এই পাঠ ও অনুশীলন শেষে আমরা- সঠিক, নিরাপদ ও কার্যকর উপায়ে পরিবারের শিশু, বয়স্ক বা অসুস্থ ব্যক্তি ও প্রতিবন্ধী সদস্যকে সেবা প্রদান করতে পারব। |
একটি জেলা-শহরে তুষারদের পরিবারের বসবাস। বাড়িতে তুষারের বড় এক বোন এবং দুই বছর বয়সের ছোট একটি ভাই। ওর বাবা সদর উপজেলার একটি অফিসে চাকুরি করেন এবং মা একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। বাবা-মা দুজনই চাকরি করেন এবং দাদি প্রায়ই অসুস্থ থাকেন তাই তার ছোট ভাইটির দেখাশোনা করাসহ পরিবারের দৈনন্দিন কাজকর্ম নিয়ে একটু সমস্যা থেকেই যায়। কয়েক দিন আগের ঘটনা। বাথরুমে ওজু করতে গিয়ে তুষারের দাদি হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যান। এ অবস্থায় দাদিকে হাসপাতালে ভর্তি করে কয়েকদিন চিকিৎসা করাতে হয়। সেখানে থাকাকালে নার্স এবং অন্যান্য স্টাফরা দাদির সেবাযত্ন করেন। তুষার রোজ একবার করে হাসপাতালে আসতো; আর দাদির সেবা যত্নের বিষয়টি মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করতো। দাদিকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসার সময় কীভাবে দাদির নিয়মিত পরিচর্যা করতে হবে, তা হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্স পরিবারের উপস্থিত সবাইকে বুঝিয়ে বলেন। মাসিক বেতনের বিনিময়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় গিয়ে নিয়মিত সেবা প্রদানকারী পাওয়া যায় কি না তা তুষারের বাবা চিকিৎসকের কাছে জানতে চান। চিকিৎসক বললেন, 'সেই সুযোগ আছে, আপনারা চাইলে আমরা ব্যবস্থা করতে পারি।
পরের দিন হাসপাতাল থেকে শাহীনা নামে একজন সেবা প্রদানকারী এলেন এবং দাদির পরিচর্যা করা শুরু করলেন। তুষার প্রশ্ন করলো, 'আমি কি এই কাজ করতে পারি? যারা এই সেবা প্রদানের কাজ করেন তাঁদের আমরা কী নামে ডাকি? তিনি খুশি হয়ে বললেন, “অবশ্যই পারো। এই কাজকে বলে সেবা প্রদান করা বা কেয়ার গিভিং (Care Giving) এবং যারা আমার মতো এই কাজ করেন, তাদেরকে সেবা প্রদানকারী বা কেয়ার গিভার (Care Giver) বলা হয়'।
তুষার বলল, 'আমি কাজটি ভালোভাবে শিখতে চাই। আপনি কি আমাকে শেখাবেন?” তিনি বললেন, 'অবশ্যই! তবে মনে রেখো, অনেক রকমের কেয়ার গিভিং আছে ; আমার প্রতিদিনের কাজ থেকে তুমি শুধু ব্যক্তি পর্যায়ের কেয়ার গিভিং শিখতে পারবে এবং তা অনুশীলনের সুযোগ পাবে।' তাঁর কথা শুনে তুষার বেশ খুশি হয়ে উঠল।
এরপর থেকে তিনি প্রতিদিনই কাজের ফাঁকে ফাঁকে কেয়ার গিভিং সম্পর্কে তুষারকে প্রশিক্ষণ দিতে লাগলেন। বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কেয়ার গিভার যেভাবে তুষারকে দক্ষ করে তুললেন, আমরা এখন সেগুলো এক এক করে শিখব।
