Academy

ধর্মাধর্ম নির্ণয়ে বেদের পরেই কোনটির স্থান?

Created: 4 months ago | Updated: 4 months ago

নবম অধ্যায়

ধর্মপথ ও আদর্শ জীবন

ধর্মপথ হচ্ছে ন্যায়ের পথ, সত্যের পথ, অহিংসা এবং কল্যাণের পথ। আমরা কেন ধর্ম পালন করি, সে সম্পর্কে বলা হয়েছে: 'আত্মমোক্ষায় জগদ্ধিতায় চ। নিজের চিরমুক্তি, আর জগতের হিত অর্থাৎ কল্যাণসাধনের জন্য। জীবনের যে পথ অনুসরণ করলে নিজের মোক্ষ বা চিরমুক্তি ঘটে এবং সকলের কল্যাণ হয়, সে পথই ধর্মপথ।

ধর্মপথের সঙ্গে নৈতিক মূল্যবোধের সম্পর্ক রয়েছে। যা নৈতিক তা ধর্ম, যা অনৈতিক তা অধর্ম । যিনি ধর্মপথে চলেন, তিনিই ধার্মিক। ধার্মিক পান স্বর্গ ও মোক্ষ। অধার্মিক পান নরক যন্ত্রণা। বারবার জন্ম, জরা ও মৃত্যুর কষ্ট । ধর্মই ধার্মিককে রক্ষা করে এবং ধর্মেরই জয় হয়। ধর্মগ্রন্থে অনেক উপাখ্যানের মধ্য দিয়েও একথা বলা হয়েছে ।

ধর্ম অনুশীলনের ক্ষেত্রে পারিবারিক জীবনের বলিষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে সততা ও শিষ্টাচার অনুশীলনের গুরুত্ব অপরিসীম । শিষ্টাচার ও শ্রদ্ধা প্রকাশের অন্যতম উপায় হচ্ছে প্রণাম ও নমস্কার। আমরা জানি মাদকাসক্তি বা মাদক গ্রহণ সুস্থ জীবনের পরিপন্থী এবং এ পথ অধর্মের পথ । ধূমপান ও মাদকগ্রহণে ব্যক্তি ও সমাজের ক্ষতি হয়। ধর্মপথে চললে মাদকাসক্তিকে প্রতিরোধ করা সম্ভব । আমরা ধর্মপথে চলব এবং অধর্মের পথ পরিহার করব। এ অধ্যায়ে উল্লিখিত বিষয়সমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করব ।

এ অধ্যায় শেষে আমরা-

  • ধর্মপথের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব
  • নৈতিক মূল্যবোধের সাথে ধর্মপথের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে পারব
  • ধার্মিকের স্বরূপ বর্ণনা করতে পারব
  • ধার্মিক ও অধার্মিকের পরিণতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে পারব
  • ধর্ম ধার্মিককে রক্ষা করে এবং ধার্মিকের জয় হয়- একথার ভিত্তিতে একটি ধর্মীয় উপাখ্যান বর্ণনা করতে পারব
  • ধর্মপথ অনুশীলনের ক্ষেত্রে পারিবারিক জীবনের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে পারব 
  • জীবনাচরণে 'সততাই উৎকৃষ্ট পন্থা- একথা ব্যাখ্যা করতে পারব এবং এ বিষয়ে একটি উপাখ্যান বর্ণনা করতে পারব

 

 

 

 

 

  • শিষ্টাচারের ধারণা ও গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব
  • শিষ্টাচারের দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রণাম ও নমস্কারের ধারণা ও গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব
  • মাদক গ্রহণ অধর্মের পথ- এ ধারণাটি ব্যাখ্যা করতে পারব
  • ধূমপান ও মাদকের কুফল ব্যাখ্যা করতে পারব
  • মাদকাসক্তি প্রতিরোধে পারিবারিক ধর্মীয় সংস্কৃতির গুরুত্ব বিশ্লেষণ করতে পারব 
  • ধর্মপথে চলতে উদ্বুদ্ধ হব, জীবনাচরণে সততা ও শিষ্টাচার প্রদর্শনে আগ্রহী এবং মাদক প্রতিরোধে সচেতন হব ।

 

পাঠ ১ : ধর্মপথের ধারণা

ধর্মপথ হচ্ছে ন্যায়ের পথ । সত্যের পথ, অহিংসা এবং কল্যাণের পথ । আমরা কেন ধর্ম পালন করি, সে সম্পর্কে বলা হয়েছে : 'আত্মমোক্ষায় জগদ্ধিতায় চ' । অর্থাৎ আমরা ধর্ম পালন করি নিজের মোক্ষলাভ এবং জগতের কল্যাণের জন্য। আমরা জানি, মোক্ষলাভের পূর্ব পর্যন্ত বারবার জন্মগ্রহণ করে পৃথিবীতে আসতে হবে । ভোগ করতে হবে জন্ম, জরা ও মৃত্যুর যন্ত্রণা। আর মোক্ষলাভ করলে ব্রহ্ম বা পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মা মিশে যাবে । একেই বলে ব্রহ্মলগ্ন হওয়া । এরই অপর নাম মোক্ষলাভ ।

এ মোক্ষলাভের জন্য কেবল ব্যক্তিগতভাবে সাধনা করলেই চলবে না । তাতে মোক্ষলাভ হবে না । পাশাপাশি

জীবনের কল্যাণ সাধন করতে হবে । কারণ জীবের মধ্যে আত্মারূপে ঈশ্বর বা পরমাত্মা অবস্থান করেন ।

তাই জীব-জগতের কল্যাণসাধনও হিন্দুধর্মাদর্শের একটি প্রধান ভিত্তি ।

সহজ কথায়, যে পথে চললে নিজের মোক্ষলাভ এবং জীব ও জগতের কল্যাণ সাধন হয়, সেই পথই ধর্মপথ ।

ধর্মের দশটি বাহ্য লক্ষণের সঙ্গেও আমরা পরিচিত । ধর্মের এ লক্ষণগুলো অনুসরণ করে জীবনযাপনের যে পথ তাকেই বলে ধর্মপথ ।

বেদ

কোনটা ধর্ম আর কোনটা অধর্ম তা নির্ণয় করার জন্য প্রকৃষ্ট প্রমাণ হচ্ছে ঋগ্‌বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ ও

