একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ১ম পত্র | NCTB BOOK

সময়ের সিঁড়ি বেয়ে মানুষের বিভিন্নমুখী চাহিদা পূরণের জন্য যুগে যুগে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন ব্যবসায় সংগঠন। ব্যবসায়ের মালিকানা, প্রকৃতি, আয়তন, কার্যক্ষেত্র ইত্যাদি ভেদে ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করেছে। নিম্নে মালিকানার দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবসায় সংগঠনের প্রকারভেদ দেখানো হলো—

একমালিকানা ব্যবসায়ের ধারণা (Concept of Sole Proprietorship Business)

সাধারণভাবে একজন ব্যক্তির মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবসায়কে একমালিকানা ব্যবসায় বলে। একক মালিকানায় পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ব্যবসায় কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। এজন্য এটিকে সবচেয়ে প্রাচীনতম ব্যবসায় সংগঠন বলা হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বলা যায়, মুনাফা অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে যখন কোনো ব্যক্তি নিজ দায়িত্বে মূলধন যোগাড় করে কোনো ব্যবসা গঠন ও পরিচালনা করে এবং উক্ত ব্যবসায়ে অর্জিত সকল লাভ নিজে ভোগ করে বা ক্ষতি হলে নিজেই তা বহন করে, তখন তাকে একমালিকানা ব্যবসায় বলে। একমালিকানা ব্যবসায় গঠন অত্যন্ত সহজ। যে কোনো ব্যক্তি নিজের উদ্যোগে স্বল্প অর্থ নিয়ে এ জাতীয় কারবার শুরু করতে পারেন এবং অধিক অর্থও বিনিয়োগ করতে পারেন। আইনের চোখে একমালিকানা ব্যবসায়ের গঠন ও পরিচালনায় তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। গ্রামে-গঞ্জে, হাট- বাজার বা রাস্তার পাশে কিংবা নিজ বাড়িতে যে কেউ ছোট-খাটো ব্যবসা শুরু করতে পারে। তবে শহরে বা পৌরসভা এলাকায় উদ্যোক্তাকে ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করে ব্যবসা আরম্ভ করতে হয়। আমাদের দেশের অধিকাংশ ব্যবসায় সংগঠন একমালিকানার ভিত্তিতে গঠিত। শুধু তাই নয় ইউরোপ ও আমেরিকার প্রায় ৮০% ব্যবসায় এক মালিকানাভিত্তিক। আমাদের দেশের সাধারণ মুদি দোকান, চায়ের দোকান, অধিকাংশ খুচরা দোকান একক মালিকানার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ।

অংশীদারি ব্যবসায়ের ধারণা (Concept of Partnership Business)

দুই বা ততোধিক ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ হয়ে নিজেদের মধ্যে মুনাফা বণ্টনের নিমিত্তে যে ব্যবসায় সংগঠন গড়ে তোলে তাকে অংশীদারি ব্যবসায় বলে। ব্যবসায় জগতে একমালিকানা সবচেয়ে প্রাচীন ও জনপ্রিয় হলেও একক মালিকের মূলধনের স্বল্পতা, অসীম দায়, ব্যবসায়ের ক্ষুদ্র আওতা ইত্যাদি সীমাবদ্ধতার জন্য ব্যবসায়ের পরিধি আরো বৃদ্ধি ও ঝুঁকি কমিয়ে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসায় করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তবে অংশীদারি ব্যবসায়ে কিছু কিছু সমস্যাও দেখা দেয়। বিশেষ করে মুনাফা বণ্টন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, দায়িত্ব ও কর্ম বিভাজন, সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ে সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও আস্থার সংকট দেখা দিতে পারে। ফলে অংশীদারি চুক্তিপত্র ও অংশীদারি আইন প্রণয়ন করতে হয়। বাংলাদেশের অংশীদারি ব্যবসায় ‘১৯৩২ সালের অংশীদারি আইন' দ্বারা পরিচালিত হয়। ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইন অনুযায়ী সদস্য সংখ্যা সর্বনিম্ন ২ জন এবং সর্বোচ্চ ২০ জন হবে। তবে অংশীদারি ব্যবসায়টি যদি ব্যাংকিং ব্যবসায় হয় তখন সর্বোচ্চ সদস্য সংখ্যা ১০ এর বেশি হবে না ।

