ত্যাগের মানসিকতা গড়ে তুলতে হলে মিনাক্ষী দেব কোন জাতক থেকে শিক্ষা নেবে?
নবম অধ্যায়
জাতক
‘জাতক' শব্দের অর্থ হলো যে জাত বা জন্মগ্রহণ করেছে। কিন্তু বৌদ্ধ সাহিত্যে গৌতম বুদ্ধের পূর্বজন্ম বা জন্ম- জন্মান্তরের জীবন-কাহিনীর ঘটনাপ্রবাহ জাতক নামে অভিহিত। বুদ্ধ হওয়ার আগে সিদ্ধার্থ গৌতমকে বহু কল্পকাল নানাকুলে জন্মগ্রহণ করে বোধিজ্ঞান বা বুদ্ধত্ব লাভের জন্য সাধনা করতে হয়েছিল। বোধি বা বুদ্ধত্ব লাভের জন্য যে সত্ত্ব সাধনায় রত থাকেন তাঁকে বোধিসত্ত্ব বলা হয়। এজন্য প্রতিটি জন্মে তিনি বোধিসত্ত্ব নামে অভিহিত। জন্মজন্মান্তরের জীবনপ্রবাহে কর্মফলের কারণে তিনি রাজা, মন্ত্ৰী, দেবতা, বণিক, চণ্ডাল, পশু-পাখি প্রভৃতি নানা কুলে জন্মগ্রহণ করে বোধিসত্ত্ব জীবনচর্চা করেছিলেন। বোধিসত্ত্ব অবস্থায় দান, শীল, নৈষ্ক্রম্য, বীর্য, ক্ষান্তি, মৈত্রী, সত্য, ভাবনা, অধিষ্ঠান ও উপেক্ষা-এই দশবিধ পারমিতা চর্চা করে তিনি চরিত্রের চরমোৎকর্ষ সাধন করেন। অতঃপর শেষজন্মে পূর্ণ প্রজ্ঞাসম্পন্ন হয়ে বোধিজ্ঞান লাভ করেন এবং সম্যক সম্বুদ্ধ নামে খ্যাত হন। জাতকের কাহিনীগুলোতে গৌতম বুদ্ধের বোধিসত্ত্ব জীবনের নানা ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। জাতকের আখ্যানগুলোতে দেখা যায়, তিনি কোথাও ঘটনার প্রধান চরিত্র, কখনো তিনি ঘটনার পর্যবেক্ষক, আবার কোথাও তাঁর ভূমিকা গৌণ। জাতকের কাহিনীগুলো নৈতিক ও মানবিক শিক্ষায় সমৃদ্ধ। জাতকের বিশেষত্ব হলো গল্পের ছলে চারিত্রিক বিশুদ্ধতা ও উৎকর্ষ সাধন করা। বুদ্ধ তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্য ও অনুসারীদের প্রসঙ্গক্রমে অতীত জীবনের ঘটনাবলি বর্ণনা করে নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশসাধনে উদ্বুদ্ধ করতেন। জাতক পাঠে সৎ গুণাবলিসম্পন্ন আদর্শ জীবন গঠন করা যায় এবং সর্বজীবের প্রতি মৈত্রী, করুণা জাগ্রত হয়। এছাড়া জাতকে গৌতম বুদ্ধের সমকালীন আর্থ-সামাজিক অবস্থার বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। জাতকের ভূমিকা এখানেও সীমাবদ্ধ নয়। যে সমস্ত কথাসাহিত্য লোকপরম্পরা চলে আসছে, আদিম অবস্থায় এগুলোর স্বরূপ কেমন ছিল, কীভাবে পরিবর্তিত হলো এবং এগুলো রচনার উদ্দেশ্য কী ছিল প্রভৃতি সম্পর্কে জানতে হলেও জাতকের পঠন-পাঠন আবশ্যক। বিশ্ব-সাহিত্যের ভাণ্ডারে গল্প-উপন্যাস, নাটক প্রভৃতি রচনার চিরন্তন উৎস হিসেবেও জাতকের ভূমিকা অনন্যসাধারণ। এ-কারণে জাতককে প্রাচীন ইতিহাসের অনন্য উৎস বলা হয়। এ অধ্যায়ে আমরা শুক জাতক, সেরিবাণিজ জাতক, জনসন্ধ জাতক এবং সুখবিহারী জাতক- এই চারটি জাতক পাঠ করব । এ অধ্যায় শেষে আমরা-