অথর্ববেদ ।

স্মৃতি

ধর্মাধর্ম নির্ণয় বেদের পরেই স্মৃতিশাস্ত্রের স্থান । বেদের পরে কর্তব্য বা অকর্তব্য ধর্ম বা অধর্ম নির্ণয়ের জন্য রচিত গ্রন্থাবলিকে বলা হয় স্মৃতিশাস্ত্র। মনুসংহিতা, পরাশর সংহিতা, যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা প্রভৃতি স্মৃতিশাস্ত্রের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ । ধর্মাধর্ম নির্ণয়ে স্মৃতিশাস্ত্রগুলো দ্বিতীয় প্রমাণ ।

সদাচার

কোন বিষয়ে বেদ ও স্মৃতিশাস্ত্র থেকে বাস্তবসম্মত উপদেশ না পাওয়া গেলে মহাপুরুষদের আচরণকে দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে এবং সে পথেই চলতে হবে । আবহমান কাল ধরে অনুসৃত ও মহাপুরুষদের দ্বারা অনুশীলিত আচরণই সদাচার । ধর্মাধর্ম নির্ণয়ে সদাচার তৃতীয় প্রমাণ ।

 

 

 

 

বিবেক

অনেক সময় ধর্মাধর্ম নির্ণয়ে কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যাচ্ছে না এরূপ অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় তখন বিবেকের বাণী গ্রহণ করতে হয় । ধর্মাধর্ম নির্ণয়ে বিজ্ঞ ব্যক্তি নিজের বিবেককেও প্রামাণ্য বলে বিবেচনা করেন । বিবেক কী বলে? যে কাজ ব্যক্তিকে বিপথগামী করে এবং সামষ্টিক অমঙ্গল ডেকে আনে, বিবেক সে-কাজকে অধর্ম বলে বিবেচনা করে । কাজেই নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে নির্ণয় করতে হবে : কাজটি করলে ধর্ম হবে, না অধর্ম হবে । নৈতিক মূল্যবোধের বিচারে যা ভালো কাজ তা ধর্মসম্মত এবং যা ভালো কাজ নয়, তা করলে অধর্ম হয় ।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, নৈতিক মূল্যবোধের সাথে ধর্মপথের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। নৈতিক মূল্যবোধ

হচ্ছে বিচারের মানদণ্ড । আর ধর্ম হচ্ছে সেই বিচারের সিদ্ধান্ত বা ফল ।

ব্যক্তি বা সমাজের ক্ষতিকর কাজ ধর্মসম্মত নয় । বিবেক সেখানে বাধা দেবেই ।

সুতরাং ধর্মপথ বলতে বোঝায় বেদ, স্মৃতি, সদাচার ও বিবেকের বিচারে ন্যায় ও সত্যের পথ এবং ধৃতি, ক্ষমা, আত্মসংযম, অক্রোধ প্রভৃতি নৈতিক গুণাবলির প্রতিফলনমূলক পথ ।

একক কাজ : ধর্মপথ সম্পর্কে পাঁচটি বাক্য লেখ ।

নতুন শব্দ : আত্মমোক্ষায়, জগদ্ধিতায়, ব্রহ্মলগ্ন, স্মৃতিশাস্ত্র

পাঠ ২ : নৈতিক মূল্যবোধের সাথে ধর্মপথের সম্পর্ক

আমরা জানি, কোনটা ভালো কাজ বা কল্যাণকর কাজ আর কোনটা মন্দ কাজ, অকল্যাণকর কাজ, তা বিচার করার যে বোধ বা বিবেচনা শক্তি, তাকেই বলে নৈতিক মূল্যবোধ । আবার ভালো কাজ করা ধর্ম এবং মন্দ কাজ করা অধর্ম । অন্য কথায়, নৈতিক মূল্যবোধ হচ্ছে, যে কাজকে ন্যায় আচরণীয় ও কল্যাণকর মনে করে, তা মেনে চললে ধর্ম হয় এবং যা ভালো কাজ নয়, তা করলে অধর্ম হয়। তাহলে নৈতিক মূল্যবোধের সাথে ধর্মপথের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে । নৈতিক মূল্যবোধ হচ্ছে বিচারের মানদণ্ড। আর ধর্ম হচ্ছে সেই বিচারের সিদ্ধান্ত বা ফল ।

এ বিষয়ে একটা উদাহরণ :

পরের দ্রব্য অপহরণ করা বা আত্মসাৎ করা নৈতিক মূল্যবোধের মানদণ্ডে অন্যায় এবং তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আবার ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে পরের দ্রব্য অপহরণ করা অধর্ম। অধর্ম করলে পাপ হয় । পাপ করলে ইহলোকে শাস্তি ভোগ করতে হয় এবং পরলোকে নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় ।

নৈতিক মূল্যবোধ আর ধর্মানুমোদিত আচরণ করার অনুশাসনের উদ্দেশ্য একই ।

নৈতিক মূল্যবোধ বলে : রাগ করবে না ।

ধর্মীয় অনুশাসনও বলে : রাগ করবে না ।

নৈতিকতা ধার্মিকের গুণ । যাঁর নৈতিকতা নেই তিনি অধার্মিক।

 

 

 

 

সুতরাং দেখা যাচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধ ধর্মপথের নির্দেশ দেয় । যিনি সে নির্দেশ মেনে ধর্মপথে চলেন, তিনি ধার্মিক বলে বিবেচিত হন । যিনি তা করেন না, তিনি অধার্মিক বলে গণ্য হন ।| 

দলীয় কাজ : দলে আলোচনা করে মূল্যবোধের সাথে ধর্মপথ সম্পর্কে দশটি বাক্য রচনা কর ।

পাঠ ৩ : ধার্মিকের স্বরূপ

ধর্মের দশটি বাহ্য লক্ষণ (ধৃতি, ক্ষমা, দম, ধী, বিদ্যা, অক্রোধ প্রভৃতি) যাঁর মধ্যে প্রকাশ পায় বা যিনি ধর্মের ঐ দশটি লক্ষণ নিজের জীবনে চলার পথে অনুসরণ করেন, তিনিই ধার্মিক। ধার্মিক ব্যক্তি বেদ, স্মৃতি, সদাচার ও বিবেকের আহ্বানকে প্রামাণ্য বলে মনে করেন। ধার্মিক ব্যক্তি কখনো ধৈর্য হারান না । তিনি ক্ষমতা থাকলেও ক্ষমা করেন। ক্ষমতার দম্ভ দ্বারা তিনি পরিচালিত হন না । তিনি সর্বাবস্থায় নিজেকে সংযত করতে পারেন ।

আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো কেবলই পরিতৃপ্ত হতে চায়। কাম, ক্রোধ লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য যখন আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে, আমরা তখন ইন্দ্রিয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিপথগামী হই । কিন্তু যিনি ধার্মিক, তিনি কাম ক্রোধ প্রভৃতি প্রবৃত্তিকে দমন করতে পারেন । তিনি ইন্দ্রিয়ের ইচ্ছায় চলেন না । বরং ইন্দ্রিয়কেই সংযত করে নিজের ইচ্ছা অনুসারে চালাতে পারেন ।

ধার্মিক ব্যক্তি ধীশক্তি সম্পন্ন । তাঁর প্রজ্ঞা তাঁকে মহান করে তোলে । সকল কিছু বিচার করার অনন্য শক্তি দান করে । তিনি নানা বিদ্যায় পারদর্শী। ধী এবং বিদ্যা তাঁকে চরিত্রের উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করে ধার্মিক ব্যক্তি সত্যপ্রিয়। তিনি কখনও সত্য থেকে দূরে সরে যান না। ধার্মিক ব্যক্তি সুখে-দুঃখে নিরুদ্বেগ থাকেন । আনন্দে অতি উদ্বেল হন না, দুঃখে ভেঙ্গে পড়েন না। দান ও দয়া ধার্মিকের দুটি প্রধান নৈতিক গুণ ।

হিন্দুধর্মের একটি দার্শনিক প্রত্যয় হচ্ছে : জীবের মধ্যে আত্মারূপে ঈশ্বর বাস করেন । জীবঃ ব্রহ্মৈব নাপরঃ’- জীব ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই নয় । ধার্মিক ব্যক্তি শঙ্করাচার্যের এ বাণী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন । তিনি গভীর জ্ঞান, নিষ্কাম কর্ম এবং অকুণ্ঠ ভগবদ্‌ভক্তিকে নৈতিক মূল্যবোধে পরিণত করেছেন। ধার্মিক ব্যক্তি বিনয়ী । তিনি নিজেকে তৃণের চেয়েও নীচু মনে করেন । তিনি বৃক্ষের চেয়েও সহিষ্ণু হন। তিনি সমদর্শী । তাঁর কাছে বর্ণভেদ নেই । জাতিভেদ নেই । ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে তিনি সমান বিবেচনা করেন ।

ধার্মিক ব্যক্তি ত্যাগের দ্বারা ভোগ করেন । তিনি যোগযুক্ত হয়ে জগতের হিতসাধনে আত্মনিবেদন করেন । জীবপ্রেম বা জীবসেবাকে পরম কর্তব্য বলে বিবেচনা করেন। ধার্মিক ব্যক্তি ধর্মপথ অনুসরণ করে আদর্শ জীবন-যাপন করেন । ধার্মিকের এ জীবনবোধ ও নৈতিক মূল্যবোধ যাঁর নেই, তিনি অধার্মিক ।

একক কাজ : ধার্মিকের পাঁচটি গুণ চিহ্নিত কর ।

 

 

 

 

পাঠ ৪ : ধার্মিক ও অধার্মিকের পরিণতি

ধার্মিক সদা সন্তুষ্ট থাকেন । তিনি সদানন্দ, সদা হাস্যময়, সদা প্রফুল্ল । প্রাপ্তি তাঁকে অহংকারী করে না, অপ্রাপ্তি তাঁকে বিষণ্ণ করে না । তিনি তাঁর কর্মকে ঈশ্বরের কর্ম বলে বিবেচনা করেন এবং সকল কর্মের ফল ঈশ্বরে সমর্পণ করেন । ধার্মিক ব্যক্তি ত্যাগ করে আনন্দ পান । সেবা করে তৃপ্ত হন । তাঁর কর্ম জ্ঞান দ্বারা পরিস্রুত এবং ভক্তি দ্বারা বিশোধিত ।

ধর্মগ্রন্থে আছে, ধার্মিক ইহলোকে শান্তি পান এবং পরলোকে তাঁর স্বর্গ লাভ হয়। ধার্মিক ধর্মকর্মের মাধ্যমে চরম অবস্থায় ব্রহ্ম লাভ করেন, তাঁর জীবাত্মা পরমাত্মায় লীন হয়ে যায় এবং ধার্মিক মোক্ষ বা চিরমুক্তি লাভ করেন।

অন্যদিকে অধার্মিক সবসময় অতৃপ্ত থাকেন বলে সর্বদাই বিষণ্ণ থাকেন। কাম তাঁকে তাড়িত করে, ক্রোধ তাঁকে উত্তেজিত করে, লোভ তাঁকে আকর্ষণ করে তাঁর অধঃপতন ঘটায় । ইহলোকে তিনি কু-কর্মে লিপ্ত থাকেন। কখনও কখনও কৃত কু-কর্মের জন্য দণ্ডিত হন এবং দণ্ড ভোগ

করেন । ধর্মশাস্ত্র অনুসারে কু-কর্ম থেকে পাপ অর্জিত হয় । পাপ মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনে । পাপী নরকযন্ত্রণা

ভোগ করেন । নরকযন্ত্রণা ভোগের পর আবার তাঁকে পৃথিবীতে এসে মানবেতর প্রাণিরূপে জন্মগ্রহণ

করতে হয় । জন্ম-নরকযন্ত্রণা-মৃত্যুর চক্রে তিনি কেবল আবর্তিত হতে থাকেন ।

তবে অধর্মের পথ পরিহার করে ধর্মপথে চললে পাপীও পরিশুদ্ধ হয়ে মুক্তিলাভ করতে পারে । লাভ করতে পারে পরম করুণাময় ভগবানের করুণা ।

মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, ধর্ম নষ্ট হলে ধর্মই ধর্মনষ্টকারীকে বিনাশ করে । আর ধর্ম রক্ষিত হলে ধর্মই ধার্মিককে রক্ষা করেন । ধর্মের জয় হয় । অধর্মের ঘটে পরাজয় । ধার্মিক সাময়িকভাবে কষ্ট পেতে পারেন। কিন্তু পরিণামে ধর্মের জয় হয়। ধার্মিক শান্তি পান। ধর্মগ্রন্থ থেকে ধর্মের জয় সম্পর্কে আমরা একটি উপাখ্যান জানব ।