মানবসেবা মহৎ ধর্ম। আমাদের পরিবারে শিশু, বয়স্ক সদস্য বা শারীরিক ও মানসিকভাবে অক্ষম (স্থায়ী বা অস্থায়ী) কেউ যখন স্বাভাবিক রুটিন কাজগুলো করতে পারে না, তখন তাদের প্রিয়জনদের সেবার ওপর নির্ভর করতে হয়। তাদের পরিচর্যা বা যত্ন নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এমনকি হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে চিকিৎসা গ্রহণ করার পরেও প্রিয়জনদের দ্বারা তাদের যত্ন প্রদান অব্যাহত রাখতে হয়। এই যত্ন বা সেবা প্রদান কার্যক্রম দীর্ঘমেয়াদিও হতে পারে।
কেয়ার গিভিং হলো একটি সেবামূলক কার্যক্রম। বৃহত্তর অর্থে কোনো ব্যক্তি বা প্রাণির সঠিক ও কার্যকর উপায়ে যত্ন বা সেবা প্রদান করার যে কৌশল বা কার্যক্রম তাই হলো- কেয়ার গিভিং। আর যিনি সেবা প্রদান করেন বা এই দায়িত্বপালন করেন তাকে কেয়ার গিভার বলা হয়। এই দায়িত্ব যে কেউ নিতে পারেন; যেমন- পিতামাতা, শিক্ষক, প্রাথমিক যত্নের শিক্ষাবিদ, শিশু যত্ন প্রদানকারী, আয়া, ঠাকুরমা, পারিবারিক বন্ধু, কোচ কিংবা আমরাও।
আমাদের দেশের সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৬০ সালে বাংলাদেশের গড় আয়ুষ্কাল ছিল ৪৫ বছর অর্থাৎ গড়ে মানুষ ৪৫ বছর বেঁচে থাকতো। বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৭৩ বছর হয়েছে। এতে বোঝা যায়, আমাদের দেশে বয়স্ক ব্যক্তির সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো বাড়বে। বয়স্ক ব্যক্তিদের দেখাশোনার জন্য বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যেখানে গড় আয়ুষ্কাল অনেক বেশি, সেসব দেশে অনেক কেয়ার গিভারের প্রয়োজন হয় এবং কেয়ার গিভার সেখানে একটি সম্মানজনক পেশা। আমাদের দেশেও অদুর ভবিষ্যতে অনেক কেয়ার গিভার প্রয়োজন হবে। আবার প্রতিটি পরিবারে বয়স্ক ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে নিজেদেরও কেয়ার গিভারের কাজ শিখে নিতে হবে, পরিবারের প্রিয় মানুষদের সেবাযত্ন করার জন্য।
একজন কেয়ার গিভার যে কাজগুলো করেন, তাকে প্রধানত দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
ব্যক্তিগত পরিচর্যায় সহায়তা করা | বিছানা প্রস্তুত করা, বিছানা থেকে তোলা বা উঠানো, দাঁত মাজানো, বাথরুমে নিয়ে যাওয়া, হাত ধোয়ানো, তেল-লোশন/ঔষধ মাখানো/মালিশ করা, শরীর ম্যাসাজ করা ও চুল আঁচড়ানো, হাত ও পায়ের নখ কাটা ইত্যাদি। |
---|
সাধারণ স্বাস্থ্য পরিচর্যা করা | চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন, জ্বর পরিমাপ (সাধারণ থার্মোমিটার ও ডিজিটাল থার্মোমিটার), ডায়াবেটিস ও প্রেসার মাপা ইত্যাদি |
---|
কেয়ার গিভিং-এর তিনটি ক্ষেত্র। এগুলো হলো-
ক. ব্যক্তিগত পরিচর্যা
খ. স্বাস্থ্য পরিচর্যা
গ. সামাজিক পরিচর্যা
কেয়ার গিভার শাহীনা বললেন, 'এতক্ষণ আমরা কেয়ার গিভিং এর ক্ষেত্রভিত্তিক পরিচর্যার সঙ্গে পরিচিত হলাম। এবার পরিচিত হব ব্যক্তিগত পরিচর্যার সঙ্গে। ব্যক্তির (নিজের ও অন্যের) প্রাত্যহিক জীবনের প্রয়োজনীয় কাজসমূহ সম্পাদনে সহযোগিতা বা সেবা প্রদান করাই হলো ব্যক্তিগত পরিচর্যা। যেমন-
