর্বে একান্ত অসহায় ছিল। বুদ্ধি, চেষ্টা ও সহিষ্ণুতার বলে আজ সে পৃথিবীর রাজা হইয়াছে। কত কষ্ট ও কত চেষ্টার পর মানুষ বর্তমান উন্নতি লাভ করিয়াছে, তাহা আমরা মনেও করিতে পারি না। কে প্রথম আগুন জ্বালাইতে শিখিল, কে প্রথম ধাতুর ব্যবহার শিক্ষা দিল, কে লেখার প্রথা আবিষ্কার করিল, তাহা আমরা কিছুই জানি না। এই মাত্র জানি যে, প্রথমে যাঁহারা নূতন কোনো প্রথা প্রচলন করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন, তাঁহারা পদে পদে অনেক বাধা পাইয়াছিলেন। অনেক সময়ে তাঁহাদিগকে অনেক নির্যাতনও সহ্য করিতে হইয়াছিল। এত কষ্টের পরও অনেকে তাঁহাদের চেষ্টা সফল দেখিয়া যাইতে পারেন নাই। আপাতত মনে হয়, তাঁহাদের চেষ্টা একেবারে বৃথা গিয়াছে। কিন্তু কোনো চেষ্টাই একেবারে বিফল হয় না। প্রবাল দ্বীপ যেরূপ একটু একটু করিয়া আয়তনে বর্ধিত হয়, জ্ঞান রাজ্যও সেইরূপ তিল তিল করিয়া বাড়িতেছে।
সারাংশ: বর্তমান সভ্যতায় বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য। বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির পিছনে রয়েছে অগণিত মানুষের নিরন্তর কর্মপ্রচেষ্টা। মানুষের কর্মপ্রচেষ্টায় যুগ যুগ ধরে নানা আবিষ্কার ও উদ্ভাবনে এই সভ্যতা সমৃদ্ধ হয়েছে।
৯
তুমি বসন্তের কোকিল, বেশ লোক। যখন ফুল ফুটে, দক্ষিণ বাতাস বহে, এ সংসার সুখের স্পর্শে শিহরিয়া উঠে, তখন তুমি আসিয়া রসিকতা আরম্ভ কর। আবার যখন দারুণ শীতে জীবলোকে থরহরি কম্প লাগে, তখন কোথায় থাক, বাপু। যখন শ্রাবণের ধারায় আমার চালাঘরে নদী বহে, যখন বৃষ্টির চোটে কাক চিল ভিজিয়া গোময় হয়, তখন তোমার মাজা মাজা কালো কালো দুলালি ধরনের শরীরখানি কোথায় থাকে? তুমি বসন্তের কোকিল, শীত বর্ষার কেহ নও।
সারাংশ: সুবিধাবাদীদের উপস্থিতি সুসময়ে দেখা যায়। দুঃখের দিনে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রয়োজনের সময়ে এই সুসময়ের বন্ধুরা কোনো উপকারে আসে না।
১০
অভাব আছে বলিয়া জগৎ বৈচিত্র্যময় হইয়াছে। অভাব না থাকিলে জীব-সৃষ্টি বৃথা হইত। অভাব আছে বলিয়া অভাব-পূরণে এত উদ্যম, এত উদ্যোগ। সংসার অভাবক্ষেত্র বলিয়া কর্মক্ষেত্র। অভাব না থাকিলে সকলেই স্থাণু-স্থবির হইত, মনুষ্যজীবন বিড়ম্বনাময় হইত। মহাজ্ঞানীগণ অপরের অভাব দূর করিতে সর্বদা ব্যস্ত। জগতে অভাব আছে বলিয়াই মানুষ সেবা করিবার সুযোগ পাইয়াছে। সেবা মানবজীবনের পরম ধর্ম। সুতরাং অভাব হইতেই সেবাধর্মের সৃষ্টি হইয়াছে। আর এই সেবাধর্মের দ্বারাই মানুষের মনুষ্যত্বসুলভ গুণ সার্থকতা লাভ করিয়াছে।
সারাংশ: জীবনে অসম্পূর্ণতা আছে বলেই মানুষ পূর্ণতার খোঁজ করে। অভাব দূর করার জন্যই সে কর্মপ্রচেষ্টায় রত থাকে। আবার কিছু মানুষ অন্যের অভাব পূরণের মধ্য দিয়ে মহান হয়ে ওঠে।
১
শৈশবে সদুপদেশ যাহার না রোচে,
জীবনে তাহার কভু মূর্খতা না ঘোচে।
চৈত্র মাসে চাষ দিয়া না বোনে বৈশাখে,
কবে সেই হৈমন্তিক ধান্য পেয়ে থাকে?
