১২.১.১ তড়িৎ বর্তনীর প্রতীক
ইলেকট্রিক সার্কিট বা তড়িৎ বর্তনীর চিত্র বা নকশা আঁকার সুবিধার জন্য আমরা প্রত্যেকটি যন্ত্রের বা সংযোগের একটি প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করে থাকি। নিচের ছকে এ রকম কিছু যন্ত্রের বা সংযোগের প্রতীক চিহ্ন দেওয়া হলো।
১২.১.২ ব্যাটারির কার্যক্রম
আমরা সবাই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে টর্চ লাইটে বা মোবাইল ফোনে ব্যাটারি সেল ব্যবহার করেছি। সাধারণত কথাবার্তায় একটি সেলের জন্যে ব্যাটারি শব্দটি ব্যবহার করলেও বিজ্ঞানের ভাষায় ব্যাটারি বলতে একাধিক কোষের (Cell) সমন্বয়কে বোঝানো হয়। একটি তড়িৎ ব্যাটারি বলে উল্লেখ করলেও প্রকৃতপক্ষে ব্যাটারি হলো একাধিক তড়িৎ কোষের সমন্বয়। ব্যাটারি সেলে ব্যবহারের জন্য তড়িৎ শক্তি জমা থাকে। চিত্র ১২,০২-এ একটি ব্যাটারির গঠন দেখানো হলো। ব্যাটারিতে সাধারণত তিনটি অংশ ইলেকট্রোলাইট অ্যানোড ক্যাথোড থাকে। একটি অ্যানোড, একটি ক্যাথোড এবং মাঝখানে ইলেকট্রোলাইট। ব্যাটারি সেলে রাসায়নিক বিক্রিয়ার অ্যানোড থেকে ইলেকট্রন সরিরে ক্যাথোডে জমা করা হয়। এর ফলে অ্যানোড এবং ক্যাথোডের মধ্যে তড়িৎ বিভব পার্থক্য তৈরি হয়। এ অবস্থার অ্যানোড এবং ক্যাথোডকে পরিবাহী তার দ্বারা সংযুক্ত করলে ক্যাথোডের ইলেকট্রনগুলো অ্যানোডে প্রবাহিত হতে থাকে। ইলেকট্রন প্রবাহের বিপরীত দিকে বিদ্যুৎ প্রবাহ ধরে নেওয়া হয়। তাই আমরা বলি অ্যানোড থেকে ক্যাথোডে বিদ্যুৎ প্রবাহ হচ্ছে। সাধারণ ব্যাটারি সেলের রাসায়নিক পদার্থ বিক্রিয়া করে খরচ হয়ে যাওয়ার পর সেটি অ্যানোড এবং ক্যাথোডে আর বিভব পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারে না বলে বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। আমরা মোবাইল টেলিফোনে যে ব্যাটারি ব্যবহার করি, সেগুলোর বিদ্যুৎ প্রবাহ তৈরির ক্ষমতা শেষ হয়ে যাবার পর নতুন করে চার্জ করিয়ে নেওয়া যায়, তখন ব্যাটারির রাসায়নিক পদার্থগুলো পুনরায় রাসায়নিক বিক্রিয়া করে বিদ্যুৎ তৈরি করার জন্য প্রস্তুত হয়।
১২.১.৩ ইলেকট্রিক সার্কিট বা তড়িৎ বর্তনী
আমাদর দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুৎ কীভাবে ব্যবহার করা হয়, সেটি বুঝতে হলে আমাদের ইলেকট্রিক সার্কিট বা তড়িৎ বর্তনী সম্পর্কে কিছু বিষয় জানতে হবে।
(ক) সিরিজে ব্যাটারি সেল: ব্যাটারি সেলকে সিরিজে (চিত্র ১২.০৩) লাগানো হলে ব্যাটারির বিভব যোগ হয়। অর্থাৎ একটি ব্যাটারি সেলে ১.৫ ভোল্ট হলে দুটি ব্যাটারি সেল দিয়ে ৩ ভোল্ট এবং তিনটি সেল দিয়ে ৪.৫ ভোল্ট পাওয়া সম্ভব।
