'রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন'- এ মতাদর্শে কোন চেতনা বিরাজ করবে?

Created: 10 months ago | Updated: 10 months ago
Updated: 10 months ago

দ্বিতীয় অধ্যায়

হিন্দুধর্মের বিশ্বাস, উৎপত্তি ও বিকাশ প্রথম পরিচ্ছেদ : হিন্দুধর্মের বিশ্বাস

গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে হিন্দুধর্ম বিশ্বাসসমূহের মধ্যে ঈশ্বরে বিশ্বাস হচ্ছে মৌল বিশ্বাস । ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, সর্বত্র বিরাজিত, তিনি এক, অভিন্ন, অনন্য পরমসত্তা। তিনি নিরাকার, তবে প্রয়োজনে সাকার রূপ ধারণ করতে পারেন। যেমন – ঈশ্বরের অবতারগণ ।

এঁদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য পূজা-অর্চনার অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। আমরা জানি ঈশ্বরের কোনো গুণ বা শক্তিকে ঈশ্বর যখন আকার দেন, তখন তাঁকে দেবতা বা দেব-দেবী বলে। তবে দেব-দেবী ও অবতারগণ সবাই এক পরমেশ্বরের বিভূতি এবং শক্তির প্রকাশক। দেব-দেবীর আরাধনার মধ্য দিয়ে শুরু ঈশ্বরের করুণা পেয়ে থাকে। কেননা, ঈশ্বরের বিভিন্ন শক্তির প্রকাশ হিসেবে দেব-দেবীর আবির্ভাব। আর অবতাররূপে তো স্বয়ং ভগবানই পৃথিবীতে নেমে আসেন। তাই বিভিন্ন অবতার ও দেব-দেবী একই ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের সাকার রূপ ।

হিন্দুধর্মে জীবনকে সার্থক ও গৌরবময় করার জন্য ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস এই চক্ষুরাশ্রম বা চারটি স্তরের কথা বলা হয়েছে। কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ- এর যে কোনো একটি নিষ্ঠার সঙ্গে অনুশীলন করলেই মানুষ মুক্তিলাভ করতে পারে। হিন্দুধর্মাবলম্বীরা সাধন জীবনের এই স্তরগুলো জেনে অনুশীলন করে জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করে ভুলতে পারেন।

এ পরিচ্ছেদে হিন্দুধর্মের বিশ্বাস মতে একেশ্বরবাদ, অবতারবাদ, চতুরাশ্রম, যোগ এবং কর্ম, জ্ঞান ও অভিযোগের ধারণার প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে।

এ অধ্যার শেষে আমরা শিখতে পারবোঃ

  • মৌলিক বিশ্বাস হিসেবে একেশ্বরবাদের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব
  • অবতারবাদের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব
  • বিভিন্ন অবতার, দেব-দেবী, প্রভৃতি একই ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের প্রকাশ বা সাকার রূপ অর্থাৎ হিন্দুধর্ম মুলত যে একেশ্বরবাদী-এ ধারণাটি ব্যাখ্যা করতে পারব
  • চক্ষুরাশ্রমের ধারণা (ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস) ব্যাখ্যা করতে পারব
  • যোগের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব
  • কর্ম, জ্ঞান ও অভিযোগের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব
  • ধর্মবোধে জাগ্রত হব এবং ধর্মাচরণে উদ্বুদ্ধ হব।

 

 

 

 

পাঠ ১ : একেশ্বরবাদ

হিন্দুধর্মানুষ্ঠান ও ধর্মাচার পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, সেখানে যেমন রয়েছে একেশ্বরের চিন্তা, ধ্যান- ধারণা, তেমনি রয়েছে বিভিন্ন অবতার এবং বহু দেব-দেবীর উপাসনা ও পূজা-অর্চনার কথা ।

এভাবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, হিন্দুধর্মাবলম্বীরা কি বহু ঈশ্বরবাদী? এ প্রশ্নের উত্তর হিন্দুধর্মগ্রন্থেই রয়েছে।

 

বেদ ও উপনিষদে বলা হয়েছে, ব্রহ্ম বা ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় । তিনি একাধিক নন। এই যে এক ঈশ্বরে বিশ্বাস, একেই বলে একেশ্বরবাদ। প্রচলিত বহু দেব-দেবীর উপাসনা হিন্দুধর্মের একটি বিশেষ দিক। তবে দেব-দেবীগণ ঈশ্বরেরই ভিন্ন ভিন্ন শক্তি বা গুণের অধিকারী ।

ঋগবেদে ইন্দ্ৰ, অগ্নি, বায়ু, ঊষা প্রভৃতি দেব-দেবীর স্তুতি রয়েছে। এঁরা ভিন্ন ভিন্ন শক্তির পরিচয় বহন করলেও এঁদের সম্মিলিত শক্তির কেন্দ্রটি হচ্ছেন ঈশ্বর। ঋগ্‌বেদে এ সম্পর্কে ঋষিদের উপলব্ধি হচ্ছে : 'একং সদ বিপ্রা বহুধা বদন্তি' ।

অর্থাৎ সদৃবস্তু এক, বিপ্রগণ তাঁকে বহুপ্রকার বলে বর্ণনা করেন। অনুরূপভাবে, কঠোপনিষদে দেখা যায় 'নেহ নানাস্তি কিঞ্চন’(কঠ ২/১/১১) ব্রহ্ম থেকে পৃথক কিছু নেই। ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয়। বিশ্বে ঈশ্বরের সমান আর কেউ নেই । শ্রীমদ্‌ভগবদ্গীতাতেও একেশ্বরের কথা বলা হয়েছে। 'প্রভবঃ প্রলয়ঃ স্থানং নিধান‍ বীজমব্যয়ম্’- (গীতা-৯/১৮) । এ কথার তাৎপর্য হচ্ছে - তাঁর থেকে জগতের উৎপত্তি, তাঁর দ্বারা স্থিতি এবং তাঁতেই হচ্ছে লয় । তিনিই জগতের নিধান - আধার ও আশ্রয় ।

সুতরাং অবতার ও দেব-দেবীগণ এক পরমেশ্বরেরই ভিন্ন ভিন্ন গুণ ও শক্তির প্রকাশ। এ কারণে উল্লেখ্য, দেব- দেবীর আরাধনা করে মানুষ যে সাফল্য অর্জন করে তাতে এক ঈশ্বরের অনুগ্রহের প্রকাশ ঘটে।

 

 

 

 

হিন্দুধর্মের বিশ্বাস, উৎপত্তি ও বিকাশ

২১

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বহুমুখী সাধনার মধ্যেও দেব-দেবীর আরাধনা ও ব্রহ্ম সাধনার মধ্যে এক সমন্বয় চেতনা রয়েছে । সাকার দেবী কালীও যিনি, নিরাকার এক ব্রহ্মও তিনি । যিনি কালী, তিনি ব্রহ্ম ।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, হিন্দুধর্মে বহু দেব-দেবীর পূজা-অর্চনার বিভিন্ন পদ্ধতি অনুশীলিত হলেও মূলত এক পরমেশ্বরেরই উপাসনা করা হচ্ছে । সুতরাং অবতার ও দেব-দেবী একই ঈশ্বরের বিভিন্ন প্রকাশ, ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়- এ বিশ্বাসকে বলা হয় একেশ্বরবাদ । এভাবে একেশ্বরবাদ হিন্দুধর্মের একটি বিশ্বাস এবং হিন্দুধর্মাবলম্বীদের একেশ্বরবাদী বলা যায় ।

পাঠ ২ ও ৩ : অবতারবাদ

 

হিন্দুধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অবতারবাদে বিশ্বাস । অবতার-এর অর্থ হচ্ছে উপর থেকে নিচে নামা

বা অবতরণ করা । স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিকে রক্ষা করার জন্য ধর্ম অনুশীলনের ব্যবস্থা রেখেছেন । ধর্মের অসাধারণ গুণ । ধর্মকে যিনি রক্ষা করেন, ধর্ম তাকে রক্ষা করে ‘ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ । তবে মনুষ্যসমাজে মাঝে মাঝে ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা দেখা দেয় । ধার্মিকদের জীবনে নেমে আসে

নিপীড়ন-নির্যাতন । দুষ্কৃতকারীদের অত্যাচার-অনাচার সমাজজীবনকে কলুষিত করে তোলে । এরূপ

অবস্থায় ভগবান স্বয়ং জীব মূর্তি ধারণ করে পৃথিবীতে নেমে আসেন । একেই বলা হয় অবতার । আর

অবতার সম্পর্কে যে দার্শনিক চিন্তা-ভাবনা, তা অবতারবাদ নামে পরিচিত ।

অবতারের উদ্দেশ্য দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ সাধন, সাধু-সজ্জনদের দুঃখ-কষ্ট লাঘব এবং ধর্ম সংস্থাপন করা । এই অবতারবাদের সূচনা লক্ষ করা যায় পৌরাণিক যুগে । অনন্ত শক্তিধর ঈশ্বর জীবের ন্যায় দেহ ধারণ করে আবির্ভূত হন । এই আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে অবশ্য অসীম ঈশ্বরের ধারণায় কোনো ছেদ ঘটে না ।

ঈশ্বর হচ্ছেন চৈতন্যময় সত্তা। তিনি চৈতন্যস্বরূপ। তিনি অসীম সসীম সকল অবস্থাতেই থাকতে পারেন । কাজেই অবতার সসীম হয়ে দেহ ধারণ করে এলেও তার মধ্যে ঐশ্বরিক শক্তি থাকে । জীবদেহ ধারণ করলেও তিনি এবং জগৎ কারণ ব্রহ্ম এক এবং তাঁর এই স্থূল দেহ ধারণ একটি মায়ার খেলা মাত্র ।

এই অবতার তিন পর্যায়ের হয়ে থাকে। যথা- গুণাবতার, লীলাবতার ও আবেশাবতার। পরমেশ্বর ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর এই তিন দেবতারূপে অবতীর্ণ হয়ে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহার করেন । এরা পরমেশ্বরের গুণাবতার । আবার পৃথিবীতে মৎস্য, কূর্ম, বরাহ প্রভৃতি স্থূল দেহধারী জীবের মূর্তিতে অবতীর্ণ হয়ে তাঁরা যে কর্মকাণ্ড করেন তাকে লীলাবতার বলা হয়। শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমেশ্বরের জ্ঞানাদি শক্তির দ্বারা আবিষ্ট । এ মহাপুরুষেরা আবেশাবতার । বিষ্ণুর দশাবতারের কথা বলা হয়েছে। এঁরা হলেন- মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম (শ্রীরামচন্দ্র), বলরাম, বুদ্ধ এবং কল্কি ।

পৌরাণিক কাহিনি থেকে জানা যায়, বেদ প্রলয় পয়োধি জলে নিমগ্ন হলে ভগবান বিষ্ণু মৎস্যরূপ ধারণ করে বেদ উদ্ধার করেন । এরপর পৃথিবী জলপ্লাবিত হলে কূর্মরূপে ভগবান পৃথিবীকে পৃষ্ঠে ধারণ করেন । এটি কূর্মাবতার । পুনরায় পৃথিবী জলপ্লাবিত হলে ভগবান বরাহরূপে পৃথিবীকে দন্তে ধারণ করেন ।

 

 

 

 

