ছক ১.১: হিন্দুধর্ম সম্পর্কিত তথ্য
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
প্রতিটি ধর্মের কিছু মৌলিক বিশ্বাস আছে। এসব বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে ধর্মটি পরিচালিত হয়। ধর্মাবলম্বীরা সেই বিশ্বাসের আলোকে নিজ জীবনের গতিপথ ঠিক করে নেন। হিন্দুধর্মও এর ব্যতিক্রম নয়। সুমহান এই প্রাচীন ধর্মটি হাজার হাজার বছর ধরে মুনি-ঋষিদের সাধনা ও উপলব্ধির ফসল। এখানে যেমন ভিন্ন ভিন্ন পথ ও চিন্তা আছে, তেমনি কিছু কিছু বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন। হিন্দুধর্মের যেসব বিষয়ে সকলে সহমত, সেগুলোই হিন্দুধর্মের মৌলিক বিষয়। এ রকম কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাক।
বেদের একটি অংশ উপনিষদ। এখানে ব্রহ্ম সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেওয়া হয়েছে। 'ব্রহ্ম' শব্দের অর্থ যা অপেক্ষা বৃহৎ ও ব্যাপক আর কিছু হতে পারে না। তৈত্তিরীয় উপনিষদে উল্লেখ আছে ঋষি ভৃগু পিতা বরুণের কাছে প্রশ্ন করেছিলেন, ব্রহ্ম কী?
উত্তরে পিতা বলেছিলেন, এই ভূতসমূহ (পৃথিবী সৃষ্টির মৌলিক উপাদানকে ভূত বলা হয়) খাঁ থেকে সৃষ্টি হয়েছে, যাঁর দ্বারা টিকে আছে এবং বিনাশের পর যাঁতে লীন হয়ে যায়, তুমি তাঁকে বিশেষরূপে জানতে চাও, তিনিই ব্রহ্ম।
উপনিষদে ব্রহ্ম সম্পর্কে যেসব ধারণা পাওয়া যায়-
১. যিনি সকল জীব ও বস্তুতে ব্যাপ্ত হয়ে আছেন তিনিই ব্রহ্ম। ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে 'সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম'। সর্বত্র বিরাজ করছেন ব্রহ্ম। তাঁর থেকে জগতের উৎপত্তি। তাঁতেই জগৎ মিলিয়ে যায়। তাঁতেই জীবিত থাকে।
২. ব্রহ্ম বিভিন্ন রূপে প্রকাশিত হলেও তিনি কিন্তু একই। অর্থাৎ বহুত্বের মধ্যে একত্ব। আগুন এক এক জায়গায় এক এক রূপ ধারণ করে। কিন্তু আগুন তো শেষমেশ আগুনই থেকে যায়।
৩. তিনি জগৎ সৃষ্টি করেছেন। আবার জগতের অভ্যন্তরে থেকেই জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। মাকড়সা যেমন নিজের শরীর থেকেই জাল বোনে আবার সেই জালের মধ্যেই অবস্থান করে।
৪. ব্রহ্ম অমৃত স্বরূপ। তিনি এ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন অমৃত আস্বাদনের জন্য। রসের আরেক রূপ অমৃত। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে মানুষকে অমৃতের পুত্র বলা হয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে বিশ্ব ধর্মসম্মেলনে বলেছিলেন, 'অমৃতের পুত্র কী মধুর ও আশার নাম! হে ভ্রাতৃগণ, এই মধুর নামে আমি তোমাদের সম্বোধন করিতে চাই। তোমরা অমৃতের অধিকারী। হিন্দুগণ তোমাদিগকে পাপী বলিতে চান না। তোমরা ঈশ্বরের সন্তান, অমৃতের অধিকারী পবিত্র ও পূর্ণ। মর্ত্য- ভূমির দেবতা তোমরা! তোমরা পাপী? মানুষকে পাপী বলাই এক মহাপাপ। মানবের যথার্থ স্বরূপের উপর ইহা মিথ্যা কলঙ্কারোপ।'
৫. ব্রহ্ম রস আস্বাদন করে আনন্দ পান। ব্রহ্মের এ আনন্দ থেকে পঞ্চভূত অর্থাৎ মাটি, জল, আগুন, বাতাস, আকাশ সৃষ্টি হয়েছে। 'ওঁ' শব্দকে ব্রহ্মের প্রতীক বলা হয়।
ব্রহ্মকে বলা হয় ত্রিগুণাতীত। অর্থাৎ তাঁর মধ্যে স্বত্ত্ব (ইতিবাচক), রজঃ (কর্মোদ্যম) এবং তমঃ (নেতিবাচক) এই তিনটি গুণের কোনোটিরই প্রকাশ নেই। তাঁকে কোনো উপাধিতে ভূষিত করা যায় না। এই ব্রহ্মকে 'নিরুপাধিক' ব্রহ্ম বলা হয়। এই রূপে তিনি এক ও অদ্বিতীয়, নিরাকার পরমব্রহ্ম; তিনি অন্তহীন এবং ব্রহ্মান্ডজুড়ে বিরাজমান।
আবার ব্রহ্মের আরও একটি রূপ আছে তার নাম হলো 'সোপাধিক' ব্রহ্ম। এই রূপে তিনি উপাধিযুক্ত। অর্থাৎ তাঁকে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করা হয়। যেমন ব্রহ্ম যখন জীবের সকল কাজ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করেন তখন তাঁকে ঈশ্বর বলা হয়। এখানে 'ঈশ্বর' হলো তাঁর উপাধি। ঈশ্বরকে আমরা ভগবানও বলি। 'ভগ' শব্দের অর্থ- ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য। এই ছয়টি গুণ আছে বলে ঈশ্বরকে ভগবান বলা হয়।
ছক ১.১: ব্রহ্মের ধারণা
| ব্রহ্ম | বাক্য |
১. |
|
|
২. |
|
|
৩. |
|
|
সবাই ছবি দুটো মনোযোগ দিয়ে দেখি। ছবিতে কী বোঝানো হচ্ছে, প্রত্যেকে নিজের মতন করে বলি।
কঠোপনিষদে বলা হয়েছে, রথকে চালানোর জন্য যেমন রথী থাকে, তেমনি মানুষের দেহকে পরিচালনার জন্য যে সত্তা আছে তাই আত্মা। এই আত্মা দুভাবে প্রকাশিত হয়। জীবাত্মা ও পরমাত্মা। ব্রহ্ম হচ্ছেন পরমাত্মা। সেই আত্মারই একটি অংশ আমরা ধারণ করে আছি জীবাত্মা রূপে।
