প্রিয় শিক্ষার্থী! পূর্বের শ্রেণিতে তুমি সালাত সম্পর্কে বেশ কিছু বিষয় শিখেছ। আগের শ্রেণির আলোচনার ধারাবাহিকতায় এ শ্রেণিতে পর্যায়ক্রমে তুমি সালাতের তাৎপর্য, উপকারিতা, ফজিলত, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, সালাতের ইমামতি, আযান ও ইকামত সম্পর্কে শিখবে ও প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করবে। এ ছাড়া তুমি সালাতুল বিতর, সালাতুল জুম'আ, সালাতুল জানাযা, সালাতুল ‘ঈদাইন, সালাতুত তারাবিহ, মাসবুক ব্যক্তির সালাত, রুগ্ণ ব্যক্তির সালাত, মুসাফিরের সালাত, সালাতের নিষিদ্ধ সময়, সাহু সিজদা সালাত সংশ্লিষ্ট তাসবিহ ও দোয়াসমূহের তাৎপর্য ও মর্ম বাণী, আদর্শ জীবন গঠনে সালাতের ভূমিকা, সালাত আদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় কয়েকটি নির্বাচিত সূরা ইত্যাদি সম্পর্কে শিখবে ও যোগ্যতা অর্জন করবে। তাহলে এবার মূল আলোচনা শুরু করা যাক।
সালাতের তাৎপর্য
ইমানের পর ইসলামের দ্বিতীয় ভিত্তি বা রুকন হলো সালাত। আল্লাহ তা'আলা আমাদের উপর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করে দিয়েছেন। মুমিনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বড় ফরয ইবাদাত হলো, সময়মতো পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা। পবিত্র কুরআন এবং হাদিসে সালাতকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় নির্ধারিত সময়ে সালাত আদায় করা মুমিনদের ওপর ফরয। (সূরা নিসা, আয়াত: ১০৩) কুরআন মাজিদে প্রায় ৮২ স্থানে আল্লাহ তা'আলা সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন- ‘আপনি আপনার পরিবারের লোকদেরকে সালাতের আদেশ দিন এবং এর ওপর অবিচল থাকুন।' (সূরা: ত্বাহা, আয়াত: ১৩২)
সালাতের ক্ষেত্রে আমরা সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করব। নির্ধারিত সময়ে সালাত আদায়ে সচেষ্ট হবো। মহান আল্লাহ সফল মুমিন ও জান্নাতুল ফিরদাউসের বাসিন্দাদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বলেন, ‘আর যারা নিজেদের সালাতের ব্যাপারে যত্নবান থাকে।' (সূরা আল্-মুমিনুন, আয়াত: ৯)
ইচ্ছাকৃতভাবে সালাত আদায় না করা মহা অপরাধ ও বড় গুনাহ। আন্তরিক সদিচ্ছা সত্ত্বেও অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুলে যাওয়া কিংবা ঘুমিয়ে পড়ার কারণে সালাত ছুটে গেলে স্মরণ হওয়ার সাথে সাথে সালাতের কাযা আদায় করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ঘুমের কারণে যার সালাত ছুটে গেছে সে যেন জাগ্রত হওয়ার সাথে সাথে সালাত আদায় করে নেয়।' (মুসলিম)
সালাত বা নামাজ শব্দটির একটি অর্থ হলো ‘সংযোগ’। সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে আমরা নিজেদের সম্পর্ক স্থাপন করি। নানা কারণে মাঝে মাঝে আমরা নিজেদেরকে অসহায় অনুভব করি। নিজেকে নিরুপায় ও একাকী মনে করার কোনো কারণ নেই। মহান আল্লাহ অবশ্যই আমাদের পাশে আছেন। যে কোনো সময় আমরা সালাতে দাঁড়িয়ে, তাঁর সামনে মাথা নত করে বুকের ভেতর জমে থাকা সব দুঃখ, কষ্ট, অপমান, হতাশা উজাড় করে দিতে পারি। তিনি অবশ্যই তা শুনবেন। তিনি সব কিছু শোনেন। আমরাই বরং তাঁর সাথে সংযোগ স্থাপন করি না। আল্লাহর নিকট বান্দার আনুগত্য ও বিনয় প্রকাশের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম হচ্ছে সালাত। সালাতের মাধ্যমেই বান্দা আল্লাহর সবচেয়ে বেশি নৈকট্য লাভ করে। সালাত হচ্ছে মুসলিম ব্যক্তির অন্তরের প্রশান্তি এবং তার সাহায্যকারী। সালাত বিপদ-আপদে আত্মাকে শক্তিশালী করে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন “তোমরা ধৈর্য এবং সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো।' (সূরা আল্-বাকারা, আয়াত: ১৫৩)
