Academy

দুজন সাদা মানুষ একবোঝা কী হাতে ঘরে ঢুকল?  

Created: 7 months ago | Updated: 7 months ago

সকালের খাবার দেবার পর দুজন সাদা মানুষ একবোঝা জামা কাপড় হাতে ঘরে ঢুকল। ভীত বন্দিদের বাঁধন খুলে দিয়ে সেগুলো কী করে পরতে হয় দেখিয়ে দেওয়া হলো। একটা বস্ত্রে পা থেকে কোমর পর্যন্ত, অন্য একটায় ঊর্ধ্বাঙ্গ ঢাকতে হয়। কুন্টার ঘা-গুলো সেরে এসেছিল। জামা-কাপড় পরামাত্র সেগুলো চুলকাতে শুরু করল। বাইরে লোকজনের কথাবার্তার কোলাহল ক্রমে বাড়ছিল। ক্রমশই লোক জমছিল। কুন্টারা জামাকাপড় পরে বিমূঢ় হয়ে বসেছিল- কী জানি এর পরে কপালে আছে!
সাদা মানুষদুটো ফিরে এসে প্রথমে রাখা বন্দিদের মাঝে তিনজনকে বার করে নিয়ে গেল। তারপরেই বাইরের আওয়াজের ধরনটা বদলে গেল। কুন্টা অবাক হয়ে কতকগুলো অবোধ্য চিৎকার শুনছিল। "নিখুঁত স্বাস্থ্য ! অফুরন্ত কর্মশক্তি।' অন্য কোনো সাদা মানুষের গলা

‘তিনশো পঞ্চাশ!’
‘চারশো !’
প্রথম সাদা মানুষটির চিৎকার শোনা গেলো, ‘ছয়! কে ছয় বলবেন? তাকিয়ে দেখুন। দুর্দান্ত কর্মক্ষমতা !” কুন্টা ভয়ে শিউরে উঠছিল। তার মুখ বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছিল । নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছিল । যখন চারজন সাদা মানুষ ঘরে ঢুকল—সে যেন অসাড় ! কুন্টাকে স্পর্শ করতে সে রাগে ভয়ে দাঁত খিঁচিয়ে উঠল ।
তখনই মাথায় একটা প্রবল আঘাত পেয়ে তার বোধশক্তি লুপ্ত হয়ে গেল। সচেতন হয়ে উঠতে দেখতে পেল—উজ্জ্বল দিবালোকে আরো দুজনের সঙ্গে সেও বাইরে লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে শত শত সাদা মানুষ হা-করে তাকিয়ে আছে। তারই মাঝে দুটো কালো মানুষ শিকল হাতে দাঁড়িয়ে। মুখের ভাব দেখে মনে হয়, পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে তারা একান্ত উদাসীন। চোখের দৃষ্টি সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত, লক্ষ্যহীন। ‘সদ্য গাছ থেকে পেড়ে আনা ৷'
‘বাঁদরের মতো তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন !
‘সবকিছু শিখিয়ে নেওয়া যাবে !”
সাদা মানুষটা পায়চারি করতে করতে হাত নেড়ে কুন্টার আপাদমস্তক নির্দেশ করে কথাগুলো চিৎকার করে বলছিল। তারপর কুন্টাকে জোর করে ঠেলে সামনে একটা বেদির মতো উঁচু জায়গায় ওঠাল। ‘একেবারে সরেস! নিজের ইচ্ছামতো গড়ে নেওয়া যাবে!
কুন্টা ভয়ে হতবুদ্ধি হয়ে লক্ষও করেনি কখন চারদিকের লোকজন এগিয়ে এসে তার সর্বাঙ্গে হাত বুলিয়ে পরীক্ষা
করছে।
‘তিনশো ডলার!’-‘তিনশো পঞ্চাশ!’
‘পাঁচশো!” “ছয়!’
সাদা মানুষটা ক্রুদ্ধ গর্জনে বলে উঠল—'বাজারের সেরা। তরুণ যুবা । কেউ কি সাড়ে সাত বলবেন? একজন চেঁচিয়ে উঠল—
“সাড়ে সাত!’
‘আট ! আট !’
ডাক উঠল—‘আট!' আর কেউ কিছু বলে ওঠার আগেই আবার শোনা গেল—'সাড়ে আট ।’ ডাক আর চড়ল না।
যে সাদামানুষটা এদিক থেকে চেঁচাচ্ছিল, সে কুন্টার শিকল খুলে নিয়ে তাকে সামনে একজনের দিকে ঠেলে দিল । এই নতুন সাদা মানুষটার পেছনে একজন কালো লোক। শিকলের প্রান্তটা তারই হাতে দেওয়া ছিল। তার প্রতি কুন্টার অনুনয়পূর্ণ চাহনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলো। সে লক্ষ্যহীন নির্বিকার দৃষ্টিতে কুন্টাকে শিকলসুদ্ধ টেনে একটা চার চাকার বাক্সের সামনে নিয়ে এল। বাক্সটার সামনে একটা বিরাট গাধাজাতীয় পশু। কালো লোকটা রূঢ়ভাবে কুন্টাকে বাক্সের মেঝেতে ঠেলে ফেলে দিয়ে শিকলটা কোথায় আটকে দিল। কিছুক্ষণ পরে কুন্টা গন্ধে অনুভব করল-সাদা মানুষটা ফিরে এসেছে। সে গাড়ির ওপরে চড়ে বসতে, কালো লোকটিও সামনের সিটের মাথায় উঠে বসে একটা চামড়ার ফিতে পশুটার পিঠে আছড়ে ফেলল । অমনি বাক্সটা গড়িয়ে চলতে শুরু করল।