সময় ছাড়িয়া দিয়া করে পণ্ডশ্রম,
ফল চাহে, সেও অতি নির্বোধ, অধম।
খেয়া-তরী চ'লে গেলে বসে এসে তীরে,
কিসে পার হবে, তরী না আসিলে ফিরে?
সারমর্ম: নৈতিকতা শেখার যথার্থ সময় শিশুকাল। ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি করতে না পারলে জীবন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এমনকি অসময়ে অতিশ্রমেও কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করা সম্ভব হয় না।
২
কোথায় স্বর্গ? কোথায় নরক? কে বলে তা বহুদূর?
মানুষেরই মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর।
রিপুর তাড়নে যখনি মোদের বিবেক পায় গো লয়,
আত্মগ্লানির নরক-অনলে তখনি পুড়িতে হয়।
প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরি কুঁড়ে ঘরে।
সারমর্ম: স্বর্গ ও নরক প্রাপ্তি ঘটে পরকালে এমনটিই প্রচলিত ধারণা। কিন্তু পৃথিবীতেই স্বর্গ কিংবা নরক রচনা করা সম্ভব। প্রীতি ও প্রেমেই স্বর্গীয় সুখ আসে; হিংসা ও কুপ্রবৃত্তি দেয় নরক-যন্ত্রণা।
৩
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে।
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি -
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
সারমর্ম: নতুনকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে পুরাতনকে চলে যেতে হয়। বর্তমান পৃথিবী নানা সংকটে জর্জরিত। নতুন প্রজন্মের জন্য পৃথিবীকে সুখকর ও বাসযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব পুরাতন প্রজন্মের।
8
আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ!
হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দু'পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান।
সারমর্ম: শ্রমজীবী মানুষের কঠোর শ্রম ও ত্যাগে গড়ে উঠেছে মানবসভ্যতা। ধনিকশ্রেণির দ্বারা নিপীড়িত হলেও তারা সত্যিকারের মহৎ মানুষ। একদিন তাদের নবজাগরণের মধ্য দিয়ে এ বিশ্বে নতুন দিনের সূচনা ঘটবে।
৫
বসুমতি, কেন তুমি এতই কৃপণা,
কত খোঁড়াখুঁড়ি করি পাই শস্যকণা।
দিতে যদি হয় দে মা, প্রসন্ন সহাস -
কেন এ মাথার ঘাম পায়েতে বহাস?
বিনা চাষে শস্য দিলে কী তাহাতে ক্ষতি?
শুনিয়া ঈষৎ হাসি কন বসুমতী,
আমার গৌরব তাহে সামান্যই বাড়ে,
তোমার গৌরব তাহে নিতান্তই ছাড়ে।
সারমর্ম: শস্যসম্পদ অর্জন করা কষ্টসাধ্য। তাই মানুষের শক্তি, সামর্থ্য ও শ্রমের এত মূল্য। অন্যের করুণার উপরে নির্ভরশীল হলে মানুষের মর্যাদা বাড়ে না। কষ্ট করে পাওয়া ফলের মধ্যে মানুষের গৌরব নিহিত।
৬
ধন্য আশা কুহকিনী! তোমার মায়ায়
অসার সংসারচক্র ঘোরে নিরবধি!
দাঁড়াইত স্থিরভাবে, চলিত না হায়!
মন্ত্রবলে তুমি চক্র না ঘুরাতে যদি!