দলীয় কাজ : আলোচনা করে ধার্মিক ও অধার্মিকের পরিণতি সম্পর্কে দশটি বাক্য রচনা কর ।

 

 

 

 

পাঠ ৫ : উপাখ্যান

ধর্মের জয়

অনেক অনেককাল আগের কথা । তখন ছিল সত্যযুগ । দৈত্যদের রাজা হিরণ্যকশিপু ।

দৈত্য আর দেবতাদের মধ্যে চিরকালের ঝগড়া। হিরণ্যকশিপুও তার ব্যতিক্রম হবেন কেন? তিনিও ছিলেন হরিবিদ্বেষী । কিন্তু দৈত্যকুলে জন্ম নিয়েছিলেন এক হরিভক্ত। তিনি রাজা হিরণ্যকশিপুর পুত্র । নাম প্ৰহ্লাদ।

প্রহ্লাদকে গুরুর কাছে অন্য বালকদের সাথে পাঠ গ্রহণ করতে পাঠানো হলো। কিন্তু পাঠে মন নেই

প্রহ্লাদের । সেখানে তাঁর হরিভক্ত হৃদয় তৃপ্তি পাচ্ছে না ।

একদিন রাজা হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে কোলে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- - বৎস প্রহ্লাদ, কোন বস্ত্র তোমার সবচেয়ে প্রিয় বল তো?

পার্থিব কোনো জিনিসই আমার প্রিয় নয়, বাবা। নিবিড় বনে গিয়ে শান্ত হৃদয়ে শ্রীহরির আশ্রয়

নেয়াতেই আমার আনন্দ ।

অবাক হয়ে গেলেন রাজা হিরণ্যকশিপু। কে তার ছেলের কানে এই হরিনাম দিয়েছে? শিশুদের বুদ্ধি

এভাবেই পরের বুদ্ধিতে নষ্ট হয় ।

- প্রহ্লাদকে আবার গুরুগৃহে পাঠাও, তার সুশিক্ষার জন্য

যত্ন নাও- বললেন রাজা ।

কিন্তু শত চেষ্টাতেও প্রহ্লাদের কোনো পরিবর্তন হলো না। তখন রাজা হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন । রাজার আদেশ পেয়ে হুংকার দিয়ে এগিয়ে এল দৈত্যেরা। ভয়ংকর তাদের চেহারা। হাতে তীক্ষ্ণ শূল। যার অগ্রভাগে মৃত্যুর আমন্ত্রণ। বলশালী অসুরেরা বালক প্রহ্লাদের কুসুমকোমল বক্ষ লক্ষ করে নিক্ষেপ করল শূল। কিন্তু হরিনামে পবিত্র বক্ষে সেই শূল বিদ্ধ হলো না ।

প্রহ্লাদকে দেয়া হলো বিষমিশ্রিত অন্ন । দেয়া হলো হাতির পায়ের নিচে। তাঁকে নিক্ষেপ করা হলো বিষধর সর্পের প্রকোষ্ঠে । সুউচ্চ পর্বত থেকে তাঁকে ছুঁড়ে ফেলা হলো কল্লোলিত মহাসমুদ্রে । - কি হলো?- জিজ্ঞেস করলেন রাজা হিরণ্যকশিপু ।

- প্রহ্লাদকে কোনোভাবেই হত্যা করা যাচ্ছে না, মহারাজ। বলল ঘাতকেরা। মহাক্রোধে আরক্তচক্ষু হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে বধ করার জন্য ছুটে গেলেন ।

 

 

 

 

- রে দুর্বিনীত, তুই কার বলে আমার শত্রুর পূজা করছিস? উপেক্ষা করছিস আমার আদেশ ?

- ধর্মের বলে, বাবা । যাকে তুমি শত্রু বলছ তিনি শত্রু নন, বাবা । তিনি সকলের বন্ধু, সকলের প্রাণ, সকলের ত্রাণকারী প্রভু । তিনি সর্বত্র আছেন । সর্বত্র থাকেন । সর্বত্র থেকে তিনি আমাকে রক্ষা করেন । . সর্বত্র থাকেন? - ক্রোধে জ্বলে উঠলেন হিরণ্যকশিপু ।

- আছে? এই স্ফটিক স্তম্ভে তোর হরি আছে ?

· আছেন,  বাবা । - প্রহ্লাদের বিনীত উত্তর ।

তাই নাকি । -সিংহাসন থেকে উঠে দ্রুতবেগে স্তম্ভের দিকে ধেয়ে গেলেন হিরণ্যকশিপু। মুষ্টির আঘাত

করলেন স্তম্ভের উপরে ।

ভীষণ শব্দ হলো সেই স্তম্ভে ।

স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল প্রকম্পিত হলো সেই মহাশব্দে । দেবগণ পর্যন্ত ভীত হলেন সেই শব্দ শুনে । হিরণ্যকশিপু বর পেয়েছিলেন, কোনো দেব, নর, যক্ষ, প্রভৃতি কেউ কোনো অস্ত্র দিয়ে স্বৰ্গ, মর্ত্য্য বা পাতালে কোনো স্থানে, দিনে বা রাতে তাঁকে হত্যা করতে পারবে না । সবাই অবাক হয়ে দেখল, স্ফটিক স্তম্ভ থেকে ভগবান শ্রীহরি বেরিয়ে এলেন নৃসিংহ মূর্তিতে। বসে আছেন তিনি ভাঙা স্তম্ভকেই আসন বানিয়ে । হিরণ্যকশিপু তাঁকে খড়গ দিয়ে আঘাত করতে উদ্যত হলেন । তখন

নৃসিংহ অবতাররূপী শ্রীহরি হুংকার ছেড়ে হিরণ্যকশিপুকে ধরে কোলের উপর ফেলে নখ দিয়ে হত্যা করলেন ।

শ্রীহরি প্রহ্লাদকে দেখা দিলেন । প্রহ্লাদ তাঁর কাছ থেকে চেয়ে নিল শ্রীহরির প্রতি অবিচল ভক্তি। ধর্মই

ধার্মিককে রক্ষা করে । ধর্মই প্রহ্লাদকে রক্ষা করেছিল । ধর্মের জয় অবশ্যম্ভাবী ।

একক কাজ : বিষ্ণু ভক্ত প্রহ্লাদকে তাঁর পিতা শাস্তি দেওয়ার জন্য যে উপায় অবলম্বন করেছিলেন, তার একটা তালিকা প্রস্তুত কর ।

