একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ১ম পত্র | NCTB BOOK

ব্যবসায় একটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। মানুষের জীবন প্রণালি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান বা শক্তিসমূহ যেভাবে প্রভাব বিস্তার করে, তেমনিভাবে ব্যবসায় এবং তৎসংক্রান্ত কার্যাবলিও পরিবেশগত বিভিন্ন চলক / উপাদান / শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়। পরিবেশের উপাদানসমূহের মধ্যে যেমন রয়েছে ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, মৃত্তিকা, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক উপাদান, তেমনি রয়েছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তি, সরকারি বিধি-বিধান ইত্যাদির মতো অ- প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ। কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের এ সময় পরিবেশগত উপাদান একক এবং সম্মিলিতভাবে অহরহ ঐ স্থানের ব্যবসায়িক কর্মধারা, সিদ্ধান্ত, ফলপ্রদতা ইত্যাদিকে প্রভাবিত করে । 

নিম্নে ব্যবসায়ের উপর পরিবেশের উপাদানসমূহের প্রভাব আলোচনা করা হলো—

১। প্রতিষ্ঠানের জন্য মূলধন প্রাপ্তি (Availability of capital for the venture): ব্যবসায় একটি সৃজনশীল ও উদ্ভাবনমূলক কাজ। ব্যবসায়ীর এরূপ উদ্ভাবনী শক্তিকে বাস্তবে রূপদানের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত মূলধনের। সংগঠন স্থাপন, কলকব্জা ও যন্ত্রপাতি ক্রয়, কাঁচামাল সংগ্রহ ইত্যাদি বাবদ প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। উদার ঋণদান নীতি, সুষ্ঠু ও কার্যকর শেয়ার বাজারের উপস্থিতি এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির উপর মূলধন সরবরাহ পরিস্থিতি নির্ভরশীল। দেশে অনুকূল অর্থনৈতিক পরিবেশ বিদ্যমান থাকলে ব্যবসায়ের মূলধন প্রাপ্তি সহজ হয়। অন্যদিকে প্রতিকূল অর্থনৈতিক পরিবেশ মূলধন প্রাপ্তিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। ফলে ব্যবসায় বাধাপ্রাপ্ত হয়।

২। অনুকূল কর কাঠামো (Favourable tax structure): দেশের বিরাজমান অনুকূল কর ও শুল্ক নীতি ব্যবসায়ের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। দেশে বিদ্যমান কর কাঠামোতে যেসব খাতে বা অঞ্চলে শিল্প-কারখানা ও ব্যবসায় স্থাপনে কর রেয়াত দেয়া হয়, সেসব খাতে বা অঞ্চলে দ্রুত শিল্প কারখানা গড়ে উঠে । প্রতিকূল কর ও শুল্ক কাঠামো নতুন শিল্প স্থাপনকে নিরুৎসাহিত করার সাথে সাথে চালু শিল্প কারখানা ও ব্যবসায় কর্মকাণ্ডের ইতি ঘটায়।

৩। লাইসেন্স প্রাপ্তির সুবিধা (Facility to getting licence): দেশে শিল্প স্থাপন ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন। শিল্প স্থাপনের এরূপ অনুমোদন বা লাইসেন্স প্রাপ্তির সুবিধা বা অসুবিধা ব্যবসায়ী কার্যক্রমে যথাক্রমে ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। তাই দেখা যায়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি অনুমোদন ও লাইসেন্স প্রদানে দীর্ঘসূত্রিতার নীতি ব্যবসায়ী উদ্যোগকে নিরুৎসাহিত করে। আবার এক্ষেত্রে ত্বরিত ব্যবস্থার নীতি শিল্প কারখানা স্থাপনে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে।

৪। ভূমি প্রাপ্তির সুবিধা (Advantages of getting land): শিল্প বা ব্যবসায় স্থাপনে যথাযথ সুবিধা সংবলিত ভূমি প্রয়োজন। সুষ্ঠু যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা, বাজারের নৈকট্য, কাঁচামাল, শ্রমশক্তি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ইত্যাদির সহজলভ্যতা সংবলিত ভূমি যথাযথ শিল্প স্থাপনের সহায়ক। অন্যদিকে শিল্প স্থাপনের উপযোগী ভূমির অপর্যাপ্ততা ব্যবসায় কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করে ।