* বৌদ্ধ জাতকের কাহিনী বর্ণনা করতে পারব;
* বৌদ্ধ জাতকের কাহিনী থেকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করতে পারব।
পাঠ : ১
শুক জাতক
অনেক অনেক দিন আগের কথা। বারানসির রাজা ছিলেন ব্রহ্মদত্ত। তখন হিমবন্ত প্রদেশে বোধিসত্ত্ব শুক পাখিরূপে জন্মগ্রহণ করেন। শুক পাখিরূপী বোধিসত্ত্ব ছিলেন বড়ই বলশালী। তিনি হাজার হাজার শুক পাখির দলপতি ছিলেন। দলপতি শুক ও তাঁর স্ত্রীর একটি পুত্রসন্তান ছিল । উভয়ে সন্তানকে আদর-স্নেহে
লালনপালন করতেন।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে শুক ও তাঁর স্ত্রীর দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে গেল । আগের মতো আর উড়তে পারেন না । মা-বাবাকে বাসায় রেখে শুকসন্তান খাবারের খোঁজে যেত। একদিন উড়ে যেতে যেতে দেখল, সমুদ্রবেষ্টিত একটি সবুজ দ্বীপ। দ্বীপটিতে ছিল একটি আমবন। সেখানে পাকা পাকা রসালো আম। সোনার মতো রং। সে মনের সুখে আমের রস খেল। মধুর মতো মিষ্টি সে রস। ফেরার পথে মা-বাবার জন্য পাকা আম নিয়ে এল।
বোধিসত্ত্ব আম খেয়েই বুঝতে পারলেন আমগুলো ছিল সেই সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপের।
তিনি ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, আমটি কি সেই সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপের ?
ছেলে বললো, হ্যাঁ বাবা।
বোধিসত্ত্ব বললেন, দেখ বাবা, অতদূরে যাওয়া বড়ই কষ্টের। যেসব শুক ওই দ্বীপে যায়, তারা বেশিদিন বাঁচে না। তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান। এই বৃদ্ধ বয়সে আমাদের আর কেউ নেই। আর কোনোদিন ওই দ্বীপে যেও না । কিন্তু শুক সন্তান মা-বাবার উপদেশ শুনলো না। লোভে পড়ে সে প্রায়ই ঐ দ্বীপে আমের রস খেতে যেত।
একদিন সে অনেক আমের রস খেল। এত বেশি খেল যে তার শরীর ভারী হয়ে গেল। তারপর বুড়ো
মা-বাবাকে খাওয়ানোর জন্য সে ঠোঁটে একটি পাকা আম নিয়ে উড়তে আরম্ভ করল। দীর্ঘ পথ চলায় সে
ক্লান্তি বোধ করছিল। তার দুচোখে ঘুম-ঘুম ভাব। তাই হঠাৎ আমটি সমুদ্রে পড়ে গেল ।