চলো কীভাবে বিছানা তৈরি করতে হয় শিখি
• প্রথমে শোয়া অবস্থান থেকে ব্যক্তিকে উঠিয়ে বসাতে হবে
• এরপর ধীরে ধীরে তাকে বিছানার এক পাশে নিয়ে যেতে হবে
• বিছানা থেকে তার পা আস্তে করে নামিয়ে নিচে দুলিয়ে ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে
• এরপর তার কাঁধ এবং নিতম্ব ধরে উপরে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে
• আনুমানিক ৪৫ ডিগ্রি কোণ করে দাঁত মাড়ির সংযোগস্থলে ব্রাশ রেখে দাঁত মাজতে হবে।
• সামনে পেছনে ব্রাশ না করে ওপর থেকে নিচে এবং নিচ থেকে ওপরে ব্রাশ করতে হয়।
• সকালে খাবারের পরে এবং রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ব্রাশ করার অভ্যাস করাতে হবে।
• তাড়াহুড়া না করে সময় নিয়ে দুই থেকে তিন মিনিট ধরে ব্রাশ করাতে হবে।
• দীর্ঘদিন একই ব্রাশ ব্যবহার না করে, কয়েক মাস অন্তর ব্রাশ বদল করে দিতে হবে।
• চকলেট কিংবা মিষ্টিজাতীয় খাবার খাওয়ার পরে দাঁত ব্রাশ করিয়ে দিতে হবে।
(প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র একটি টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, ফ্লস)
• সামনের দাঁতগুলো আগে ব্রাশ করতে হবে। (উপরে-নিচে)
• অভ্যন্তরীণ পৃষ্ঠগুলো পরিষ্কার করতে হবে।
• জিহ্বা পরিষ্কার করতে হবে
• পানি দিয়ে কুলকুচি করে ধুয়ে ফেলতে হবে।
• এভাবে ২/৩ বার পুনরাবৃত্তি করতে হবে।
সতর্কতা বা যা করা উচিত নয়।
হালকা করে ব্রাশ করতে হবে, অতিরিক্ত জোরে ব্রাশ করলে দাঁতের এনামেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রবীণদের টয়লেটে যাওয়া ও আসার জন্য সাহায্যের প্রয়োজন হয়। এমনকি বয়স্ক বা প্রাপ্তবয়স্করা বেশ স্বাধীন হলেও, বাথরুমে যাওয়ার সময় তাদের একটু সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে। তাড়াহুড়ো করে বাথরুমে যাওয়ার সময় বা রক্তচাপের পরিবর্তনের কারণে টয়লেট থেকে বসে বা দাঁড়ানোর সময় বয়স্কদের ক্ষেত্রে পড়ে যাওয়া বা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
কাজেই এক্ষেত্রে তাঁর চলাফেরার দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে ব্যবহারকারীর উপযোগী করে তোলার জন্য টয়লেটে স্টান্ড এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বাথরুম বা টয়লেটের মেঝে যেন শুকনা থাকে সেটা লক্ষ্য রাখতে হবে অর্থাৎ কোনোভাবেই পিচ্ছিল যেন না থাকে।
হাত ধোয়ার নিয়মকানুন
• হাত পানি দিয়ে ভিজিয়ে নিতে হবে।
• হাত এবং কবজির সমস্ত পৃষ্ঠে সাবান মাখিয়ে নিতে হবে।
• দুই হাত একসাথে দ্রুত এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ঘষে নিতে হবে।
• হাত, আঙ্গুলের ডগা, নখ এবং কবজির সমস্ত পৃষ্ঠতল ঘষা নিশ্চিত করতে হবে। কমপক্ষে ২০ সেকেন্ডের জন্য হাত এবং কবজি ঘষতে হবে।
• এরপর হাত এবং কবজি পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