ভবিষ্যৎ-অন্ধ মূঢ় মানব-সকল
ঘুরিতেছে কর্মক্ষেত্রে বর্তুল আকার;
তব ইন্দ্রজালে মুগ্ধ; পেয়ে তব বল
যুঝিছে জীবন-যুদ্ধ হায়! অনিবার।
নাচায় পুতুল যথা দক্ষ বাজিকরে,
নাচাও তেমনি তুমি অর্বাচীন নরে।
সারমর্ম: আশা জীবন-সংসারের অদৃশ্য চালিকাশক্তি। আশা না থাকলে মানবজীবন স্থবির ও জড়তায় পর্যবসিত হতো। আশা আছে বলেই এর মন্ত্র-মায়ায় মানুষ সামনে এগিয়ে চলে, সমৃদ্ধির লক্ষ্যে জীবন-যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।
৭
নিখিলের এত শোভা, এত রূপ, এত হাসি-গান,
ছাড়িয়া মরিতে মোর কভু নাহি চাহে মন-প্রাণ
এ বিশ্বের সব আমি প্রাণ দিয়ে বাসিয়াছি ভালো -
আকাশ বাতাস জল, রবি-শশী, তারকার আলো।
সকলেরই সাথে মোর হয়ে গেছে বহু জানা-শোনা,
কত কি-যে মাখামাখি, কত কি-যে মায়া-মন্ত্র বোনা।
বাতাস আমারে ঘিরে খেলা করে মোর চারিপাশ,
অনন্তের কত কথা কহে নিতি নীলিমা আকাশ।
চাঁদের মধুর হাসি, বিশ্বমুখে পুলক চুম্বন,
মিটিমিটি চেয়ে থাকা তারকার করুণ নয়ন,
বসন্ত নিদাঘ-শোভা, বিকশিত কুসুমের হাসি,
দিকে দিকে শুধু গান, শুধু প্রেম-ভালবাসাবাসি।
সারমর্ম: প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পৃথিবীকে অপরূপ করেছে। প্রকৃতি মানুষের মনকে পুলকিত করে; আবার প্রকৃতির প্রেমে মানুষের মন বাঁধা পড়ে। এই মায়া ত্যাগ করে কেউই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিতে চায় না।
৮
ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,
ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।
রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে
আজকে যে যা বলে বলুক তোরে,
সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ ক'রে
পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা।
আয় দুরন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।
সারমর্ম: নবীনের কর্মচঞ্চলতায় পৃথিবী নতুন রূপে সাজে। যারা পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে রাখে, তারা নতুন পরিবর্তনকে ভয় পায়। তারুণ্যের প্রাণশক্তিতে সবাইকে উজ্জীবিত হতে হবে।
৯
দৈন্য যদি আসে, আসুক, লজ্জা কিবা তাহে?
মাথা উঁচু রাখিস।
সুখের সাথী মুখের পানে যদি নাহি চাহে,
ধৈর্য ধরে থাকিস।
রুদ্ররূপে তীব্র দুঃখ যদি আসে নেমে,
বুক ফুলিয়ে দাঁড়াস,
আকাশ যদি বজ্র নিয়ে মাথায় পড়ে ভেঙে,
ঊর্ধ্বে দু'হাত বাড়াস।
সারমর্ম: বিপদ ও দুঃখে কাতর হলে চলবে না। ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জীবনের কঠিন পথ অতিক্রম করতে হয়। সংগ্রাম ছাড়া জীবনে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব নয়।
১০
তুমি আসবে ব'লে, হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর।
তুমি আসবে ব'লে হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মতো চিৎকার করতে করতে,
তুমি আসবে ব'লে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।
তুমি আসবে ব'লে ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।
তুমি আসবে ব'লে বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভুর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর।
তুমি আসবে ব'লে হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।
সারমর্ম: অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। শত্রুবাহিনীর চরম আক্রোশ ও নির্মমতার শিকার হয়েছে নারী, শিশুসহ আপামর জনসাধারণ। লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীনতাকে কোনো মূল্য দিয়ে মাপা যায় না।
আরও দেখুন...