সূর্য যদি পরমাত্মা হয়, আমরা যেন তার এক একটি আলোককণা। পরমাত্মা থেকে যেমন জীবাঝার সৃষ্টি হয়, তেমনি এটি পরমাত্মায় মিলিয়েও যায়। এর ধ্বংস বা বিনাশ নেই। গীতায় আত্মার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, শস্ত্র (এক ধরনের অস্ত্র) একে ছিন্ন করতে পারে না। আগুন একে দগ্ধ করতে পারে না। জলও আর্দ্র করতে পারে না। বায়ু পারে না শুষ্ক করতে।
এই আত্মা এক দেহ থেকে আরেক দেহে স্থানান্তরিত হয়। গীতায় এ সম্পর্কে হয়েছে
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়
নবানি গৃহাতি নরোহপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা-
ন্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী। ২/২২
অর্থাৎ, মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে, আত্মাও তেমনি জীর্ণ দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ করে।
মৃত্যুর পর আবার জন্ম নেয়াকে জন্মান্তর বলা হয়। হিন্দুরা বিশ্বাস করে, মৃত্যুর পর গতজন্মের কর্ম অনুসারে - একজন মানুষ নতুন জন্মলাভ করে অথবা মোক্ষলাভ করে।
জন্ম-মৃত্যুর এই চক্রকে ভবচক্র বলা হয়।
মানুষ জন্মলাভ করে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পৃথিবীতে জীবন কাটায়, তারপর মৃত্যুবরণ করে। মৃত্যুর পরে মানুষ মোক্ষলাভ করে অথবা আবার জন্ম নেয়। হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করা হয়, জন্ম-মৃত্যুর ভবচক্র থেকে মুক্তি পাওয়া মানুষের প্রধান লক্ষ্য। এই মুক্তিকে বলা হয় মোক্ষ বা নির্বাণ বা অমৃতলাভ। মুক্তিলাভ করলে জীবাত্মা পরমাত্মায় মিশে যায়; দুঃখ জরা গ্লানি আর মানুষকে স্পর্শ করতে পারে না।
মোক্ষলাভ হলে মানুষ কামনা-বাসনা থেকে মুক্তি পায়, নিজের সমস্ত কাজ এবং কাজের ফলাফল ঈশ্বরের প্রতি সমর্পণ করে। পাত্রের জলের যেমন আলাদা অবস্থান থাকে কিন্তু পাত্রকে ভেঙে দিলে সে বৃহৎ জলের সঙ্গে মিশে যায়। তেমনি জীবাত্মাও মোক্ষলাভ করে পরমাত্মায় লীন হয়ে যায়।
কিন্তু মুক্তি লাভের উপায় কী? শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (৩৮) বলা হয়েছে, হে বিশ্বাসী নরনারী ও দিব্যধামবাসী! তোমরা শোনো, আমি অন্ধকারের ওপারে অবস্থিত সেই জ্যোতির্ময় পুরাণ পুরুষকে জেনেছি এবং জেনে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়েছি। ইহা ব্যতীত অমৃত লাভের অন্য কোনো উপায় নেই।
জ্যোতির্ময় পুরাণ পুরুষ হচ্ছেন ব্রহ্ম। অর্থাৎ ব্রহ্মকে না জানা পর্যন্ত মুক্তির উপায় নেই।
ব্রহ্মজ্ঞান লাভের উপায় হলো সাধনা। হিন্দুধর্মে সাধনার তিনটি পথের কথা বলা হয়েছে।
বৈরাগ্য সাধনা: কোনোকিছুর প্রতি আসক্ত না হয়ে কেবল ঈশ্বরের সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা। যিনি বৈরাগ্য সাধনা করেন তিনি বিশ্বাস করেন, ঈশ্বর আমার সব দায়িত্ব নিয়েছেন, আমার আর ঈশ্বরের সত্তার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।
যোগাভ্যাস: যোগের অভ্যাস হচ্ছে যোগাভ্যাস। যোগ শব্দের অর্থ যুক্ত হওয়া। এখানে যোগাভ্যাস অর্থ পরমেশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, তাঁর সান্নিধ্যলাভ। যোগের অর্থ পরমেশ্বরের তাঁর সান্নিধ্যলাভ। যোগাভ্যাস করার জন্য কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়- সংযম, নিয়ম, বিভিন্ন আসন, শ্বাসচর্চা, ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ, সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলা ইত্যাদি।
ভক্তি: পরমেশ্বরের প্রতি ভালোবাসাকে ধর্মশাস্ত্রে বলা হয়েছে ভক্তি। আত্মীয়-পরিজনের প্রতি ভালোবাসার ঊর্ধ্বে ভগবানের প্রতি এই ভালোবাসা। ভক্ত এখানে ঈশ্বরকে খুব কাছের এবং আপন বলে ভাবেন। ভাবতে ভাবতে তিনি সবকিছুতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব দেখতে পান। নানারকম পূজা-পার্বণ, ধ্যান, মন্ত্র ইত্যাদির সমন্বয়ে এই সাধনপথ তৈরি হয়েছে।
আমরা প্রত্যেকে পুনর্জন্ম অথবা মোক্ষলাভের পক্ষে 'পুনর্জন্ম কিংবা মোক্ষলাভ' ছকে নিজের মতামত লিখি।
ছক ১.৩: হিন্দুধর্ম তথ্য
| পুনর্জন্ম | মোক্ষলাভ |
তুমি কোনটি চাও? (টিক দাও) |
|
|
কেন চাও তা দুটি যুক্তি দিয়ে বোঝাও। |
|
ঈশ্বর তাঁর মহামায়া শক্তিকে অবলম্বন করে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের জন্য তিনটি রূপ ধারণ করেন- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব। বিষ্ণু ঈশ্বরের জগৎ-পালক রূপ। জগৎ রক্ষায় বিষ্ণু বিভিন্ন সময়ে মানুষের রূপ ধরে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, পৃথিবীতে যখনই ধর্মের অধঃপতন এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন আমি দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য যুগে যুগে অবতীর্ণ হই। ঈশ্বর যখন ধর্ম রক্ষার জন্য দেহধারণ করে পৃথিবীতে আসেন তখন তাঁকে অবতার বলা হয়। 'অবতার' শব্দের অর্থ যিনি নিজের অবস্থান থেকে অবতরণ করেন।