• একটি পরিষ্কার তোয়ালে দিয়ে হাত এবং কবজি মুছে দিতে হবে বা বাতাসে শুকিয়ে নিতে হবে।
* সতর্কতা বা যা করা উচিত নয়
পানির ট্যাপ বা কল বন্ধ করতে একটি তোয়ালে বা টিস্যু ব্যবহার করতে হবে।
হাতে যেন সাবান থেকে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
শরীরের বাহ্যিক অংশগুলো যেমন- চুল সুন্দর করে পরিপাটি করে রাখা, হাত ও পায়ে লোশন/তেল ব্যবহার করা, মুখে ক্রিম মাখানো, নখ সাজানো ইত্যাদি কাজগুলো করার ক্ষেত্রে রোগী বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সহায়তা করার প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে-
• গোসল বা হাত-মুখ ধোয়ার পরপরই শরীর বা হাতে পায়ে তেল বা লোশন মাখাতে হবে; মুখে ক্রিম দিয়ে দিতে হবে।
• চুল শুকানোর পর তেল দিতে হবে, ভেজা অবস্থায় দেওয়া যাবে না।
• আলতোভাবে ম্যাসাজ করে মাখতে হবে যাতে রোগী ব্যাথা না পান।
• লম্বা চুল হলে চুল আঁচড়ানোর সময় আগে হাত দিয়ে ভালোভাবে জট খুলে নিতে হবে।
নখের সাজসজ্জা একটি সহজ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ স্বযত্ন । নখ ছোট করে রাখলে শুধু সুন্দরই দেখায় না, এতে ময়লা এবং ব্যাকটেরিয়া থাকার আসঙ্কা কম থাকে, নখ বড় থাকলে সংক্রমণের কারণ হতে পারে।
চলো কীভাবে হাত-পায়ের নখ কাটতে হয় শিখি
• প্রথমে পানি দিয়ে নখ নরম করে নিতে হবে
• সঠিক সরঞ্জাম (নেল কাটার/ ব্লেড) সংগ্রহ করে নিতে হবে
• দু'হাতের আঙ্গুলের নখ ছাঁটাই করে নিতে হবে
• দু'পায়ের আঙ্গুলের নখ ছাঁটাই করে নিতে হবে
• নখের অমসৃণ বা রুক্ষ প্রান্ত নেল কাটারের সাহায্যে ঘষে মসৃণ করে নিতে হবে
• নখ নমনীয় রাখতে ছাঁটাই করার পরে ময়েশ্চারাইজ করার জন্য একটু লোশন লাগিয়ে দিতে হবে।
দলগত কাজ দলে ভাগ হয়ে উপরের কাজগুলো ড্যামি দিয়ে (প্রয়োজন হলে) শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের সহায়তা নিয়ে ভূমিকাভিনয় করে দেখাও। সকল দলকেই অভিনয় করে দেখাতে হবে। একেক দল একেকটি কাজ অভিনয় করে দেখাও। কারও পদ্ধতি সঠিক না হলে অন্যরা পরামর্শ দিয়ে তাদেরকে অনুশীলন করাও। |
একক কাজ উপরের কাজগুলো বাড়িতে অনুশীলন করো। বাড়িতে নিজের পরিবারের কারো (হতে পারে দাদা/দাদি, নানা/নানী, মা/বাবা, ছোট/বড় ভাই/বোন, কিংবা অসুস্থ যে কেউ, যিনি পরিবারের সাথেই থাকেন) সাহায্য প্রয়োজন হলে অবশ্যই চাহিদা অনুযায়ী সেবা দিবে। তাদের জন্য কাজগুলো করে বার বার অনুশীলনের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করার চেষ্টা করো। কোন কাজটি কতবার করেছ তার হিসেব রাখো। একমাস পর শিক্ষকের নির্দেশনা অনুযায়ী ছকটি পূরণ করে তাঁকে দেখাও। |
ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য পরিচর্যার কোন কোন বিষয়ে আমরা কতটুকু পারদর্শিতা অর্জন করেছি তা যাচাই করি
ছক ৮.১ : স্বাস্থ্য পরিচর্যার অনুশীলন