সালাতের উপকারিতা
সালাত আল্লাহর বিধান। এই বিধানটি মানুষের কল্যাণের জন্য দেওয়া হয়েছে। সালাত আদায়ের মাধ্যমে মানুষ বিভিন্ন উপকার পেতে পারে। যেমন-
শারীরিক উপকারিতা: সালাত এমন একটি ইবাদাত যার মাধ্যমে শরীর চর্চার অধিকাংশ উপকারিতাই পাওয়া যায়। যথাযথভাবে সালাত আদায়ের মাধ্যমে ফুসফুস, মস্তিষ্ক, মেরুদণ্ড, মাংসগ্রন্থি, ঘাড় ইত্যাদি অঙ্গের রোগের উপকার পাওয়া যায়। স্নায়ুবিক দুর্বলতা ও জোড়ায় ব্যথ্যা সারানোর জন্য চিকিৎসকরা সালাত আদায়ের পরামর্শ দেন। এ কথা সত্য যে, সালাতে সিজদার সময় মস্তিষ্কতন্ত্রী, চোখ ও মাথাসহ অন্যান্য অঙ্গে রক্তপ্রবাহ পরিমিত পর্যায়ে থাকে। ফলে চোখের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় ও মস্তিষ্ক প্রখর হয়। প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আমাদের শরীরকে সচল ও কার্যকর রাখা নিশ্চিত করে। আলস্য বা কর্মবিমুখতা দূর হয়। তবে সালাতের মূল উদ্দেশ্য মহান আল্লাহর প্রতি আত্ম-নিবেদন।
মানসিক উপকারিতা: বর্তমানে মানুষের অশান্তির মূল কারণ হলো মানসিক অস্থিরতা। এই অস্থিরতা দূরীকরণের লক্ষ্যে সারা বিশ্বে গবেষণা হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ধ্যান (Medi- tation) কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। সালাত হলো এক উন্নতমানের ধ্যান (Meditation)। কেউ যদি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে আল্লাহ আমাকে দেখছেন ও আমার সব অবস্থা জানেন, তাহলে তার কোনো প্রকার হতাশা থাকতে পারে না। এ ছাড়া মহানবি (সা.) যখন কোনো পেরেশানিতে ভুগতেন তখন তিনি হযরত বেলাল (রা.)-কে বলতেন ‘হে বেলাল, সালাতের ব্যবস্থা করে (আযান দিয়ে) আমাদের শান্তি দাও।' (আবু দাউদ) বস্তুত মানুষের শরীর ও মন এক অপরের পরিপূরক। সালাত আদায়ের মাধ্যমে মন উৎফুল্ল থাকে।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপকারিতা: মসজিদ হলো মহান আল্লাহ তা'আলার ঘর, যেখানে দৈনিক পাঁচবার সম্মিলিতভাবে সালাত আদায় করা হয়। সেখানে ধনী-গরিব কোনো ভোদাভেদ থাকে না। সকলে স্ব স্ব পদমর্যাদা ভুলে মহান আল্লাহর দরবারে হাজিরা দেয়। একে অপরের খোঁজ-খবর নিয়ে সুখে দুঃখে পাশে দাঁড়ায়। ফলে মুসলিম সমাজের বন্ধন সুদৃঢ় হয়। সালাত আদায়ের মাধ্যমে ইসলামি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। আর নিয়মিত সালাত আদায় করলে সমাজ হতে অপসংস্কৃতি দূর হয়।
সালাতের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য
ইসলাম আমাদের দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা। আর এ দ্বীনের ভিত্তি হলো সালাত। সালাত সকল ইবাদাতের প্রধান। মুমিনের জন্য সালাত মিরাজ স্বরূপ। বস্তুত সালাতের মাহাত্ম্য ও উপকারিতা অশেষ। সালাত আদায়ের মাধ্যমে অগণিত কল্যাণ লাভ করা যায়।
সালাতে রয়েছে দুনিয়া আখিরাতের মহা সফলতা। আল-কুরআনে বিনয় ও নম্রতার সাথে সালাত আদায়কারী মুমিনদের সফলকাম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (সূরা আল-মু'মিন, আয়াত: ১-২)। আবার অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই সাফল্য লাভ করবে যে পবিত্রতা অর্জন করে এবং তার রবের নাম স্মরণ করে ও সালাত কায়েম করে।' (সূরা আল-আ'লা, আয়াত: ১৪-১৫)