নৃসিংহরূপে অবতীর্ণ হয়ে তিনি অত্যাচারী দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুকে বধ করেন এবং রক্ষা করেন ভক্ত প্রহলাদকে । ভগবান বামনরূপে অবতীর্ণ হয়ে রাজা বলির দর্প চূর্ণ করেন । ক্ষত্রিয় প্রতাপে পৃথিবী নিপীড়িত হলে তিনি পরশুরামরূপে পৃথিবীকে একুশবার ক্ষত্রিয়হীন করেন। অত্যাচারী রাজা রাবণের বিনাশ সাধন করেন শ্রীরামচন্দ্র অবতার । হলধর বলরাম হল কর্ষণ করে পৃথিবীকে অমৃতময় করেন। একইসঙ্গে তিনি অন্যায়কেও দমন করেন । বুদ্ধরূপে তিনি অহিংসা, সাম্য, মৈত্রী ও করুণার নৈতিক শিক্ষায় সকলকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াসী হন। কলিযুগের শেষ ভাগে যখন অধর্ম ও অসত্যের প্রভাব প্রকট হয়ে উঠবে তখন বিষ্ণু কল্কিরূপে অবতীর্ণ হয়ে জগতে ধর্ম ও সত্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন। অবতারের সংখ্যা অবশ্য নির্ণয় করা সম্ভব নয়। শ্রীমদ্‌ভাগবত পুরাণে বলা হয়েছে, অবতার অসংখ্য। এখানে প্রধানত দশ অবতারের কথা বলা হয়েছে।

দশ অবতারের মধ্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্ভুক্ত নন। তিনি স্বয়ং ভগবান। তাই তাঁকে বলা হয় মহা- অবতারী । দশ অবতারের মধ্য দিয়ে তাঁরই শক্তির প্রকাশ ঘটেছে । কবি জয়দেব রচিত 'গীতগোবিন্দ' কাব্যে কৃষ্ণপ্রশস্তিতে বলা হয়েছে-

“বেদকে তুমি করেছ উদ্ধার, বহন করেছ পৃথিবীর ভার, দশন শিখরে ধারণ করেছ মেদিনী, দৈত্যের অত্যাচার থেকে করেছ তাকে মুক্ত, চূর্ণ করেছ ছলে বলির দর্প, মুক্ত করেছ ধরণীকে ক্ষত্রিয়ের অত্যাচার থেকে, জয় করেছ দুর্জয় দশাননকে, শ্যামল করেছ মেদিনীকে হল কর্ষণ করে, মুক্ত অন্তরে বিলিয়েছ করুণা, তুমিই আবার আসবে ম্লেচ্ছ নিধনকল্পে, দশমূর্তিধারী হে কৃষ্ণ, তোমাকে প্রণাম ।”

সুতরাং মৎস্য, কূর্ম, বামন প্রভৃতি ভগবানের অংশ অবতার । শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের পূর্ণ অবতার। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণরূপে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন । তাই শ্রীমদ্‌ভাগবতে বলা হয়েছে, ‘কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম্’— শ্ৰীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান ।

 

 

 

 

নৃসিংহরূপে অবতীর্ণ হয়ে তিনি অত্যাচারী দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুকে বধ করেন এবং রক্ষা করেন ভক্ত প্রহলাদকে । ভগবান বামনরূপে অবতীর্ণ হয়ে রাজা বলির দর্প চূর্ণ করেন । ক্ষত্রিয় প্রতাপে পৃথিবী নিপীড়িত হলে তিনি পরশুরামরূপে পৃথিবীকে একুশবার ক্ষত্রিয়হীন করেন। অত্যাচারী রাজা রাবণের বিনাশ সাধন করেন শ্রীরামচন্দ্র অবতার । হলধর বলরাম হল কর্ষণ করে পৃথিবীকে অমৃতময় করেন। একইসঙ্গে তিনি অন্যায়কেও দমন করেন । বুদ্ধরূপে তিনি অহিংসা, সাম্য, মৈত্রী ও করুণার নৈতিক শিক্ষায় সকলকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াসী হন। কলিযুগের শেষ ভাগে যখন অধর্ম ও অসত্যের প্রভাব প্রকট হয়ে উঠবে তখন বিষ্ণু কল্কিরূপে অবতীর্ণ হয়ে জগতে ধর্ম ও সত্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন। অবতারের সংখ্যা অবশ্য নির্ণয় করা সম্ভব নয়। শ্রীমদ্‌ভাগবত পুরাণে বলা হয়েছে, অবতার অসংখ্য। এখানে প্রধানত দশ অবতারের কথা বলা হয়েছে।

দশ অবতারের মধ্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্ভুক্ত নন। তিনি স্বয়ং ভগবান। তাই তাঁকে বলা হয় মহা- অবতারী । দশ অবতারের মধ্য দিয়ে তাঁরই শক্তির প্রকাশ ঘটেছে । কবি জয়দেব রচিত 'গীতগোবিন্দ' কাব্যে কৃষ্ণপ্রশস্তিতে বলা হয়েছে-

“বেদকে তুমি করেছ উদ্ধার, বহন করেছ পৃথিবীর ভার, দশন শিখরে ধারণ করেছ মেদিনী, দৈত্যের অত্যাচার থেকে করেছ তাকে মুক্ত, চূর্ণ করেছ ছলে বলির দর্প, মুক্ত করেছ ধরণীকে ক্ষত্রিয়ের অত্যাচার থেকে, জয় করেছ দুর্জয় দশাননকে, শ্যামল করেছ মেদিনীকে হল কর্ষণ করে, মুক্ত অন্তরে বিলিয়েছ করুণা, তুমিই আবার আসবে ম্লেচ্ছ নিধনকল্পে, দশমূর্তিধারী হে কৃষ্ণ, তোমাকে প্রণাম ।”

সুতরাং মৎস্য, কূর্ম, বামন প্রভৃতি ভগবানের অংশ অবতার । শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের পূর্ণ অবতার। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণরূপে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন । তাই শ্রীমদ্‌ভাগবতে বলা হয়েছে, ‘কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম্’— শ্ৰীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান ।

 

 

 

 

 

 

 

ঈশ্বরের পূর্ণ স্বরূপ মানুষের ধারণার অতীত । তবে অবতার পুরুষের মাধ্যমে মানুষ ঈশ্বরের স্বরূপ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করতে পারে । ঈশ্বর সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞ, সর্বত্র বিরাজিত। অবতাররূপে দেহ ধারণ করে অসীম, অনন্ত সসীমরূপ ধারণ করে থাকেন। তাই হিন্দুদের নিকট অবতার স্বয়ং ভগবানেরই এক মুক্ত প্রকাশ । আর এ জন্যই হিন্দুরা অবতারকে ভগবৎ-শক্তির আশ্রয় হিসেবে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন অবতার ও দেব-দেবী একই ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের প্রকাশ বা সাকার রূপ। এ অর্থে হিন্দুধর্ম মূলত একেশ্বরবাদী ।

পাঠ ৪ ও ৫ : চতুরাশ্রম

হিন্দুধর্মের দুইটি দিক প্রত্যক্ষ করা যায় : ব্যবহারিক ও পারমার্থিক । ব্যবহারিক জীবনের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিক বা পরমার্থিক উন্নয়নের লক্ষ্য থাকে। ধর্মের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে শাস্ত্রে বলা হয়েছে, যা 

থেকে অভ্যুদয় অর্থাৎ সাংসারিক উন্নতি ও নিশ্চিত মঙ্গল লাভ হয় তার নাম ধর্ম। এ থেকে বোঝা যায়, হিন্দুধর্মের ঋষিগণ মানব জীবনকে বিকশিত ও সার্থক করে তোলার জন্য সচেষ্ট ছিলেন ।

স্বাভাবিকভাবে মানুষের জীবিত থাকার সময় ধরা হয় একশত বৎসর । এই শত বর্ষের জীবনকে চারটি স্তরে বা আশ্রমে বিভক্ত করা হয় । প্রতিটি বিভাগের সময়সীমার গড় পঁচিশ বছর । প্রথম পঁচিশ বছরকে বলা হয় ব্রহ্মচর্য আশ্রম । দ্বিতীয় পঁচিশ বছর গার্হস্থ্য আশ্রম। তৃতীয় পঁচিশ বছর বানপ্রস্থ আশ্রম এবং শেষ পঁচিশ বছরকে সন্ন্যাস আশ্রম বলা হয় ।

 

 

 

 

 

১. ব্রহ্মচর্যাশ্রম

প্রতিটি আশ্রমেই সুনির্দিষ্ট কর্তব্য কর্ম রয়েছে। মানুষের পাঁচ বছর বয়স হলেই তাকে গুরুগৃহে গমন করে ব্রহ্মচর্য জীবন শুরু করতে হয়। শুরুর নিকট দীক্ষাগ্রহণ এবং গুরুর তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করতে হয়। এটাই ব্রহ্মচর্যাশ্রম। এ আশ্রমে থেকে শিষ্যকে তরুর নির্দেশে বহু শাস্ত্র অধ্যয়ন, আত্মসংযম, পরিশ্রম জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হয় ।

বিদ্যাশিক্ষা সমাপ্ত হলে গুরুর নির্দেশে নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করে ব্রহ্মচারী গার্হস্থ্য জীবনে প্রবেশ করে।

বিবাহের মাধ্যমে সন্তান- সপ্ততি লাভ এবং তাদের ভরণ-পোষণসহ পারিবারিক জীবনে প্রতিদিন পাঁচটি যজ্ঞ কর্মের অনুশীলন করতে হবে। এই পাঁচটি যজ্ঞ হচ্ছে। পিতৃষজ্ঞ, দৈবযজ্ঞ, ভূতযজ্ঞ, নযজ্ঞ ও ঋষিষজ্ঞ । মানুষ জন্মগ্রহণ করে মাতা-পিতার মাধ্যমে। মাতা-পিতার তত্ত্বাবধানে সেবা-যার বড় হতে থাকে। মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি, সেবা যত্ন সন্তানের প্রধান কর্তব্য আর এ কর্তব্যগুলো সম্পাদন করার মাধ্যমে একজন সন্তান পিতৃযজ্ঞ সম্পন্ন করে থাকে ।

মানুষের জীবন ধারণের জন্য প্রকৃতির দান গ্রহণ করতে হয় । এই দানের কর্তা বা উৎস হলেন স্বয়ং ভগবান। প্রকৃতির মধ্য দিয়ে ভগবানের মহত্ত্ব প্রকাশিত। তাই প্রকৃতিদত্ত বা ভোগ করার সময় মানুষ কৃতজ্ঞ চিত্তে প্রকৃতি ভগবানকে তার ভোগ্যবস্তু নিবেদন করে থাকে। এই কর্মটিকে বলা হয় দৈবস। ভূষদ্ধ হচ্ছে পাখিসহ অন্যান্য জীবজার আহার প্রনানসহ নানা প্রকার পরিচর্যা। অতিথি সেবাকে বলা হয় नृয। পদ্ধতিগতভাবে বেদসহ প্রয়োজনীয় গ্রন্থাদি পাঠের যারা জ্ঞান ও নৈতিকতা অর্জনের প্রচেষ্টাকে বলা হয় ঋষিযজ্ঞ । প্রাচীনকালে মুনিঋষিদের নিকট থেকে টাজ জ্ঞান অর্জন করতে হতো বলে এ যজ্ঞের নাম ঋধি ।