কাজ | কতবার অনুশীলন করেছি | কী কী সমস্যায় পড়েছি | কীভাবে সমাধান করা যায় (আমার অনুভুতি) | অভিব্যক্তি (আইকন) |
---|---|---|---|---|
বিছানা করতে সহায়তা করেছি। | ||||
বিছানা থেকে উঠানো অনুশীলন করেছি | ||||
দাঁত মাজতে সাহায্য করেছি | ||||
বাথরুমে যেতে সাহায্য করেছি | ||||
হাত ধোয়ায় সাহায্য করেছি। | ||||
তেল, লোশন, ক্রিম মাখাতে সাহায্য করেছি | ||||
নখ কাটতে সহায়তা করেছি। | ||||
অভিভাবকথাকে সেবা দিয়েছি তার মতামত | ||||
শিক্ষকের মন্তব্য |
স্বাস্থ্য পরিচর্যা
কেয়ার গিভার শাহীনা তুষারকে ব্যক্তিগত পরিচর্যার বিভিন্ন কলাকৌশল শেখানোর পর বললেন, 'আরও বেশ কিছু ব্যক্তিগত কাজ রয়েছে যেগুলো তুমি আরেকটু বড় হলে শিখতে পারবে। এখন যা যা শিখলে তা তুমি তোমার দাদির সেবায় নিয়মিত কাজে লাগাও'।
এরপর তিনি কেয়ার গিভিং এর স্বাস্থ্যগত পরিচর্যা এবং এর বিভিন্ন ব্যবহারিক দিক সম্পর্কে শেখানোর উদ্যোগ নিলেন। তিনি তুষারকে যা যা শেখালেন আমরাও এখন তা এক এক করে শিখব।
স্বাস্থ্য পরিচর্যার যেসব বিষয় আমরা অনুশীলন করব, সেগুলো হলো-শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সংক্রান্ত বিষয়; যেমন-
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবনে সহায়তা করতে শেখা অর্থাৎ চিকিৎসকের চিকিৎসাপত্র অনুযায়ী সকাল, দুপুর ও রাতের ওষুধ খাওয়াতে সাহায্য করা যেমন- ট্যাবলেট/ ক্যাপসুল/সিরাপের ক্ষেত্রে-
১+১+১ মানে; সকাল, দুপুর ও রাতে ৩ তিন বেলা ১টি করে খাবে।
১+০+১ মানে সকাল ও রাতে ২ দুই বেলা ১টি করে খাবে।
০+০+১ মানে শুধু মাত্র রাতের বেলায় ১টি খাবে।
[বি. দ্র. ০ = খাবে না, ১ = খাবে]
চলো কীভাবে ওষুধ খাওয়াতে হয়, তা শিখি
ধাপ-১ চিকিৎসাপত্র অনুযায়ী বেলাভিত্তিক (সকাল, দুপুর কিংবা বিকাল ও রাত) সঠিক ওষুধ নির্বাচন করে ওষুধ আলাদা করে নিতে হবে।
ধাপ-২ গ্লাস সঠিকভাবে ধরে পানি (প্রয়োজন হলে) ও সঠিক ওষুধ খাওয়াতে সহায়তা করতে হবে।
দেহের তাপমাত্রা (জ্বর) পরিমাপ করা
কপালে হাত দিলেই টের পাওয়া যায় কারও জ্বর আছে কি না। হাতের পেছন দিয়ে কপাল ছুঁয়েও জ্বরের ধারণা মেলে। তবে জ্বর হয়েছে, এটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য থার্মোমিটার দিয়ে মেপে দেখতে হয়। জ্বর পরিমাপের জন্য বিভিন্ন রকম থার্মোমিটার বাজারে প্রচলিত আছে। এছাড়াও আজকাল থার্মাল স্ক্যানার ব্যবহার করেও শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ করা হয়।
চলো কীভাবে জ্বর পরিমাপ করতে হয়, তা শিখি
সাধারণ থার্মোমিটার এর ক্ষেত্রে :
১. প্রথমে থার্মোমিটারটি স্পিরিট বা সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার শুকনা কাপড় বা ন্যাপকিন টিস্যু দিয়ে মুছে নিতে হবে।
২. থার্মোমিটারে পারদের অবস্থান কোথায় আছে তা ভালোভাবে দেখে নিতে হবে।
৩. যদি তা ৯৭ ডিগ্রির ফারেনহাইট এর ওপরে থাকে, তবে জোরে ঝাঁকিয়ে পারদ নিচে নামিয়ে আনতে হবে।