৫। সুষ্ঠু যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা (Smooth communication and transportation system): সুষ্ঠু ও পর্যাপ্ত যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক উপাদান-যা ব্যবসায় বা শিল্পের প্রতিষ্ঠা ও এর অগ্রগতিতে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা একদিকে যেমন কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য অপরিহার্য, অন্যদিকে উৎপন্ন পণ্য বাজারজাতকরণের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ । আবার উন্নত যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্যও একান্ত অপরিহার্য ।

৬। বাজারে প্রবেশের সুযোগ (Facility to access in the market): উৎপাদিত পণ্য অবাধে বিক্রয়ের সুযোগ তথা পণ্যের বাজার লাভের সুযোগ আরেকটি অর্থনৈতিক উপাদান-যা শিল্পীয় উৎপাদনকে প্রত্যক্ষভাবে উৎসাহিত করে। মূলত পণ্য উৎপাদিত হয় বাজারে বিক্রয়ের নিমিত্তে। এমতাবস্থায়, কোনো পণ্যের বাজার যদি একচেটিয়া বা নিয়ন্ত্রিত বা সংরক্ষণমূলক হয় তবে ঐ শিল্পের অগ্রগতি ব্যাহত হয়। অনেক সময় দেখা যায় পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক, কপিরাইট অথবা অন্য কোনো সরকারি নির্দেশ পণ্যের বাজারকে সংরক্ষিত ও সংকুচিত করে রাখে । এরূপ অবস্থায় ব্যবসায় কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে।

৭। অনুকূল ঋণ ও আর্থিক সুবিধা (Favourable credit and financial facilities): ব্যবসায়ীগণ শিল্প স্থাপন এবং চলমান শিল্পে প্রয়োজনীয় চলতি মূলধন যোগান দেয়ার নিমিত্তে অথবা সম্প্রসারণের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি মূলধন বা ঋণের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। এমতাবস্থায়, কোনো অঞ্চলে এরূপ মূলধন বা ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ না থাকলে ব্যবসায়ীগণ নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। ফলে ব্যবসায় কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়। আবার প্রয়োজনীয় ঋণ বা মূলধনের যোগান দেয়ার জন্য যে অঞ্চলে পর্যাপ্ত ব্যাংক, সুষ্ঠু শেয়ার বাজার বা বিদেশি সাহায্য বিদ্যমান সেখানে সহজেই শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে।

৮। সহায়ক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি (Presence of supporting and service organisations): কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বা শিল্প প্রতিষ্ঠানই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এককে খাত বা শিল্পে উন্নয়ন অন্যান্য অনেক শিল্প বা ব্যবসায়ের সমর্থন বা সহায়তার উপর নির্ভরশীল। তাই ব্যাংক, বিমা, পরিবহন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, ফায়ার সার্ভিস, পাইকারি ও খুচরা দোকান, মেরামতি সপ, টেলিযোগাযোগ, ডাক ইত্যাদির মতো সেবাদানকারি এবং সহায়ক প্রতিষ্ঠান ব্যবসায় প্রচেষ্টাকে বেগবান করে তুলতে পারে ।

৯। সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা (Socio-cultural conditions): কোনো সমাজে নতুন শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ বা উদ্যম গড়ে উঠা না উঠার পেছনে ঐ অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশ বা মূল্যবোধের প্রভাব অনেকখানি। আধুনিক প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক রীতিনীতি, আচার-আচরণ, মূল্যবোধ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, পছন্দ-অপছন্দ, আবেগ-অনুভূতি ইত্যাদি নতুন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার সহায়ক হলেও সনাতনী সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ব্যবসায় উদ্যোগ সৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটায়। সনাতনী সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে বিশ্বাসীগণ সামন্তবাদী চিন্তা- চেতনায় বিশ্বাসী। তাঁরা ব্যবসায়ে অর্থ-বিনিয়োগের চেয়ে ভূমির মালিকানায় অর্থ বিনিয়োগকে অধিক সামাজিক মর্যাদার প্রতীক মনে করেন। ফলে বিনিয়োগ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয় বিধায় ব্যবসায় কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়।