সালাত অশ্লীলতা ও অন্যায় থেকে বাঁচার রক্ষাকবজ। কেননা সালাত কায়েমকারী নিজের মাঝে আল্লাহভীতি অনুভব করে যা তাকে সকল অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। মহান আল্লাহ বলেন—
অর্থ: ‘নিশ্চয়ই সালাত অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।' (সূরা আল-‘আনকাবুত, আয়াত: ৪৫)
সালাত আদায়ের মাধ্যমে বান্দা দুনিয়া ও আখিরাতের নিরাপত্তা লাভ করে। যেমন মহানবি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সকালের (ফজরের) সালাত আদায় করল সে আল্লাহর জিম্মায় (নিরাপত্তায়) চলে গেল।' (মুসলিম)
সালাত মুমিনদের জন্য দুনিয়ার জীবনে দৃঢ়তা ও স্থিরতা আনে। মহান আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে অতিশয় অস্থিরচিত্তরূপে। যখন কোনো মন্দ তাকে স্পর্শ করে তখন সে হা-হুতাশ করে। আর যখন কল্যাণ তাকে স্পর্শ করে, সে অতি কৃপণ হয়। তবে সালাত আদায়কারীগণ ব্যতীত। যারা তাদের সালাতে সদা প্রতিষ্ঠিত।' (সূরা আল-মা'আরিজ, আয়াত: ১৯-২৩)
সালাতের মধ্যে রিজিকের প্রশস্ততা রয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন, ‘এবং আপনার পরিবারবর্গকে সালাতের আদেশ দিন আর তাতে অবিচল থাকুন, আমি আপনার নিকট কোনো রিযিক চাই না, আমিই আপনাকে রিযিক প্রদান করি এবং শুভ পরিণাম তো মুত্তাকীদের জন্য।' (সূরা ত্বা হা, আয়াত: ১৩২) ইবনে কাসীর (রহ.) এ আয়াতের তাফসীরে বলেন, যদি সালাত প্রতিষ্ঠা করো তাহলে এমনভাবে তোমার নিকট রিযিক আসবে, যার ধারণাও তুমি করতে পারবে না।
সালাত হলো উত্তম যিকির। কারণ, সালাতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এর সম্পূর্ণটাই আল্লাহর যিকির। মহান আল্লাহ তাঁর যিকিরের জন্য সালাত প্রতিষ্ঠার আদেশ দিয়েছেন। এর মাধ্যমে আত্মিক ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করা যায়। আল্লাহ তা'আলা বলেন—
অর্থ: ‘জেনে রাখো! আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্তি লাভ করে।' (সূরা আর-রা‘দ, আয়াত : ২৮) মহান আল্লাহ বলেন, আমার স্মরণের লক্ষ্যে সালাত কায়েম কর (সূরা ত্বাহা, আয়াত : ১৪)
হাদিসে এসেছে মহানবি (সা.) বিলাল (রা.) কে বলেন, ‘উঠো বিলাল এবং আমাদেরকে সালাতের মাধ্যমে প্রশান্তি পৌঁছাও।' (মুসনাদে আহমদ)
সালাত সর্বোত্তম আমল। আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) মহানবি (সা.) কে জিজ্ঞাসা করেন: সর্বোত্তম আমল কোনটি? তিনি বলেন, ‘সময়মতো সালাত আদায় করা।' (বুখারি ও মুসলিম)
সালাত হিফাযত বা সংরক্ষণকারীর জন্য আল্লাহর প্রতিশ্রুতি হলো যে, তিনি তাকে জান্নাত দান করবেন। মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ বান্দার ওপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন, যে তা হিফাযত করল তার জন্য আল্লাহর প্রতিশ্রুতি হলো যে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।' (আবু দাউদ অন্য হাদিসে মহানবি (সা.) বলেন, ‘যে সালাতের হিফাযত করল, সালাত তার জন্য জ্যোতি, প্রমাণ ও কিয়ামতের দিন মুক্তির কারণ হবে।' (মুসনাদে আহমদ)
সালাত আদায়ের মধ্য দিয়ে আল্লাহর ভালোবাসা অর্জন করা যায়। ইহা বান্দা ও তার প্রতিপালকের মধ্যে সম্পর্ক গড়ার মাধ্যম। মহান আল্লাহ বলেন— ‘আর সিজদাহ কর ও (আমার) নিকটবর্তী হও।' (সূরা আল আলাক, আয়াত: ১৯)