ক্লান্তি ও ঘুমে সে চেনা পথ হারিয়ে ফেলল এবং নিচু হয়ে পানি স্পর্শ করে উড়তে লাগল । ক্লান্ত, শ্রান্ত শুকসন্তান এক সময়ে গভীর সমুদ্রে পড়ে গেল। তখনই সমুদ্রের একটি বড় মাছ তাকে গিলে ফেলল। বোধিসত্ত্ব দেখলেন, বেলা যায়। সূর্য ডুবে গেল। আস্তে আস্তে রাতও নেমে এল। তাঁদের সন্তান ফিরে এল না। তিনি বুঝতে পারলেন, সে সমুদ্রে পড়ে মারা গেছে।
মা-বাবা তার জন্য হাহাকার করতে লাগলেন ।
তাঁদের দেখাশোনার আর কেউ রইল না। এক সময় বুড়ো মা-বাবা ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় মারা গেলেন ৷
উপদেশ : গুরুজনের কথা মেনে চলতে হয়।
অনুশীলনমূলক কাজ
শুকসন্তান মা-বাবার উপদেশ না শুনে কী করত? বাবা-মার উপদেশ না শোনায় শুক সন্তানের কী পরিণতি হয়েছিল লেখ ।
পাঠ : ২
সেরিবাণিজ জাতক
বোধিসত্ত্ব একবার সেরিব নামক রাজ্যে ফেরিওয়ালা হয়ে জন্মেছিলেন। তখন তাঁর নাম ছিল সেরিবান। সেই দেশে সেরিবা নামে আরও একজন ফেরিওয়ালা ছিল। সে খুবই লোভী ছিল। একবার বোধিসত্ত্ব সেরিবাকে সঙ্গে নিয়ে অন্ধপুর নগরে বাণিজ্য করতে গিয়েছিলেন।
অন্ধপুরে এক সময় এক ধনী শ্রেষ্ঠী পরিবার বাস করতেন। কিন্তু ধন-সম্পদ হারিয়ে সেই শ্রেষ্ঠী পরিবার গরিব হয়ে যায়। পরিবারের সব পুরুষ একে একে মারা যায়। সেই পরিবারে একটি ছোট মেয়ে ও বুড়ি ঠাকুরমা ছাড়া আর কেউ বেঁচে রইল না। তারা প্রতিবেশীর বাড়িতে কাজ করে অতি কষ্টে সংসার চালাত ।
তাদের বাড়িতে একটি সোনার থালা ছিল। শ্রেষ্ঠী সেই সোনার থালায় ভাত খেতেন। শ্রেষ্ঠীর মৃত্যুর পর সেই থালার ব্যবহার আর কেউ করত না। এভাবে অনেক দিন ব্যবহার না করায় থালাটার গায়ে ময়লা জমে যায়। তারপর ভাঙা থালাবাটির সঙ্গে পড়ে থাকতে থাকতে সেটা আর সোনা বলেও মনে হতো না। বুড়ি ঠাকুরমাও থালাটির কথা ভুলে গিয়েছিলেন।
একদিন ফেরিওয়ালা লোভী সেরিবা ‘কলসি কিনবে, কলসি কিনবে' বলতে বলতে সেই শ্রেষ্ঠীর বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। ফেরিওয়ালার ডাক শুনে মেয়েটি ঠাকুরমাকে বলল, ও ঠাকুরমা, আমাকে একখানা
গয়না কিনে দাও না । ঠাকুরমা বললেন, আমরা গরিব মানুষ, পয়সা পাব কোথায়?
মেয়েটি তখন পুরানো ভাঙা থালাবাটির ভিতর থেকে সোনার থালাটি নিয়ে এসে বলল, এটা তো আমাদের কোনো কাজে লাগে না। এটি বিক্রি করে কিনে দাও না। ঠাকুরমা মেয়েটির কথায় রাজি হয়ে ফেরিওয়ালাকে ডাকলেন। ডেকে বললেন, এই থালার বদলে আমার নাতনিকে একটা গয়না দেবেন?