একক কাজ : ধর্মের জয় উপাখ্যান থেকে কী শিক্ষা পেলে? লেখ ।

নতুন শব্দ : সত্যযুগ, হিরণ্যকশিপু, দৈত্যকুল, পার্থিব, শূল, প্রকোষ্ঠ, আরক্তচক্ষু, দুর্বিনীত, 9 অবশ্যম্ভাবী ।

পাঠ ৬ : ধর্মপথ ও পারিবারিক জীবন

মানুষ পরিবারবদ্ধ হয়ে বাস করে । আর আমরা তো জানি পরিবারের সকল সদস্যের স্বার্থ একসূত্রে গাঁথা থাকে । তাই ধর্মপথ অনুসরণ তথা অনুশীলনের ক্ষেত্রে পারিবারিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে । পরিবারে বড়দের কাছ থেকে ছোটরা আচার-আচরণ শেখে। পরিবারের ছোটরা বড়দের অনুসরণ ও অনুকরণ করে। তাই পরিবারে ধর্মপথ অনুশীলন-অনুসরণের চর্চা থাকা চাই । পরিবারে যদি সর্বদা সত্য কথার চর্চা হয়, কেউ যদি মিথ্যার আশ্রয় না নেয়, তাহলে সে পরিবারের কেউ মিথ্যার আশ্রয় নেবে না ।

 

 

 

 

 

 

 

পরিবারে যদি আত্মসংযম শেখানো হয়, লোভকে দমন করার দৃষ্টান্ত থাকে, তাহলে সে পরিবারের কেউ লোভী হবে না । যে পরিবারের ধর্মাদর্শ 'রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন'- এ অক্রোধের চেতনা, সে পরিবারে শান্তি বিরাজ করবেই । সহমর্মিতা ও পরমতসহিষ্ণুতা পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের একটি অতি প্রয়োজনীয় নৈতিক মূল্যবোধ । এর অভাবে গণতন্ত্র ও সংহতি বিনষ্ট হয় ।

পরিবারে কেউ যদি নিজের মত অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়, তাহলে পরমতসহিষ্ণুতার আদর্শ সে পরিবারে থাকতে পারে না । ওই পরিবারের সদস্যরা সমাজেও গণতান্ত্রিক মনোভাব দেখান না। অতি আদরের শিশু-কিশোর সদস্যরা মা-বাবাকে নিজের মত অনুসারে কাজ করতে বাধ্য করে। যখন যা চাইবে, তা দিতে হবে। এ মানসিকতা নিয়ে সে যখন সমাজ-জীবনে আচরণ করতে যায়, তখন সে পরমতসহিষ্ণুতা তো দেখায়ই না, বরং নিজের মত জোর করে অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। পরিবারের সদস্যরা সততা, সত্যপ্রিয়তা, পরমতসহিষ্ণুতা ও মানবতায় মণ্ডিত ধর্মপথ অনুসরণ করলে, পরিবার শান্তিপূর্ণ থাকবে । আর প্রতিটি পরিবার যদি ধর্মপথে চলে, তাহলে সমাজও ধর্মপথে চলবে । সুতরাং ধর্মপথ অনুসরণ-অনুশীলনের ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।

দলীয় কাজ : ধর্মপথ অনুশীলনে পারিবারিক জীবনের ভূমিকা সম্পর্কে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দশটি বাক্য লেখ এবং একটি উদাহরণ দাও ।

পাঠ ৭ : সততাই উৎকৃষ্ট পন্থা

মিথ্যার আশ্রয় নিলে তার ফল ভালো হয় না । তাই বলা হয়, ‘সততাই উৎকৃষ্ট পন্থা' । এ সম্পর্কে একটি উপাখ্যানের বিবরণ দেব।

গরিব কাঠুরিয়ার সততা

ছায়াসুনিবিড় ছোট্ট একটি গ্রাম । গ্রামের পাশে বন । আর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট্ট একটা নদী । ঐ গ্রামে বাস করতেন এক গরিব কাঠুরিয়া। পাশের বন থেকে কাঠ কেটে বিক্রি করে সংসার চালাতেন তিনি।

একদিন তিনি বনে কাঠ কাটতে গেছেন । যে গাছের ডালটা তিনি কুঠার দিয়ে কাটছিলেন, সেটা নদীর ওপর দিয়ে নদীর দিকে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল । গাছের ডালটা কাটার সময় হঠাৎ এক অঘটন ঘটল। কাঠুরিয়ার অসতর্কতায় তাঁর কুঠারটা পড়ে গেল

নদীতে । ঘরে খাবার নেই । কাঠ কেটে বিক্রি করবেন, তারপর চাল-ডাল সব কিনবেন, তবে পরিবারের

সবাই মিলে খাবেন ! এখন যে সবাই মিলে উপোস করে থাকতে হবে! মনের দুঃখে কাঁদতে লাগলেন তিনি ।

 

 

 

 

 

কাঠুরিয়ার দুঃখে জলদেবীর দয়া হলো। তিনি নদীর ভেতর থেকে উপরে উঠে এলেন । শরীরের অর্ধেকটা জলে, অর্ধেকটা জলের উপরে । ডাক শুনে নদীর দিকে তাকাতেই কাঠুরিয়া দেখেন, জলদেবী তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে। মিটিমিটি

- শোন কাঠুরিয়া । -

হাসছেন । তাঁর হাতে রয়েছে একটি সোনার কুঠার।

জলদেবী কাঠুরিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন,

- এ কুঠারটাই তো তোমার, তাই না ?

কাঠুরিয়া জলদেবীর হাতের কুঠারের দিকে তাকালেন। রোদের আলোয় ঝকমক করছে সোনার কুঠার। এ কুঠারটি তাঁর নিজের বলে নিয়ে নিতে পারেন তিনি। তাতে তাঁর দারিদ্র্য-দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে যাবে । সোনালি সুখের আলোতে ভরে উঠবে তাঁদের জীবন, তাঁদের সংসার। কিন্তু তাতে ধর্ম নষ্ট হবে। অসৎ হয়ে যাবেন তিনি । এক মুহূর্তে সবটা ভেবে নিয়ে কাঠুরিয়া মাথা নেড়ে জলদেবীকে জানালেন,

ওটা আমার কুঠার নয় ।

• 'তাই নাকি?'- হেসে বললেন জলদেবী। -

- একটু অপেক্ষা করো আমি আসছি ।'