ঈশ্বর নিরাকার। তিনি এক এবং অভিন্ন। বিভিন্ন দেবদেবী ও অবতার নিরাকার ঈশ্বরের বিভিন্ন শক্তির প্রকাশ।
পুরাণে বিষ্ণুর দশ অবতারের কথা বলা হয়েছে। সংক্ষেপে একে দশাবতার বলা হয়।
|
হিন্দুধর্মের প্রধান লক্ষ্য মুক্তি বা মোক্ষলাভ হলেও বাস্তবজীবনের প্রয়োজনকে কখনো অস্বীকার করা হয়নি। বাস্তবজীবনের আরো তিন লক্ষ্য আছে- ধর্ম (ন্যায়পরায়ণতা), অর্থ (ধন-সম্পদ) এবং কাম/ কামনা। এভাবে ধর্ম, আর্থ, কাম ও মোক্ষ এ চারটিকে একসঙ্গে চতুর্বর্গ বলা হয়।
চতুর্বর্গের সঙ্গে সংগতি রেখে জীবনকেও চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ভাগগুলো হলো- ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য. বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। একে সংক্ষেপে চতুরাশ্রম বলা হয়।
ব্রহ্মচর্য: শৈশবে বেদ-বিদ্যা লাভ ও শাস্ত্রের জ্ঞান অর্জনের জন্য গুরুগৃহে যেতে হবে। সেখানে আবাসিক ছাত্র হিসেবে অবস্থান করে, গুরুর ও গুরুমাতার সেবা করে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান লাভ করবে। পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করবে।
গার্হস্থ্য: ব্রহ্মচর্য আশ্রম শেষে বাড়ি ফিরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। তারপর শুরু হবে গার্হস্থ্য জীবন। পিতা- মাতার সেবা, পরিবারের প্রতিপালন, আত্মীয়-স্বজন ও অতিথি সেবা, পুত্র-কন্যার শিক্ষাদানের ব্যবস্থা, পূজা- অর্চনা ইত্যাদি করতে হবে।
বানপ্রস্থ: পঁচিশ বছর গার্হস্থ্য জীবন পালনের পর তৃতীয় আশ্রমের শুরু হয়। বানপ্রস্থ আশ্রমের মূল মন্ত্র হলো 'ভোগবর্জিত ত্যাগ'। চিত্তের পরিশুদ্ধির জন্য তীর্থ ও মন্দির পরিদর্শনের মধ্যে দিয়ে এ আশ্রমের সূচনা। সাধনা ও কৃচ্ছু সাধনের জন্য বনে যাত্রা করা কর্তব্য।
সন্ন্যাস: মোক্ষলাভের চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার জন্য সন্ন্যাসজীবনে প্রবেশ করতে হবে। শাস্ত্রানুসারে পঁচিশ বছর বানপ্রস্থ শেষে সন্যাস গ্রহণ করতে হবে। ধ্যান ও প্রাণায়ামের মাধ্যমে আত্মজ্ঞানের অনুশীলন করতে হবে।
কলিযুগে মানুষের আয়ুষ্কাল কম হওয়ায় চতুরাশ্রমের প্রচলন তেমনভাবে নেই।
ছক ১.৫: পুরোনো দিনের কথা
নিয়ম/ প্রথার শিরোনাম | যেভাবে পালন করতেন |
|
|
|
|
|
|
|
|
তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমাদের ধর্মে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক নিয়ম ও প্রথার পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের ধর্মের সবচেয়ে সুন্দর দিক এই গতিশীলতা। যুগের সঙ্গে ধর্মের রীতি-নীতি পরিবর্তনের কথা ধর্মেই বলা হয়েছে।
হিন্দুধর্মের গ্রন্থগুলো দুটো ভাগে ভাগ করা হয়। শ্রুতি ও স্মৃতি। শ্রুতি অংশে আছে বেদ। এখানে আত্মার প্রকৃতি, ঈশ্বরের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক, সৃষ্টিতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয় রয়েছে। এসব ধারণা চিরন্তনী। পরিবর্তনের সুযোগ নেই।
স্মৃতি অংশে রয়েছে বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্র, যেমন- পুরাণ। এতে জীবন চলার পথে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা, নিয়ম ও রীতি-নীতি রয়েছে। কিন্তু এক যুগের নিয়ম-কানুন আরেক যুগের নিয়ম-কানুন থেকে ভিন্ন। যুগের সঙ্গে সঙ্গে প্রথা ও নিয়মের পরিবর্তনকে যুগধর্ম বলা হয়।
শাস্ত্রে কোন যুগে কেমন ধর্ম হবে তাও বলা হয়েছে। হিন্দুশাস্ত্রে সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সময়কালকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সত্যযুগ, ত্রেতাযুগ, দ্বাপরযুগ ও কলিযুগ। সত্যযুগে সবাই সত্য কথা বলত। সৎ পথে চলত। কিন্তু ত্রেতাযুগে তা এক চতুর্থাংশ কমে আসে। পরের দুই যুগেও সমান পরিমাণে কমে আসে। এখন - কলিযুগ চলছে। অর্থাৎ চতুর্থ যুগ। এই যুগের পর সত্য ফুরিয়ে যাবে। আবার নতুন করে সত্যযুগের শুরু হবে। এভাবে যুগচক্র চলবে।
মনুসংহিতায় এক এক যুগে এক একটি কর্মকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলা হয়েছে-
তপঃ পরং কৃতযুগে ত্রেতায়াং জ্ঞানমুচ্যতে।
দ্বাপরে যজ্ঞমেবাহুর্দানমেকং কলৌ যুগে।।
(মনুসংহিতা, ১।৮৬)