মহানবি (সা.) বলেন, ‘বান্দা স্বীয় রবের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয় সিজদাহ অবস্থায়। অতএব, তোমরা সিজদায় বেশি বেশি দোয়া করো।' (মুসলিম)
সর্বোপরি, সালাতের মাহাত্ম্য ও অপরিসীম। সালাত আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর ভালোবাসা ও নৈকট্য লাভ করা যায়। এর মাধ্যমে সকল প্রকার অশ্লীল ও মন্দকাজ থেকে দূরে থেকে অন্তরের প্রশান্তি লাভ করা যায়। এটি পাপমুক্তির উপায়। এক কথায়, সালাত দুনিয়া ও আখিরাতের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ ও সফলতা লাভের মাধ্যম ।
সালাত আদায়ে একনিষ্ঠতা ও একাগ্রতা
আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের অন্যতম উপায় হচ্ছে একাগ্রতার সাথে সালাত আদায় করা। সালাতের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নিকট তার আবেদন নিবেদন পেশ করে তৃপ্তি লাভ করতে পারে। আর আল্লাহ তা‘আলাও বান্দার আবেদন গ্রহণ করে থাকেন। তাহলে বান্দাকে অবশ্যই বিনয়ের সাথে সালাতে দাঁড়াতে হবে। যেমন: কুরআন মাজিদে আল্লাহ তা'আলা বলেন—
অর্থ: ‘তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে দাঁড়াবে।' (সূরা আল বাকারা, আয়াত: ২৩৮)
নামায অবস্থায় বান্দার মন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে অথচ মুসল্লি টেরও পায় না। কারণ, মানব মন কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করতে অভ্যস্ত। গভীর মনোযোগের সাথে কোনো কাজে নিয়োজিত না হলে মন স্থির থাকে না । তা ছাড়া শয়তান হচ্ছে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। সে বান্দার সকল ইবাদাত বিশেষত সালাত নষ্ট করার জন্য বিভিন্ন বিষয় মনের মধ্যে হাজির করে দেয়। তাই বান্দার মন সালাতে ঠিক থাকে না। এজন্যই বান্দাকে খুশু খুযু (বিনয় ও একাগ্রতা) ও মনের স্থিরতার সাথে সালাত আদায় করতে হবে। যেমন: পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন—
অর্থ: ‘মুমিনগণ অবশ্যই সফলকাম হয়েছে, যারা নিজেদের সালাতে বিনয়ী।' (সূরা আল-মু'মিনুন, আয়াত : ১,২)
পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের রাকাআতসমূহ
ফজর: ফজরের সালাত মোট ৪ রাকাআত। এর মধ্যে ২ রাকাআত সুন্নত এবং ২ রাকাআত ফরয। প্রথমে সুন্নত আদায় করতে হয় এবং তারপরে ফরয আদায় করতে হয়। মনে রাখবে, ফজরের সুন্নত সালাতের গুরুত্ব অন্যান্য ওয়াক্তের সুন্নত সালাতের চেয়ে অনেক বেশি।
যোহর : যোহরের সালাত মোট ১০ রাকাআত। আর এগুলো হলো— ৪ রাকাআত সুন্নত মুয়াক্কাদাহ— যা সাধারণত এ ওয়াক্তের ফরয সালাতের পূর্বে আদায় করতে হয়, তারপর ৪ রাকাআত ফরয সালাত আদায় করতে হয় এবং ফরযের পরে আরো ২ রাকাআত সুন্নত সালাত আদায় করতে হয়।
আসর: আসরের সালাত ৪ রাকাআত-যা ফরয। তবে এ ফরযের পূর্বে ৪ রাকাআত সুন্নত সালাত আদায় করা অনেক সাওয়াবের কাজ। তবে এটি না করলে কোন গুনাহ নেই।
মাগরিব: মাগরিবের সালাত মোট ৫ রাকাআত। এর মধ্যে ৩ রাকাআত ফরয এবং ফরয শেষে অনতিবিলম্বে ২ রাকাআত সুন্নত মুয়াক্কাদাহ সালাত আদায় করতে হয়।
এশা: এশার সালাত মোট ৬ রাকাআত। প্রথমে ৪ রাকাআত ফরয সালাত আদায় করতে হয়। তারপর ২ রাকাআত সুন্নত সালাত আদায় করতে হয়। এশার ফরযের পূর্বেও ৪ রাকাআত সুন্নত সালাত আদায় করা হয়, যা না করলে কোন গুনাহ নেই, করলে সাওয়াব হয়।