জলদেবী আবার ডুব দিলেন নদীর জলে। জল থেকে উঠে এসে এবার তিনি কাঠুরিয়াকে একটা রূপার কুঠার দেখালেন । এবারও কাঠুরিয়া জানালেন, ঐ কুঠারটিও তাঁর নয় ।

জলদেবী কাঠুরিয়াকে অপেক্ষা করতে বলে আবার নদীর জলে ডুব দিলেন। এবার তিনি নিয়ে এলেন কাঠুরিয়ার নিজের লোহার কুঠার । কাঠুরিয়া সেই লোহার কুটারটি দেখে বলে উঠলেন,

-হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তো আমার কুঠার ।

জলদেবী মুগ্ধ হলেন দরিদ্র কাঠুরিয়ার সততায় । তিনি কাঠুরিয়াকে সোনা ও রূপার কুঠার দুটিও দিয়ে দিলেন।

কাঠুরিয়ার দারিদ্র্য দূর হলো । তাঁকে আর অতো কষ্ট করে কাঠ কাটতে হয় না। কুঁড়েঘরের জায়গায় দালান উঠল । বেশ কিছু জমিও কিনলেন তিনি ।

তাই না দেখে গাঁয়ের মোড়ল অবাক হয়ে গেলেন । কেমন করে এত তাড়াতাড়ি দরিদ্র কাঠুরিয়া ধনী হয়ে গেল!

মোড়ল এলেন কাঠুরিয়ার বাড়ি ।

কাঠুরিয়ার কাছে সব শুনলেন ।

 

. ‘ও, তাহলে এই কথা! জলদেবীর কৃপায় ধনী! আচ্ছা ।'- মনে মনে বললেন তিনি ।

মোড়ল নদীর ধারে উপস্থিত হয়ে ইচ্ছে করে হাতের লোহার কুঠার নদীতে ফেলে দিয়ে হাঁউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন । তার কান্না শুনে জলদেবী নদীর ভেতর থেকে উঠে এলেন । বললেন, তোমার কি হয়েছে? মোড়ল কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমার কুঠার নদীতে পড়ে গেছে । এখন যে সবাইকে উপোস করে থাকতে হবে । মনের দুঃখে সে আবার কাঁদতে শুরু করে । জলদেবী বললেন, ঠিক আছে আমি দেখছি । এরপর জলদেবী উঠে এলন একটি সোনার কুঠার নিয়ে ।

- এই কুঠার কি তোমার?

লোভে চকচক করে উঠল মোড়লের চোখ ।

তিনি ব্যগ্রকণ্ঠে বলে উঠলেন,

. হ্যাঁ, হ্যাঁ, এটাই আমার কুঠার । 

-জলদেবী খুব রেগে গেলেন । তিনি সোনার কুঠার নিয়ে ডুব দিলেন নদীর ভেতরে ।

অনেকক্ষণ হয়ে গেল ।

জলদেবী আর উঠলেন না ।

মোড়ল বিরস বদনে, বিষণ্ন মনে ফিরে গেলেন তাঁর গাঁয়ে ।

মিথ্যাচার নয় । সততাই উৎকৃষ্ট পন্থা। এ-কথা আমরা মনে রাখব এবং জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে সততার পরিচয় দেব ।

একক কাজ : কাঠুরিয়ার দারিদ্র্য দূর হলো কীভাবে? বোর্ডে লেখ । :

পাঠ ৮: শিষ্টাচার

শিষ্টাচারের ধারণা

সততার মতো শিষ্টাচারও আদর্শ জীবনের অঙ্গ। আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে শিষ্টাচার অপরিহার্য । নম্র, ভদ্র বা শিষ্ট আচারকে বলে শিষ্টাচার । শিষ্টাচার মনুষ্যত্বের অন্যতম প্রধান উপাদান । এ শিষ্টাচারের জন্যও মানুষ পশু-পাখি থেকে আলাদা ।

ধর্মপথে চলার ক্ষেত্রে শিষ্টাচার অন্যতম পাথেয় । প্রথমে পরিবারের কথাই ধরা যাক।

মাতা, পিতা ও অন্যান্য গুরুজনকে আমরা প্রণাম জানাই । এই প্রণাম জানানোর মধ্য দিয়ে যে শিষ্টাচার

প্রকাশ পায়, তার নাম ভক্তি বা শ্রদ্ধা ।

আবার সমবয়সীদের শুভেচ্ছা জানাই এবং ছোটদের স্নেহ করি । সবই শিষ্টাচারের রকমফের।

 

হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

'টিশ্বর আমাদের সৃষ্টি করেছেন। দেবদেবীরা আমাদের নিজ নিজ শক্তি বা গুণ দিয়ে সহায়তা করেন ।

তাই আমরা তাঁদের অব-তি করি, প্রণামমন্ত্র উচ্চারণ করে তাদের প্রণাম জানাই। তাই ধর্মাচারের মধ্য দিয়েও শিষ্টাচার প্রকাশ পায় । শিষ্টাচার একটি নৈতিক মূল্যবোধ এবং ধর্মের অঙ্গ । শিষ্টাচার বা তদ্র ব্যবহারের দ্বারা আমরা মানুষের মন জয় করতে পারি। সমাজজীবনে চলার পথে

শিষ্টাচার একটি প্রয়োজনীয় গুণ বা নৈতিক মূল্যবোধ ।

কারও সঙ্গে দেখা হলে আমরা শুভেচ্ছা বিনিময় করি। আমরা বড়দের প্রণাম করি বা নমস্কার জানাই । সমবয়সীদের শুভেচ্ছা জানাই এবং ছোটদের আশীর্বাদ করি। এক্ষেত্রে প্রথাগত শিষ্টাচার হচ্ছে, বয়সে যে ছোট, সে প্রণাম বা নমস্কার জানাবে। বড়রা কল্যাণ হোক, দীর্ঘজীবী হও ইত্যাদি বলে আশীর্বাদ করবেন। এটাই রীতি।

প্রশান বা নমস্কারের ধারণা

প্রণাম বলতে বোঝায় প্রকৃষ্টরূপে নয়ন বা নমস্কার। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বঙ্গীয় শব্দকোষ” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, প্রণাম চার প্রকার:

১. অভিবাদন

২. পঙ্গজ প্রণাম

৩. অষ্টাঙ্গ প্রণাম

8. নমস্কার

বাক্য দ্বারা 'প্রণাম করি বলে আনত হওয়াকে অভিবাদন বলা হয়। অনেক সময় বাক্য উচ্চারণ না করে কেবল অনত হয়েও অভিবাদন হয়।