কোম্পানি সংগঠনের ধারণা (Concept of Company Organisation)

একমালিকানা ব্যবসায়ের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে ব্যবসায়ের যে অনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল কালক্রমে তা আর একমালিকানার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। একমালিকানা ব্যবসায়ের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা বিশেষ করে মূলধনের স্বল্পতা ও একক পরিচালনা ও ক্ষুদ্র আয়তনের জন্য অংশীদারি ব্যবসায়ের উৎপত্তি হয়। কিন্তু অংশীদারি ব্যবসায়ও মূলধনের সীমাবদ্ধতা, আইনগত সীমাবদ্ধতা, স্থায়িত্বহীনতা ও অসীম দায়ের ভার থেকে মুক্ত হতে পারেনি। এক সময় মানুষের চাহিদা, প্রয়োজনীয়তা ও ব্যবসায়ের আওতা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলশ্রুতিতে আইনের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয় অধিক মূলধন ও বৃহদায়তনের যৌথ মূলধনী ব্যবসায় যা কোম্পানি সংগঠন নামেও পরিচিত। কতিপয় ব্যক্তি স্বেচ্ছায় মিলিত হয়ে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সম্মিলিতভাবে পুঁজি সরবরাহ করে সীমাবদ্ধ দায়ের ভিত্তিতে যে ব্যবসায় গঠন করে তাকে কোম্পানি সংগঠন বা যৌথ মূলধনী কোম্পানি বলে ।

যৌথ মূলধনী ব্যবসায় আইনের মাধ্যমে সৃষ্ট ও পরিচালিত হয়। সর্বপ্রথম কোম্পানি আইন পাস হয় ব্রিটেনে ১৮৪৪ সালে যা `The joint stock Company Act 1844' নামে পরিচিত ছিল। ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম কোম্পানি আইন পাস হয় ১৮৫০ সালে। ১৯১৩ সালে ভারতীয় কোম্পানি আইন আবার নতুন করে পাস হয়। স্বাধীন বাংলাদেশেও অনেক বছর যাবৎ ১৯১৩ সালের কোম্পানি আইন চালু ছিল । কোম্পানি আইনের ব্যাপক সংষ্কার করে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে নতুন কোম্পানি আইন প্রবর্তন করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের সকল কোম্পানি ব্যবসায় ১৯৯৪ সালের আইন অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে। কতিপয় ব্যক্তি স্বেচ্ছায় মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে যৌথভাবে মূলধন বিনিয়োগ করে দেশের প্রচলিত কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোন ব্যবসায় গঠন করলে তাকে কোম্পানি সংগঠন বলে। এ ব্যবসা নিজ নাম ও সীলমোহর দ্বারা পরিচালিত এবং সদস্যদের থেকে ভিন্ন অস্তিত্বের অধিকারী হয়ে থাকে ।

সমবায় সমিতির ধারণা (Concept of Co-operative Society)

