তাপ এক ধরনের শক্তি। আমরা দেখেছি শক্তি কাজ করতে পারে অর্থাৎ বল প্রয়োগ করে বস্তুকে বলের দিকে সরাতে পারে, যেমন ট্রেন বা গাড়িতে আসলে জ্বালানি তেল জ্বালিয়ে তাপ তৈরি করা হয় যেটা ট্রেন বা গাড়িকে ছুটিয়ে নিয়ে যায়। সেজন্য আলো, বিদ্যুৎ বা গতিশক্তির মতো আমরা নতুন ধরনের এই শক্তির নাম দিয়েছি তাপশক্তি ।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমরা যদি আণবিক পর্যায়ে দেখতে পেতাম অর্থাৎ যেকোনো পদার্থের দিকে তাকালেই তার অণুগুলোকে দেখতে পেতাম তাহলে সম্ভবত তাপশক্তি নামে একটা নতুন নাম না দিয়ে এটাকে “গতিশক্তি” নামেই রেখে দিতাম। তার কারণ তাপশক্তি বলতে আমরা যেটা বোঝাই সেটা আসলে পদার্থের অণুগুলোর সম্মিলিত গতিশক্তি ছাড়া কিছু নয়। একটা কঠিন পদার্থে অণুগুলো যখন উত্তপ্ত হয় তখন অণুগুলো নিজের নির্দিষ্ট অবস্থানে থেকে কাঁপতে থাকে। যত বেশি উত্তপ্ত হবে অণুগুলোর কাঁপুনি তত বেড়ে যাবে। যদি অনেক বেশি উত্তপ্ত হয় তাহলে অণুগুলোর নিজেদের ভেতরে যে আন্তঃআণবিক বল রয়েছে অণুগুলো সেই বলকে ছাড়িয়ে মুক্ত হয়ে যাবে। তখন আমরা সেটাকে বলি তরল। তখন অণুগুলো এলোমেলোভাবে একে অন্যের ভেতর দিয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে। তাদের একটা গতি থাকে, কাজেই এটা গতিশক্তি। যত উত্তপ্ত করা হয় অণুগুলো তত জোরে ছোটাছুটি করে। যদি আরো উত্তপ্ত করা হয় তখন অণুগুলো আণবিক বন্ধন থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়ে যেতে পারে। আমরা তখন সেটাকে বলি গ্যাস। একটা গ্যাসকে যত উত্তপ্ত করা হবে অণুগুলো তত জোরে ছোটাছুটি করবে। গতি যত বেশি হবে গতিশক্তি তত বেশি হবে।
যেহেতু খালি চোখে আমরা অণুগুলোকে দেখি না, তাদের ছোটাছুটি দেখি না, তাই আমরা পরোক্ষভাবে পুরো জিনিসটা বোঝার চেষ্টা করি, আমরা সেটাকে তাপশক্তি নাম দিই এবং তাপমাত্রা বলে পদার্থের অবস্থা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। কাজেই আমরা বলতে পারি পদার্থের অণুগুলোর কম্পন বা গতির কারণে যে শক্তি পাওয়া যায় সেটা হচ্ছে তাপ। যেহেতু এটা শক্তি তাই স্বাভাবিকভাবে অন্য শক্তির মতোই তার একক হচ্ছে জুল (j). তাপের আরো একটি একক আছে, তার নাম ক্যালরি (cal)। 1 gm পানির তাপমাত্রা 1°C বাড়াতে হলে যে পরিমাণ তাপের দরকার সেটা হচ্ছে 1 ক্যালরি। 1 ক্যালরি হচ্ছে 4.2 J এর সমান।
তোমরা হয়তো খাবারের জন্য ক্যালরি শব্দটি ব্যবহার করতে শুনেছ। ফুড ক্যালরি বলতে আসলে বোঝানো হয় মানুষ নির্দিষ্ট খাবার থেকে কী পরিমাণ শক্তি পায় এবং এটার জন্য একক আসলে k cal বা 1000 ক্যালরি। তবে সেটা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাব না। এখানে আমরা খাবার থেকে পাওয়া শক্তি নয় তাপশক্তি নিয়েই আলোচনা করব।
আমরা যদি তাপকে একটা শক্তি হিসেবে মেনে নিই, তাহলে সাথে সাথে এরপরের যে বিষয়টা আমাদের জানতে হবে সেটা হচ্ছে কীভাবে তাপশক্তি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয়। সাধারণভাবে আমাদের ধারণা সব সময়ই শক্তির প্রবাহ হয় বুঝি বেশি শক্তি থেকে কম শক্তিতে। ছোট একটা গরম আলপিনে যে পরিমাণ তাপশক্তি রয়েছে তার থেকে অনেক বেশি তাপশক্তি রয়েছে এক গ্লাস পানিতে। কিন্তু গরম আলপিনটা আমরা যদি পানিতে ডুবিয়ে দিই তাহলে কিন্তু আলপিনের অম্ল তাপশক্তি থেকেই খানিকটা চলে যাবে গ্লাসের পানিতে। তার কারণ তাপশক্তির প্রবাহটা তাপের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে না, এটা নির্ভর করে তাপমাত্রার উপরে। দুটো ভিন্ন তাপমাত্রার জিনিস যদি একে অন্যের সংস্পর্শে আসে তাহলে সব সময়ই বেশি তাপমাত্রা থেকে তাপ কম তাপমাত্রার জিনিসে যেতে থাকবে যতক্ষণ না দুটোর তাপমাত্রা সমান হচ্ছে।
আমরা এখনো কিন্তু “তাপমাত্রা" নামের রাশিটি সংজ্ঞায়িত করিনি। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে এটি এত ব্যবহার হয় যে বিষয়টি কী বুঝতে কারোই সমস্যা হয় না। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বলতে পারি এটা হচ্ছে পদার্থের ভেতরকার অণুগুলোর গড় গতিশক্তির একটা পরিমাপ। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বলতে পারি, তাপমাত্রা হচ্ছে সেই তাপীয় অবস্থা যেটি ঠিক করে একটা বস্তু অন্য বস্তুর সংস্পর্শে এলে সেটি কি তাপ দেবে নাকি ভাপ নেবে। বিষয়টা বোঝানোর জন্য আমরা পানির পৃষ্ঠদেশের উচ্চতার সাথে তুলনা করতে পারি। যদি পানির দুটি পাত্রে পানির পৃষ্ঠদেশের উচ্চতা ভিন্ন হয় তাহলে পাত্র দুটিকে একটি নল দিয়ে একত্র করার পর কোন পাত্রে পানি বেশি কোন পাত্রে পানি কম সেটি পানির প্রবাহ ঠিক করবে না। কোন পাত্র থেকে কোন পাত্রে পানি যাবে সেটা নির্ভর করবে কোন পাত্রের পানির পৃষ্ঠদেশের উচ্চতা কত তার ওপর। সব সময়ই বেশি উচ্চতা থেকে পানি কম উচ্চতায় প্রবাহিত হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না দুটি উচ্চতা সমান হয়ে যাচ্ছে। এখানে পানির পরিমাণটাকে তাপশক্তির সাথে তুলনা করতে পারি, পানির পৃষ্ঠদেশের উচ্চতাকে তুলনা করতে পারি তাপমাত্রার সাথে। তাপমাত্রার বেলাতেও এটা সত্যি যে যতক্ষণ পর্যন্ত না দুটি বস্তুর তাপমাত্রা সমান হচ্ছে ততক্ষণ তাপ প্রবাহিত হতে থাকবে।