কুন্টা শিকলটা ভালো করে পরীক্ষা করে দেখল । বড়ো ক্যানুতে তাদের যে শিকল দিয়ে বাঁধা হয়েছিল, তার থেকে এটা হালকা ধরনের। প্রাণপণে চেষ্টা করলে কি ছেঁড়া যাবে না? কিন্তু এখন গাড়ি থেকে লাফাবার উপযুক্ত সময় নয়।
কুন্টা একবার মাথা তুলে সাদা মানুষটার দিকে তাকাল। সেই মুহূর্তে সেও পেছন ফিরে তাকাতে তাদের চোখাচোখি হয়ে গেল । ভয়ে কুন্টার দেহ হিম। কিন্তু সাদা মানুষটার মুখে ভাবের লেশমাত্র ছিল না ।
পথের ধারে বিস্তৃত শস্যক্ষেত্র। বিভিন্ন রঙের শস্য দেখা যাচ্ছে। তার মাঝে ভুট্টা সে চিনতে পারল। জুফরেতে ফসল কাটবার সময় যেমন দেখতে হয়, তেমনি। খানিকক্ষণ পর সাদা মানুষ এবং কালোটি দুজনেই শুকনো রুটি আর মাংস বের করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগল । কুন্টার খুবই ক্ষিধে পেয়েছিল। খাদ্যের সুগন্ধে তার জিভে জল এসে গেল । তবুও সামনের কালো লোকটি যখন পেছন ফিরে তাকে এক টুকরো রুটি দিতে চাইল, সে তার মুখ ফিরিয়ে নিল।
সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। তাদের গাড়ির পাশ দিয়ে আর একটি গাড়ি বিপরীত দিকে ছুটে গেল। গাড়িটির পেছনে চরম ক্লান্তিভরে দ্রুত পদক্ষেপে চলছিল মোটা কাপড়ের পুরোনো ছেঁড়া পোশাক পরা সাতটি কালো মানুষ। তাদের মুখে গভীর হতাশার ছাপ। ক্রমে অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে কুন্টাদের গাড়িটা পাশের ছোটো রাস্তায় ঢুকে পড়ল । দূরে গাছের ফাঁকে একটা বিরাট সাদা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। এবার কী হবে? এখানেই কি তাকে হত্যা করে খাওয়া হবে?
বাড়িটার কাছে এসে কুন্টা আরো কালো মানুষের গন্ধ পেল। অন্ধকারের ভেতর তিনটি মানুষের আকার বোঝা যাচ্ছিল। একজনের হাতে আলো ঝোলানো। বড়ো ক্যানুর অন্ধকার খোলের ভেতর এ ধরনের আলো কুন্টা দেখেছে। কেবল এটার চারপাশে একটা স্বচ্ছ চকচকে আবরণ, তার ভেতর দিয়ে অবশ্য স্পষ্ট দেখা যায়। কালো লোকগুলোর পাশ দিয়ে একটা সাদা মানুষ এগিয়ে এল। গাড়িটা থেমে যেতে একজন আলোটা উঁচু করে ধরল। ভেতরের সাদা মানুষটা নেমে এসে নতুন লোকটার সঙ্গে করমর্দন করল। তারপর দুজনে হাসিমুখে বাড়ির দিকে চলে গেল ।
কুন্টার মনে একটু আশা হলো । এবার কালো লোকেরা তাকে ছেড়ে দেবে না? কিন্তু এ কেমন কালো লোক? তারা তাকে দেখে বিদ্রূপের হাসি হাসছে! নিজের স্বজাতির লোক নিয়ে এরা পরিহাস করছে? ছাগলের মতো সাদা মানুষের হুকুমে কাজ করে? এদের আফ্রিকাবাসীর মতো দেখাচ্ছে বটে, কিন্তু এরা কখনো তা হতে পারে না । গাড়িটা কুন্টাকে নিয়ে এগিয়ে গেল । অন্য কালো লোকগুলো হাসাহাসি করতে করতে পাশে পাশে চলল। কিছুদূর গিয়ে গাড়িটা থামতে, চালক নেমে এসে শিকলের অপর প্রান্ত খুলে রূঢ় ভঙ্গিতে টান মেরে কুন্টাকে নামতে ইঙ্গিত করল।
লোকগুলো জোর করে তাকে নামাল । তারপর একটা খুঁটির সঙ্গে শিকলটা আবার বেঁধে দিল । কুন্টা দৈহিক যন্ত্ৰণা, ত্রাস, ক্রোধ ও ঘৃণাতে কাতর হয়ে সেখানে পড়ে থাকল। একজন তার সামনে এক পাত্র জল ও এক পাত্র খাদ্য নামিয়ে রাখল। খাদ্যটা যেমন অদ্ভুত দেখতে, তেমনি অদ্ভুত তার গন্ধ । তবুও তা দেখেই কুন্টার রসনা