৪. থার্মোমিটারের সরু প্রান্ত শিশুর ক্ষেত্রে যেকোনো বাহুর নিচে (বগলে) রেখে হাত শরীরের সঙ্গে মিশিয়ে দুই মিনিট চেপে ধরে রাখতে দিতে হবে।
৫. বড়দের বেলায় মুখের ভেতর জিহ্বার নিচে রেখে ঠোঁট দিয়ে চেপে রাখতে হয় এক থেকে দুই মিনিট রাখতে হবে।
৬. দুই মিনিট রাখার পর থার্মোমিটারে জ্বরের পরিমাপ বা রিডিং দেখে নিতে হবে। পারদের সূক্ষ্ম কালো রেখা থার্মোমিটারের যে দাগের সাথে মিলেছে সেটাই তার তাপমাত্রা
৭. তারিখ ও সময় ধরে থার্মোমিটারের রিডিং নির্দিষ্ট স্থানে কাগজে লিখে রাখতে হবে। এর জন্য নিচের মতো একটি ছক ব্যবহার করা যেতে পারে।
ছক ৮.২ : শরীরের তাপমাত্রার রেকর্ড
তারিখ | সময় | থার্মোমিটারের রিডিং |
---|---|---|
৮. ব্যবহারের পর থার্মোমিটারটি পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে, পরিষ্কার কাপড় বা টিস্যু দিয়ে মুছে জায়গায় রাখতে হবে।
ডিজিটাল থার্মোমিটার এর ক্ষেত্রে :
১. থার্মোমিটারটি স্পিরিট বা সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে শুকনা কাপড়ে মুছে নিতে হবে (সতর্কতা: ডিজিটাল থার্মোমিটারের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে ভেতরে যেন পানি প্রবেশ না করে)।
২. থার্মোমিটারের সুইচে চাপ দিয়ে চালু করতে হবে।
৩. থার্মোমিটারের সরু প্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে যেকোনো বাহুর নিচে (বগলে) রেখে হাত শরীরের সঙ্গে মিশিয়ে দু-তিন মিনিট চেপে ধরে রাখতে হবে।
৪. বড়দের বেলায় মুখের ভেতর জিহ্বার নিচে রেখে ঠোঁট দিয়ে এক থেকে দুই মিনিট চেপে রাখতে হবে।
৫. ডিজিটাল থার্মোমিটারে মিউজিক বাজলে বের করে নিতে হবে।
৬. এবার তাপমাত্রা কত ভেসে উঠেছে তা। দেখে নিতে হবে।
৭. তারিখ ও সময় ধরে থার্মোমিটারের রিডিং নির্দিষ্ট স্থানে কাগজে লিখে রাখতে হবে। এর জন্য একটি ছক ব্যবহার করা যেতে পারে।
ছক ৮.৩ : শরীরের তাপমাত্রার রেকর্ড
তারিখ | সময় | থার্মোমিটারের রিডিং |
---|---|---|
৮. ব্যবহারের পর পরিষ্কার করে ধুয়ে মুছে রাখতে হবে।
প্রজেক্ট ওয়ার্কবিদ্যালয়ে একটি হেল্থ ক্যাম্পের আয়োজন করো। এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক, শ্রেণির অন্যান্য শিক্ষক, বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষার্থী এবং নিজেদের ক্লাসের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করে একটি সুন্দর পরিকল্পনা করো। হেল্থ ক্যাম্প করার উদ্দেশ্য হলো অন্য শ্রেণির শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের অন্যান্য কর্মচারীদের কেয়ার গিভারের কাজ সম্পর্কে সচেতন করা, এর গুরুত্ব বোঝানো, সকলের কেন কেয়ার গিভারের কাজ শেখা দরকার তা বোঝানো এবং কিছু কৌশল প্রদর্শন করা। হেলথ ক্যাম্প করার পর অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি প্রতিবেদন লেখো। |
পরিকল্পনার সময় যা যা লক্ষ্য রাখবে | |