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। জীবনের প্রয়োজনীয় অনেক দ্রব্যই সমাজের নিকট থেকে সংগ্র করতে হয়। মানুষ তার দৈনন্দিন চাহিদা যেমন- খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ইত্যাদি সমাজের ভিন্ন ভিন্ন লোকের নিকট থেকে পেয়ে থাকে। সামাজিক চাহিদার কারণে মানুষ মঠ, মন্দির, উপাসনালয়, বিদ্যালয় এবং চিকিৎসালয় ইত্যাদি স্থাপনের মধ্য দিয়ে সেবাধর্ম অনুশীলন করে। এ সম কর্মের মধ্য দিয়ে সমাজের প্রতি তার কর্তব্য সম্পাদন করে। এটিকেই বলা হয় গার্হস্থ্য আশ্রমের কর্ম। ব্রহ্মচর্য শেষে বিবাহ করে সংসারধর্ম পালন গার্হস্থ আশ্রমের অন্তর্গত।

 

 

 

 

 

 

 

৩. বানপ্রস্থ আশ্রম

তৃতীয় পর্যায়ে আসে বানপ্রস্থ আশ্রমের কথা । সেখানে মানুষ সংসারের দায়-দায়িত্ব সন্তানের উপর ন্যস্ত করে নির্জন পরিবেশে অবসর জীবনযাপন করে । এখানে সংসার জীবনের সঙ্গী স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে থাকতে পারেন তবে তাঁদের জীবন চর্চায় সংযম, ত্যাগ, নির্লোভ আচরণের বিধান থাকে । বানপ্রস্থে বনে যাওয়ার বিধান থাকলেও সভ্যতার অগ্রগতিতে মানুষ বনবাসী না হয়ে গৃহ ত্যাগ করে কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সেবা বা পূজা-অর্চনার মাধ্যমে বৈরাগ্যময় জীবন-যাপন করতে পারে । এ পর্যায়ে ভজন, পূজন, কীর্তন, জপ, ধ্যান প্রভৃতি ধর্মীয় কর্মে মগ্ন থেকে বানপ্রস্থের জীবনস্তর কাটানো যায় ।

৪. সন্ন্যাস

আশ্রম জীবনে চতুর্থ পর্যায়ে আসে সন্ন্যাসের কথা। এ সময় পঁচাত্তর থেকে একশ বছরের মধ্যে জীবন ধারণের শাস্ত্রীয় নির্দেশ আছে । সন্ন্যাস শব্দের অর্থ সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ । এই আশ্রমে এসে সন্ন্যাসী একাকী জীবনধারণ করবেন । এ সময় সন্ন্যাসীদের সঙ্গে তার স্ত্রীও থাকবেন না। সন্ন্যাসী জাগতিক সকল কর্ম পরিত্যাগ করে কেবল ঈশ্বর চিন্তাতেই মগ্ন থাকবেন । মাত্র দুপুর বেলার আহারের সামগ্রী লোকালয় থেকে সংগ্রহ করবেন । বাকি দুবেলা দুধ, ফল ইত্যাদি সংগ্রহ করে স্বল্প পরিমাণে আহার করবেন । আশ্রয়হীন অবস্থায় মন্দিরে দেবালয়ে ক্ষণকালের জন্য আশ্রয় নিতে পারেন। পোশাক-পরিচ্ছদ থাকবে নিতান্তই সাধারণ । অতীত জীবনের স্মৃতি সব পরিহার করে এক মনে এক ধ্যানে ঈশ্বর চিন্তায় মগ্ন থাকবেন । শাস্ত্রবচনে জানা যায় ‘দণ্ডগ্রহণমাত্রেণ নরো নারায়ণো ভবেৎ।' অর্থাৎ সন্ন্যাস গ্রহণ করলেই মানুষ নারায়ণ বা দেবতা হয়ে যায় । তবে সন্ন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে কর্মফলাসক্তি ও ভোগাসক্তি ত্যাগ । এ সম্পর্কে শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতায় বলা হয়েছে-

অনাশ্রিতঃ কর্মফলং কার্যং কর্ম করোতি যঃ।

স সন্ন্যাসী চ যোগী চ ন নিরগ্নির্ন চাক্রিয়ঃ ॥ (৬/১) অর্থাৎ, কর্মফলের বাসনা না করে যিনি কর্তব্যকর্ম করেন, তিনিই সন্ন্যাসী, তিনিই যোগী । শুধু গৃহাদি কর্ম বা শরীর ধারণের উপকরণ সংগ্রহে কর্মত্যাগই সন্ন্যাস নয় ।

শাস্ত্রীয় যুগবিভাগ অনুসারে বর্তমান যুগ কলিযুগ। এ সময়ে ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস এ চার আশ্রমের অনুশীলন সম্ভব নয় । বর্তমানে ব্রহ্মচর্য ও বানপ্রস্থ আশ্রম নেই বললেই চলে । ব্রহ্মচর্য বর্তমানে ছাত্র জীবনে পর্যবসিত হয়েছে। গার্হস্থ্য ও সন্ন্যাস এ দুটি আশ্রম লক্ষ করা যায় । তবে গার্হস্থ্য জীবনে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, মাতা, পিতা এদের পরিত্যাগ করে বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস গ্রহণে উৎসাহিত করা হয় না। তাই কলিযুগে গার্হস্থ্য আশ্রমে থেকে জীবনযাপন করাই ভালো। এতেই মানুষের জীবন সার্থক হয় এবং কল্যাণময় হয় ।

 

পাঠ ৬ ও ৭ : যোগের ধারণা

যোগসাধনা মুক্তিলাভের একটি বিশেষ উপায় । ‘যোগ' শব্দটি সাধারণভাবে সংযোগ অর্থই ব্যক্ত করে । একের সঙ্গে অপরের সংযোগকে সংক্ষেপে যোগ বলা হয়। কিন্তু সাধন ক্ষেত্রে এই যোগের অর্থ আরও গভীরে নিহিত । জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সংযোগই যোগসাধনা । যোগশাস্ত্রে, শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতায় এবং 

 

 

 

 

 

 

 

 

পতঞ্জলির যোগ দর্শনে বলা হয়েছে- ‘যোগঃ চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ' । অর্থাৎ চিত্তবৃত্তির নিরোধকে যোগ বলা হয়। মোক্ষ লাভের জন্য প্রথমে প্রয়োজন আত্মোপলব্ধি । আর এই আত্মোপলব্ধির জন্য প্রয়োজন শুদ্ধ, স্থির ও প্রশান্ত মন বা চিত্তের স্থিরতা ।

মনকে শুদ্ধ ও শান্ত করার জন্য যোগদর্শনে আট প্রকার সাধনপ্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে; যেমন- ১. যম ২. নিয়ম ৩. আসন ৪. প্রাণায়াম ৫. প্রত্যাহার ৬. ধারণা ৭. ধ্যান ও ৮. সমাধি । এই আট প্রকার যোগাঙ্গ অনুশীলন করে একজন যোগী মুক্তিলাভ করতে পারেন । যোগাঙ্গগুলোর পরিচয় নিচে বর্ণনা করা হলো :

১. যম : 'যম' শব্দটি মূলত সংযম অর্থ প্রকাশক । মুক্তিলাভের জন্য সাধক দৈনন্দিন জীবনে আচার-আচরণে সংযমী হবেন। তাকে অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহ - এ পাঁচটি বিষয়ের অনুশীলন করতে হবে । এই পাঁচটিকে বলা হয় যম । দেহ, মন ও বাক্যের দ্বারা কোনো জীবকে হত্যা না করা বা নির্যাতন না করাকে বলে অহিংসা । যোগী পুরুষ বাক্যে কর্মে সত্যনিষ্ঠ হবেন । কখনো মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করবেন না । আবার অস্তেয় বলতে বোঝায় অপরের জিনিস চুরি না করা। মনে যেন চুরি করার ইচ্ছাও না জাগে । সে সঙ্গে ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করতে হবে। বিনা প্রয়োজনে কোনো দ্রব্য গ্রহণ করা যাবে না, একে বলা হয় অপরিগ্রহ ।

২. নিয়ম : শৌচ, সন্তোষ, তপস্যা, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বর প্রণিধান এই পাঁচটি অনুষ্ঠান নিয়মের অন্তর্ভুক্ত। শৌচ দুই প্রকারের : বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ । স্নানাদির মাধ্যমে দেহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখে বাহ্যিক শৌচ লাভ হয় । আবার সৎ চিন্তা, মৈত্রী, দয়া প্রভৃতি ভাবনার দ্বারা অভ্যন্তরীণ শৌচ লাভ হয়ে থাকে । স্বাভাবিকভাবে যা পাওয়া যায় তাতে সন্তুষ্ট থাকাই সন্তোষ । আবার শ্রদ্ধার সাথে শাস্ত্র নির্ধারিত ব্রত উদ্‌যাপন করাকে বলে তপস্যা । বেদাদি ধর্মশাস্ত্র নিয়মিত অধ্যয়ন করাই স্বাধ্যায় । ঈশ্বরকে সর্বক্ষণ চিন্তা করার নাম ঈশ্বর প্ৰণিধান ।

৩. আসন : দেহ ও মনকে সুস্থ ও স্থির রাখার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেহভঙ্গি বা দেহাবস্থানকে বলে আসন । যোগ সাধনায় আসন অনুশীলন একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার । আসন রয়েছে অনেক প্রকারের, যেমন- পদ্মাসন, বজ্রাসন, গোমুখাসন ইত্যাদি । এই আসন অনুশীলনের মধ্য দিয়ে যোগীপুরুষ নিজ দেহ ও মনকে ঈশ্বর চিন্তায় নিবিষ্ট করার যোগ্যতা অর্জন করে । তবে কোনো গুরু বা যোগীর নিকট এই আসন প্রক্রিয়া শিক্ষা করা দরকার । তা না হলে হিতে বিপরীত হতে পারে। অবৈজ্ঞানিকভাবে আসন অভ্যাসে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ।

৪. প্রাণায়াম : শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিক গতিকে নিয়ন্ত্রণ এবং নিজ আয়ত্তে আনাই প্রাণায়াম । প্ৰাণায়াম তিন প্রকার । যেমন- রেচক, পূরক এবং কুম্ভক । শ্বাস ত্যাগ করে সেটি বাইরে স্থির রাখার নাম রেচক । শ্বাস গ্রহণের নাম পূরক । নিয়মিত গতিরোধ করে শ্বাস ভিতরে ধরে রাখার নাম কুম্ভক । এই প্রাণায়াম যোগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ । প্রাণায়ামে যেমন সুফল পাওয়া যায় তেমনি ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে । তাই অভিজ্ঞ গুরুর নিকট প্রাণায়াম শিক্ষা করতে হয় ।

 

 

 

 

 

 

৫. প্রত্যাহার : দেহের ইন্দ্রিয়গুলোকে নিজ নিজ বিষয় হতে মুক্ত করে চিত্তের অনুগামী করার নাম 

প্রত্যাহার । ইন্দ্রিয়গুলোকে নিজ নিজ বিষয় হতে মুক্ত করা কষ্টসাধ্য বটে কিন্তু অসাধ্য নয়। দৃঢ় সংকল্প ও অভ্যাসের দ্বারা ইন্দ্রিয়গুলোকে অন্তর্মুখী করা যায়। ইন্দ্রিয়গুলো অন্তর্মুখী হলে চিত্তে বিষয়-আসক্তি নষ্ট হয়। এমতাবস্থায় চিত্ত আরাধ্য বস্তুতে নিবিষ্ট হতে পারে।

