প্রতিটি জীবের জীবন শুরু হয় একটিমাত্র কোষ থেকে। বহুকোষী জীবের ক্ষেত্রে এককোষী জাইগোট বিভাজিত হয়ে বিভিন্ন টিস্যুতে রূপান্তরিত হয়ে পরিণত জীবদেহ গঠন করে। এককোষী জীবেরা কোষ বিভাজনের মাধ্যমে প্রজনন বা সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটায় । একটি কোষ বিভাজিত হয়ে দুটি কোষে পরিণত হওয়ার আগেই মাতৃকোষের DNA ডবল হেলিক্সটি দুটি ডবল হেলিক্সে পরিণত হয় যে প্রক্রিয়ায় একটি DNA ডাবল হেলিক্স থেকে একই রকম দুটি অণুর সৃষ্টি হয়, তাকে DNA-র রেপ্লিকেশন বা প্রতিলিপন বলে।) DNA-র প্রতিলিপি সৃষ্টিই কোষ বিভাজনের পূর্বশর্ত। ইন্টারফেজ পর্যায়ে বা সংশ্লেষণমূলক উপপর্যায়ে DNA তার প্রতিরূপ সৃষ্টি করে। কিন্তু কীভাবে DNA-র রেপ্লিকেশন সম্পন্ন হয় তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। লেভিয়েস্থান ও ক্রেন ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে DNA অণুর রেপ্লিকেশনের ব্যাপারে তিনটি সম্ভাব্য পদ্ধতি বা অনুকল্প প্রস্তাব করেন, যথা-
১. সংরক্ষণশীল,
২. অর্ধসংরক্ষণশীল এবং
৩. বিচ্ছুরণশীল।
১. সংরক্ষণশীল অনুকল্প বা পদ্ধতি (Conservative hypothesis) : এক্ষেত্রে রেপ্লিকেশনে সৃষ্ট দুটি DNA অণুর একটিতে দুটি সূত্রই পুরনো থাকে আর অন্যটিতে দুটি সূত্রই নতুন সংশ্লেষিত হয়।
২. অর্ধসংরক্ষণশীল অনুকল্প (Semi-conservative hypothesis) : এক্ষেত্রে রেপ্লিকেশনে সৃষ্ট দুটি DNA-র প্রত্যেকটিতেই একটি করে পুরনো সূত্র এবং একটি করে নতুন সংশ্লেষিত সূত্র থাকে ।
৩. বিচ্ছুরণশীল অনুকল্প (Dispersive hypothesis) : এক্ষত্রে রেপ্লিকেশনে সৃষ্ট দুটি DNA-র প্রত্যেকটিতেই স্থানে স্থানে কিছু পুরনো, কিছু নতুন সংশ্লেষিত অংশ যুক্ত থাকে ।
১৯৫৮ সালে মেসেলসন ও স্টাহল তেজস্ক্রিয় পরীক্ষার মাধ্যমে আদি কোষে (Ecoli) এবং ১৯৬০ সালে হাবার্ট টেইলর প্রকৃত কোষে DNA-এর প্রতিলিপন অর্ধ-সংরক্ষণশীল পদ্ধতিতে হয় তা প্রমাণ করেন। ১৯৬০ সালে সুয়েকা মানব হেলা কোষে এবং সাইমন ১৯৬১ সালে Chlamydomonas -এ অর্ধরক্ষণশীল পদ্ধতি প্রমাণ করেন।
অর্ধরক্ষণশীল প্রক্রিয়ায় DNA অণুর রেপ্লিকেশন বা প্রতিলিপিন যে প্রক্রিয়ায় মাতৃ DNA থেকে তার অনুরূপ DNA উৎপন্ন হয় তাকে রেপ্লিকেশন বলে। DNA অণুর রেপ্লিকেশন হয়ে থাকে অর্ধসংরক্ষণশীল পদ্ধতিতে (semiconservative method) অর্থাৎ নতুন সৃষ্ট ডাবল হেলিক্স-এর একটি হেলিক্স থাকবে পুরাতন এবং একটি হেলিক্স হবে নতুনভাবে সৃষ্ট। Mathew Messelson ও Franklin Stahl ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে এটি প্রতিষ্ঠিত করেন।
নিচে রেপ্লিকেশন প্রক্রিয়াটি সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো- রেপ্লিকেশন পদ্ধতিটি তিনটি দশায় বিভক্ত :
প্রারম্ভিক দশা
১. রেপ্লিকেশন শুরুর মূহুর্তে DNA হেলিক্সের সূত্রদুটি একটি নির্দিষ্ট স্থানে খুলতে শুরু করে এবং সূত্রের প্যাঁচ উন্মুক্ত হতে থাকে। DNA-এর (যে নির্দিষ্ট স্থান থেকে রেপ্লিকেশন শুরু হয় তাকে রেপ্লিকন (replicon) বলে) DNA অণুর দৈর্ঘ্য বরাবর এইরূপ রেপ্লিকন একাধিক থাকে। Ecoli ব্যাকটেরিয়াতে এই স্থানটিকে Origin of replication (Ori) বা অরি নামে চিহ্নিত করা হয়। এজন্য রেপ্লিকনকে প্রতিলিপনের সূচনা বিন্দু-ও বলে ।
২. প্রথমে এই স্থানে DNA-এর একটি সূত্রে কতগুলো প্রোটিন। D যুক্ত হয়। এই প্রোটিনগুলোকে SSBP (Single Stranded Binding Protein) বলে । প্রতি সূত্রের যে স্থানে SSBP আবদ্ধ হয়, সে স্থানে সূত্রদুটি উন্মুক্ত হয় এবং Y-আকৃতির ফর্ক (fork) গঠন করে। এই ফর্ককে রেপ্লিকেশন ফর্ক (replication fork) বলে ।