"তত্রসার' নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে- রায়, জানুয়, মন্ত্রক, বক্ষস্থল ও দর্শনেন্দ্রিয় যোগে অবনত হয়ে যে প্রণাম করা হয় তাকে পঞ্চাঙ্গ প্রণাম বলে।

জানু, পদ, হন্ত, বক্ষ, বুদ্ধি, শির, বাক্য ও দৃষ্টি প্রণামের এ আটটি অঙ্গ। এ আটটি অঙ্গ ব্যবহার করে প্রণাম করলে তাকে অষ্টাঙ্গ বা শাষ্টাস প্রণাম বল ।

 

 

 

 

নমস্কার

নমস্কার প্রণামের প্রতিশব্দ । তবে এখানে নমস্কার হচ্ছে হাত জোড় করে মাথায় ঠেকানো । নমস্কার তিন প্রকার । যথা- কায়িক, বাচিক ও মানসিক ।

নমস্কারের মাহাত্ম্য সম্পর্কে নৃসিংহ পুরাণে বলা হয়েছে-

‘নমস্কারঃ স্মৃতো যজ্ঞঃ সর্বযজ্ঞেষু চোত্তমঃ ।

নমস্কারেণ চৈকেন নরঃ পুতো হরিং ব্রজেৎ '

অর্থাৎ নমস্কার সকল যজ্ঞের মধ্যে প্রধান । একমাত্র নমস্কার দ্বারা মানব বিশুদ্ধ হয়ে হরিকে লাভ করে ।

একক কাজ : প্রণাম কত প্রকার ও কী কী? লেখ

আমরা পূজা করার সময় নির্দিষ্ট প্রণামমন্ত্র উচ্চারণ করে দেব-দেবীদের প্রণাম জানাই । গুরুজনদের প্রণাম করি এবং নমস্কার জানাই ।

সাধু-সজ্জন-বৈষ্ণব-ভক্তেরা সবাইকে প্রণাম বা নমস্কার করেন। এর মধ্যে একটি ধর্মদর্শন রয়েছে। আসলে আমরা প্রণাম বা নমস্কার করছি কাকে?

হিন্দু ধর্মদর্শন অনুসারে এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে- জীবের মধ্যে আত্মারূপে ব্রহ্ম বা ঈশ্বর অবস্থান করেন, সেই ব্রহ্মকে প্রণাম বা নমস্কার করছি ।

এ ধর্মদর্শনের কারণে সকলেই প্রণম্য । সুতরাং শিষ্টাচারের অঙ্গরূপে প্রণাম বা নমস্কারের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে ।

পাঠ ৯ : মাদক গ্রহণ অধর্মের পথ

আমরা জানি মাদক গ্রহণ বা মাদকাসক্তি অনৈতিক এবং অধর্মের পথ । কারণ মাদকাসক্তি মাদক গ্রহণকারীর স্বাভাবিক চেতনাকে বিমূঢ় করে দেয় । তিনি আর প্রকৃতিস্থ থাকেন না, সুস্থ থাকেন না । আর অসুস্থ দেহ ও মনে তিনি যে আচরণ করেন, তাতে অনৈতিকতা প্রকাশ পায় ।

ধূমপান, মদ, গাঁজা, আফিম, হেরোইন, কোডিন (ফেনসিডিল) ইত্যাদি মাদক । এগুলো গ্রহণ করা একবার শুরু হলে তা নেশায় পরিণত হয় আর সহজে ছাড়া যায় না । মাদকাসক্ত মাদকদ্রব্য না পেলে অস্থির হয়ে ওঠেন । তার আচরণ কখনও কখনও হয়ে ওঠে ধ্বংসাত্মক ।

ধূমপান ও মাদকাসক্তির কুফল

ধূমপান ও মাদকাসক্তি দৈহিক, মানসিক, আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি সাধন করে। ধূমপানের ফলে নানাবিধ রোগ হয়। যেমন- নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, যক্ষ্মা, ফুসফুসের ক্যান্সার, গ্যাস্টিক আলসার, ক্ষুধামান্দ্য, হৃদরোগ ইত্যাদি। তা ছাড়া ধূমপান শুধু ধূমপায়ীরই ক্ষতি করে না, অন্যদেরও ক্ষতির

কারণ হয় ।

 

 

 

মাদকগ্রহণেও নানা প্রকার অসুখ হয় এবং মাদকাসক্ত স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে দূরে সরে যান । মাদকগ্রহণে মানসিক ক্ষতি হয়। মাদকাসক্ত অবস্থায় বিবেকবুদ্ধি লোপ পায়। মাদকাসক্তের চৈতন্য পর্যন্ত লোপ পেতে পারে। মাদকাসক্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কবিকৃতি পর্যন্ত ঘটতে পারে। মাদকদ্রব্য ক্রয় করার জন্য অর্থ যোগাড় করতে গিয়ে মাদকাসক্ত অসৎ উপায় অবলম্বন করতেও দ্বিধা করে না। মাদকাসক্তির কারণে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন পর্যন্ত শিথিল হয়ে যায় ।

মাদকাসক্তি প্রতিরোধে পারিবারিক ধর্মীয় সংস্কৃতির গুরুত্ব

পরিবারই সমাজের প্রথম স্তর । পারিবারিক ধর্মীয় সংস্কৃতি ও নৈতিক মূল্যবোধ গোটা পরিবারের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে । পরিবারের সকল সদস্যকে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে হবে যে আমাদের দেহে আত্মারূপে ব্রহ্ম অবস্থান করছেন। সুতরাং এ দেহ ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের মন্দির। তাকে কোনোভাবেই অপবিত্র করা চলবে না । দ্বিতীয়ত, হিন্দুধর্ম অনুসারে মাদকাসক্তি ঘোরতর পাপ সমূহের অন্যতম । কেবল মাদকাসক্তই পাপী নন, যাঁরা তাঁর সঙ্গ করেন, তাঁরাও পাপী। কারণ মাদকাসক্তের পাপ তাঁদেরও স্পর্শ করে ।

মাদকাসক্তকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনাও একটি পারিবারিক কর্তব্য। সন্তানদের গড়ে তোলা পিতা-মাতার

ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব। তাই লক্ষ রাখা প্রয়োজন সন্তানেরা কেমন করে তাদের দৈনন্দিন জীবনটা অতিবাহিত করছে । সন্তানদের কেবল শাসন নয়, সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। উদ্বুদ্ধ করতে হবে ধর্মীয় সংস্কৃতি ও নৈতিক মূল্যবোধের আলোকে । আমরা ধর্মীয় কল্যাণ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মহত্তর সাধনায় লিপ্ত থাকব ।

পারিবারিক ধর্মীয় সংস্কৃতি ও নৈতিক মূল্যবোধের আলোকে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জীবন হবে পবিত্রতার আলোকে উদ্ভাসিত । তবে পারিবারিক শিক্ষা দিতে হবে কেবল শাসনের আকারে নয়, দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে বলা হয়েছে- 'আপনি আচরি ধর্ম জীবেরে শিখায়' ।

পারিবারিক ধর্মীয় সংস্কৃতি থেকে আমরা এমন শিক্ষা পেতে চাই, যা পরিবারের সকল সদস্যকে ধূমপান ও মাদকগ্রহণের মতো অনৈতিক কাজ থেকে দূরে রাখে । পরিবারের সবাই যেন অঙ্গীকার করে-

‘ধূমপান মাদকগ্রহণ অধর্মের পথ. চালাব না সে পাপপথে আমার জীবনরথ।'

 

 

 

 

বাড়ির কাজ :

১. নিজের জীবন থেকে শিষ্টাচার প্রদর্শনের ঘটনা লিখে এনে শিক্ষকের কাছে জমা দেবে । ২. ‘ধূমপান ও মাদকাসক্তি প্রতিরোধে পরিবারের ভূমিকা'- শীর্ষক একটি প্রবন্ধ রচনা করে এনে শিক্ষকের কাছে জমা দেবে ।

অনুশীলনী

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন :

১। হিরণ্যকশিপু রাজা ছিলেন-

ক. দৈত্যদের

খ. পশুদের

গ. দেবতাদের

ঘ. মানবকুলের

২। মানুষকে কেন নরক যন্ত্রণা ভোগের পর মানবেতর প্রাণীরূপে জন্মগ্রহণ করতে হয়?

ক. পাপ ক্ষয় হয় বলে

খ. পাপ নিঃশেষ হয় না বলে

গ. পুণ্য সঞ্চয় করার জন্য

ঘ. পৃথিবীকে ভালোবাসার কারণে

উদ্দীপকটি পড় এবং ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দাও :

রোদেলা ব্যবহারিক বিজ্ঞানের ছবি এঁকে শিক্ষককে দেখাবে বলে বেঞ্চের উপর রাখল । শিপ্রা হাতের ধাক্কায় ‘ওয়াটার পট' উল্টে দিলে সেটা নষ্ট হয়ে যায়। পরের দিন সে আবার এঁকে আনলে শিপ্রা এবারও তা নষ্ট করার চেষ্টা করে । রোদেলা শিপ্রাকে এমন আচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে সে আঁকতে পারছে না । একথা শুনে রোদেলা তাকে আঁকতে সাহায্য করে ।

৩ । রোদেলার প্রতি শিপ্রার হিংসাত্মক আচরণের কারণ হলো

i. অসহায়তা

ii. অপারগতা

iii. হীনম্মন্যতা

নিচের কোনটি সঠিক?

ক. i ও ii

গ. ii ও iii

খ. ii

ঘ. i, ii ও iii

 

 

৪ । শিপ্রার দুষ্কর্মের প্রতিবাদ না করার মধ্য দিয়ে রোদেলার কোন মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে?

ক. ক্ষমা

খ. বিদ্যানুরাগ

গ. হিংসা

ঘ. অনীহা

সৃজনশীল প্রশ্ন :

১। দিব্যেন্দু ইতিহাসের অধ্যাপক। সকালে পূজাহ্নিক করে তিনি কর্মস্থলে বের হন । তিনি প্রতিদিন পশুপাখিদের খাবার দেন এবং দরিদ্র অসহায়দের প্রচুর দান-ধ্যান করেন। দিব্যেন্দু বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা এবং গ্রন্থ রচনা করেন । সত্য ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে অনেক সময় তিনি প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন । কিন্তু তা সত্ত্বেও কখনও সত্য প্রচারে বিমুখ হন না এবং তাঁর বক্তব্য গ্রহণ করা না হলেও ভেঙ্গে পড়েন না । এ সকল কারণে তিনি প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হন ।

ক. যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা কোন শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত?

খ. জীবঃ ব্রহ্মৈব নাপরঃ - শ্লোকটির অর্থ বুঝিয়ে লেখ।

গ. দিব্যেন্দুর আচরণিক মূল্যবোধের মাধ্যমে সমাজ ও পরিবার কীভাবে উপকৃত হতে পারেতা তোমার পঠিত বিষয়বস্তুর আলোকে ব্যাখ্যা কর। 

ঘ. দিব্যেন্দুর দৃষ্টান্ত প্রমাণ করে যে, ‘সৎকর্ম কখনও বিফলে যায় না' – পঠিত বিষয়বস্তুর আলোকে মূল্যায়ন কর।

২। রিদিমা প্রতিদিন পূজা করার সময় প্রণাম মন্ত্র পাঠ করে দেবতার উদ্দেশে প্রণাম জানায় । পূজা শেষে বাবা-মাকে প্রণাম করে দিনের কাজ শুরু করে । গুরুজনদের প্রতিও সে শ্রদ্ধাশীল । সে কখনও কারো সাথে অসদাচরণ করে না এবং ছোট ভাইবোনদেরকেও অত্যন্ত আদর-যত্ন করে । তাই সে পরিবার ও প্রতিবেশীসহ সকলের কাছেই প্রিয়। মানুষের প্রতি রিদিমার এ আচরণ সমাজের মানুষের মূল্যবোধকে প্রভাবিত করেছে ।

ক. তন্ত্রসার কী?

খ. আমরা দেবতাদের স্তব-স্তুতি করি কেন?

গ. বর্ণিত অনুচ্ছেদে রিদিমার চরিত্রে কোন শিক্ষার প্রতিফলন প্রতিভাত হয়েছে তা তোমার পঠিত বিষয়বস্তুর আলোকে ব্যাখ্যা কর।

ঘ. রিদিমার দৃষ্টান্তই স্মরণ করিয়ে দেয় যে সমাজে শিষ্টাচারের গুরুত্ব অপরিসীম’– কথাটি মূল্যায়ন কর।

Content added By

Related Question

View More

Promotion