৬. ধারণা : অদ্বিতীয় লক্ষ্যবস্তুতে মনকে ধারণ বা স্থাপিত করার নাম ধারণা। সমস্ত বাহ্যবস্তু পরিহার করে মনকে ব্রহ্মবস্তুতে স্থাপন করতে হবে। এর দ্বারা যোগীর চিত্ত সুম্মিত হয় ।

৭. ধ্যান: ধারণা ও ধ্যান দুইটি গভীর সম্পর্ক যুক্ত। ধারণার দ্বারা মনকে লক্ষ্য বস্তুতে স্থির রাখা যায় । ধারণার সে স্থির অবস্থাটি ধ্যানে আরো নিবিড় হয়। যে বিষয়ে মনকে স্থির রাখা হয়েছে সে বিষয়ে অবিচ্ছিন্ন ভাবনাকে ধ্যান বলে। অবিচ্ছিন্ন ধারণাই ধ্যান। পরমতত্ত্বকে উপলব্ধি করার জন্য ধ্যান অত্যন্ত আবশ্যক ।

৮. সমাধি : যোগ সাধনার সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে সমাধি । ধারণা মনকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেয়, আর ধ্যানে সে সুযোগ অবিচ্ছিন্ন থাকে । সমাধিতে এসে যোগীর ধ্যানলব্ধ চিত্তে স্থিরতা আরো গভীর হয় । সমাধিতে যোগীর চিত্ত আরাধ্য বস্তুতে সম্পূর্ণভাবে লীন হয়ে যায়। সে সময় যোগীর চিত্তটি স্থির নিষ্ক্রিয় অবস্থায় উন্নীত হয় । তখন ধ্যান-কর্তা, ধ্যানের বিষয় এবং ধ্যান প্রক্রিয়া এই তিনটি মিশ্রিত হয়ে একাকার হয়ে যায় । এই একাকার অবস্থায় ধ্যানীর নিজস্ব কোনো অনুভূতি থাকে না; আরাধ্য বস্তুর সঙ্গে একীভূত হয়ে যায় । এটাই সমাধির চরম অবস্থা ।

উক্ত অষ্টাঙ্গযোগের স্তরগুলোকে দুইভাগে ভাগ করা যায়- বহিরঙ্গ সাধন এবং অন্তরঙ্গ সাধন। যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম এবং প্রত্যাহার এই পাঁচটিকে বলা হয় যোগ সাধনার বহিরঙ্গ সাধন; ধারণা ধ্যান ও সমাধিকে বলা হয় অন্তরঙ্গ সাধন। যোগসাধনার মাধ্যমে যোগী মুক্তি লাভ করে থাকেন ।

 

 

পাঠ ৮ও ৯ : কর্মযোগ

মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি ঈশ্বর বা মোক্ষলাভ । ঋষিগণ এই মোক্ষলাভের উপায় হিসেবে তিনটি সাধন পথের নির্দেশ দিয়ে গেছেন । কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ এই সাধন পদ্ধতিগুলোর যে কোনো একটি নিষ্ঠার সঙ্গে অনুশীলন করে একজন সাধক মোক্ষলাভ করতে পারেন ।

যা কিছু করা হয় তাকেই বলে কর্ম । আমরা প্রতিনিয়ত জীবন ধারণের জন্য যে-কাজ করি তার সকলই কর্ম । কর্ম দু'রকম- সকাম কর্ম ও নিষ্কাম কর্ম । যখন বিশেষ কোনো ফলের আশায় কর্ম করা হয় তখন

 

 

 

তাকে বলে সকাম কর্ম । অর্থাৎ, কামনা বাসনা যুক্ত কর্ম । এই কর্মে কর্মকর্তার কর্তৃত্বের অভিমান থাকে ফলাকাঙ্ক্ষা থাকে; এমন বোধ হয় আমি কর্ম করছি, আমি কর্মের কর্তা, কর্মের ফলও আমিই ভোগ করব । কিন্তু নিষ্কাম কর্ম ভিন্ন রকম । এখানে কর্তা কর্ম করেন কোনো রকম ফলের আশা না নিয়ে । তিনি মনে করেন কর্মের কর্তা আমি নই, কর্মফলও আমার নয় । নিষ্কাম কর্মের ফল কর্মকর্তাকে স্পর্শ করে না । এই নিষ্কাম কর্মই যোগ সাধনার ক্ষেত্রে কর্মযোগ । সকাম কর্মে বন্ধন হয়; আর নিষ্কাম কর্মে মোক্ষলাভ হয় । কর্মকে যোগে পরিণত করে তা অনুশীলন করলে অভীষ্ট মোক্ষলাভ সম্ভব ।

বৈদিক যুগে সকাম কর্মের সর্বোচ্চ ফলপ্রাপ্তি হিসেবে স্বর্গ লাভের কথা জানা যায় । পুণ্যফল ভোগের শেষে স্বর্গ থেকে চলে এসে পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় । ‘ক্ষীণে পুণ্যে মর্ত্যলোকং বিশন্তি' (গীতা)- পুণ্য ক্ষয় হলে মানুষ পুনরায় মর্ত্যলোকে জন্মগ্রহণ করে । এ অবস্থায় মানবজীবনে শ্রেষ্ঠ সম্পদ মোক্ষলাভ সম্ভব হয় না । তাই উপনিষদের ঋষিগণ কর্ম ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণের উপদেশ দেন। তাঁদের বক্তব্য - কর্ম করলেই কর্মফল উৎপন্ন হবে । ঐ কর্মফল ভোগের জন্য কর্মকর্তাকে জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবদ্ধ হতে হয় । এর থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য সন্ন্যাস গ্রহণ আবশ্যক । এটা হচ্ছে সন্ন্যাসবাদীদের মত ।

দ্বাপর যুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এসে উক্ত সন্ন্যাসবাদীদের মত খণ্ডন করে বললেন, মোক্ষলাভের জন্য কর্মত্যাগের প্রয়োজন নেই । দেহধারী জীবের পক্ষে সম্পূর্ণরূপে কর্মকে পরিত্যাগ করা সম্ভব নয় । যাঁরা মুক্তিলাভের প্রত্যাশায় জাগতিক কর্মকাণ্ড ত্যাগ করেন, তাঁরাও কিন্তু আধ্যাত্মিক কর্ম অনুশীলন করতে থাকেন । মুক্তিলাভের সোপান হিসেবে সংযম, নিয়ম, আসন ইত্যাদি অষ্টাঙ্গ যোগ অনুশীলন করেন; ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্য শ্রবণ, মনন. আসন প্রভৃতি কর্ম তাদের চলতেই থাকে। তাহলে মুক্তিকামী সন্ন্যাসীগণও কর্মকে একেবারে পরিত্যাগ করতে পারেন না ।

কর্মই জীবন । জীবন ধারণের জন্য কর্ম করতেই হবে । তবে এই আবশ্যিক কর্মের মাধ্যমে মানুষ মুক্তিলাভ করতে পারে না। কর্মকে যোগে বা নিষ্কাম কর্মে পরিণত করতে হবে। মনে করতে হবে বিশ্ব জগৎ ঈশ্বরের বিরাট কর্মক্ষেত্র । এই কর্মক্ষেত্রে সর্বক্ষণ ঈশ্বরেরই কর্ম হচ্ছে । আর এই কর্ম করার জন্য ঈশ্বর জীবদের নিয়োগ করেছেন । তবে ফলের আশায় নয় । ঈশ্বরের নিয়োজিত ব্যক্তি হিসেবে কর্ম করা । ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জিত এই কর্মই কর্মযোগ । কর্মফলকে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া । শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন-

‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন ।

মা কৰ্মফলহেতুভূমা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মাণি ॥' (২/৪৭) অর্থাৎ, কর্মে তব অধিকার, ফলে কভু নয় । ফলাসক্তি ত্যাগ কর, কর্ম ত্যাজ্য নয়। কর্মযোগের নির্দেশ হচ্ছে-

কর্মফল যেন তোমার কর্মপ্রবৃত্তির হেতু না হয়,

কর্মত্যাগেও যেন তোমার প্রবৃত্তি না হয় ।

১. কর্মকর্তাকে কর্মফল ঈশ্বরে সমর্পণ করতে হবে । আমি কর্ম করছি, এরূপ অনুভূতি থাকবে না ।

২. প্রত্যেককে নিজ নিজ কর্ম অবশ্যই নিষ্পন্ন করতে হবে । ৩. ফলের আশা ত্যাগ করে কর্ম করতে হবে ।

৪. এরূপ কর্মে কর্মকর্তা অন্তরে অনাবিল আনন্দ লাভ করেন ।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

৫. তখন ভগবানের প্রতি ভক্তির উদয় হয় এবং এভাবে কর্মানুশীলন করতে করতে ঈশ্বরানুগ্রহে মানুষের মুক্তিলাভ হয়ে থাকে ।

পাঠ ১০ ও ১১ : জ্ঞানযোগ

মোক্ষলাভের অন্যতম উপায় হচ্ছে জ্ঞানযোগ । জ্ঞানের অনুশীলন দ্বারা পরম সত্তায় উপনীত হওয়ার পদ্ধতি জ্ঞানযোগ । শাস্ত্রে আত্মতত্ত্ব ও পরমার্থতত্ত্ব জানাকে জ্ঞান বলা হয়েছে। আর জ্ঞানের পথে

জ্ঞানযোগ

স্রষ্টাকে জানার যে সাধনা তাকে বলে জ্ঞানযোগ । জ্ঞানী জগৎ ও জীবের প্রকৃতি ও পরিণতি জেনে সৃষ্টির ঊর্ধ্বে স্রষ্টাকে অন্তরে অনুভব করেন। তিনি উপলব্ধি করেন, তাঁর নিজের মধ্যে এবং বিশ্বের সকল প্রাণীর মধ্যে একই চেতনা অবস্থান করছে। জগতের সবকিছু সেই পরম চৈতন্যের দ্বারা চৈতন্যময় । এই চৈতন্যই আত্মা বা জীবাত্মা ।

 

 

 

জ্ঞানী আরও উপলব্ধি করেন, প্রত্যেক জীবের মধ্যে যে জীবাত্মা রয়েছে, তা বিশ্ব আত্মা বা পরমাত্মা । জ্ঞানীর দৃষ্টিতে পরমাত্মার অবস্থান ধরা পড়ে বিশ্ব চরাচরের মধ্যে। তবে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে সেই পরমতত্ত্ব ধরা পড়ে না। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ঈশ্বরের মায়া শক্তি দ্বারা জীব আচ্ছন্ন থাকে । তার নিকট আত্মতত্ত্ব বা পরমতত্ত্ব প্রকাশিত হয় না। তবে ঈশ্বর-অনুগ্রহে যখন মায়ার প্রভাব কেটে যায় তখন জীব আত্মতত্ত্বজ্ঞ এবং ব্রহ্মজ্ঞ হতে পারে । এভাবে তার সর্বত্র সমবুদ্ধি জন্মে, বাসনা শুদ্ধ হয়, সুন্দর হয় তার আচরণ । তখন সাধকের অহংকার থাকে না, হিংসা থাকে না। গুরুসেবা, দেহ-মনে পবিত্র থাকা, জ্ঞানের বিষয়ে জানার আগ্রহ, ক্ষমা-এ সকল গুণ তার মধ্যে প্রকাশ পায়। শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে জ্ঞানীর বিশটি লক্ষণের উল্লেখ রয়েছে। জ্ঞানী কৰ্মতত্ত্ব উপলব্ধি করে থাকেন । তাই তার কর্ম হয় নিষ্কাম । শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতার জ্ঞানযোগ অধ্যায়ে কর্মতত্ত্ব সম্বন্ধে তিনটি কথা রয়েছে— কর্ম, অকর্ম ও বিকর্ম । শাস্ত্রবিহিত যে সকল কর্ম করতে হয় সেগুলোকে বলে কর্ম। আর যা শাস্ত্র নিষিদ্ধ সেগুলো হচ্ছে বিকর্ম । আর কোনো কাজ না করাকে বলা হয় অকর্ম। কর্মতত্ত্ব গহীন অরণ্যের মতো। সেখানে জ্ঞানী তাঁর

