একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ১ম পত্র | NCTB BOOK

সমাজের কমবিত্তসম্পন্ন, অসহায় ও পশ্চাদপদ শ্রেণির মানুষকে আর্থিক, বৈষয়িক, শিক্ষাগত, স্বাস্থ্যগত আইনগত ইত্যাদি নানান বিষয়ে সহযোগিতা করার জন্য প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ সারাবিশ্বে এনজিও নামে পরিচিত । উল্লিখিত শ্রেণির মানুষকে সংঘবদ্ধ করে তাদের উন্নয়নের ধারায় নিয়ে আসা এবং তাদেরকে উদ্যোগী, প্রত্যয়ী ও দক্ষ করে গড়ে তোলাও এরূপ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য। দেশ ও বিদেশ থেকে দান, অনুদান ও ঋণ সংগ্রহ করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিদেশী সংস্থা বা সরকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের অঙ্গীকারে এরূপ প্রতিষ্ঠানসমূহ অর্থসংস্থান করে। প্রান্তিক পর্যায়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পের উদ্যোক্তাদের ঋণদান, পরামর্শ প্রদান, প্রশিক্ষণদানসহ নানান সহায়তা দিয়ে এ সকল প্রতিষ্ঠান উদ্দীপনামূলক ও সমর্থনমূলক সেবা সহায়তা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে এনজিও ব্যুরোর অধীনে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছিল ২,২০৯টি। ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) প্রতিষ্ঠা করেছে। যার মাধ্যমে জুন ২০১৩ পর্যন্ত ৭১৯ প্রতিষ্ঠানকে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনার সনদ প্রদান করা হয়েছে। এদের মধ্যে ব্রাক, আশা, প্রশিকা, স্বনির্ভর বাংলাদেশ, কারিতাস, টিএমএসএস, শক্তি, ব্যুরো বাংলাদেশ, এসএসএস ইত্যাদি নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কোম্পানি আইনের অধীনে অলাভজনক সংস্থা (Non- profit Organization) হিসেবে নিবন্ধিত হয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান এ ধরনের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। দেশের প্রধান কয়েকটি এনজিও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ

চিত্র : NGO থেকে ঋণ নিয়ে সফল হয়েছেন এমন একজন নারী উদ্যোক্তা

ব্রাক / BRAC / Bangladesh Rural Advancement Committee

BRAC বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এনজিও প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে জনাব ফজলে হোসেন আবেদের নেতৃত্বে এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু । দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে ঋণদান কর্মসূচি ছাড়াও এ সংস্থা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে থাকে । বাংলাদেশের সকল জেলায় এ প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচি বিস্তৃত। ডিসেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত সংস্থাটির মোট ক্রমপুঞ্জিভূত ঋণ বিতরণ ও আদায়ের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১,৬৬,০৯৯.২৬ কোটি ও ১,০৪,৮৮২.২৩ কোটি টাকা। বিতরিত ঋণ সুবিধাভোগীর সংখ্যা ছিল ৫৩,৩৭,৯৫১ জন। যার মধ্যে মহিলা সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৪৬,৭১,০৪৪ জন। প্রতিষ্ঠানটি প্রান্তিক পর্যায়ে ক্ষুদ্র শিল্পের উন্নয়নে যে সকল ক্ষেত্রে ঋণ দেয় তার মধ্যে কাপড় বুনন, হাঁস-মুরগী পালন, আসবাবপত্র তৈরি, তৈল উৎপাদন, গুড়, দড়ি, বাঁশ ও বেতের সামগ্রী তৈরি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানে ইচ্ছুক যুবক ও যুব মহিলাদের বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে । প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এ প্রতিষ্ঠান পরামর্শক সুবিধা প্রদান করে। আধুনিক ডিজাইন ও প্রযুক্তি সরবরাহের মাধ্যমে গ্রামীণ শিল্পজাত পণ্যের মান উন্নয়নে এ প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। দেশের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প; যেমন- হস্তজাতশিল্প সামগ্রী, সিল্ক, জামদানি, নকশী কাঁথা ইত্যাদির উন্নয়নেও ব্রাক কাজ করছে। ব্রাকের নিজস্ব ডেইরি ফার্মে উৎপাদিত আড়ং দুধ বাজারজাত করা হয়। বড় শহরগুলোতে ব্রাকের নিজস্ব বিপণন কেন্দ্র 'আড়ং' সবার নিকট সু পরিচিত।

আশা / ASA

বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ১৯৭৮ সালে আশা প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং ১৯৯২ সালে বিশেষায়িত ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ শুরু করে। আশার উদ্ভাবনমূলক স্বল্প ব্যয় সাপেক্ষ ও টেকসই ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি মডেল হিসেবে বাংলাদেশে পরিচিতি লাভ করেছে। উল্লেখ্য, গ্রামীণ ব্যাংক অনুমোদিত ননব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান; এনজিও নয়। তাদের ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি অত্যন্ত প্রসারিত। তবে বাংলাদেশে যত এনজিও কাজ করছে আশা ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির বিষয়ে অত্যন্ত সফল প্রতিষ্ঠান। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এর ক্রমপুঞ্জিভূত ঋণ বিতরণ দাঁড়িয়েছে ১,০২,৯০৫.০০ কোটি টাকা এবং আদায় ৮৯,৬১১ কোটি টাকা। গ্রামীণ জনপদে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সংগঠিত করে তাদের ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সহায়ক সেবা দিয়ে চলেছে ।