এক নজরে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের রাকাআতসমূহ | ||||
---|---|---|---|---|
ওয়াক্ত | সুন্নাত (মুয়াক্কাদাহ) | ফরয | সুন্নাত (মুয়াক্কাদাহ) | ওয়াজিব |
ফজর | ২ রাকাআত | ২ রাকাআত | ||
যোহর | ৪ রাকাআত | ৪ রাকাআত | ২ রাকাআত | |
আসর | ৪ রাকাআত | |||
মাগরিব | ৩ রাকাআত | ২ রাকাআত | ||
এশা | ৪ রাকাআত | ২ রাকাআত | ৩ রাকাআত (বিতর সালাত) | |
মোট ফরয সালাত | = ১৭ রাকাআত |
জামাআতে সালাত আদায়
জামাআত শব্দটি আরবি। এর শাব্দিক অর্থ হলো একত্রিত হওয়া, জনসমাবেশ, সমবেত হওয়া ইত্যাদি। শরিয়তের দৃষ্টিতে নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত স্থানে মুসলিম সম্প্রদায়ের ইমামের পেছনে সমবেত হয়ে সালাত আদায় করাকে জামাআতে সালাত আদায় বলা হয়।
জামাআতে সালাত আদায়ের মাহাত্ম ও গুরুত্ব
ইসলামে জামআত বা সমবেতভাবে সালাত আদায় করার গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বিভিন্নস্থানে জামাআতবদ্ধ হয়ে সালাত আদায়ের প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
অর্থ: ‘তোমরা রুকুকারীদের সাথে রুকু করো।' (সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ৪৩)
এখানে মূলত জামাআতে সালাত আদায় করাকে নির্দেশ করা হয়েছে। আমরা যদি রাসুলে করিম (সা.) এর জীবনের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো তিনি কখনো জামাআত ছাড়েননি। জামাআতে সালাত আদায়ের ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘জামাআতে সালাত আদায়ের মাহাত্ম্য একাকী সালাত আদায়ের চেয়ে ২৭ গুণ বেশি।' (বুখারি ও মুসলিম)
হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তা'আলা সেদিন আরশের নিচে ছায়া প্রদান করবেন, যেদিন আল্লাহর ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া থাকবে না। তাদের মধ্যে একজন হলো ঐ ব্যক্তি যার আত্মা মসজিদের সাথে লাগানো সম্পৃক্ত থাকে। অর্থাৎ সালাত ও জামাআতের প্রতি অধীর আগ্রহী ব্যক্তি।' (বুখারি ও মুসলিম) বিশিষ্ট মুসলিম মনীষী সাঈদ ইবনে মুসায়্যিব (রহ.) পঞ্চাশ বছর সময় ধরে ফরয সালাতে কোন মানুষের ঘাড় দেখেননি। অর্থাৎ তিনি প্রথম কাতারে শামিল ছিলেন। আর ইবনে সামাআহ (রহ.) বলেন, চল্লিশ বছর পর্যন্ত আমার তাকবিরে উলা তথা প্রথম তাকবির ছোটেনি। শুধুমাত্র সে দিন ছাড়া যে দিন আমার মায়ের ইন্তেকাল হয়েছিল। অতএব কখনো কেউ মসজিদে জামাআতে শরিক হতে অপারগ হলে একাকী সালাত আদায় না করে বাসায় পরিবার পরিজনকে সাথে নিয়ে সালাত আদায় করা উত্তম।
জামাআতে সালাত আদায় করার ফলে মুসল্লিদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব, মহব্বত, ঐক্য ও সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়। তাই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও অধিক সাওয়াব পাওয়ার আশায় প্রত্যেক মুমিন বান্দার জামাআতে সালাত আদায় করা একান্ত প্রয়োজন।
ইমাম