 

 

 

 

 

 

 

জ্ঞানালোকে কর্তব্যকর্ম নির্ণয় করে থাকেন। আান অনুশীলনে মানুষের সমস্ত রকম দুঃখ, তাপ দূর হয় । তক্ত মাত্রই ঈশ্বরের প্রিয় পাত্র হলেও গীতার জ্ঞানী তকই ভগবানের বেশি প্রিয় (গীতা, ৭/১৭)। জান অর্জনের জন্য গীতার নির্দেশ হচ্ছে তত্ত্বদর্শী গুরুর নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁকে প্রণাম বন্দনা করতে হবে, সেবা কর্ম দ্বারা তাঁকে ভুষ্ট করতে হবে এবং বিনীতভাবে তাঁকে প্রশ্ন করতে হবে। সেবা কর্মে ভূষ্ট আত্মত গুরু তখন জ্ঞানপ্রার্থীকে উপদেশ দিয়ে থাকেন । জ্ঞান লাভে ইচ্ছুক ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে-

শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ ।

জ্ঞানং লব্ধা পরাং শান্তিমটিরেণাধিগচ্ছতি । (৪/৩৯) অর্থাৎ, যিনি শ্রদ্ধাবান, একনিষ্ঠ সাধন তৎপর এবং জিতেন্দ্রিয়, তিনি জ্ঞান লাভ করেন। আত্মজ্ঞান লাভ করে শীঘ্রই তিনি পরম শান্তি লাভ করেন ।

সংক্ষেপে জ্ঞানযোগের ফল হচ্ছে :

১. জ্ঞান পরম পবিত্র । সকল অপবিত্রতাকে দূর করে দেওয়ার ক্ষমতা আনের রয়েছে।

২. জ্ঞানীর পাপ বিনষ্ট হয় । জ্ঞানের উপরে অজ্ঞানতা থাকতে পারে না। জ্ঞানীর কর্ম বন্ধন থাকে না । তাই জ্ঞানী পরম সুখে অবস্থান করেন। জ্ঞান লাভের জন্য আমরা সবাই,

যত্নশীল হব ।

পাঠ ১২৩১৩ : ভক্তিযোগ

ভক্তিকে অবলম্বন করে যে ঈশ্বর আরাধনা তাকে ভক্তিযোগ বলে। ভক্তিকে অবলম্বন করে ভগবানের সঙ্গে যোগসূত্র রচনা করা অভিযোগ। অভির অশেষ শক্তি, ভক্তিতেই যুক্তি। ভক্তি মানব হৃদয়ের একটি সুকুমার বৃত্তি ।

নারদীয় ভক্তি সূত্রে বলা হয়েছে- ভগবানে ঐকান্তিক প্ৰেম ৰা ভালোবাসাকে ভক্তি বলে। ঈশ্বরের প্রতি প্রেমভাবকে ভি বলে। শাকিলা সূত্রে অভির লক্ষণ সম্বন্ধে বলা হয়েছে ভগবানের পদে যে একান্ত রতি, তারই নাম ভক্তি। শ্রীমদভগবদ্‌গীতার স্বাদশ অধ্যারের নাম ভক্তিযোগ। এর আগে কর্মজ্ঞানের কথা, ভগবানের বিভূতি ও বিশ্বরূপের পরিচয় পাওয়া গেছে। অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সঞ্চণ ঈশ্বর, নির্গুণ ঈশ্বর সম্বন্ধে জেনেছেন।

দ্বাদশ অধ্যায়ের শুরুতে অর্জুনের মনে প্রশ্ন জেগেছে নির্গুণ, নির্বিশেষ, অরপ ব্রহ্মের সাধনা আর ব্যঙ্ক ঈশ্বরকে সাকাররূপে আরাধনা করার মধ্যে কোনটি উত্তম পথ? উত্তরে ভগবান বলেছেন, সাধনার উত্তর পথেই ক্লেশ আছে । তবে অব্যক্ত ব্রহ্মচিন্তার চেয়ে সণ মূর্তিমান সাকার ঈশ্বরের আরাধনা করা অপেক্ষাকৃত সহজ । ঈশ্বরকে যারা সাকারে গুণময়রূপে আরাধনা করেন তাঁরাই মূলত ভক্তি পথের সাধক। ভক্তিকে অবলম্বন করে যিনি সাধনা করেন তিনিই শুরু । ভক্ত সম্বন্ধে গীতায় বলা হয়েছে- যে ব্যক্তি আসক্তি, ভয়

 

 

 

 

 

 

 

ক্রোধ ত্যাগ করে ঈশ্বরের শরণাপন্ন হন, তিনি ভগবদ্‌ভাব লাভ করেন । তার পাপ তাপ দুঃখ বেদনা থাকে না । ভক্তির মাধ্যমে ভক্ত ভগবানের অনুগ্রহ পেয়ে থাকেন । ভগবানের শ্রীচরণে আত্মসমর্পণই ভক্তিযোগের প্রধান কথা । তবে মনে রাখা প্রয়োজন, এ ভক্তির মূলে থাকবে গভীর বিশ্বাস- ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, তিনি করুণাময়, তিনি ভক্তবাঞ্ছাকল্পতরু ।

গীতায় বহুবিধ সাধন পথের উল্লেখ রয়েছে । সে সকল পথে সাধনায় নিষ্ঠা থাকলে ঈশ্বরের করুণা লাভ করা যায় । তবে কর্মযোগের বা জ্ঞানযোগের যে পথেরই সাধক হোন না কেন, সকল পথেই ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করা সম্ভব । গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-

‘যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্ ।

মম বৰ্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ ॥' (৪/১১)

–হে পার্থ, যে আমাকে যেভাবে উপাসনা করে, আমি তাকে সেভাবেই তুষ্ট করি। মানবগণ সকল প্রকারে আমার পথই অনুসরণ করে । অর্থাৎ, মানবগণ যে পথই অনুসরণ করুক না কেন, সকল পথেই আমাতে পৌঁছতে পারে । ভক্তিযোগে ভক্তের চিত্তে ভগবানের অশেষ করুণা ও সর্বশক্তিমত্তায় থাকে গভীর বিশ্বাস । এই বিশ্বাস অবলম্বন করে ভক্ত ভগবানকে একমাত্র আশ্রয়স্থল মনে করেন ভগবান একমাত্র গতি । এই অনুভূতি নিয়ে ভগবানে আত্মসমর্পণই ভক্তিমার্গের প্রধান ভাব । অর্থাৎ, ভগবানে শরণাগতি বা আত্মসমর্পণ ভক্তিযোগের

সার কথা ।

নতুন শব্দ- অষ্টাঙ্গযোগ, চতুরাশ্রম, একেশ্বরবাদ, অবতারতত্ত্ব, জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ, ভক্তিযোগ ।

 

 

অনুশীলনী

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন :

১। জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সংযোগকে কী বলে?

ক. যোগশাস্ত্র

খ. যোগসাধনা

গ. যোগ দর্শন

ঘ. যোগাঙ্গ

২। সন্ন্যাস শব্দের অর্থ কী?

খ. কর্ম পরিত্যাগ

ঘ. ভোগাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ

ক. সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ গ. গৃহত্যাগ

৩। গার্হস্থ্য কলিযুগের জন্য উত্তম আশ্রম, কারণ-

i. এর মধ্যে থেকে মানুষ সমাজের প্রতি তার কর্তব্য পালন করে ।

ii. জাগতিক সকল কর্ম পরিত্যাগ করে কেবল ঈশ্বর চিন্তাতেই মগ্ন থাকেন ।

iii. এতে মানুষের জীবন সার্থক ও কল্যাণময় হয় ।

 

 

 

 

নিচের কোনটি সঠিক?

ক. i ও ii

খ. ii ও iii

গ. i ও iii

ঘ. i, ii ও iii

নিচের অনুচ্ছেদটি পড় এবং ৪ ও ৫ নং প্রশ্নের উত্তর দাও :

গোবিন্দ বাবু একজন সাধারণ গৃহস্থ । সংসারে সন্তান প্রতিপালন ও অর্থ উপার্জন সকল ক্ষেত্রেই তিনি ঈশ্বরে কর্মফল অর্পণ করে কর্ম করার চেষ্টা করেন । এটাই তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য । কিন্তু মাঝে মাঝে বৃদ্ধ বয়সে তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তার সন্তানরা নেবে কিনা এটা ভেবেও শঙ্কিত হন ।

৪ । ঈশ্বরে কর্মফল অর্পণে গোবিন্দ বাবুর মূল লক্ষ্য ছিল কোনটি?

ক. জ্ঞান

খ. ভক্তি

গ. মোক্ষ

ঘ. কর্ম

৫। গোবিন্দ বাবুর অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ার কারণ কী ?

ক. বিষয়প্রীতি

খ. সন্তানপ্রীতি

গ. ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার চিন্তা

ঘ. ঈশ্বর সাধনায় মনোযোগহীনতা

সৃজনশীল প্রশ্ন :

দ্বিজেন্দ্রনাথ একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। তাঁর বয়স ৭৫ বছর । তিনি সংসারে থেকেও অত্যন্ত সংযমী । তিনি সংসারের সমস্ত দায়িত্ব পুত্রের হাতে অর্পণ করে মন্দিরে মন্দিরে ঈশ্বর ধ্যানে মগ্ন থাকেন । এতেও তাঁর আত্মতৃপ্তি হয় না বিধায় তিনি জীবনের পরম প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে সংসার ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন ।

একেশ্বরবাদ কী?

খ. প্রত্যাহার বলতে কী বোঝায় ?