সরলার্থ: সত্যযুগে তপস্যাই মানুষের শ্রেষ্ঠ ধর্ম, ত্রেতাযুগে জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ, দ্বাপর যুগে যজ্ঞ এবং কলিতে একমাত্র দানই শ্রেষ্ঠ ধর্ম।
ছক ১.৬: 'জীবনদর্শন' ছক
|
স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া ও সাহিত্য প্রতিযোগিতা কিংবা অন্যান্য বড় কোনো অনুষ্ঠান শুরুর পূর্বে বিভিন্ন ধর্মের পবিত্র গ্রন্থসমূহ থেকে কোনো একটি অংশ পাঠ করা হয়। আমাদের ধর্মের ক্ষেত্রে গীতা থেকে শ্লোক পাঠ করা হয়ে থাকে। আমাদের মধ্যে অনেকেই গীতা পাঠ করতে পারি আবার কেউ কেউ পারি না। তবে গীতা পাঠের পর গীতার শ্লোকের যে অর্থ বলা হয়, তা শুনতে বেশ ভালো লাগে। সেখান থেকে আমরা অনেক কিছু জানতে ও শিখতে পারি। আমরা নিজেরা যদি গীতা পড়তে পাড়ি তাহলে তো বেশ ভলোই হতো। আচ্ছা আজ আমরা যদি আমাদের ক্লাসেই একটি গীতাপাঠ প্রতিযোগিতার আয়োজন করি, তবে কেমন হয়? আমাদের হিন্দুধর্মের শিক্ষককে বিচারক হিসেবে রেখে আমরা গীতাপাঠ প্রতিযোগিতার একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারি।
এসো, এর জন্য নিজেরা জানি এমন কোনো শ্লোক বা নিচে প্রদত্ত চারটি শ্লোকের মধ্যে থেকে যে-কোনো একটি শ্লোক কয়েকবার অনুশীলন করি। এরপর প্রতিযোগিতার নিয়ম মেনে তা শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপন করি। সঠিক উচ্চারণ ও ছন্দে পাঠের জন্য শিক্ষকের সহায়তা নিতে পারি।
১. নিয়তং কুরু কর্ম ত্বং কর্ম জ্যায়ো হ্যকর্মণঃ। শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিন্ধ্যেদকর্মণঃ ।। (গীতা, ৩/৮) সরলার্থ: তুমি সর্বদা কাজ করো। কাজ না করার চেয়ে কাজ করা শ্রেষ্ঠ। কাজ না করলে তোমার জীবনযাত্রাও পরিচালিত হবে না। | ২. রাগদ্বেষবিমুক্তৈস্তু বিষয়ানিন্দ্রিয়েশ্চরন। আত্মবশ্যৈবিধেয়াত্মা প্রসাদমধিগচ্ছতি। (গীতা ২/৬৪) সরলার্থ: সংযতচিত্ত মানুষ প্রিয় বস্তুতে স্বাভাবিক আসক্তি ও অপ্রিয় বস্তুতে স্বাভাবিক বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হয়ে, তাঁর বশীভূত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন করে ভগবানের কৃপা লাভ করেন। |
৩. ক্রোধাদ ভবতি সম্মোহঃ সম্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ। স্মৃতিভ্রংশাদ বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি। (গীতা, ২/৬৩) সরলার্থ: ক্রোধ থেকে সম্মোহ, সম্মোহ থেকে স্মৃতিবিভ্রম, স্মৃতিবিভ্রম থেকে বুদ্ধিনাশ এবং বুদ্ধিনাশ হওয়ার ফলে সর্বনাশ হয়। | ৪. শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ। জ্ঞানং লক্কা পরাং শান্তিমচিরেণাধিগচ্ছতি ।। (গীতা, ৪/৩৯) সরলার্থ: যিনি শ্রদ্ধাবান, তৎপর ও সংযত-ইন্দ্রিয় তিনিই জ্ঞান লাভ করেন। জ্ঞান লাভ করে অচিরেই। তিনি পরম শান্তি লাভ করেন। |
ছক ১.৭: গীতাদর্শন
|
আমরা গীতাপাঠ প্রতিযোগিতায় দেখলাম সবাই একইভাবে বা নিয়মে গীতা পাঠ করেনি। আবার অনেক ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা পূজায় যেভাবে গীতা পাঠ করা হয়ে থাকে তা স্কুলের অনুষ্ঠানের গীতা পাঠের মতো নয়। তবে সব ক্ষেত্রেই কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে গীতা পাঠ করা হয়। সাধারণত গীতা পাঠের শুরুতে বিভিন্ন মঙ্গলাচরণ শ্লোক, শ্রীমদ্ভগবদ্দীতার মূল শ্লোক, তার অর্থ ও তাৎপর্যসহ পাঠ, পরিশেষে গীতার মাহাত্ম্য পাঠ ও সব শেষে শান্তিপাঠ করা হয়। তবে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের শুরুতে যখন গীতাপাঠ করা হয় তখন সংক্ষিপ্ত আকারে তা করা হয়ে থাকে। এবার আমরা স্কুলে বা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র গীতা পাঠ কীভাবে করি তা জানব। এরপর যে কোনো অনুষ্ঠানে সহজেই গীতাপাঠ করতে পারব।
ধারাবহিকভাবে এটি অনুসরণ করে গীতাপাঠ সম্পন্ন করতে হবে।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ কৌরব ও পান্ডবদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। যুদ্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন তৃতীয় পান্ডব অর্জুনের রথের সারথি। যুদ্ধের শুরুতে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ধর্মযুদ্ধ করার প্রেরণা দেন। সেজন্য তিনি কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। সেসব উপদেশের সংকলনই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা। গীতা মহাভারতের একটি অংশ। মহাভারতের ভীষ্মপর্বে (২৫-৪২ অধ্যায়) গীতা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রয়েছে। তবুও গুরুত্ব বিবেচনায় মহাভারতের এই অংশটি পৃথক গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে। গীতায় শ্লোকসংখ্যা সাতশত। তাই একে সপ্তশতীও বলা হয়।
ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডু দুই ভাই। ধৃতরাষ্ট্রের একশত পুত্র- দুর্যোধন, দুঃশাসন, বিকর্ণ প্রমুখ। এঁদের বলা হয় কৌরব। অন্যদিকে পান্ডুর পাঁচ পুত্র- যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব। এঁদের বলা হয় পাণ্ডব। ধৃতরাষ্ট্র জন্ম থেকেই অন্ধ ছিলেন। তাই বড় ছেলে হওয়া সত্ত্বেও তিনি রাজা হতে পারেননি। তাঁর বদলে রাজা হন ছোট ভাই পাণ্ডু। অতএব, নিয়ম অনুসারে পান্ডুর বড় ছেলে যুধিষ্ঠিরের রাজা হওয়ার কথা। কিন্তু কৌরবরা পাশা খেলায় কপটতা করে পাণ্ডবদের পরাজিত করেন। তাঁদের বনবাসে পাঠিয়ে দুর্যোধন অন্যায়ভাবে রাজা হন। বনবাস থেকে ফিরে এসে পাণ্ডবরা নিজেদের রাজ্য ফেরত চান। কিন্তু দুর্যোধন যুদ্ধ ছাড়া রাজ্য ফিরিয়ে দিতে রাজি নন।
ফলে হারানো রাজত্ব উদ্ধারের জন্য কুরু-পাণ্ডব দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। অধার্মিক ও দুর্বৃত্তদের বিনাশ এবং ধর্মপ্রতিষ্ঠার জন্য এই যুদ্ধ। কুরুক্ষেত্র নামক স্থানে এই যুদ্ধ হয় বলে এর নাম কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ।
শ্রীমদ্ভগবদ্দীতা মোট আঠারোটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রতিটি অধ্যায়কে বলা হয় যোগ। প্রতিটি অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন। এখানে আমরা গীতার প্রতিটি অধ্যায়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানব।
অর্জুনবিষাদ-যোগ: কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের শুরুতে প্রতিপক্ষে আত্মীয়-স্বজনদের দেখে অর্জুনের মন বিষাদে ভরে ওঠে। আত্মীয়-স্বজনদের হত্যা ছাড়া যুদ্ধজয়ের কোনো বিকল্প নেই। তাঁর শরীর কাঁপতে থাকে। গলা শুকিয়ে যায়। দেহ অবসন্ন হয়। হাত থেকে গাণ্ডীব খসে পড়ে। এই অবস্থায় তিনি যুদ্ধ না করার সিদ্ধান্ত নেন। ধনুর্বাণ ত্যাগ করে রথের উপর বসে পড়েন।
সাংখ্যযোগ: সাংখ্য শব্দের অর্থ সম্যক জ্ঞান। সম্যক বিচার-বুদ্ধি। এই অধ্যায় থেকেই শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ প্রদান শুরু। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রথমে অর্জুনকে হতাশা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াতে উপদেশ দেন। তারপর তিনি অর্জুনের কাছে দেহের নশ্বরতা, আত্মার অবিনশ্বরতা, স্থিতপ্রজ্ঞের লক্ষণ, কর্মযোগের প্রারম্ভিক জ্ঞান বর্ণনা করেন। অর্জুনকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।
কর্মযোগ: নিজের বৃত্তি ও ধর্ম অনুসারে কর্তব্যকর্ম করা, আমি কর্ম করি এই অহংবোধ ত্যাগ করা, জ্ঞানের সাথে কর্ম করা ইত্যাদি কর্মযোগের মূল বিষয়।
জ্ঞানযোগ: জ্ঞানের লক্ষণ, জ্ঞান লাভের উপায়, জ্ঞানীর বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি জ্ঞানযোগের আলোচ্য বিষয়। প্রসঙ্গক্রমে এখানে ভগবানের অবতারতত্ত্ব এবং ব্যক্তির গুণ, পেশাভিত্তিক কর্ম আলোচিত হয়েছে।
সন্ন্যাসযোগ: প্রকৃত সন্ন্যাসীর তাৎপর্য এখানে তুলে ধরা হয়েছে। কর্মফল ঈশ্বরে অর্পণ, আমি করি এই অহংবোধ ত্যাগ- এটাই সন্ন্যাসযোগের মূল কথা। সংসারে থেকেও এভাবে প্রকৃত সন্ন্যাসী হওয়া সম্ভব। গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীর চেয়েও গৃহী সন্ন্যাসী উত্তম।
জ্ঞানবিজ্ঞান-যোগ: অপরা ও পরা ভেদে প্রকৃতি দুই প্রকার। পঞ্চভূতের সাথে মন, বুদ্ধি ও অহংকার যোগ হয়ে অপরাপ্রকৃতি সৃষ্টি হয়। জীবের মধ্যে স্থিত চেতনপুরুষই পরাপ্রকৃতি। অপরা ও পরা মিলেই বিশ্বজগতের সৃষ্টি। এটাই জ্ঞানবিজ্ঞান-যোগের বিষয়বস্তু।
অক্ষরব্রহ্ম-যোগ: ক্ষর অর্থ বিনাশ। অক্ষর মানে অবিনাশ। পরমেশ্বরের নির্গুণভাবই অক্ষর। তিনিই নিরাকার ব্রহ্ম। এখানে সেই ব্রহ্মতত্ত্ব, ব্রহ্মের উপাসনা এবং ব্রহ্মচিন্তার ফল সম্পর্কে বলা হয়েছে। অর্জুনকে যুদ্ধে উৎসাহী করতে এসব বিষয় আলোচিত হয়েছে।
রাজবিদ্যা-রাজগুহ্য-যোগ: রাজবিদ্যা অর্থ শ্রেষ্ঠবিদ্যা এবং রাজগুহ্য অর্থ শ্রেষ্ঠ রহস্যময় বিদ্যা। শ্রেষ্ঠ ও রহস্যময় বিদ্যাই এই যোগের আলোচ্য বিষয়। পরমেশ্বর সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ গুণে বশীভূত নন। এঁকে বলা হয় নির্গুণ ব্রহ্ম। আবার ভক্তের জন্য তিনি গুণের দ্বারা বশীভূত হন। তাঁকে বলা হয় সগুণ ব্রহ্ম। সেক্ষেত্রে তিনিই স্রষ্টা, তিনি সৃষ্টি। তিনিই কর্মকর্তা, তিনিই কর্মফলদাতা। পত্র-পুষ্প-ফলে, জলে ভক্তিসহকারে ভজনার দ্বারা তাঁকে লাভ করা যায়। ভগবানের এই উদার ও সর্বজনীন রূপ এখানে আলোচিত হয়েছে।