---|---|
• কবে, কখন করতে চাই • কোথায় করতে চাই • কীভাবে করতে চাই • কীভাবে হেলথ ক্যাম্পের আইটেম সংগ্রহ করা হবে • কী কী সেবা প্রদান করা হবে • স্টলে কী কী সামগ্রী থাকবে | • কীভাবে ক্যাম্প সাজানো হবে • কাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হবে • কী কী স্টল থাকবে • কারা কোন স্টলের দায়িত্বে থাকবে • কে কে প্রতিবেদন লিখবে • শৃংখলা বজায়ের দায়িত্বে কারা থাকবে ইত্যাদি |
সম্ভব হলে পুরো ক্লাস থেকে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ক্লাসের মোট সদস্যকে ৫ টি দলে ভাগ করে নিতে পারো। প্রতিবেদনে কী কী থাকবে তার শিরোনাম বা হেডিং তৈরি করে। প্রতিটি দলকে একেকটি শিরোনামের উপর লিখে আনতে বলা যেতে পারে। এরপর সবার লেখা একত্রিত করে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করা যেতে পারে। অথবা প্রতিটি দল থেকে একটি করে প্রতিবেদন তৈরি করে শিক্ষকের কাছে জমা দিতে পারো। |
শাহীনা তুষারকে বললেন, “একজন ব্যক্তির জন্য শুধুমাত্র শারীরিক পরিচর্যাই সব নয়, তাকে সুস্থ রাখার জন্য অনেক ধরনের মানসিক সহায়তাও প্রয়োজন হয়। সামাজিক বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করে দিতে হয়। যেমন- ব্যক্তির পারিপার্শ্বিক পরিবেশে, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, তাদের সাথে খেলাধুলা করা, খবরের কাগজ ও বই পড়ে শোনানো, টেলিভিশন দেখা, মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অন্যান্য আপনজনদের সাথে যোগাযোগ করতে সহায়তা করা, পার্কে বা কোনো খোলা মাঠে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া, কেনা কাটায় সাহায্য করা ইত্যাদি'।
আজকের এই বিজ্ঞানের উৎকর্ষের যুগে কেয়ার গিভারের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন রোবট আমাদের অনেক কাজ করে দিলেও কেয়ার গিভিং এর জন্য যে মমতা, সহমর্মিতা ও আবেগের প্রয়োজন হয়, রোবটের তা নেই । অর্থাৎ মানবিক ভালোবাসা চাই মানুষের জন্য। তাই কেয়ার গিভিং এর চাহিদা সব দেশেই দ্রুত বেড়ে চলেছে।
আমাদের প্রতিদিনের চলার পথেও অনেক শিশু, বয়স্ক বা অসুস্থ কেউ সামনে পড়তে পারে, তাৎক্ষণিকভাবে যার সাহায্য প্রয়োজন। এমন কোনো মুহূর্ত সামনে এলে আমরা অবশ্যই এগিয়ে যাব এবং সাহায্যের হাতটি বাড়িয়ে দিব। এক মুহূর্তের সাহায্য হয়ত তাকে অনেক বড় কোনো ক্ষতি থেকে বাঁচাতে পারে। আমরা সর সময় মনে রাখব, এই পৃথিবীতে কেউই চিরস্থায়ী সুস্থতা নিয়ে জন্মায় না। যেকোনো সময় যে কারও শারীরিক বা মানসিক সমস্যা তৈরি হতে পারে। আমরা একে অন্যের জন্য মমতা নিয়ে পাশে দাঁড়ালে একদিন অন্যরাও হয়তো আমাদের দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়াবে। তাই চলো, আমরা সবাই মিলে একটি মানবিক পৃথিবী গড়ে তুলি; মমতা ও ভালোবাসা নিয়ে পরিবার ও সমাজের পাশে দাঁড়াই ।
Read more