খ) সমান্তরালে ব্যাটারি সেল: কয়েকটি সেল সমান্তরাল ভাবে (চিত্র ১২.০৪) লাগানো হলে তার বিভবের পরিবর্তন হয় না কিন্তু বেশি বিদ্যুৎ প্রবাহ করতে পারে কিংবা সার্কিটে বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ প্রবাহ করতে পারবে।
(গ) ধরা যাক আমরা ব্যাটারি দিয়ে কয়েকটি বাল্ব জ্বালাতে চাই। সেটি দুইভাবে করা সম্ভব, সিরিজ সার্কিট বা সিরিজ বর্তনী এবং সমান্তরাল সার্কিট বা সমান্তরাল বর্তনী ।
সিরিজ সার্কিটে (চিত্র ১২.০৫) একটি বাল্ব অনেক উজ্জ্বলভাবে জ্বলবে কিন্তু দুটি বা তিনটি বাল্ব লাগানো হলে বিদ্যুৎ প্রবাহ আনুপাতিকভাবে কমে যাবে বলে বাল্বগুলো অনুকূলভাবে জ্বলবে। সিরিজ সার্কিট একটি সুইচ লাগানো হলে সুইচ অফ করার সাথে সাথে সবগুলো বাল্ব একসাথে নিতে যাবে।
সমান্তরাল সার্কিট
সমান্তরাল সার্কিটে (চিত্র ১২.০৬) আমরা যতগুলো বাল্বই লাগাই না কেন, সবগুলোর দুই প্রান্তেই ব্যাটারি সেল থেকে সমান বিভব পার্থক্য প্রয়োগ করা হয় বলে সবগুলো বাল্বই সমান উজ্জ্বলতার জ্বলবে। এই সার্কিটে ইচ্ছে করলে প্রত্যেকটা বাধের জন্য আলাদা সুইচ লাগিয়ে প্রত্যেকটিকে আলাদাভাবে জ্বালানো এবং নেভানো সম্ভব।ব্যাটারি সেলের বিভব পার্থক্য সবসময় সমান থাকে বলে এগুলোকে ডিসি সাপ্লাই বলা হয়। আমাদের বাসায় যে বৈদ্যুতিক সাপ্লাই দেওয়া হয়, সেগুলো প্রতি সেকেন্ডে পঞ্চাশবার ধনাত্মক থেকে ঋণাত্মক বিভবে পরিবর্তিত হয় বলে সেগুলোকে এসি (Alternating Current) বলা হয়। একটি সাধারণ ব্যাটারি সেলে বিভব পার্থক্য মাত্র ১.৫। সেই তুলনায় আমাদের বাসার বিদ্যুৎ সাপ্লাই ২২০৮, এখানে উল্লেখ্য, বিদ্যুৎ প্রবাহ ৫ov থেকে বেশি হলে আমরা সেটি অনুভব করতে পারি এবং ২২০/ সাপ্লাই থেকে অনেক বড় ইলেকট্রিক শক খাওয়া সম্ভব এবং এই ইলেকট্রিক শকের কারণে শরীরের ভেতর দিয়ে যথেষ্ট বিদ্যুৎপ্রবাহ হলে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে।
উদাহরণ: দুইটি দ্বিমুখী সুইচ ব্যবহার করে একটি সার্কিট ডিজাইন করো, যেটি ব্যবহার করে যেকোনো সুইচ দিয়েই একটি লাইট বাল্ব জ্বালানো কিংবা নেভানো সম্ভব।
১২.১.৪ বাড়িতে তড়িৎ বর্তনীর নকশা বা হাউজ ওয়ারিং
আমাদের প্রায় সবার বাড়িতেই বিদ্যুৎ-সংযোগ আছে। তোমরা কী জান, এই সংযোগ দেওয়ার পূর্বে বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং বিতরণ করার জন্য একটা নকশা আঁকতে হয়? বাসায় বিদ্যুৎ বিতরণের একটি নকশা কেমন হতে পারে সেটি দেখানো হলো। বাড়িতে তড়িৎ-সংযোগের জন্য সিরিজ বর্তনী উপযোগী নয়। কারণ সুইচ অন করলে একই সাথে সংযুক্ত সব বাল্ব জ্বলে উঠবে, ফ্যান চলতে থাকবে। আবার অফ করলে সবগুলো একই সাথে অফ হয়ে যাবে। তার চাইতে বড় কথা, সবগুলো সিরিজে থাকলে