প্রশিকা / Proshika 

প্রশিকা বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ এনজিও। ১৯৭৫ সালে ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জের কয়েকটি গ্রামে প্রশিকার উন্নয়ন কার্যক্রম সূচিত হয় এবং ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি আনুষ্ঠানিকভাবে বৃহত্তর পরিসরে কাজ শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের বিকাশে শুরু থেকেই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র শিল্প, তাত শিল্প, হস্ত শিল্প, গবাদি পশুপালন, মৌমাছি চাষ, চারা উৎপাদনসহ অনেক নতুন নতুন উপজীবিকা সৃষ্টিতে প্রশিকা ভূমিকা রেখেছে। এজন্য প্রশিক্ষণ প্রদান, ঋণদান, তত্ত্বাবধান ইত্যাদি কাজ প্রতিষ্ঠানটি করে থাকে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের হিসাব অনুযায়ী প্রশিকা ৫৯টি জেলায় ২৪,১৩৯টি গ্রাম ও ২,৩৮০টি বস্তিতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। এ সময় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ১৭,৯৪,৭৫৯টি প্রকল্পের মাধ্যমে ক্রমপুঞ্জিভূত ৫,৪০৫.৫৭ কোটি টাকার ঋণ সহায়তা দিয়েছে। এ সময় পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিভূত আদায়ের পরিমাণ ছিল ৫,৯৩৬.৩৩ কোটি টাকা ।

স্বনির্ভর বাংলাদেশ / Shanirvar Bangladesh

১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়ের একটা বিশেষ সেল (Cell) হিসেবে সমাজ উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করলেও ১৯৮৫ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি বেসরকারি সংস্থা হিসেবে নিবন্ধিত হয়ে তৃণমূল জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। আত্মকর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধ করে সদস্যদের আস্থাবর্ধক বিভিন্ন কাজে লাগানোর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। এ পর্যন্ত ৫০টি জেলার ১৫৯টি উপজেলায় এর কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে । প্রতিষ্ঠানটি আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে শুরু থেকে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৫,১৪,৪০০ জন বিত্তহীন ঋণগ্রহীতাকে ২০৮৩.১২ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে এবং খাল আদায় করেছে ১,৮১৩.৬২ কোটি টাকা ।

ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ / Thengamara Mohila Sabuj Sangha TMSS 

বগুড়া জেলাকে কেন্দ্র করে ১৯৮০ সালে TMSS বেসরকারি সংস্থা হিসেবে কাজ শুরু করলেও বর্তমানে বাংলাদেশের ৬৩টি জেলায় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বিস্তৃত । প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই দারিদ্র্য দূরীকরণ, আর্থ- সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি মূলত দরিদ্র ও বিত্তহীন। মহিলাদের মধ্যে কাজ করে। তাদেরকে ঋণ সহায়তা ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি দোকান পরিচালনা, হাস-মুরগি প্রতিপালন ও খামার পরিচালনা, মাছ চাষ, নার্সারি প্রতিষ্ঠা ও কুটির শিল্পের বিভিন্ন কাজে সহায়তা দিয়ে আত্মকর্মসংস্থানে সহায়তা করে। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ৬৩টি জেলার ৩৭,৪০,৭৪৮ জন মহিলাকে এ সংস্থার আওতায় সংঘবদ্ধ করে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিভূত ৯,৪৫৩.৫১ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এবং ক্রমপুঞ্জিভূত ৮,৩৫৯.৪৫ কোটি টাকা ঋণ আদায় করেছে।

মাইডাস / Micro Industries Development Assistance Services / MIDAS

ক্ষুদ্র শিল্পে নিয়োজিত প্রান্তিক শিল্প মালিকদের আর্থিক, কারিগরি ও প্রশিক্ষণ সুবিধা দিয়ে দেশের অর্থনেতিক উন্নয়নে তাদের ভূমিকাকে শক্তিশালী করার জন্য ১৯৮১ সালে NGO ব্যুরোতে নিবন্ধন নিয়ে ১৯৮২ সালে থেকে MIDAS তার কাজ শুরু করে। ক্ষুদ্র শিল্পের উদ্যোক্তা ও মালিকদের ঋণদান, এর সাথে সম্পৃক্তদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, তথ্য ও পরামর্শ প্রদান, নতুন নতুন ব্যবসায় ক্ষেত্র ও উপায়-পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা, নতুন ব্যবসায় ও পদ্ধতিকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নিকট জনপ্রিয়করণ, ক্ষুদ্র শিল্পোৎপাদকদের পণ্য ও সেবা বাজারজাতকরণে সহায়তা দান ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি এক্ষেত্রে স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই যথেষ্ট সুনাম অর্জন করতে সমর্থ হয় । পরবর্তীতে ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠানটি তাদের কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করার জন্য মাইডাস ফাইন্যান্সিং লিমিটেড (MFL) নামে একটা নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান গঠন করে। প্রতিষ্ঠানটি তার ছয়টি কার্যক্রমের মধ্যে MIDI কর্মসূচির অধীনে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানসমূহকে ৫০,০০০ থেকে ১০,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিয়ে থাকে। এছাড়া SED কর্মসূচির আওতায় ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান উন্নয়নে ঋণ প্রদান করে ।

 

Content added || updated By