একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ১ম পত্র | NCTB BOOK

বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে কৃষির অবদান ছিল মাত্র ১৫.৩৩%। শিল্প ও সেবা খাতের অবদান ছিল যথাক্রমে ৩১.২৮ % ও ৫৩.৩৯%। এ তথ্যই প্রমাণ করে, ব্যবসায় ইতোমধ্যেই সকল সমাজে ও অর্থনীতিতে শক্ত ভিত গড়তে সমর্থ হয়েছে। এ পর্যায়ে যদি কোনো দেশ ব্যবসায় উদ্যোগকে উৎসাহিত না করে, নতুন নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণি যদি বের হয়ে আসতে না পারে অথবা ব্যবসায়ী সমাজ যদি নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়ে ব্যবসায় সম্প্রসারণ করতে ব্যর্থ হয়- তবে ঐ দেশের উন্নতির চিন্তা অবাস্তব । সেজন্য সকল দেশেই ব্যবসায় উদ্যোগকে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়ে থাকে। একটা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যবসায় উদ্যোগের গুরুত্ব নিম্নে তুলে ধরা হলো:

ক) অর্থনৈতিক গুরুত্ব (Economic importance) : মানুষ আর্থিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে এবং দেশের আয় ও ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পায় এমন গুরুত্বের বিষয়কেই অর্থনৈতিক গুরুত্ব বলে। ব্যবসায় উদ্যোগের অর্থনৈতিক গুরুত্ব যে সকল ক্ষেত্রে লক্ষণীয় তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

  • ব্যবসায়ের উন্নয়ন (Development of business) : সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টির সবকিছুরই একটা গতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন । তাই কোনো কিছুই স্থির দাঁড়িয়ে থাকে না। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেও কথাটি প্রযোজ্য। একটি দেশের ব্যবসায় উদ্যোগও যদি পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতি বিধান করে এগুতে না পারে তবে নিঃসন্দেহে ঐ দেশ ব্যবসা-বাণিজ্যে পিছিয়ে পড়ে। তাই এ অবস্থা উত্তরণ করে ব্যবসায়ের উন্নয়ন ঘটাতে নতুন নতুন ব্যবসায় উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই ।
  • ব্যবসায় ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ (Extension of the area of business): পরিবর্তনের ধারায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পণ্য, সেবা, পদ্ধতি, প্রক্রিয়া, প্রযুক্তি ইত্যাদি আবিষ্কার ও উদ্ভাবন ঘটছে। কম্পিউটার প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, মোবাইল ফোন প্রযুক্তি ইত্যাদি নতুন হলেও উন্নত দেশগুলো এর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়কে কিভাবে দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছে তা ভাবতেও অবাক লাগে। নতুন নতুন ব্যবসায় উদ্যোগ এ ধরনের কর্মক্ষেত্রে ব্যবসায় সম্প্রসারণ ঘটিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে।
  • সম্পদের সদ্ব্যবহার (Proper utilization of resources) : একটা দেশের খনিজ সম্পদ যদি মাটির নীচেই পড়ে থাকে, জনসংখ্যা যদি জনশক্তিতে উন্নীত না হয়, অন্যান্য সম্পদ ও সম্ভাবনাকে যদি কাজে লাগানো না যায় তবে তা জাতীয় উন্নয়নে কোনই ভূমিকা রাখতে পারে না। নতুন নতুন ব্যবসায় উদ্যোগের ফলে দেশের অব্যবহৃত প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক সম্পদ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব হয় । যা নতুন নতুন সম্পদ সৃষ্টিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।
  • উৎপাদন বৃদ্ধি (Increase of production) : উৎপাদন বলতে নতুন উপযোগ সৃষ্টিকে বুঝায় । বনে একটা বৃক্ষের মূল্য তেমন বেশি নয় । বন থেকে কেটে এনে তা থেকে কাঠ এবং কাঠ থেকে যখন আসবাবপত্র তৈরি করা হয় তখন ঐ বৃক্ষটি আসবাবপত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রতিটা পর্যায়ে মূল্য সংযোজন করতে করতে অনেক মূল্যবান সম্পদ সৃষ্টি করে। ব্যবসায় উদ্যোগের ফলে ছোট-বড় সকল ক্ষেত্রে যখন উৎপাদন বাড়ে তখন সেই সাথে মানুষের আয়, ভোগ, সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সবই বৃদ্ধি পায় । যা নতুন উৎপাদনকে আবার প্রভাবিত করে।
  • ব্যক্তিগত ও জাতীয় আয় বৃদ্ধি (Increase of personal and national income) : নতুন নতুন ব্যবসায় উদ্যোগ শুধুমাত্র উদ্যোক্তা ও উদ্যোক্তাদেরই আয় বৃদ্ধি করে না এই উদ্যোগে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা হয়। ফলে অনেক মানুষের আয়ের সুযোগ ঘটে। দেশে যখন নতুন নতুন ব্যবসায় উদ্যোগ সম্প্রসারণ হয় তখন এর ফলে ব্যাংক, বিমা, পরিবহনসহ বিভিন্ন সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এতে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ও সমৃদ্ধি লাভ করে। সরকারও ভ্যাট, ট্যাক্স, শুল্ক ইত্যাদি বিভিন্ন খাতে রাজস্ব পেয়ে থাকে । ফলে সামগ্রিকভাবেই দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায় ।
  • দক্ষতার উন্নয়ন (Development of efficiency) : পৃথিবীতে সেই জাতিই তত উন্নত যারা দক্ষতার বিচারে এগিয়ে । বৃটিশ, জাপানিজ ও আমেরিকান জাতি দক্ষতার বিচারে এগিয়ে থাকায় সর্বত্রই কর্তৃত্ব করে চলেছে । কম খরচে বেশি উৎপাদন করতে পারা বা সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করতে পারাকেই দক্ষতা বলা হয়ে থাকে । কাজের মধ্য দিয়েই মানুষ কার্যত দক্ষতা অর্জন করে । সেজন্য কাজের সুযোগ থাকা দক্ষতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসায় উদ্যোগ নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র, বাজার, পদ্ধতি ও প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটায়- যা এর সম্পৃক্ত জনশক্তির মানোন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।