ইমাম শব্দের অর্থ নেতা। ইমাম সালাত পরিচালনা করেন। জামাআতে সালাত আদায়ের সময় মুসল্লিগণ যাকে অনুসরণ করে সালাত আদায় করে তিনিই ইমাম। ইমামতি করা দ্বীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ যা স্বয়ং নবি করিম (সা.) সারা জীবন করে গেছেন। অতঃপর তাঁর মৃত্যুর পর চার খলীফা তা সম্পাদন করেছেন। মুসলিম সমাজের উত্তম ব্যক্তিরাই সাধারণত এই পবিত্র দায়িত্বটি পালন করে থাকেন। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা ইসলামের দ্বিতীয় রোকন। মহান আল্লাহ জামাআতবদ্ধভাবে সালাত আদায় করার আদেশ করেছেন। আর সেই আদেশ ইমাম ব্যতীত বাস্তবায়িত হয় না। মহানবি (সা.)-এর আমলেও প্রত্যেক এলাকায় মসজিদে বা সাময়িক কোনো স্থানে একজন ইমামের নেতৃত্বে সালাত আদায় হতো। উপস্থিত মুসল্লিদের মধ্যে সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তির ইমামতি করাই নিয়ম। তবে সময় মতো উপযুক্ত ইমাম পাওয়া যায় না বলে এখন মসজিদে সুনির্দিষ্ট ইমাম নিয়োগ করা হয়ে থাকে।
ইমামের দায়িত্ব ও কর্তব্য
ইমামতি সাধারণ কোনো পেশা নয়। এর রয়েছে অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য। সেবার মানসিকতা নিয়েই এ পেশায় আত্মনিয়োগ করা উচিত। একজন ইমাম শুধু মসজিদের ইমাম নন, তিনি সমাজেরও ইমাম। তিনি মানুষ, মনুষ্যত্ব ও সমাজ নিয়ে ভাবেন।
ইমামের মূল দায়িত্ব হলো, সালাতে নেতৃত্ব দেওয়া। নামাজের যাবতীয় দিক খেয়াল রাখা একজন ইমামের জন্য অবশ্য কর্তব্য। সালাতে কাতার ঠিক করা। সালাত যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “তোমাদের কেউ লোকদের ইমামতি করলে সে যেন সালাত সংক্ষেপ করে। কেননা তাদের মধ্যে ছোট বালক, দুর্বল ও অসুস্থ লোক থাকতে পারে।' (বুখারি)
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন, “তোমরা তোমাদের মধ্যকার উত্তম ব্যক্তিকে তোমাদের ইমাম নিয়োগ করবে। কারণ তিনি হবেন তোমাদের পক্ষে তোমাদের প্রতিপালকের প্রতিনিধি।' (দারাকুতনি) ইমামকে হতে হবে সকলের আস্থাভাজন। মুসল্লিদের সালাত শুদ্ধ হচ্ছে কি না তিনি তা খেয়াল রাখবেন। যারা সালাত পালন করে না, তাদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে মসজিদে আনার ব্যবস্থা করবেন। ইমামের সংস্রবে থেকে মুসল্লিরা ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য, সহমর্মিতা ও অন্যান্য নৈতিক গুণ অর্জন করবে।
মুক্তাদি
যারা ইমামের পেছনে দাঁড়িয়ে তাঁকে অনুসরণ করে সালাত আদায় করে তারাই মুক্তাদি। মুক্তাদি ইমামের পেছনে ইকতিদা করবে। মনে মনে এই নিয়ত করবে যে, ‘আমি এই ইমামের পেছনে সালাত আদায় করছি।' সালাতের যাবতীয় কাজে মুক্তাদি ইমামের অনুসরণ করবে।
মুক্তাদির কর্তব্য
ইকামত হওয়ার সাথে সাথে সালাতে দাঁড়িয়ে যাবে। ফরয সালাতের ইকামত হলে সুন্নাত পড়বে না। নিজ দায়িত্বে কাতার সোজা করবে। সামনের কাতারগুলো আগে পূরণ করবে। কাতারের মধ্যকার ফাঁকা জায়গা না রেখে একে-অপরের সাথে মিলিয়ে দাঁড়াবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি কাতারে মিলিয়ে দাঁড়ায়, আল্লাহ তার সাথে সম্পর্ক রাখেন। আর যে মিলিয়ে দাঁড়ায় না আল্লাহ তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।' (আবু দাউদ) দুই কাতারের মাঝে ব্যবধান বেশি রাখবে না। সামনের কাতারে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে। পরে এসে মানুষ ডিঙিয়ে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করবে না। ইমামের পেছনে দাঁড়াবে ও তাঁকে অনুসরণ করবে। রুকু, সিজদা, বসা বা উঠা কোনোটাই ইমামের আগে আগে করবে না। সব কাজ ইমামের অব্যবহিত পরে করবে। যদি ইমাম ভুল করেন, তবে নিকটবর্তী মুক্তাদি সংশোধন করে দেবেন। এক্ষেত্রে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে ইমামকে সতর্ক করবেন অথবা ভুল আয়াত শুদ্ধভাবে পড়ে তাকে সাহায্য করবেন।
আরও দেখুন...