১০। অনুকূল সরকারি নীতিমালা (Favourable government policies): রাষ্ট্রীয় সকল পর্যায়ে প্রণীত ও জারিকৃত বিভিন্ন আইন-কানুন, বিধি-বিধান, সরকারি-আদেশ-অধ্যাদেশ ইত্যাদির বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে একজন ব্যবসায়ী বা শিল্প উদ্যোক্তাকে ব্যবসায় স্থাপন ও পরিচালনা করতে হয়। ব্যবসায়ের জন্মলগ্ন থেকে বিলুপ্তিকাল পর্যন্ত বিভিন্ন আইনকানুন ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করে। সরকারি এরূপ আইনকানুনের মধ্যে কর, শুল্ক, ভ্যাট, ব্যবসায় সংগঠন, ব্যাংক, বিমা, বৈদেশিক বিনিময়, পরিবেশ, শ্রমিক, পরিবহন, আমদানি-রপ্তানি ইত্যাদি বিষয়ক বিধি-বিধান অন্যতম। ব্যবসায়ের প্রতি সরকারের মনোভাব প্রণীত ও জারিকৃত এসব আইন, বিধি-বিধান ইত্যাদিতে প্রতিফলিত হয় ।

১১। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (Economic system): অর্থনৈতিক পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও একটি দেশের ব্যবসায় প্রয়াসকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। ‘মুক্ত’ বা পুঁজিতান্ত্রিক' অর্থ ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে রাষ্ট্রের তেমন হস্তক্ষেপ না থাকায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে উদ্যোগ প্রাধান্য লাভ করে। অন্যদিকে, ‘নিয়ন্ত্রিত’ বা ‘সমাজতান্ত্রিক' অর্থ ব্যবস্থায় উৎপাদনের সমগ্র প্রক্রিয়া রাষ্ট্রের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে বিধায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যবসায় উদ্যোগ গ্রহণ বা শিল্প স্থাপন বাধাগ্রস্ত হয়।

১২। দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা (Political stablility): দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা শিল্প বা ব্যবসায় পরিবেশকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, ঘন ঘন সরকার ও নীতির পরিবর্তন ইত্যাদি শিল্প ও বাণিজ্যিক পরিবেশকে বিঘ্নিত করে। কারণ এরুপ পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও এদের বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ব্যবসায়ের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি সুষ্ঠু নীতিমালা বহাল থাকলে শিল্প-বাণিজ্যের উন্নয়ন ঘটে ।

১৩। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (Science and technology): মানুষের জীবনে নাটকীয় পরিবর্তন সাধনে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারি উপাদান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। বর্তমান যুগের পেনিসিলিন, ওপেনহার্ট সার্জারি, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন ইত্যাদি বিস্ময়কর আবিষ্কার ও ব্যবহার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নেরই ফসল। প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়ন একদিকে যেমন উৎপাদনকে সহজতর করে, উৎপাদনের গুণগত মান ও পরিমাণ বৃদ্ধি করে, তেমনি তা ব্যবসায়ীদের জন্য বিপর্যয়ও সৃষ্টি করতে পারে। কারণ নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব পুরাতন প্রযুক্তির প্রতিস্থাপনকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে ।

উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, ব্যবসায় কর্মকাণ্ড পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান এবং তা থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বা দেশে পরিবেশগত শক্তির এরূপ প্রভাব ভিন্নতর হয়ে থাকে। এজন্য রাষ্ট থেকে রাষ্ট্রে, অঞ্চল থেকে অঞ্চলে ব্যবসায়ের প্রকৃতি, গতিধারা, উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি ইত্যাদিতে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।

Content added || updated By