হযরত ইসমাঈল (আ.) ছিলেন আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মহান পূর্বপুরুষ। তিনি পিতা ইবরাহিম (আ.) এর সাথে পবিত্র কাবাঘর নির্মাণ করেন। প্রিয় শিক্ষার্থী, আজ আমরা ইসমাঈল (আ.)-এর জীবন ও চরিত্র-মাধুর্য সম্পর্কে জানব।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
হযরত ইসমাঈল (আ.) ছিলেন ইবরাহিম (আ.)-এর জ্যেষ্ঠপুত্র এবং মা হাজেরার গর্ভজাত সন্তান। তাঁর জন্মের সময় পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর বয়স ছিল ৮৬ বছর। তিনি সিরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতা বিবি হাজেরা মিসরের কিবতী রাজবংশীয় মহিলা ছিলেন। ইবরাহিম (আ.)-এর বৃদ্ধ বয়সে মহান আল্লাহর নিকট দোয়ার বরকতে আল্লাহ তাঁকে উক্ত পুত্রসন্তান দান করেন। পবিত্র কুরআনে এ বিষয়ে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এক সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান করুন। অতএব আমি তাকে অতিসহনশীল এক পুত্রসন্তানের সুসংবাদ দিলাম।' (সূরা আস-সাফফাত, আয়াত: ১০০-১০১)
নির্বাসন ও জমজম কূপ সৃষ্টি
হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর জন্মের কিছুদিন পর ইবরাহিম (আ.) মহান আল্লাহর নির্দেশে তাঁকে ও তাঁর মাকে মক্কার ফারান পর্বতের উপত্যকায় বিজন ভূমিতে একটি বড় গাছের নিচে রেখে আসেন। বস্তুত এটি ছিল মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বড় পরীক্ষা। তিনি তাঁদের খাবারের জন্য এক থলে খেজুর ও এক মশক পানি দিয়ে আসেন এবং তাদের খাদ্য-পানীয় ও হেফাজতের জন্য মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেন।
বিবি হাজেরা তাঁর সন্তানকে বুকের দুধ পান করিয়ে লালন-পালন করতে থাকেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যে তাঁদের পানি ও খাবার ফুরিয়ে যায়। দুগ্ধপোষ্য শিশু ইসমাঈল পানির পিপাসায় ছটফট করতে থাকেন। তিনি শিশুর কান্না সহ্য করতে না পেরে পানি ও খাবারের সন্ধানে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে ছোটাছুটি করতে থাকেন। এ পাহাড়দ্বয়ে সাতবার ছোটাছুটির পরেও কোথাও পানি কিংবা খাবার পেলেন না। অবশেষে ইসমাঈলের কাছে ফিরে এসে দেখতে পান যে, আল্লাহর অসীম কুদরতে শিশু ইসমাঈলের পায়ের আঘাতে সে স্থানে পানির স্রোতধারা প্রবাহিত হচ্ছে। এটাই হলো জমজম কূপের উৎস। হযরত হাজেরা (আ.) ঐ কূপ থেকে নিজে এবং তার শিশুপুত্র ইসমাঈলকে পানি পান করান। তিনি মশক ভরে পানি রাখলেন এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন।
কুরবানি
ইসমাঈল (আ.) যখন ১৩ কিংবা ১৪ বছরের যুবক, তখন হযরত ইবরাহিম (আ.) স্বপ্নযোগে পুত্র ইসমাঈল (আ.) কে কুরবানির জন্য আদিষ্ট হন। নিঃসন্দেহে এটি ছিল মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি কঠিন পরীক্ষা। স্বপ্ন থেকে জাগ্রত হয়ে ইবরাহিম (আ.) পুত্রকে বললেন, “হে আমার সন্তান! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে কুরবানি করছি। এ ব্যাপারে তোমার মতামত কী? তখন তিনি বললেন, হে আমার পিতা! আপনি যা করতে আদিষ্ট হয়েছেন, তা-ই করুন। ইনশাআল্লাহ আমাকে আপনি ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত দেখতে পাবেন।' (সূরা আস সাফফাত, আয়াত: ১০২)