বিভূতিযোগ: বিভূতি শব্দের অর্থ মহিমাময় রূপ, বিবিধ সৃষ্টি। প্রকৃতির মাঝে পরমেশ্বর যে-রূপে বিরাজমান তাই তাঁর বিভূতি। গ্রহ, নক্ষত্র, আকাশ, বাতাস সবকিছুর মধ্যে তিনি রয়েছেন। দৃশ্যমান জগৎ তাঁর একটি অংশমাত্র। তাঁর পূর্ণ মহিমা অকল্পনীয়, অচিন্তনীয়।
বিশ্বরূপদর্শন-যোগ: বিশ্বরূপের অর্থ ভগবানের ঐশ্বরিক রূপ। তাঁর অনন্ত মস্তক, অনন্ত চক্ষু, অনন্ত চরণ। তাঁর আদি, অন্ত বা মধ্য নেই। স্থাবর-অস্থাবর, দেব-দানব জগতের সবকিছুই তাঁর মধ্যে রয়েছে। অর্জুন এসব দেখে ভীত হয়ে ভগবানকে সৌম্য মনুষ্যরূপ ধারণ করার জন্য প্রার্থনা করেন।
ভক্তিযোগ: ভগবানের প্রতি ভক্তের আন্তরিক ভালোবাসাই ভক্তি। ভক্তের কাছে তিনি সাকার রূপে আবির্ভূত হন। যিনি সকল জীবপ্রকৃতিকে ভালোবাসেন, দয়া করেন তিনিই শ্রেষ্ঠ ভক্ত। ভক্তির মাধ্যমে ভগবানকে পাওয়া সম্ভব। এগুলো ভক্তিযোগের মুখ্য আলোচ্য বিষয়।
ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞ-বিভাগযোগ: ক্ষেত্র অর্থ জমি। ক্ষেত্রজ্ঞ অর্থ জমি সম্পর্কে যিনি জানেন। সুখ-দুঃখের অনুভূতিযুক্ত শরীরই ক্ষেত্র এবং পরমেশ্বরই এর ক্ষেত্রজ্ঞ। এই জ্ঞান লাভ করলে অবিদ্যা নাশ হয়। মোক্ষ লাভ হয়।
গুণত্রয়-বিভাগযোগ: এখানে সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ তিন গুণের বৈশিষ্ট্য, গুণের দ্বারা আত্মার বন্ধনপ্রক্রিয়া, ত্রিগুণাতীতের বৈশিষ্ট্য, ভক্তকর্তৃক গুণকে অতিক্রম ও ব্রহ্মপ্রাপ্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
পুরুষোত্তম-যোগ: এখানে পুরুষদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বা উত্তম পুরুষ সম্পর্কে বলা হয়েছে। জীবপ্রকৃতির মধ্যে স্থিত পরিণামী পুরুষকে বলা হয় ক্ষরপুরুষ। আবার, নির্গুণ ব্রহ্মই অবিনাশী অক্ষর পুরুষ। ক্ষর ও অক্ষরের উর্ধ্বে যে পুরুষ তিনি পুরুষোত্তম। মোহমুক্ত হয়ে সেই পুরুষোত্তমের ভজনায় সর্বজ্ঞ হওয়া সম্ভব।
দৈবাসুরসম্পদ-বিভাগযোগ: দৈবিক ও আসুরিক ভাব সম্পর্কে এখানে বলা হয়েছে। নির্ভীকতা, চিত্তশুদ্ধি, সংযম, দান, সরলতা, অহিংসা, সত্য, অক্রোধ, ক্ষমা, ধৈর্য, শুচিতা ইত্যাদি দৈবীভাব। দম্ভ, অহংকার, অভিমান, ক্রোধ, নিষ্ঠুরতা ইত্যাদি আসুরিকভাব।
শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগযোগ: শ্রদ্ধা অর্থ বিশ্বাস বা আস্থা। সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক ভেদে শ্রদ্ধা তিন প্রকার। অনুরূপভাবে আহার, যজ্ঞ, তপস্যা ও দান- প্রতিটি তিনভাগে বিভক্ত। এই অধ্যায়ে শ্রদ্ধা, আহার, দানাদি বিষয়ে বিস্তৃতভাবে বলা হয়েছে। সাত্ত্বিক শ্রদ্ধা, সাত্ত্বিক আহার, সাত্ত্বিক দান অনুশীলনের জন্য অর্জুনকে এখানে উপদেশ দেওয়া হয়েছে।
মোক্ষযোগ: মোক্ষ অর্থ মুক্তি। ভগবানকে পাওয়ার মাধ্যমে মোক্ষ লাভ হয়। কায়মনোবাক্যে ভগবানের শরণ নিলেই ভক্তের মোক্ষলাভ বা ভগবৎপ্রাপ্তি হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ শুনে ভক্ত অর্জুনের মোক্ষ লাভ হয়েছিল। তিনি সংশয়শূন্য মনে ধর্মযুদ্ধ করতে সম্মত হন-এসব বিষয় এখানে বলা হয়েছে।
ছক ১.৮: গীতার যোগ
যোগের নাম | আমি যেভাবে কাজে লাগাব |
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
গীতার দর্শন
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপদেশের মধ্যে একটি দর্শন রয়েছে, যার প্রতিটি বিষয় মানবজীবনের জন্য অনুসরণীয়। সেসবের মধ্য থেকে কিছু বিষয় এখানে তুলে ধরা হলো
হতাশা বর্জন: আশাই জীবনের চালিকাশক্তি। আশাবাদী মানুষ বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে লক্ষ্য অর্জনের পথে অগ্রসর হয়। অন্যদিকে হতাশাগ্রস্ত মানুষ কাজের শুরুতেই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগে। যার ফলে সে ব্যর্থ হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাই অর্জুনকে যুদ্ধের শুরুতেই বিমর্ষভাব ত্যাগ করার উপদেশ দিয়ে বলেন-
ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ
নৈতত্ত্বয্যুপপদ্যতে
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যজোত্তিষ্ঠ
পরন্তপ ।।
(গীতা, ২/৩)
সরলার্থ: হে পার্থ, কাতর হয়ো না, এই কাপুরষতা তোমায় শোভা পায় না। তুচ্ছ হৃদয়ের দুর্বলতা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াও।
কর্মযোগের অনুশীলন: কর্মই জীবন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষকে কাজ করে যেতে হয়। কাজ না করে জীবন কাটানো সম্ভব নয়। কিন্তু কর্ম করলে মানুষকে ফলভোগ করতে হয়। ভালো কাজের জন্য ভালো ফল। মন্দ কাজের জন্য মন্দ ফল ভোগ করতে হয়। এক্ষেত্রে গীতার দর্শন হচ্ছে কর্মবিমুখ না হয়ে, কর্মের প্রতি মোহগ্রস্ত না হয়ে, কর্মফল ঈশ্বরে অর্পণ করে কাজ করতে হবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-