কোনো বাল্ব বা ফ্যানই প্রয়োজনীয় ভোন্টেজ পাবে না, ভাগাভাগি হওয়ার কারণে ভোল্টেজ কমে যায়। মূলত বাসায় তড়িৎ-সংযোগ সমান্তরাল সংযোগব্যবস্থা মেনে করা হয়। এবার নিচে একটি হাউজ ওয়ারিংয়ের বিশদ চিত্র দেওয়া হলো (চিত্র ১২,০৭) এতে মেইন লাইনকে কীভাবে সংযোগ করে অন্যান্য উপাদান যেমন ফিউজ বা সার্কিট ব্রেকার, মেইন সুইচ, প্লাগ-সকেট, ডিস্ট্রিবিউশন বক্স এবং প্রয়োজনীয় বাতি বা পাখার সংযোগ দেওয়া হয় তা দেখানো হলো। বাসায় বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রধান তার দুটির একটি হলো জীবন্ত (সাধারণত লাল রঙের) তার এবং অন্যটি নিরপেক্ষ তার (সাধারণত কালো রঙের) জীবন্ত তারে বিদ্যুৎ ভোল্টেজ (২২০ volt) থাকে। নিরপেক্ষ তারে কোনো তড়িৎ ভোল্টেজ থাকে না যেহেতু এটিকে মাটির সাথে সংযোগ করে দেওয়া হয়। এটি সার্কিট পূর্ণ করে বিদ্যুৎ প্রবাহ নিশ্চিত করে থাকে।মেইন তারটি ফিউজ বা সার্কিট ব্রেকার হয়ে মিটারে যায়। এর মাধ্যমে বাড়িতে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ শক্তি খরচ হচ্ছে তা মিটারে লিপিবদ্ধ হয়। মিটার হতে তার দুটি মেইন সুইচে যায়। এই সুইচের সাহায্যে বাড়ির ভিতরের বিদ্যুৎ প্রবাহ প্রয়োজন হলে পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া।মেইন সুইচ থেকে তার দুটি ডিস্ট্রিবিউশন বক্সে যায়। সেখানে তার দুটি বিভিন্ন শাখা লাইনে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রত্যেক শাখা লাইনের জন্য পৃথক পৃথক ফিউজ বা সার্কিট ব্রেকার থাকে। ছবিতে লাইটের জন্য ৫A, ফ্যানের জন্য ১০%, হিটারের জন্য ১৫A এবং প্লাগ সকেটের জন্য ৩০A সার্কিট ব্রেকার দেখানো হয়েছে। এদের প্রত্যেকটিতেই জীবন্ত তারের সংযোগ আছে এবং প্রত্যেকটি বাতি পাখার জন্য আলাদা আলাদা সুইচ সংযোগ দেওয়া আছে।বাড়িতে বৈদ্যুতিক ওয়ারিং দেওয়ার সময় বাতি বা পাওয়ার সুইচের যাবতীয় ফিউজ যেন জীবন্ত তারের সাথে সংযোগ হয়, সেদিকে বিশেষ করে নজর দিতে হবে। তাছাড়া সমস্ত তার পিভিসি বা যেকোনো অপরিবাহী পদার্থ দ্বারা মোড়ানো হতে হবে।বর্তমানে ওয়ারিং কেবলকে সাধারণত দেয়ালের প্লাস্টারের ভিতর দিয়ে টানা হয়। তাছাড়া সব ধরনের যন্ত্রপাতির জন্য ফিউজ সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতির (যেমন ফ্রিজ, টিভি ইত্যাদি) জন্য উপযোগী ফিউজ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া প্রয়োজনীয় লোড নিতে পারে, সে ধরনের কেবল (Cable) ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে বিদ্যুৎ প্রবাহের সময় তার উত্তপ্ত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
Read more