গ. দ্বিজেন্দ্রনাথ সংসারে থেকে জীবনের কোন স্তরে অবস্থান করছেন তা তোমার পঠিত বিষয়বস্তুর আলোকে ব্যাখ্যা কর।

ঘ. ‘জীবনের পরম প্রাপ্তি লাভে দ্বিজেন্দ্রনাথের সিদ্ধান্তটি ছিল যৌক্তিক।'- তোমার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দাও ।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

দ্বিতীয় অধ্যায়

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : হিন্দুধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

 

বিশ্বে প্রচলিত ধর্মসমূহের মধ্যে হিন্দুধর্ম অন্যতম প্রাচীন ধর্ম । এর প্রাচীন নাম সনাতন ধর্ম। এই সনাতন ধর্মের প্রবর্তকরূপে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে নির্দেশ করা যায় না। এ ধর্মের মূলে রয়েছেন ভগবান স্বয়ং। জগৎ সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে এ ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে। তবে মানব সভ্যতার কোন বিস্মৃত অতীতে হয়ত কোন আদিম মানবের মনে প্রথম ধর্মবোধ জেগে ওঠে। সেখান থেকে এ ধর্মের যাত্রা শুরু ।

মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে এ ধর্মের বিকাশ ও প্রসার লক্ষণীয়। বহিরাগত আর্য সম্প্রদায়ের ধর্মমতের সঙ্গে প্রাগার্য ধর্মমতের সংশ্লেষণে হিন্দুধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ। হিন্দুধর্ম চিন্তায় একেশ্বরবাদ, অবতারবাদ, ঈশ্বরের গুণ ও শক্তি হিসেবে দেব-দেবীর উপাসনা ও পূজা পদ্ধতির পরিচয় মেলে। ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বেদ, উপনিষদ (বেদাস্ত), পুরাণ, গীতা, ভাগবতের প্রকাশ ঘটে এবং দার্শনিক চিন্তায়ও বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায় ৷ বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতেও সনাতন ধর্মের সংস্কার ও ধর্মসাধনার নব নব রূপ লক্ষণীয় । রাজা রামমোহন রায়, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, প্রভু জগদ্বন্ধু, ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র, বাবা লোকনাথ, হরিচাঁদ ঠাকুর, স্বামী স্বরূপানন্দ, স্বামী প্রণবানন্দ, এ.সি. ভক্তি বেদাস্ত স্বামী প্রভুপাদ প্রমুখ ধর্মগুরুর গৌরবময় অবদান হিন্দুধর্মকে আধুনিকতার পরিমণ্ডলে উন্নীত করেছে। এঁদের সকলের প্রচেষ্টায় হিন্দুধর্ম বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচার ও প্রসার লাভ করেছে ।

এ অধ্যায়ে হিন্দুধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে এবং বাংলাদেশে হিন্দুধর্ম প্রচার, সংস্কার ও বিকাশে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ব্যাখ্যা করা হয়েছে ।

এ অধ্যায় শেষে আমরা-

• হিন্দুধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করতে পারব

• বাংলাদেশে হিন্দুধর্ম তথা সনাতন ধর্ম প্রচার, সংস্কার ও বিকাশে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা

  ব্যাখ্যা করতে পারব

• হিন্দুধর্মের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য সম্পর্কে অবহিত হয়ে তা সমুন্নত রাখতে উদ্বুদ্ধ হব ।

 

 

পাঠ ১ : হিন্দুধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

হিন্দুধর্মের অপর নাম সনাতন ধর্ম । বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত ধর্মসমূহের মধ্যে এই সনাতন ধর্ম তথা হিন্দুধর্ম একাধারে প্রাচীন এবং নবীন । প্রাচীন এ কারণে যে, সনাতন ধর্ম তার সনাতন ঐতিহ্য বজায় রেখেছে । আর নবীন এ কারণে যে, সনাতন ঐতিহ্য বজায় রেখেও এ ধর্ম যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলছে। এ ধর্মের প্রবর্তক হিসেবে কোনো একক ব্যক্তিবিশেষকে চিহ্নিত করা যায় না। এ ধর্মের মূলে রয়েছেন ভগবান স্বয়ং । সৃষ্টির আদিকাল থেকে এ ধর্মমতের পরিচয় মেলে। দীর্ঘ যাত্রাপথে ধর্মের মূলতত্ত্বকে ধরে রেখেও নতুন নতুন ধর্মীয় চিন্তা গ্রহণ করে এ ধর্ম ক্রমশ পল্লবিত হয়েছে এবং হচ্ছে। সিন্ধু সভ্যতার মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পার নিদর্শন থেকে হিন্দুধর্মের কিঞ্চিৎ পরিচয় ও ধারণা পাওয়া যায়। আর্যরা এদেশের বহিরাগত সম্প্রদায় । তারা যখন ভারত ভূমিতে আসে তখন তাদের সঙ্গে ছিল নিজস্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি। এদেশের প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে আর্য সভ্যতার সংঘর্ষ এবং পরিণতিতে সিন্ধুসভ্যতার সঙ্গে আর্য সভ্যতার একটা সমন্বয় ঘটে । এর ফলে হিন্দুধর্মের ধর্মচর্চার সঙ্গে আর্যদের ধর্মবিশ্বাস মিলিত হয়ে একটা নতুন রূপ ধারণ করে । কালক্রমে এটি আর্যসভ্যতা, আর্যধর্ম নামে প্রাধান্য লাভ করে। এই ঐতিহাসিক পটভূমিকায় স্থিত সনাতন ধর্ম তার নতুন অভিধায় পরিচিত হওয়া শুরু করে। আর্যগণ সুপ্রাচীন সিন্ধুনদের তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করতে থাকে। বহিরাগত আফগান ও পার্সিক সম্প্রদায় সিন্ধুনদকে হিন্দুনদ বলে উচ্চারণ করত। তাদের উচ্চারণে সিন্ধুর 'স' পরিবর্তিত হয়ে ‘হ’-তে রূপ নেয় এবং সিন্ধু শব্দটি হিন্দু বলে উচ্চারিত হতে থাকে । তাই অনেক গবেষকের মতে সিন্ধু শব্দ থেকেই হিন্দু শব্দের উৎপত্তি এবং সিন্ধু নদের তীরবর্তী লোকদের ধর্মই হিন্দুধর্ম বলে আখ্যায়িত হয়। সনাতন ধর্ম ক্রমে হিন্দুধর্ম নামে পরিচিতি লাভ করে । তবে সময়ের অগ্রগতিতে মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের অনুষঙ্গী হিসেবে সনাতন ধর্মের চিন্তা- চেতনায় নতুনত্বের সংযোজন ঘটে । হিন্দুধর্মের এই বিকাশমান বৈশিষ্ট্যটি তিনটি স্তরে বিন্যস্ত করে দেখা যায়— বৈদিক যুগ, পৌরাণিক যুগ ও আধুনিক যুগ ।

বৈদিক যুগ

বেদ হিন্দুধর্মের আদি ধর্মগ্রন্থ । বৈদিক ধর্মগ্রন্থসমূহের রয়েছে চারটি ভাগ : সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ। সংহিতা ও ব্রাহ্মণভাগ নিয়ে বেদের কর্মকাণ্ড, আবার আরণ্যক ও উপনিষদ ভাগ দুটি নিয়ে বেদের জ্ঞানকাণ্ড । বেদের সংহিতা অংশে ইন্দ্ৰ, অগ্নি, সূর্য, বরুণ, ঊষা, রাত্রি প্রভৃতি দেব-দেবীর স্তব-স্তুতি রয়েছে। বেদের মন্ত্র উচ্চারণ করে দেবগণের উদ্দেশে যাগযজ্ঞ করে অভীষ্ট লাভের প্রার্থনা করা হতো । বেদ-মন্ত্রগুলো রহস্যময় । সাধারণের জ্ঞানে এর তাৎপর্য অনেক সময় ধরা পড়ে না । তবে যাগযজ্ঞের অনুশীলন করে আর্যগণ দুইটি বস্তুর প্রতি প্রার্থনা জানাতেন। বস্তু দুইটি হচ্ছে- শ্রী ও ধী।

 

 

 

 

 

 

শ্রী অর্থাৎ ধন-ধান্য, বল-বিক্রম, যশ ইত্যাদি পার্থিব কাম্যবস্তু । ধী হচ্ছে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। আবার বেদের অন্য কতগুলো মন্ত্রের বিষয়বস্তু বুদ্ধি, জ্ঞানজ্যোতিঃ, অমৃততত্ত্ব। এ দুইটি চিন্তাধারার মধ্য দিয়ে হিন্দুধর্মের মূল তত্ত্বটি প্রকটিত হয়েছে। ধর্মের সংজ্ঞায় জানা যায় যা থেকে জাগতিক কল্যাণ এবং পারমার্থিক মঙ্গল লাভ হয় সেটিই ধর্ম । এটি সনাতন তথা হিন্দুধর্মের মূল ভিত্তি । বৈদিক যুগের ঋষিদের ধর্মীয় চিন্তাচেতনায় জাগতিক এবং পারমার্থিক উভয়বিধ কল্যাণ অর্জনের উদ্দেশ্য ছিল । বৈদিক যুগে ঋষিগণ ছিলেন সুখবাদী, জীবনবাদী । বাজসনেয় সংহিতায় বলা হয়েছে-

তেজোঽসি তেজো ময়ি ধেহি । বীর্যমসি বীর্যং ময়ি ধেহি । বলমসি বলং ময়ি ধেহি । ওজোহস্যোজো ময়ি ধেহি । মন্যুরসি মন্যুং ময়ি ধেহি । সহ্যোৎসি সহ্যং ময়ি ধেহি ।

অর্থাৎ তুমি তেজস্বরূপ, আমাকে তেজ দাও, আমাকে তেজস্বী কর। তুমি বীর্যস্বরূপ, আমায় বীর্যবান কর। তুমি বলস্বরূপ, আমায় বলবান কর। তুমি ওজঃস্বরূপ, আমায় ওজস্বী কর। তুমি মন্যু স্বরূপ (অন্যায়দ্রোহী), আমায় অন্যায়দ্রোহী কর । তুমি সহ্যস্বরূপ (সহ্যশক্তি), আমায় সহনশীল কর ।

বৈদিক যুগের প্রার্থনায় দেখা যায় জীবনে সমৃদ্ধি, জীবের প্রতি স্নেহ-প্রীতি এবং জগতের শান্তি কামনা । এই প্রার্থনাগুলোর মধ্য দিয়ে এক পরমশক্তি ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করা হয়েছে । একে ঈশ্বরবাদ বলা যায় । এখানে উল্লেখ্য, বৈদিক যুগে ধর্মানুষ্ঠানের রূপ ছিল যজ্ঞক্রিয়া । যজ্ঞকর্মের অনুশীলন করে মানুষ অভীষ্ট কর্মফল লাভ করতে পারতেন। এটিকে পরবর্তীকালে বলা হলো যাগ-যজ্ঞাদি কাম্যকর্ম, জীবের সংসার বন্ধনের কারণ । এগুলো মোক্ষলাভের সহায়ক নয় । যজ্ঞকর্ম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হলে যজ্ঞকারীর অভীষ্ট ফল লাভ হয়, এমনকি স্বর্গপ্রাপ্তিও ঘটে। কিন্তু পুণ্য ক্ষয় হলে জীবকে স্বর্গভোগ ছেড়ে পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয়। মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ উদ্দেশ্য হচ্ছে ঈশ্বর লাভ বা মোক্ষলাভ। বৈদিক যুগের জ্ঞানপ্রধান উপনিষদ ও দার্শনিক চিন্তার পর্যায়ে এসে তৎকালীন ঋষিগণ উপলব্ধি করেন, মোক্ষলাভই জীবনের উদ্দেশ্য আর এই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য কাম্যকর্ম পরিত্যাগ করে সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করতে হবে । এখানে সনাতন ধর্মচিন্তায় নতুন উপলব্ধি এসে যায় । মোক্ষলাভের সহায়ক ধর্মচিন্তায় সন্ন্যাসবাদের আবির্ভাব ঘটে । এ স্তরে মুক্তিলাভের পথ প্রদর্শক হিসেবে বহু উপনিষদ গ্রন্থ রচনা হয় । এ পর্যন্ত দুইশতেরও অধিক উপনিষদের পরিচয় জানা গেছে। তবে কৌষিতকী, ঐতরেয়, ছান্দোগ্য, ঈশ, কেন, কঠ, তৈত্তিরীয় প্রভৃতি বারোটি উপনিষদকে প্রধান ও প্রামাণ্য উপনিষদ বলা হয়। এগুলোর মধ্যেও পরস্পর মতভেদ রয়েছে। ব্রহ্মলাভের পথ সুগম করার উদ্দেশ্যে মহর্ষি বাদরায়ণ বেদব্যাস ‘ব্রহ্মসূত্র' গ্রন্থে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন । একেই বলা হয় বেদান্ত দর্শন ।