কর্মণ্যেবাধিকারন্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্মফলহেতুর্ভূমা তে সঙ্গোহস্তকর্মণি।।
(গীতা, ২/৪৭)
সরলার্থ: কর্মেই তোমার অধিকার, কর্মফলে কখনও নয়। কর্মফল লাভের আশায় তুমি কর্ম করো না, আবার কর্ম ত্যাগেও যেন তোমার প্রবৃত্তি না হয়।
গীতার পরিভাষায় এ ধরনের কর্মকে বলে নিষ্কাম কর্ম। যার অনুশীলনে মানুষকে মোহগ্রস্ত হতে হয় না। কোনো দুঃখকষ্টও তাকে ভোগ করতে হয় না।
প্রকৃত জ্ঞানের অনুশীলন: যা দ্বারা কোনো কিছু জানা যায় তাই জ্ঞান। জ্ঞান অনুশীলনের মাধ্যমে পৃথিবীর উন্নতি হয়েছে। জ্ঞানের মাধ্যমেই জীবন আলোকিত হয়। ভ্রান্ত জ্ঞানে জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। একজন প্রকৃত জ্ঞানীই নিষ্কাম কর্মের অনুশীলন করতে পারেন। মূঢ় বা অজ্ঞানী ব্যক্তির পক্ষে কর্মযোগী হওয়া সম্ভব নয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-
ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে।
তৎ স্বয়ং যোগসংসিদ্ধঃ কালেনাত্মনি বিন্দতি।।
(গীতা, ৪/৩৮)
সরলার্থ: এই জগতে জ্ঞানের মতো পবিত্র আর কিছু নেই। কর্মযোগে সিদ্ধপুরুষ সেই জ্ঞান কালক্রমে নিজের অন্তরে নিজেই লাভ করেন।
স্থিতপ্রজ্ঞ হওয়া: অশান্ত মনে কোনো জটিল বিষয়ের সমাধান হয় না। উল্টো সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হয়। সমাধানের জন্য প্রয়োজন শান্ত মন। শান্ত মনের মানুষ প্রতিকূল পরিবেশে যথার্থ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। গীতার পরিভাষায় ইন্দ্রিয়-নিয়ন্ত্রিত সংযমী শান্ত মনের মানুষকে স্থিতপ্রজ্ঞ বলা হয়েছে। 'যাঁর দুঃখে উদ্বেগ নেই, সুখের প্রতি স্পৃহা নেই, কাজের প্রতি যাঁর মোহ নেই, ক্রোধ বা বিশেষ ভীতি নেই তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ'। (গীতা, ২/৫৬) অতএব, সুখ-দুঃখের উর্ধ্বে উঠে মোহশূন্য শান্ত মনে কাজের জন্য এবং সঠিক সমাধানের জন্য মানুষকে স্থিতপ্রজ্ঞ হতে হবে।
মানবচরিত্রের উন্নয়ন: মানুষের চরিত্র কতগুলো বৈশিষ্ট্যের সমষ্টি, গীতার পরিভাষায় যাকে গুণ বলা হয়। সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ ভেদে তা তিন প্রকার। সত্ত্ব গুণ হলো সেই গুণ যা মানুষকে নির্মল সুখের অনুভূতি দেয়, সৃজনশীল করে, সঠিক চিন্তাভাবনা করতে সাহায্য করে। যা মানুষকে চঞ্চল করে, রাগ বাড়িয়ে দেয়, উত্তেজনা সৃষ্টি করে, তা রজঃ গুণ। যা মোহ সৃষ্টি করে, আলস্য বাড়িয়ে দেয়, ভ্রান্তি বাড়িয়ে দেয়, তা তমঃ গুণ।
যে-গুণের আধিক্য বেশি, ব্যক্তির চরিত্রে সেই বৈশিষ্ট্যই প্রকাশ পায়। একজন ভালো মানুষের সবকিছু ভালো, খারাপ মানুষের সবকিছু খারাপ, এমনটি নয়। নিজের সহপাঠী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের বিরূপ আচরণকে এই দৃষ্টিতে বিচার করলে মনে কোনো ক্ষোভ বা অস্বস্তি থাকে না। নিয়মিত সৎসঙ্গ, সৎকাজের সাথে যুক্ত থাকার মাধ্যমে গুণের পরিবর্তন করা সম্ভব। তমঃ থেকে রজঃ বা রজঃ থেকে সত্ত্ব গুণের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেরও পরিবর্তন করা সম্ভব। এই দর্শনকে অনুসরণ করে মানুষ তার চরিত্রের উন্নয়ন ঘটাতে পারে।
সর্বভূতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধি: ঈশ্বর আত্মারূপে সর্বভূতে বিরাজমান। গাছ-পালা, জীবজন্তু, প্রকৃতি সবকিছুর মধ্যে ঈশ্বর রয়েছেন। গীতার ভাষায়, “সর্বস্য চাহং হৃদি সন্নিবিষ্টঃ” (গীতা, ১৫/১৫)- আমি সকল জীবের হৃদয়ে প্রবেশ করি। এই দর্শন ধারণ করে সর্বজীবের মধ্যে আত্মাকে দর্শন করা যায়। ফলে মনের হিংসা ও পারস্পরিক বিভেদ লোপ পায়। গাছ-পালা, পশু-পাখি সবার প্রতি হৃদয়ে ভালোবাসা জন্মে। এতে বিশ্বজগতের কল্যাণ হয়।
পরমেশ্বরের প্রতি ভক্তি: প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে কোনো না কোনো কারণ থাকে। জগৎ সৃষ্টির মূল কারণ ঈশ্বর। পরমেশ্বর নিরাকার হলেও ভক্তের কাছে তিনি সাকার রূপে আবির্ভূত হন। ভগবানের প্রতি ভক্তের যে ভালোবাসা তাই ভক্তি। শ্রীকৃষ্ণের ভাষায়, 'পত্র, পুষ্প, ফল, জলসহ যে ভক্ত কামনাশূন্য হয়ে ভক্তিসহকারে আমার উপাসনা করে আমি তাঁর উপহার গ্রহণ করি'। (গীতা, ৯/২৬) অতএব, ভক্তির মাধ্যমে ভগবানকে লাভ করে পরম প্রশান্তি পাওয়া যায়।
ছক ১.৯: আমার বৈশিষ্ট্য
সত্ত্ব | রজঃ | তমঃ |
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
ছক ১.১০: গীতামৃত
১.