৩. এরপর DNA কার্যকারিতায় DNA সূত্রের বেসগুলোর মধ্যে হাইড্রোজেন বন্ডগুলো ভেঙ্গে যায়। এর ফলে সূত্রদুটি পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং রেপ্লিকেশন ফর্কের আকৃতি স্পষ্ট হয় ।
৪. পরবর্তী পর্যায়ে DNA" গাইরেজ (gyrase) এনজাইম সম্মুখের DNA সূত্রকের প্যাঁচকে একত্রিত হতে দেয়না। কিন্তু প্রতিলিপনকৃত পিছনের অংশের প্যাঁচ তৈরিতে সাহায্য করে।
৫. পৃথক হওয়া প্রতিটি সূত্র তার সম্পূরক সূত্র তৈরির ছাঁচ বা র টেম্পলেট (template) হিসেবে কাজ করে যার উপর পরিপুরক নতুন DNA সূত্র সংশ্লেষিত হয়।
৬. DNA সূত্রদুটি উন্মুক্ত হওয়ার সাথে নতুন নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি সম্ভব হয়না, কারণ DNA নিজে থেকে নতুন নিউক্লিওটাইড শৃঙ্খল তৈরি করতে পারে না।
৭. এ সময় প্রাইমেজ (primase) এনজাইম পৃথককৃত একটি সূত্রকে ছাঁচ হিসেবে ব্যবহার করে তার একটি অংশ ব্যবহার করে একটি RNA প্রাইমার ( RNA Primer) কয়েকটি ক্ষারকের সংক্ষিপ্ত সিকোয়েন্স। ছোট RNA খন্ডক অর্থাৎ RNA প্রাইমার DNA সূত্রের উন্মুক্ত স্থানে যুক্ত হয় । এরপর RNA প্রাইমার DNA পলিমারেজ দ্বারা উন্মুক্ত টেমপ্লেটে DNA নিউক্লিওটাইডগুলোকে (যেমন-dATP, dCTP, dGTP, dTTP) শৃঙ্খলিত করে।
সম্প্রসারণ দশা :
৮. প্রাইমার যুক্ত হওয়ার পর প্রাইমারের মুক্ত ৩ -OH প্রান্তে DNA পলিমারেজ এনজাইম এর প্রভাবে নিউক্লিওটাইডগুলো যুক্ত হতে থাকে এবং প্রতিলিপন কাজের সূচনা করে। এর ফলে নতুন DNA সূত্রটি দীর্ঘ হতে থাকে । মাতৃ DNA-এর উন্মুক্ত সূত্রদুটি টেমলেটের কাজ করে যার উপর পরিপুরক নতুন DNA সূত্র সংশ্লেষিত হয়।
৯. উৎস থেকে প্রতিলিপি গঠন একদিকে অথবা উভয়দিকে হতে পারে। একদিকে হলে তাকে একমুখী প্রতিলিপন এবং যখন উভয়দিকে এ প্রক্রিয়া ঘটে তখন তাকে দ্বিমুখী প্রতিলিপন বলে।
১০. প্রতিলিপন চলতে থাকলে রেপ্লিকেশন ফর্কও সরতে থাকে এবং দীর্ঘকরণ ৫ - তা অভিমুখে হতে থাকে। যে সূত্রের মেরুত্ব ৩' - ৫' তাতে DNA সূত্রের সংশ্লেষণ হয় ক্রমিক (continuous) এবং যে সূত্রের ৫-৩ মেরুত্ব, তাতে সংশ্লেষণ হয় অক্রমিক (discontinuous) ভাবে।
১১. (অক্রমিক প্রতিলিপিকরণ ঘটে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খন্ডকে। DNA-এর এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খন্ডকগুলো যার মেরুত্ব ৫' - ৩' তাদের ওকাজাকি (okazaki) খন্ডক বলে। বিজ্ঞানী Okazaki এর সমাধান দেন। তাই তাঁর নাম অনুসারে এই খন্ডকের নামকরণ করা হয়েছে।
১২. পরবর্তীতে লাইগেজ এনজাইমের সাহায্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খন্ডগুলো সংযুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ সূত্র গঠন করে।
১৩. পৃথককৃত DNA-র দুটি সূত্রের মধ্যে (যে সূত্রে নিরবিচ্ছিন্নভাবে অর্থাৎ ক্রমিক সংশ্লেষণ ঘটে ফর্কের দিকে বৃদ্ধি পেতে থাকে তাকে লিডিং সূত্র (leading strand) এবং যে সূত্রে DNA সংশ্লেষ ওকাজাকি খন্ডের মাধ্যমে অর্থাৎ নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রতিলিপন ঘটেনা খন্ড খন্ড ভাবে ঘটে তাকে ল্যাগিং সূত্র (lagging strand) বলে।
সমাপ্তি দশা
ল্যাগিং সূত্রে খন্ডগুলোর মাঝে ফাঁক পূরণ করে দেয় DNA লাইগেজ এনজাইম। ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খন্ডকগুলো সংযুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ সূত্র গঠন করে প্রতিলিপিত অংশকে নিরবিচ্ছন্নতা দান করে। অপত্য DNA দুটি বিপরীত প্রান্তে যুক্ত হয়ে দুটি ডবল হেলিক্স-এ পরিণত হয়ে প্রতিলিপন সমাপ্তি হয়।
Read more