ফেরিওয়ালা থালাটা উলটে পালটে দেখলো। দেখেই থালাটি সোনার বলে মনে হলো। তখন সে থালার পিছনে সুঁচ দিয়ে দাগ কেটে বুঝল থালাটা সত্যিই সোনার। সঙ্গে সঙ্গে সে তাদের ঠকিয়ে জিনিসটা হাতিয়ে নেবে ঠিক করল। সে বলল, এর আবার দাম কী? সিকি পয়সায় নিলেও ঠকা হয় – এরূপ বলে সে অবহেলার ভান করে থালাটা ফেলে দিয়ে চলে গেল ।
একটু পরেই সেই পথ দিয়ে ফেরার পথে বোধিসত্ত্ব 'কলসি কিনবে, কলসি কিনবে' বলে ডাক দিলেন। ফেরিওয়ালার ডাক শুনে মেয়েটি ঠাকুরমার কাছে আবার গয়না কেনার বায়না ধরল ।
বুড়ি ঠাকুরমা বললেন, নিজের কানেই তো শুনেছ থালাটির কোনো দাম নেই। ঘরে বেচার মতো আর কোনো জিনিস তো নেই ।
মেয়েটি বলল, সেই ফেরিওয়ালা ভালো না। ওর কথা শুনে গায়ে জ্বালা ধরে যায়। এই ফেরিওয়ালার ডাক কত মিষ্টি। এ বোধ হয় থালাটা নিতে রাজি হবে। একবার দেখি না ।
বুড়ি বোধিসত্ত্বকে ডেকে বসতে বললেন। তারপর থালাটা তাঁর হাতে দিলেন। বোধিসত্ত্ব দেখামাত্রই
বুঝলেন থালাটা সোনার। তিনি বললেন, মা, এই থালার দাম লক্ষ টাকা । আমার কাছে এত টাকা তো নেই।
বুড়ি বললেন, একটু আগেই এক ফেরিওয়ালা এসেছিল। সে বলল, এর দাম সিকি পয়সাও নয়। বোধ হয় আপনার পুণ্য বলে থালাটা সোনার হয়ে গেছে। আমরা এটা আপনাকেই দেব। তার বদলে আপনি যা ইচ্ছে দিন। বোধিসত্ত্বের তখন নগদ পাঁচশত টাকা ও পাঁচশত টাকার জিনিসপত্র ছিল। তার থেকে তিনি মাত্র আটটি টাকা রাখলেন। তারপর সোনার থালাটা নিয়ে নদীর কূলে চলে গেলেন। ঘাটে খেয়ানৌকা ছিল। বোধিসত্ত্ব নৌকায় উঠে মাঝিকে বললেন, আমাকে নদী পার করে দাও ভাই ।
এদিকে লোভী সেরিবা আবার বুড়ির বাড়িতে গেল। সে বলল, থালাটা দাও তো। ফিরে যেতে যেতে ভাবলাম থালাটার বদলে কিছু না দিলে ভালো দেখায় না। সেজন্য আবার এলাম। বুড়ি বললেন, সে কী কথা? তুমি না বললে ওটার দাম সিকি পয়সাও হবে না। এইমাত্র একজন সাধু ফেরিওয়ালা এসেছিলেন । বোধ হয় তিনি তোমার মনিব হবেন। তিনি সেটা হাজার টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে গেছেন ।
বুড়ির কথা শোনা মাত্রই লোভী ফেরিওয়ালার মাথা ঘুরে গেল। সে তখন পাগলের মতো লাফালাফি শুরু করল। জিনিসপত্র, টাকাপয়সা যা ছিল ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর, হায়! আমার সর্বনাশ হয়েছে, সেরিবান ছলনা করে আমার লক্ষ টাকার সোনার থালাটা হাতিয়ে নিয়ে গেছে। বলতে বলতে সে বোধিসত্ত্বকে ধরার জন্য নদীতীরের দিকে ছুটল। নৌকা তখন মাঝনদীতে চলে গেছে। সেরিবা পাগলের মতো চিৎকার করে মাঝিকে বলতে লাগল, নৌকা ফেরাও, নৌকা ফেরাও। কিন্তু বোধিসত্ত্বের নিষেধ শুনে মাঝি নৌকা ফেরাল না।
পাঠ : : 3