হযরত ইবরাহিম (আ.) মিনা প্রান্তরে প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাঈলকে কুরবানি করতে শুরু করলেন। এমন সময় তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে আওয়াজ শুনতে পেলেন, ‘হে ইবরাহিম! তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি।' (সূরা আস সাফফাত, আয়াত: ১০৫)। আল্লাহর ইচ্ছায় পুত্র ইসমাঈল (আ.) এর স্থলে একটি সাদা দুম্বা কুরবানি হয়ে গেল আর ইসমাঈল (আ.) দুম্বার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। আল্লাহ তা‘আলা এ ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি ইসমাঈলকে এক মহান যবেহের বিনিময়ে মুক্ত করলাম এবং একে আমি পরবর্তী লোকদের মধ্যে স্মরণীয় করে রাখার ব্যবস্থা করলাম।' (সূরা আস সাফফাত, আয়াত: ১০৭-১০৮) এ স্মৃতির সম্মানার্থে কুরবানি করা উম্মতে মোহাম্মাদির উপর ওয়াজিব।
কাবাগৃহ নিৰ্মাণ
কাবাঘর সর্বপ্রথম ফেরেশতাগণ এবং পরে হযরত আদম (আ.) পুনর্নির্মাণ করেন। পরবর্তী সময়ে হযরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর হুকুমে হযরত ইসমাঈল (আ.) এর সহযোগিতায় কাবা ঘর পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। কাবা ঘর নির্মাণের পর তাঁরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেন, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের এ প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমকে কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি সবকিছু শোনেন এবং জানেন।' (সূরা আল বাকরা, আয়াত: ১২৭)।
ইসমাঈল (আ.)-এর গুণাবলি ও মহত্ত্ব
কুরআন মাজিদে ইসমাঈল (আ.)-এর সততা, ধৈর্য, সহনশীলতা, ওয়াদা পালন, সালাতের হেফাজতকারী, পরিবারকে সালাত আদায়ের নির্দেশদানকারী এবং আল্লাহর ইবাদাতের দিকে মানুষকে আহ্বানকারী প্রভৃতি গুণের উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর প্রশংসায় পবিত্র কুরআনের ৯টি সূরার ২৫টি আয়াত বর্ণিত হয়েছে। তিনি ছিলেন যাবীহুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর সমীপে স্বেচ্ছায় জীবন উৎসর্গকারী।
তিনি বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল আরবি ভাষী ছিলেন। নবি (সা.) বলেন, সর্বপ্রথম ‘স্পষ্ট আরবি’ ভাষা ব্যবহার করেন হযরত ইসমাঈল (আ.) তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। (আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ) ইসমাঈল (আ.) ছিলেন কুরাইশী আরবি ভাষায় ওহীপ্রাপ্ত প্রথম নবি। এটি ইসমাঈল (আ.) এর জন্য একটি অনন্য গৌরবের বিষয়। এ জন্য তাঁকে আবূল আরাব (أبول العربية) বা আরবদের পিতা বলা হয়।
উপাধি
বর্ণিত আছে যে, একদা তিনি জনৈক ব্যক্তির সাথে একটি নির্ধারিত স্থানে অপেক্ষা করার অঙ্গীকার করেন। সে লোকটি কথা অনুযায়ী নির্দিষ্ট স্থানে না আসলেও তিনি তার জন্য তিন দিন পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকেন। অতঃপর তৃতীয় দিন লোকটির সাথে তাঁর সেখানে দেখা হয়। (ইবনে কাছির) নিজের ওয়াদা রক্ষার জন্য তিন দিন পর্যন্ত কষ্ট করে অপেক্ষা করেছিলেন বলে তাঁকে আল্লাহ তা‘আলা সাদেকুল ও‘আদ বা অঙ্গীকার পালনকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। কুরআন মাজিদে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘তিনি ওয়াদা পালনে সত্যনিষ্ঠ ছিলেন এবং তিনি আল্লাহর রাসুল ও নবি।' ( সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৫৪)
মৃত্যু
হযরত ইসমাঈল (আ.) ১৩৭ বছর বয়সে মক্কা নগরীতে ইন্তেকাল করেন (আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ)। প্রসিদ্ধ মত অনুসারে তাঁকে কাবার হাতীমে তাঁর মা হাজেরার কবরের পাশে দাফন করা হয়। মহান আল্লাহর প্রতি ইসমাঈল (আ.)-এর অগাধ বিশ্বাস ও আনুগত্য, ত্যাগ এবং পিতৃভক্তি, অঙ্গীকার পালন ইত্যাদি আমাদের জীবনের অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।
দলগত কাজ: শিক্ষার্থীরা হযরত ইসমাঈল (আ.) এর চরিত্রের উত্তম গুণাবলি সম্পর্কে পরস্পরে আলোচনা করবে এবং একটি পোস্টার তৈরি করবে। |
Read more