লালায়িত হয়ে উঠল। কিন্তু কুন্টা মুখ ফিরিয়েই থাকল। কালো লোকগুলো তা দেখে আবারও বিদ্রূপের হাসি হাসল। গাড়ির চালক আলোটা তুলে ধরে মোটা খুঁটির কাছে গিয়ে শিকলটা জোরে টেনে কুন্টাকে দেখিয়ে দিল—ওটা ছেঁড়া যাবে না। তারপর খাবারের দিকে ইঙ্গিত করে শাসানির ভঙ্গি করল। সবাই হাসতে হাসতে চলে গেল ।

 

কুন্টা অপেক্ষা করতে লাগল—কখন সবাই ঘুমোবে, কখন সে পালাবার সুযোগ পাবে। এরই মধ্যে একটা কুকুর এসে তার খাবারের পাত্র খালি করে দিয়ে গেল। রোষে কুন্টার সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল। সে খানিকটা জলপান করে নিল। কিন্তু তাতে শারীরিক অবস্থার বিশেষ উন্নতি হলো না ।
পালাবার অদম্য ইচ্ছা অতি কষ্টে দমন করে সারারাত সে জেগে কাটাল। সে জানে শিকল ভাঙবার চেষ্টা করলেই ঝনঝনানির শব্দে পাশের কুটিরের লোক ছুটে আসবে। ইতোমধ্যেই কুকুরের ডাকে গাড়ির চালকটি একবার বেরিয়ে এসে শিকল পরীক্ষা করে গিয়েছে।

 

পুবের আকাশ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছিল । কুন্টা আর একটু জল পান করল । এমন সময় সেই কালো লোক চারটে দ্রুত পায়ে এসে কুন্টাকে টেনে তুলে আবার সেই গড়ানো বাক্সের মতো গাড়িটাতে চড়ে বসল। তারপর গাড়ি বড় রাস্তা দিয়ে আগের দিনের মতই চলল । কুন্টার দুই চক্ষু অপরিসীম ক্রোধ ও ঘৃণায় সামনের মানুষগুলোর পিঠের ওপর অগ্নিবর্ষণ করতে থাকল । যদি এদের খুন করা যেত! কিন্তু বুদ্ধি স্থির রাখতে হবে । মাথা গরম করলে চলবে না। অযথা শক্তি ক্ষয় করে লাভ নেই ।
কিছু দূর গিয়ে ঘন বন দেখা গেল। কতক জায়গায় গাছ কেটে জঙ্গল সাফ করা হয়েছে। আবার কিছু জায়গায় জঙ্গল পোড়ানো হচ্ছে। ধূসর বর্ণ ধোঁয়ার রাশি উঠছিল। সাদা মানুষরাও কি জুফরের মতো গাছপালা পুড়িয়ে জমির ফলন শক্তি বৃদ্ধি করে?

আরো খানিকটা দূরে কাঠের তৈরি একটি ছোট্ট চৌকো কুটির, আর তার সামনে পরিষ্কার একখণ্ড জমি । একটা ষাঁড়ের পেছনে বাঁকানো হাতলওয়ালা কী একটা মস্ত জিনিস। একজন সাদা মানুষ হাতল দুটো চেপে ধরেছে। তাতে পেছনের মাটি বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আরো দুটো রোগামতন সাদা মানুষ গাছের নিচে উবু হয়ে আছে। তিনটে রোগা-পটকা শুয়োর আর কিছু মুরগি চারপাশে ছুটোছুটি করছে। কুটিরের দরজায় একটি লাল চুলের সাদা মেয়ে মানুষ। তিনটে সাদা বাচ্চা খেলে বেড়াচ্ছিল। তারা গাড়িতে কুন্টাকে দেখে হাত নেড়ে চেঁচাতে লাগল । কুন্টার ভাব দেখে মনে হলো সে হায়েনা শিশু দেখছে! এতদিনে সে সত্যি একটি সাদা মানুষের পুরো পরিবার দেখতে পেল। পথে যেতে যেতে আগেকার মতো আরো দুটি মস্ত সাদা বাড়ি দেখা গেল । প্রত্যেকটির ওপর দিকে একটার ওপর আর একটা চাপানো—দুটো বাড়ির সমান। প্রত্যেকটিরই কাছাকাছি বেশ কিছু ছোটো ছোটো অন্ধকার কুটির। কুন্টা আন্দাজ করল—সেগুলোতেই কালো লোকেদের বাস। আর চারপাশ ঘিরে বিস্তীর্ণ তুলোর খেত ৷ অল্পদিন আগে ফসল তোলা হয়েছে। তখনও গোছা-গোছা তুলো চারদিকে ছড়ানো-ছিটানো ।

 

Content added By

Related Question

View More