জনসন্ধ জাতক
অনেক অনেক দিন আগের কথা। সে-সময়ে বারানসিতে ব্রহ্মদত্ত রাজত্ব করতেন। তখন বোধিসত্ত্ব ব্রহ্মদত্ত নামক রাজার পাটরানির গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তখন তাঁর নাম রাখা হয়েছিল অনসন্ধ। তিনি বড় হয়ে বিদ্যাশিক্ষার জন্য তক্ষশীলা গমন করেন। সকল শিল্পশাস্ত্রে পারদর্শিতা লাভ করে বারানসিতে ফিরে আসেন। তিনি যেদিন ফিরে এসেছিলেন সেদিনই রাজা ব্রহ্মদত্ত ছেলের সফলতায় কারাগার থেকে সমস্ত বন্দিকে মুক্তি দেন। তারপর তাঁকে উপরাজ পদে অভিষিক্ত করেন। তাঁর শাসনে প্রজাগণ সুখেই কালযাপন করতে থাকেন।
অভিষেকের কয়েক বছর পর তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। প্রজারা বোধিসত্ত্বকে রাজা নির্বাচন করেন। তিনি নগরের চার দ্বারে, মাঝখানে ও প্রাসাদের নিকটে ছয়টি দানশালা স্থাপন করে দৈনিক ছয় লক্ষ মুদ্রা দান দিতেন। এ মহাদান দেখে জম্বুদ্বীপবাসী বিস্মিত হল। তাঁর শাসনগুণে প্রজারা সন্তুষ্ট হলো। চুরি ডাকাতি বন্ধ হলো। কোথাও বিবাদের লেশমাত্র ছিল না। কারাগার শূন্য হয়ে গেল ।
বোধিসত্ত্ব নিজে পঞ্চশীল রক্ষা করতেন। যথারীতি উপোসথ পালন করতেন। যথাধর্ম রাজ্যশাসনে মনোযোগী ছিলেন। সকলকে ধর্মপথে চলতে, সাধুভাবে নিজ নিজ কার্য সম্পাদন ও ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করতে সর্বদা উপদেশ দিতেন।
একদিন রাজা জনসন্ধ পূর্ণিমার পঞ্চদশীয় উপসোথ দিনে উপোসথ ব্রত গ্রহণ করেন। তিনি ভাবলেন, সমস্ত লোকের যাতে সুখ শান্তি মঙ্গল বর্ধিত হয়, যাতে তারা অপ্রমত্তভাবে চলে আমি তাদেরকে সেরূপ উপদেশ দেব। তিনি ভেরি বাজিয়ে অন্তঃপুর ও নগরবাসীকে সমবেত করালেন। তিনি রাজাঙ্গনে অলংকৃত রাজপালঙ্কে উপবেশন করে নগরবাসীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, নগরবাসীগণ, মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর :
১. বাল্যকালে বিদ্যাশিক্ষা কর।
২. যৌবনে ধন উপার্জন কর ।
৩. কুটিলকর্ম ও কুপ্রবৃত্তি পরিহার কর ।
৪. নিষ্ঠুর ও ক্রোধপরায়ণ হয়ো না ।
৫. মাতাপিতার সেবায় অবহেলা করো না ।
৬. গুরুর নিকট শিক্ষা কর ।
৭. শ্রমণ-ব্রাহ্মণ ও সাধুসজ্জনকে সম্মান প্রদর্শন কর।
৮. প্রাণিহত্যা থেকে বিরত থাক ।
৯. কৃপণতা পরিহার করে খাদ্যভোজ্য ও পানীয় দান কর ।
১০. অন্য পুরুষ বা মহিলার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পরদার লঙ্ঘন করো না। অপ্রমত্ত হও।
দশবিধ কর্তব্য সম্পাদন কর।
রাজার উপরোক্ত দশটি উপদেশ পরবর্তীকালে 'দশরাজধর্ম' বা 'দশবিধ কর্তব্য' নামে পরিচিতি লাভ করে । রাজা সৎ উপদেশ দানের পাশাপাশি নিজেও সৎ জীবনযাপন করতেন এবং ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে রাজকার্য পরিচালনা করতেন ।