|
২.
|
৩.
|
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা একখানি অমূল্যগ্রন্থ। হিন্দুধর্মানুসারী মানুষের কাছে এর বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। কারণ গীতায় কর্ম ও জ্ঞানের সাথে ভক্তির সমন্বয় সাধন করা হয়েছে। ভক্তির মাধ্যমেও ভগবানকে পাওয়া যায়। সেই পথের সন্ধান গীতায় দেওয়া হয়েছে। গীতার প্রথম কথা- কর্তব্যকর্মের মাধ্যমে জীবন অতিবাহিত করা। কিন্তু কর্ম করলে জীবকে তার ফল ভোগ করতে হয়। এই অবস্থায় কর্মফল ঈশ্বরে অর্পণ করে কর্ম করে যাওয়াই গীতার উপদেশ। কর্মযোগের ভাষায় এ ধরনের আসক্তিশূন্য কর্মকে বলা হয় নিষ্কাম কর্ম। কিন্তু একজন অজ্ঞানীর পক্ষে নিষ্কাম কর্মের অনুশীলন সম্ভব নয়। জ্ঞান জাগরিত হলে ভ্রান্তজ্ঞান বিদূরিত হয়। তখন তিনি কর্মফল ঈশ্বরে সমর্পণ করে নিষ্কাম কর্ম করতে পারেন। জ্ঞানযোগের মতে, ঈশ্বরই কর্মফলের বিধাতা। তিনি অব্যয়, অক্ষয়, নিরাকার পরমব্রহ্ম, পুরুষোত্তম। প্রতিটি জীবের মধ্যে তিনি আত্মারূপে বিরাজ করেন। এই আত্মা জন্মে না, মরে না। অস্ত্র দিয়ে তাঁকে বিদ্ধ করা যায় না, আগুন দিয়ে পোড়ানো যায় না। শরীর নষ্ট হলেও আত্মা অবিনশ্বর। এই জ্ঞান জাগরিত হলে জীবের মধ্যে অজ্ঞানতা বা ভ্রান্তদর্শন থাকে না। তিনি প্রকৃত নিষ্কাম কর্মের অনুশীলনে পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
কিন্তু ভ্রান্তদর্শী মানুষের মনে প্রকৃত জ্ঞান জাগরিত হয় না। কী উচিত, কী অনুচিত- তা তিনি বুঝতে পারেন না। ফলে প্রকৃত সত্য নির্ধারণে ব্যর্থ মানুষ জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে হতাশাগ্রস্ত বা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে হতাশাগ্রস্ত অর্জুন তারই একটি প্রতীকী চরিত্র মাত্র। যুগে-যুগে, দেশে-দেশে, সমাজজীবনে, পারিবারিক জীবনে যুদ্ধ সর্বদা চলছে। এমনকি ব্যক্তির নিজের অন্তরের মধ্যেও যুদ্ধ চলমান। এই যুদ্ধ সুর-অসুর, সুন্দর- অসুন্দর, শুভ-অশুভের মধ্যে। এই অবস্থায় প্রকৃত কর্তব্য নির্ধারণের জন্য, সর্বোপরি সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য একজন প্রকৃত পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেই পথপ্রদর্শক। তিনি অর্জুনকে কর্মযোগের আলোচনার পরই জ্ঞানের কথা বলেছেন।
কর্ম ও জ্ঞানের পাশাপাশি ভক্তির মাধ্যমে পরমেশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করা সম্ভব। ভগবানের প্রতি ভক্তের গভীর শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসকেই ভক্তি বলে। পিতৃভক্তি, মাতৃভক্তি, প্রিয়জন-প্রীতি ইত্যাদি সার্বিক ক্ষেত্রে যে ভালোবাসা তার থেকে ঘনিষ্ঠতম আন্তরিক টান হলো ভগবানের প্রতি ভক্তের ভক্তি। গীতার দর্শন অনুসারে পরমব্রহ্ম নিরাকার হলেও ভক্তের আহ্বানে তিনি সাকার রূপে আবির্ভূত হন।
ভগবানের এই সাকার রূপের প্রমাণ দিতে গিয়ে গীতার অবতারতত্ত্বের প্রসঙ্গ এসেছে। অবতার অর্থ ভগবানের মনুষ্যরূপে জন্ম নেওয়া, অবতীর্ণ হওয়া। যখন যখন ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের বৃদ্ধি ঘটে, ভগবান তখন দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন তথা ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য অবতীর্ণ হন। অবতার পুরুষের আবির্ভাবের বাইরে ভক্তের প্রার্থনা অনসারে যেকোনো রূপে তিনি ভক্তের কাছে ধরা দেন। গীতার বিশ্বরূপদর্শন যোগে তার প্রমাণ দেওয়া হয়েছে। ভক্ত অর্জুনের প্রার্থনায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বিশ্বরূপ দর্শন করিয়েছেন। আবার সৌম্যশান্ত সখারূপেও তার কাছে ফিরে এসেছেন।
কর্ম ও জ্ঞানমার্গের উর্ধ্বে এই ভক্তিমার্গে অবস্থান। এখানে ভক্তের সার্বিক দায়িত্ব ভগবানেরই। ভগবান বলেছেন-
সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।
(গীতা, ১৮/৬৬)
সরলার্থ: সকল ধর্মাচরণ ত্যাগ করে তুমি একমাত্র আমার শরণ নাও। আমি তোমাকে সকল পাপ হতে মুক্ত করবো। শোক করো না।
ভক্তের কাছে ভগবানের এ ধরনের প্রতিশ্রুতি ও ভক্তের সর্বোত্তম প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!
কর্ম ও জ্ঞানযোগের পাশাপাশি ভক্তিমার্গের কথা তুলে ধরার কারণে গীতা তাই একটি অনন্য সাধারণ গ্রন্থ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জীবনযুদ্ধে উপস্থিত মানুষ এর বাণীকে অনুসরণ করে সার্বিক সমস্যার সমাধান পেতে পারে। এই সমাধান কর্মের পথে, জ্ঞানের পথে অথবা ভক্তের ভক্তির মাধ্যমে। এই স্বাতন্ত্র্যই গীতাকে আজ হিন্দু- ধর্মানুসারীসহ সারা বিশ্বের আলোকিত মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।
ছক ১.১০: জীবনোপদেশ
১.
|
২.
|
৩.
|