সমবায়ের শাব্দিক অর্থ হলো সম্মিলিত উদ্যোগ বা প্রচেষ্টায় কাজ করা। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা ও চিন্তা থেকেই সমবায়ের উৎপত্তি। শিল্পবিপ্লব ও প্রযুক্তিনির্ভর বৃহদায়তন ব্যবসায় সংগঠনের বিকাশের ফলে পূঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার ভিত যত মজবুত হতে থাকে, এর প্রভাবে সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্যও দেখা দিতে থাকে। স্বল্পবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির পেশাজীবী ও ব্যবসায়িরা আর্থিকভাবে দূরবস্থার সম্মুখীন হতে থাকে। পুঁজিবাদি সমাজের সৃষ্ট এ জাতীয় অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দূরবস্থা থেকে মুক্তির প্রয়াসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমবায় সংগঠন গড়ে উঠে। সর্বপ্রথম সমবায় আন্দোলনের সূচনা হয় পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও জাপানে। তবে সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রপথিক সংগঠন হচ্ছে ১৮৪৪ সালে উত্তর ইংল্যান্ডের রচডেল নামক স্থানে প্রতিষ্ঠিত রচডেল সমবায় সমিতি (Rochdale Equitable Pioneers Society)। ২৮ জন তাঁত শ্রমিকের ২৮ স্টার্লিং পাউন্ড পুঁজি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এ সমবায় সমিতিকে বিশ্বের সর্বপ্রথম সমবায় ব্যবসায় হিসেবে গণ্য করা হয়। সমাজের শ্রমজীবী, মধ্যবিত্ত ও স্বল্পবিত্তের কতিপয় ব্যক্তি স্বেচ্ছায় মিলিত হয়ে সমধিকারের ভিত্তিতে নিজেদের আর্থিক উন্নতির জন্য যে ব্যবসায় সংগঠন গড়ে তোলে তাকে সমবায় সমিতি বলে । মুনাফা অর্জন নয়, সদস্যদের কল্যাণসাধনই সমবায় সমিতির প্রধান উদ্দেশ্য ।

রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের ধারণা (Concept of the State Enterprise)

সাধারণ অর্থে সরকার কর্তৃক গঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবসায়কে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় বলে । এরূপ ব্যবসায় রাষ্ট্র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আবার ব্যক্তিমালিকানাধীন যেকোনো ব্যবসায়কে রাষ্ট্রের প্রয়োজনের জাতীয়করণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ে নিয়ন্ত্রণ, প্রাকৃতিক সম্পদসহ সকল সম্পদের সুসম বণ্টন ও ব্যবহারের উদ্দেশ্যে এবং বিশেষ কিছু জনকল্যাণমূলক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। তাছাড়া দেশরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য অস্ত্র নির্মাণ শিল্পের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার উদ্দেশ্যেও প্রতিষ্ঠা ও পরিচালিত হয়ে থাকে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই রাষ্ট্রীয় পরিচালনায় বেশ কিছু ব্যবসায় পরিচালিত হয়ে থাকে ।

ব্যবসায় জোটের ধারণা (Concept of Business Combination)

ব্যবসায় জোট মূলত কোম্পানি সংগঠনেরই ব্যাপকতর ও বর্ধিত রূপ। উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ধনি দেশসমূহের কোম্পানি মালিকগণ নিজেদের মধ্যকার প্রতিযোগিতা হ্রাস, একচেটিয়া ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা এবং সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের জন্য সম্মিলিত হয়ে জোট গঠন করেন। ট্রাস্ট, কার্টেল, হোল্ডিং কোম্পানি, পুল প্রভৃতি এ ধরনের জোটের বিভিন্ন রূপ। জোট গঠনের ফলে সমাজে ধনি-দরিদ্রের পার্থক্য ব্যাপকতর হয় এবং শ্রেণি সংগ্রামের ধারণা দৃঢ়মূল হতে থাকে ।

যৌথ উদ্যোগে ব্যবসায়ের ধারণা (Concept of Joint Venture Business)

দেশি ও বিদেশি উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে কোনো ব্যবসায় গঠন ও পরিচালনা করা হলে তাকে যৌথ উদ্যোগে ব্যবসায় বলে। উন্নয়নশীল ও ধনি দেশগুলোর উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে এরূপ ব্যবসায় বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এরূপ ব্যবসায়ের বিশেষ সুবিধা হলো, এতে দেশের অভ্যন্তরে বিদেশি পুঁজি ও প্রযুক্তির সহজ আগমন ঘটে, অভ্যন্তরীণ সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার সম্ভব হয় এবং বিদেশি উদ্যোক্তাদের সাহচর্যে দেশীয় উদ্যোক্তাগণ দক্ষতা অর্জন করতে পারে। ফলে শিল্পায়ন ত্বরান্বিত হয় ।

 

Content added By