রাজার উপদেশ শুনে জনগণও ধর্ম ও ন্যায়ের সঙ্গে জীবনযাপন করে সুখে বসবাস করতে থাকেন।
উপদেশ : রাজা ধার্মিক হলে প্রজারাও ধার্মিক হন ।
অনুশীলনমূলক কাজ
জনসন্ধ কে ছিলেন? দশরাজধর্ম বা দশবিধ কর্তব্যগুলো কী কী লেখ ।
পাঠ : ৪ সুখবিহারী জাতক
পুরাকালে বারানসি ব্রহ্মদত্তের সময় বোধিসত্ত্ব উদীচ্য ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করেন। ঘর সংসার খুব দুঃখময়, গৃহত্যাগ বরং সুখকর – এই ভেবে তিনি হিমালয়ে চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। অবশেষে তিনি ধ্যান ও আর্ট রকম ধ্যানফলের অধিকারী হন। তাঁর পাঁচশত তপস্বী শিষ্য ছিল ।
একবার বর্ষাকালে বোধিসত্ত্ব শিষ্যসহ হিমালয়ে গিয়ে পৌঁছেন। সেখান থেকে নগর ও জনপদে ভিক্ষা করতে করতে বারানসিতে গিয়ে পৌঁছেন। সেখানে তিনি রাজার উদ্যানে অতিথি হয়ে বর্ষার চার মাস অতিবাহিত করেন। তারপর তিনি বিদায় নেওয়ার জন্য রাজার কাছে গেলেন।
রাজা বললেন, আপনি বুড়ো হয়েছেন। এই বয়সে আপনি হিমালয়ে ফিরে যাবেন কেন? শিষ্যদের হিমালয়ের আশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে আপনি এখানে থাকুন। রাজার অনুরোধে তিনি রাজি হলেন। তখন তিনি জ্যেষ্ঠ শিষ্যকে বললেন, তোমার ওপর পাঁচশো শিষ্যের দেখা শোনার ভার দিলাম। তুমি তাদের নিয়ে হিমালয়ে চলে যাও। আমি এখানে থাকব।
বোধিসত্ত্বের এই জ্যেষ্ঠ শিষ্য আগে রাজা ছিলেন। রাজত্ব ছেড়ে এসে তিনি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছেন।
ধ্যানসাধনা করে তিনি আর্ট রকম ধ্যানফলের অধিকারী হন। তিনি গুরুর আদেশ পেয়ে শিষ্যদের নিয়ে
হিমালয়ে চলে যান। সেখানে তপস্বীদের সঙ্গে থাকতে থাকতে তিনি একদিন গুরুদেবকে দেখার জন্য
ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। তখন তিনি বললেন, তোমরা এখানে ভালোভাবে থেকো। আমি একবার গুরুদেবকে
বন্দনা করে আসি ।
এই বলে তিনি বারানসিতে গিয়ে গুরুদেবের নিকট উপস্থিত হন। গুরুদেবকে বন্দনা করে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করেন। তারপর পাশে একখানা মাদুর পেতে শুয়ে পড়েন। ঠিক এ-সময় তপস্বীর সঙ্গে দেখা করার জন্য রাজাও সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি তপস্বীকে বন্দনা করে এক পাশে উপবেশন করলেন।
নবাগত তপস্বী রাজাকে দেখেও বিছানা ছেড়ে উঠলেন না। আয়েশ করে শুয়ে থেকে তিনি বলতে লাগলেন, আহা কী সুখ, আহা কী সুখ! রাজা ভাবলেন তপস্বী বোধ হয় তাঁকে অবজ্ঞা করছেন। তা না হলে এভাবে আহা কী সুখ, আহা কী সুখ বলছেন কেন?