এখানে উল্লেখ্য, ব্রহ্মসূত্রের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে অদ্বৈতবাদ, বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদ, ভেদবাদ, অভেদবাদ, ভেদাভেদবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদের উত্থান ঘটে এবং হিন্দুদর্শন-চিন্তায় এক সমৃদ্ধ যুগের আবির্ভাব ঘটে । বৈদিক যুগের ধর্মচিন্তায় কাম্যকর্ম মোক্ষদায়ক নয় । তাই বেদান্তের ব্রহ্মচিন্তা হিন্দুধর্মের চিন্তাজগতে এক পরিবর্তন ধরা পড়ে ।

এভাবে সনাতন ধর্মের দুইটি শাখা প্রকট হয়ে ওঠে; একটি কর্মমার্গ, অপরটি জ্ঞানমার্গ ।

 

 

 

 

 

পাঠ ২ : স্মৃতিশাস্ত্র বা ধর্মশাস্ত্র

বৈদিক শিক্ষার কর্ম ও জ্ঞান এ দুই মতের সংযোগ স্থাপন করে সৃষ্টি হয় স্মৃতিশাস্ত্র। এখানে এসে জানা যায় মোক্ষলাভের জন্য কর্ম ও জ্ঞান উভয়েরই প্রয়োজন রয়েছে। হিন্দুদের জীবনচর্চার আশ্রম বিভাগে জানা গেছে, প্রথম পঁচিশ বছর ব্রহ্মচর্য আশ্রমে বিদ্যা শিক্ষা ও সংযম শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। এর পরের পঁচিশ বছর গার্হস্থ্য আশ্রমে ধর্ম সংযুক্ত অর্থ, কাম, সেবা আচরণীয়। পরে বানপ্রস্থ আশ্রমে মুনিবৃত্তি অবলম্বন এবং সন্ন্যাস আশ্রমে কর্ম ত্যাগ করে ব্রহ্মচিন্তায় নিমজ্জন । এখানে প্রথম দুই আশ্রমে কর্মযোগ এবং শেষের দুই আশ্রমে জ্ঞানযোগের পরিচয় মেলে। স্মৃতিশাস্ত্রে হিন্দুসমাজ পরিচালনার বিধি-বিধানও সন্নিবেশিত রয়েছে। এভাবে হিন্দুধর্মে জাগতিক এবং পারমার্থিক চিন্তার ক্রমশ বিকাশ ঘটতে থাকে ।

পৌরাণিক যুগ

পৌরাণিক যুগে হিন্দুধর্মের চিন্তা জগতে ভক্তির প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। বেদ ও উপনিষদের মধ্যেও ভক্তিভাবের ইঙ্গিত রয়েছে। এটি পৌরাণিক যুগে এসে বিশেষ বৈশিষ্ট্য লাভ করে। আর ভক্তিমার্গের প্রাধান্য লাভ করার সনাতন ধর্মে এক রূপান্তর সংঘটিত হয়। ভক্তিকে অবলম্বন করে পরম তত্ত্বে উপনীত হওয়ার যাত্রাপথে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রকাশ ঘটে। দেবতা একাধিক, তাই পরব্রহ্মের স্থান নিয়ে বিভিন্ন দেব-দেবীর অনুসারী ভক্তগণের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দেয়।

 

 

 

 

 

 

এভাবে বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত প্রভৃতি সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। আর হিন্দুধর্মের অবতার পুরুষদের মাহাত্ম্য কীর্তনে বিভিন্ন পুরাণ ও উপপুরাণ প্রণীত হয় । বিষ্ণুপুরাণ, শিবপুরাণ, কূর্মপুরাণ, মৎস্যপুরাণ, লিঙ্গপুরাণ, ভাগবতপুরাণ এবং বেশকিছু উপ-পুরাণও এই যুগে রচিত হয় । বৈষ্ণব ধর্মে বিষ্ণু বা শ্রীকৃষ্ণ ভগবান হিসেবে পূজিত হন । আবার বৈষ্ণব ধর্মমতের মতো আর একটি প্রভাবশালী ধর্মমত হলো শৈব ধর্মমত । তাদের মতে শিবই সমস্ত আগমশাস্ত্রের বক্তা ।

আবার বিশ্বচরাচরে সর্বত্র শক্তির প্রকাশ । ব্রহ্ম বস্তুকে যখন সগুণ, সক্রিয় বলে ধারণা করা হয় তখনই তাঁর শক্তির চিন্তা এসে পড়ে; কেননা শক্তিরই প্রকাশ হয় ক্রিয়াতে । শক্তি ও শক্তিমান অভিন্ন । যেমন অগ্নি ও তার দাহিকা শক্তি । দাহিকা শক্তি ছাড়া অগ্নির কল্পনা অসম্ভব । অনুরূপভাবে শক্তি ব্যতীত শক্তিমানের কর্মক্ষমতা থাকে না । সুতরাং শক্তিও পরম আরাধ্য ।

এই যে বৈষ্ণব, শৈব, শাক্তমতের উল্লেখ করা হলো, এসব মতের সবগুলোতেই সগুণ ঈশ্বর, জগতের সত্যতা এবং ভক্তিমার্গের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করা হয়েছে। বৈদিক কর্মবাদ ও বেদান্তের নির্গুণ ব্রহ্মবাদ থেকে পৌরাণিক ধর্মসমূহের পার্থক্য লক্ষ করা যায় । শাস্ত্রবচন থেকে জানা যায়, বিষ্ণু, রুদ্র, শক্তির দেবী- এঁরা সবাই এক মূলতত্ত্বের প্রকাশ বা বিকাশ – ‘একং সদ বিপ্রা বহুধা বদন্তি'। এক ব্রহ্মকেই মনীষীরা বিভিন্ন নামে ও রূপে অভিহিত করেন । ধর্মচর্চার অবলম্বন হিসেবে ভক্তি সনাতন সাধনার চিন্তাজগতে এক বিশেষ পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এ প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার প্রসঙ্গটি স্মরণ করা যায়। ভক্তিপথে ঈশ্বর আরাধনার বিশেষ আহ্বান আছে শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতায়। এ গ্রন্থটিতে হিন্দুধর্মের সাধন প্রক্রিয়াগুলোর কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি প্রভৃতি বিষয় সংরক্ষিত ও সমন্বিত রয়েছে । ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উদার আহ্বানে হিন্দুধর্মের সমন্বয়-চেতনা বিবৃত হয়েছে ।

গীতার ভক্তিবাদের প্রকাশ বিভিন্ন পর্যায়ে লক্ষ করা যায়। এখানে ভগবানের আহ্বান রয়েছে – সতত আমাকে স্মরণ কর, আমাতে মনোনিবেশ কর । আমার ভজনা কর, আমাতেই সমস্ত কর্ম সমর্পণ কর, একমাত্র আমারই শরণ লও ইত্যাদি উক্তির মধ্য দিয়ে ভগবদ্ভক্তির উপদেশ লাভ করা যায়। এই ভক্তির ধারাটি আরো বিকাশ লাভ করে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে শ্রীমদ্‌ভাগবত গ্রন্থে ।

 

পাঠ ৩ : আধুনিক ধর্ম সংস্কারের যুগ

ঊনবিংশ শতকে হিন্দুধর্মে তথা বাংলাদেশের হিন্দুধর্মে এক বিশেষ চিন্তাচেতনার বিকাশ লক্ষ করা যায় । বিজ্ঞানমনস্ক সুধীজন সনাতন তথা হিন্দুধর্মের প্রচলিত পূজা-পার্বণ, ধ্যান-ধারণা ইত্যাদি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন । তাঁরা মনে করেন, যুক্তিসংগত নির্দেশ ছাড়া সামাজিক আচার-আচরণে যে প্রচলিত ধর্মীয় বিধি-বিধান সেগুলো সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। শাস্ত্রেও বলা হয়েছে 'যুক্তিহীনবিচারেণ ধর্মহানিঃ প্রজায়তে'-যুক্তিহীন বিচারে ধর্মের হানি ঘটে। এক্ষেত্রে যুক্তিবাদী সংস্কারক মনীষীদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায়ের কথা বিশেষভাবে স্মরণীয় । তিনি লক্ষ করেন, বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসক হয়ে এক হিন্দু সম্প্রদায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীচিন্তায় সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে । সব উপাস্য যে একই ব্রহ্মের বিভিন্ন প্রকাশ,

 

 

 

 

 

হিন্দু সম্প্রদায় তা ভুলতে বসেছে। তখন তিনি এক ব্রহ্মের উপাসনার তত্ত্বকে উপস্থাপিত করেন। এভাবে তিনি হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য এক ব্রহ্মকে সাধনার আহ্বান জানালেন। স্থাপন করলেন 'ব্রাহ্মসমাজ'। তিনি বললেন ব্রহ্মই একমাত্র আরাধ্য । হিন্দুরা একেশ্বরবাদী।

তাঁর এই সংস্কার-চেতনা সুধীমহলে নন্দিত হলেও সাধারণ মানুষ তাদের প্রচলিত বিশ্বাস ও পূজা-পার্বণ ত্যাগ করতে পারেনি । এদের অনুভূতিতে শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সাকার মাতৃসাধনার সাফল্যের দ্বারা। একশ্বেরবাদী ধারণা আর বহু দেব- দেবীরূপে ঈশ্বর আরাধনা এ দুইয়ের সমন্বয় সাধিত হয় ঠাকুর রামকৃষ্ণের অমর উপদেশে – 'যত মত, তত পথ'; 'যত্র জীব, ত্র শিব' ইত্যাদি বাণীর মাধ্যমে।

ঠাকুর রামকৃষ্ণের ভাবাদর্শগুলো প্রচারের উদ্দেশ্যে ১৮৮৬ সালে রামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৮৯৭ সালে স্বামী বিবেকানন্স কর্তৃক রামকৃষ্ণ মিশন স্থাপিত হয়। এই রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন নামে যুগ্ম প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাপী রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলন বা বেদান্ত আন্দোলন সক্রিয়ভাবে পরিচালনা করছে। স্বামী বিবেকানন্দের বাণী 'বিবাদ নয়, সহায়তা; বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাব গ্রহণ; মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি'। এই আদর্শটি শুধু হিন্দুধর্মের প্রেক্ষাপটে নয়, এটি বিশ্ব মানবতার ক্ষেত্রেও সমানভাবে ক্রিয়াশীল।

হরিচাঁদ ঠাকুর ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে আবির্ভূত হয়ে হিন্দু সমাজে সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষকে এক হরিনামে মেতে থাকার আহ্বান জানান। তাঁর এই ধর্মনীতি থেকেই মতুয়া ধর্মের উদ্ভব । এ ধর্মের মূলমন্ত্র হচ্ছে ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে হরিনামে মেতে থাকা। হরিনামই জগতে কল্যাণ, শাস্তি, সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ ।