খ) সামাজিক গুরুত্ব (Social importance) : সমাজের মানুষের প্রয়োজন পূরণে কাজে লাগে বা বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলায় সহায়তা দেয় এমন প্রয়োজনীয় বিষয়কেই সামাজিক গুরুত্ব হিসেবে দেখা হয় । ব্যবসায় উদ্যোগের সামাজিক গুরুত্ব নিম্নে তুলে ধরা হলো: 

  • বেকার সমস্যার সমাধান (Solution of unemployment problem) : বেকারত্ব একটা অভিশাপ । এটা ব্যক্তির বেলায় যেমনি প্রযোজ্য তেমনি সমাজের ক্ষেত্রেও প্রয়োগযোগ্য। বেকারত্ব মানুষের মাঝে হতাশা ও সমাজে অস্থিরতার সৃষ্টি করে। সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও অপরাধ প্রবণতা সৃষ্টির এটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ । ব্যবসায় উদ্যোগের ফলে নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে ওঠে। নতুন নতুন ব্যবসায় প্রকল্প গৃহীত হয়। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসে- এভাবে ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠায় ব্যাপক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটে। যা দেশের বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
  • নতুন নতুন পণ্য ও সেবা প্রাপ্তি (Receiving new products & services) : নতুন নতুন পণ্য ও সেবা মানুষের জীবনকে স্বচ্ছন্দময় করে তোলে। নতুন উদ্যোক্তা যখন নতুন উদ্যোগ নিয়ে ব্যবসায়ে নামে তখন স্বভাবতই গ্রাহকদের নতুন কিছু দেয়ার আগ্রহ তাদের মধ্যে কাজ করে । প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে গ্রাহকদের সন্তুষ্টির বিষয়টি মাথায় রেখেই পণ্য ও সেবা উৎপাদনে ব্যবসায়ীরা তৎপর থাকে । মোবাইল, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ইত্যাদি নতুন প্রযুক্তির ব্যবসায়ে প্রতিনিয়ত যে নতুন নতুন সেবা যোগ হচ্ছে এবং মানুষ উপকৃত হচ্ছে- তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
  • উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি (Creation of eagerness and inspiration): উদ্যোক্তাগণ সাধারণত ছোট পরিসরের ব্যবসায় দিয়ে শুরু করেন। যখন সে উদ্যোগ সফল হয় তখন তার উদ্যোগে অনেকেই উৎসাহিত হয়। এভাবে উদ্যোক্তা নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসেন। পুরনো উদ্যোক্তা সাফল্যের ধারায় নতুন নতুন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। বিদেশী উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসে। এতে অর্থনীতিতে যেমনি গতির সঞ্চার হয় তেমনি সব ধরনের মানুষ এর সুফল লাভ করায় মানুষের মধ্যেও ইতিবাচক ভাবধারার প্রসার ঘটে ।
  • বিদেশ নির্ভরতা হ্রাস (Reducing the foreign dependency): ব্যবসায় উদ্যোগ বিদেশ নির্ভরতা কমিয়ে একটা দেশকে স্বাবলম্বী ও স্বনির্ভর হতে সাহায্য করে। বাংলাদেশ একসময় টেলিভিশন, ফ্রিজ, কম্পিউটার ইত্যাদি বিভিন্ন সামগ্রী বিদেশ থেকে আমদানি করতো। এখন দেশীয় উদ্যোক্তারাই এগুলো উৎপাদন করছে। গার্মেন্টস এর বিভিন্ন মালামাল এখন দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। এতে একদিকে যেমনি বিদেশ নির্ভরতা কমছে সেই সাথে দেশের ইমেজও বাড়ছে।
Content added By