বোধিসত্ত্ব বললেন, মহারাজ, এই তপস্বী আগে আপনার মতো রাজা ছিলেন। কিন্তু তপস্বী হয়ে এখন যে-সুখ পেয়েছেন রাজ্য-সুখ ভোগ করার সময় তা পাননি। রাজসুখ তাঁর কাছে তুচ্ছ মনে হচ্ছে। প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে ধ্যান-সমাধির বিমল সুখে তিনি এখন বিভোর। সেজন্যই হৃদয়ের উচ্ছ্বাসে এরকম বলছেন— এরূপ বলে বোধিসত্ত্ব রাজাকে ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা দেবার জন্য এই গাথা বললেন,
রক্ষকের প্রয়োজন নাহি যার হয়,
অপরের রক্ষা হেতু ব্ৰিত যে নয়,
কামনা-অতীত সেই পুরুষ-প্রবর,
অপার সুখের স্বাদ পায় নিরন্তর ।
অর্থাৎ যাঁর মধ্যে কামনা-বাসনা নেই তিনিই প্রকৃত সুখী। তিনি কারো ছায়ায় নিজেকে রক্ষা করার কথা
ভাবেন না। নিজের জন্য কিছু করার কথা তিনি চিন্তা করেন না ।
এই ধর্ম উপদেশ শুনে রাজা বোধিসত্ত্বকে প্রণাম নিবেদন করে প্রাসাদে চলে গেলেন। তপস্বীও বোধিসত্ত্বকে বন্দনা করে হিমালয়ে প্রত্যাবর্তন করলেন। বোধিসত্ত্ব বারানসিতে থেকে গেলেন। তিনি পূর্ণ বয়সে পূর্ণ জ্ঞানে দেহত্যাগ করে ব্রহ্মলোকে চলে গেলেন ।
উপদেশ : ভোগে নয়, ত্যাগেই সুখ ।
অনুশীলনমূলক কাজ
বোধিসত্ত্ব কেন হিমালয়ে চলে যান? রাজা কেন তপস্বীকে দেখে রেগে গেলেন?
অনুশীলনী
শূণ্যস্থান পূরণ কর
১. তিনি হাজার হাজার শুক পাখির------- ছিলেন।
২. শ্ৰেষ্ঠী সেই------- থালায় ভাত খেতেন।
৩. বোধিসত্ত্ব নিজ------- রক্ষা করতেন ।
8. ধ্যানসাধনা করে তিনি------- ধ্যানফলের অধিকারী হন
৫. যাঁর মধ্যে------- ------- নেই তিনিই প্রকৃত সুখী।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. শুক সন্তান আমের রস খেতে কোথায় যেত ?
২. বুড়ি ঠাকুরমার সোনার থালার দাম কত ?
৩. লোভী ফেরিওয়ালার লোভের পরিণতি কী হলো ?
বর্ণনামূলক প্রশ্ন
১. বোধিসত্ত্ব শুক সন্তানকে কী উপদেশ দিয়েছিলেন এবং কেন ?
2. ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু' কথাটি সেরিবানিজ জাতক অবলম্বনে ব্যাখ্যা কর ।
৩. দশরাজধর্মের গুরুত্ব বাখ্যা কর ।
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১। সুখবিহারী জাতকে বোধিসত্ত্ব গৃহত্যাগ করে কোথায় চলে গেলেন ?
ক. গভীর বনে
খ. হিমালয়ে
গ. নদীর তীরে
ঘ. বৌদ্ধবিহারে
২. তপস্বী : আহা কী সুখ ! – এ কথাটি কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে ?