এখানে উল্লেখ্য, হিন্দুধর্ম বিকাশের ক্ষেত্রে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর (পঞ্চদশ শতক) প্রেমভক্তির ধর্ম তা আন্দোলনটি বিশেষ অবদান রাখতে সমর্থ হয়। চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রেমভক্তির আন্দোলনটি হিন্দুধর্ম চেতনায় বিভিন্ন দেব-দেবীর অনুসারীদের বিদ্বেষ এবং বর্ণভেদ প্রথা দূর করতে অনেকখানি সমর্থ হয় । প্রেমপূর্ণ ভক্তি দিয়েই পরম আরাধ্য ভগবানকে লাভ করা যায়। আর ধর্ম আচরণে ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণ, নারী, পুরুষ সকলের সমান অধিকার রয়েছে। চৈতন্য মহাপ্রভূর এই প্রেমভক্তি অনুসরণ করে আবির্ভাব ঘটে প্রভু জ সুন্দরের। তিনি চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রদর্শিত পথের সাধক হয়ে ধর্ম সাধনার ক্ষেত্রে এক অনন্য অবদান রেখে গেছেন। তাঁর এই আদর্শকে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে তাঁর পরম ভক্ত মহেন্দ্রজী মহানাম সম্প্রদার প্রতিষ্ঠা করেন এই সম্প্রদায়ের গৌরবোজ্জ্বল নক্ষত্র বৈষ্ণব আচার্য হচ্ছেন ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী। তাঁর সুগভীর গাণ্ডিত্যে এবং একনিষ্ঠ ভক্তিতে কৃষ্ণ-গৌর-বন্ধু শীলা মাধুর্য প্রকাশিত। মহানাম কীর্তন জীবের উদ্ধারের উপকরণ।

 

 

 

 

 

শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত প্রেমভক্তির ধর্মটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচার করার মানসে ১৯৬৬ সালে জুলাই মাসে নিউইয়র্ক শহরে শ্রীল এ.সি. ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ ইসকন' (ISKCON) প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি বৈষ্ণব ধর্মের পরিপোষক । শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা, শ্রীমদ্ভাগবদ, শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থের ইংরেজি ভার্সন প্রকাশ করেন ।

বৈরাগ্যময় জীবনের অনুসারী প্রভুপাদ সমাজ জীবন থেকে বিভিন্ন প্রকার পাপকর্ম দূর করতে সচেষ্ট হন। তাঁর অনুশীলিত ‘হরে কৃষ্ণ' মহামন্ত্র কীর্তন জীবের মুক্তিলাভের অবলম্বন হয়ে জগতে নাম মাহাত্ম্য প্রচার করছে ।

 

ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ১৮৮৮ সালে পাবনা জেলার হিমাইতপুর গ্রামে আবির্ভূত হন । তিনি ‘সৎসঙ্গ' নামে একটি ধর্মীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। সৎসঙ্গের আদর্শ হচ্ছে ধর্ম কোনো অলৌকিক ব্যাপার নয় বরং বিজ্ঞানসিদ্ধ জীবনসুত্র । ভালোবাসাই মহামূল্য যা দিয়ে শান্তি কেনা যায়। এ সংঘের পাঁচটি মূলনীতি হচ্ছে- যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি, স্বস্ত্যয়নী ও সদাচার। আর এ সংঘের মূল স্তম্ভ হিসেবে শিক্ষা, কৃষি, শিল্প ও সুবিবাহ নীতিগুলো অনুশীলিত হচ্ছে। এমনিভাবে ধর্ম ও বিজ্ঞানকে একত্রিত করে জীবন গঠনই সৎসঙ্গীদের আদর্শ। তাঁর ছড়া, কবিতা, প্রার্থনা, গীত, সংকীর্তন গান এগুলো বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছে। সৎসঙ্গ চায় আদর্শ মানুষ, আদর্শ গৃহী, আদর্শ ধর্মযাজক । তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন ধর্মের ঐক্য প্রতিষ্ঠায় নন্দিত হচ্ছে ।

হিন্দুধর্মের বিকাশের স্তরে স্তরে যে নতুন নতুন ধর্মচর্চার রূপ প্রকাশিত হয়েছে, সেক্ষেত্রে অখণ্ডমণ্ডলীর অবদান স্মরণীয় । এঁদের সংগঠনের নাম 'অযাচক আশ্রম'। এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংস ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের চাঁদপুর শহরে আবির্ভূত হন। অযাচক আশ্রমের নামটির মধ্যেই এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে অর্থ যাচঞা না করা এ

 

 

 

 

 

সংগঠনের আদর্শ। স্বাবলম্বী হয়ে সমাজের কল্যাণের জন্য কাজ করাই এ সংগঠনের মুখ্য উদ্দেশ্য। অযাচক আশ্রমের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমবেত উপাসনায় চরিত্র গঠন, সমাজ সংস্কার, ব্রহ্মচর্য, স্বাবলম্বন ও জগতের কল্যাণের কাজে নিযুক্ত থাকা। স্বামী স্বরূপানন্দের আদর্শকে রূপদান করার লক্ষ্যে চরিত্র গঠন আন্দোলন শুরু হয় ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারি। এর মূল আবেদন ‘আমি ভালো মানুষ হব এবং অপরকে ভালো হতে সহায়তা দিব' । স্বামী স্বরূপানন্দ রচিত বহু গ্রন্থ, সংগীত সমাজের কল্যাণ সাধনে বিশেষ অবদান রাখতে সমর্থ হচ্ছে ।

স্বামী স্বরূপানন্দের জীবনাদর্শ থেকে আমরা এ শিক্ষা পাই যে, সকলকে সমানভাবে ভালোবাসতে হবে। সকলের তরে সকলে আমরা – এ ছিল তাঁর কল্যাণময় জীবনভাবনা ।

স্বামী প্রণবানন্দের (১৮৯৬-১৯৪১) সেবাদর্শ হিন্দু সমাজকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করছে। ১৯২১ সালে তিনি দুর্ভিক্ষপীড়িত জনগণের সেবা করেন । তিনি অস্পৃশ্যতাকে দূর করে সমাজে ঐক্য প্রতিষ্ঠার কথা বলতেন । জনগণের সেবা করার জন্য তিনি 'ভারত সেবাশ্রম সংঘ' নামে একটি সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন ।

বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী সাধনায় সিদ্ধি লাভ করার পরও লোকসেবা বা লোকশিক্ষার জন্য সাধারণের মধ্যে নেমে এসেছিলেন । তিনি বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার বারদীতে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে জনগণের সেবা করতে থাকেন । সততা, নিষ্ঠা, সংযম, সাম্য ও সেবা ছিল তাঁর নৈতিক আদর্শের মূলমন্ত্র । তিনি প্রচলিত অর্থে গুরুগিরি করেননি। কিন্তু পালন করেছেন একজন লোকশিক্ষকের ভূমিকা। তাঁর সান্নিধ্যে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা তাঁকে গুরুই বিবেচনা করতেন। বাংলাদেশ এবং ভারতসহ বিদেশের বিভিন্ন স্থানে লোকনাথ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাবা লোকনাথকে কেন্দ্র করে বারদীর লোকনাথ মন্দিরের পরিচালনা পরিষদ, ঢাকার স্বামীবাগে প্রতিষ্ঠিত লোকনাথ মন্দিরকেন্দ্রিক লোকনাথ সেবক সংঘ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এ রকম আরও ধর্মীয় সংগঠন হিন্দুধর্মের প্রচার ও বিকাশে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে চলেছে ।

হিন্দুধর্মের চিন্তা-চেতনায় বিভিন্ন মত ও পথের সন্ধান মেলে। তবে এই বৈচিত্র্যের মধ্যে এক মহামিলন সূত্র লক্ষ করা যায়। হিন্দু ধর্ম সংস্কারপন্থী হয়েও সনাতন ভাবধারা সংরক্ষণ করে চলছে । মানব জীবনের ব্যবহারিক সমৃদ্ধিসহ আধ্যাত্মিক জীবনের পরম কল্যাণ লাভ হিন্দু ধর্মের মৌলিক স্তম্ভ । এটি যুগ পরিক্রমার বৈচিত্র্যময় প্রকাশের মধ্য দিয়ে এক অনন্য ভাবেরই দ্যোতনা বহন করছে। হিন্দুধর্মের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য চেতনা উপলব্ধি করে হিন্দুধর্মাবলম্বীগণ গৌরব বোধ করে থাকেন ।

নতুন শব্দ- সিন্ধুসভ্যতা, জ্ঞানকাণ্ড, সন্ন্যাস ধর্ম, ব্রহ্মসূত্র, শাক্ত, সমন্বয়, একেশ্বরবাদ ।

 

 

 

 

 

অনুশীলনী

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন :

১। হিন্দুধর্মের ক্রমবিকাশকে কয়টি স্তরে বিভক্ত করা হয়েছে?

ক. একটি

গ. তিনটি

খ. দুটি

ঘ. চারটি

২। কোন মহাপুরুষের প্রেমভক্তি অনুসরণ করে বাঙালি হিন্দুধর্ম চেতনার আকাশে প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরের আবির্ভাব

ঘটে?

ক. ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র

খ. ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী

গ. শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু

ঘ. হরিচাঁদ ঠাকুর

i. জাগতিক এবং পারমার্থিক চিন্তার ক্রমবিকাশ

৩। স্মৃতিশাস্ত্র বলতে বোঝায় –

ii. জ্ঞান, ভক্তি ও রাজযোগের সমন্বয়

iii. কর্ম ও জ্ঞানের সংযোগ স্থাপন

নিচের কোনটি সঠিক?

ক. i

গ. iii

খ. ii

ঘ. i ও iii

নিচের অনুচ্ছেদটি পড় এবং ৪ ও ৫ নং প্রশ্নের উত্তর দাও :

নৃপেন্দ্রনাথ মুখার্জী একজন উদার মনের মানুষ । তিনি তাঁর পিতার মৃত্যুবার্ষিকীতে অষ্টপ্রহর নামযজ্ঞের আয়োজন করেন । সেখানে তাঁর গ্রামের উঁচু-নিচু, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলকে আমন্ত্রণ জানান । তার বাড়িতে সকলে নাম সংকীর্তনে মেতে ওঠেন।

৪ । উদ্দীপকের নৃপেন্দ্রনাথের চরিত্রে তোমার পঠিত কোন মহাপুরুষের আদর্শ ফুটে উঠেছে?

ক. স্বামী স্বরূপানন্দ

খ. ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র

গ. হরিচাঁদ ঠাকুর

ঘ. শ্রীচৈতন্যদেব

৫। উক্ত মহাপুরুষের মতাদর্শ থেকে উদ্ভব হয়েছে -

ক. ভক্তিবাদ

খ. মতুয়াবাদ

গ. অযাচক আশ্রম

ঘ. সৎসঙ্গ সংগঠন

 

 

 

 

সৃজনশীল প্রশ্ন :

শংকর বেশ কিছুদিন হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে কোনো চাকুরি যোগাড় করতে না পেরে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এ সময় তার ছোটবেলার বন্ধু দুর্জয় শংকরকে একটি আশ্রমে নিয়ে যায় । এ আশ্রমে কারো কাছ থেকে কোনো চাঁদা বা সাহায্য নেওয়া হয় না। এরা নিজেদের অর্থের সংস্থান নিজেরাই করে। শংকর এ আশ্রমের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করে এবং সকল ভেদাভেদ ভুলে সমাজের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করে ।

ক. অবতারবাদ কী?

খ. একেশ্বরবাদ বলতে কী বোঝায়?

গ. শংকর কোন মহাপুরুষের মতাদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়? তোমার পঠিত বিষয়ের আলোকে ব্যাখ্যা কর।

ঘ. পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে উক্ত মহাপুরুষের মতাদর্শের শিক্ষা মূল্যায়ন কর ।

Content added By
Promotion