ক. রাজাকে অবজ্ঞা করার
খ. রাজ্যসুখ ভোগ করার
গ. ধ্যান সমাধির সুখে বিভোর হওয়ার
ঘ. রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার
নিচের অনুচ্ছেদটি পড়ে ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দাও :
সীমান্ত বড়ুয়া পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। তাঁর পিতা দুইটি গার্মেন্টস শিল্পের মালিক । পিতার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি গার্মেন্টস দুইটির মালিক হন এবং নিয়মনীতি পালনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি কর্মচারীদের সম্মান করতেন এবং শীল পালনে ও সৎভাবে স্ব-স্ব কাজ সম্পাদনের উপদেশ দিতেন।
৩। সীমান্ত বড়ুয়ার সাথে জাতকে কোন রাজার চরিত্রের মিল পাওয়া যায় ?
ক. জনসন্ধ
গ. শিবি
খ. বেস্সান্তর
ঘ. ইন্দ্ৰ
৪। সীমান্ত বড়ুয়ার উপদেশ পালনে কর্মচারীদের জীবন হতে পারে
i. সুখকর
ii. শান্তিপূর্ণ
iii. মঙ্গলময়
নিচের কোনটি সঠিক ?
ক. i ও ii
খ. ii ও iii
গ. i ও iii
ঘ. i, ii ও iii
সৃজনশীল প্রশ্ন
১। সৌরভ চাকমা বৃদ্ধ মা-বাবার দেখাশুনা ও সেবাশুশ্রুষা করতেন। বন থেকে কাঠ কেটে এনে বিক্রি করে পরিবারে ভরণপোষণ করতেন। একদিন বাবা বললেন, “লোভের বশবর্তী হয়ে তুমি গভীর বনে যাবে না, সেখানে গেলে কেউ জীবন নিয়ে ফিরে আসে না।” তবুও প্রচুর কাঠ সংগ্রহের আশায় সে গভীর বনে প্রবেশ করলে বিষধর সাপের কামড়ে তাঁর মৃত্যু হয় ।
ক. জাতক কী ?
খ. রাজা ব্রহ্মদত্ত সমস্ত বন্দিকে মুক্তি দেন কেন ?
গ. সৌরভ চাকমার সাথে জাতকে কার চরিত্রের ইঙ্গিত পাওয়া যায় ব্যাখ্যা কর ।
ঘ. সৌরভের বাবার উপদেশ যুক্তিসংগত, কথাটি জাতকের উপদেশের আলোকে বিশ্লেষণ কর ।
২। পুরাকালে বারানসিরাজ ব্রহ্মদত্তের সময় বোধিসত্ত্ব বণিক হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। হঠাৎ বণিকের মৃত্যু হওয়াতে তাঁর পরিবার অসহায় হয়ে পড়ে। মৃত্যুর পর বোধিসত্ত্ব সুবর্ণ হংস হয়ে জন্ম নেন। বোধিসত্ত্ব তাঁর পূর্ব জন্মের পরিবারের অসহায়ত্বের কথা জানতে পেরে একটি করে সোনার পালক বণিকের স্ত্রীর নিকট পৌঁছে দেন, বণিকের স্ত্রী তা বিক্রি করে সংসার চালাত। কিন্তু স্ত্রী ছিল লোভী। একসাথে সব পালক নিতে গিয়ে সুবর্ণ হংসকে মেরে ফেলল। তখন সে হায়! হায়! করতে লাগল ।
ক. সুখ বিহারী জাতকের উপদেশ কী ?
খ. জাতকের পঠন-পাঠন আবশ্যক কেন ? ব্যাখ্যা কর ।
গ. বণিকের স্ত্রীর সাথে জাতকে কার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায় – ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “বণিকের স্ত্রীর শেষ পরিণতি জাতকের সেরিবা ফেরিওয়ালার সাথে সম্পৃক্ত” – এ কথাটির - সাথে তুমি কি একমত ? উত্তরের স্বপক্ষে মতামত দাও ।