নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলা সাহিত্য - কবিতা | NCTB BOOK

দ্বিতীয়ে প্রণাম করোঁ মাও বাপ পাত্র ।

যান দয়া হন্তে জন্ম হৈল বসুধায় ॥

পিঁপিড়ার ভয়ে মাও না থুইলা মাটিত ।

কোল দিআ বুক দিআ জগতে বিদিত ॥

অশক্য আছিলঁ মুই দুর্বল ছাবাল ।

তান দয়া হন্তে হৈল এ ধড় বিশাল ॥

না খাই খাওয়াএ পিতা না পরি পরাএ ।

কত দুক্ষে একে একে বছর গোঞাএ ॥

পিতাক নেহায় জিউ জীবন যৌবন।

কনে বা সুধিব তান ধারক কাহন ॥

ওস্তাদে প্রণাম করোঁ পিতা হন্তে বাড় ।

দোসর-জনম দিলা তিঁহ সে আহ্মার ॥

আহ্মা পুরবাসী আছ জথ পৌরজন ।

ইষ্ট মিত্ৰ আদি জথ সভাসদগণ ।

তান সভান পদে মোহার বহুল ভকতি ।

সপুটে প্রণাম মোহার মনোরথ গতি ॥

মুহম্মদ সগীর হীন বহোঁ পাপ ভার ৷

সভানক পদে দোয়া মাগোঁ বার বার ।

Content added By

শাহ মুহম্মদ সগীর আনুমানিক ১৪-১৫ শতকের কবি। মুসলমান কবিদের মধ্যে তিনিই প্রাচীনতম । তিনি গৌড়ের সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের রাজত্বকালে (১৩৯৩-১৪০৯ খ্রিষ্টাব্দ) ইউসুফ জোলেখা কাব্য রচনা করেন। কাব্যটি পঞ্চদশ শতকের প্রথম দশকে রচিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। কাব্যের রাজবন্দনায় ‘মহামতি গেছে' বলে যাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে তিনি গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ বলে অনুমিত। শাহ মুহম্মদ সগীরের কাব্যে চট্টগ্রাম অঞ্চলের কতিপয় শব্দের ব্যবহার লক্ষ করে মুহাম্মদ এনামুল হক তাঁকে চট্টগ্রামের অধিবাসী বলে বিবেচনা করেছেন। কাব্যের রাজবন্দনায় “মুহম্মদ সগীর তান আজ্ঞার অধীন'-এ কথা থেকে ধারণা করা হয় যে, তিনি হয়ত সুলতানের কর্মচারী ছিলেন কিংবা কাব্যচর্চায় তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। শাহ মুহম্মদ সগীর তাঁর ইউসুফ জোলেখা কাব্যে দেশি ভাষায় ধর্মীয় উপাখ্যান বর্ণনা করতে চেয়েছিলেন, তবে কাব্যে ধর্মীয় পটভূমি থাকলেও তা হয়ে উঠেছে মানবিক প্রেমোপাখ্যান ।

Content added By

পুরাবাসী- নগরবাসী। বন্দনা- স্তুতি, প্রশংসা। করোঁ - করি। যান- যার। হন্তে- হতে, থেকে । থুইলা- রাখল । অশক্য- অশক্ত, দুর্বল। আছিলু- ছিলাম। মুই- আমি । ছাবাল- ছাওয়াল, ছেলে, সন্তান । তান - তাঁর । গোঙাও- গুজরান করে, অতিবাহিত করে। পিতাক- পিতাকে। নেহায়- স্নেহে। বিদিত- জানা। মনোরথ- ইচ্ছা, অভিলাষ । জিউ- আয়ু জীবিত থাকা। কনে- কখনও। ধারক- ধারের, ঋণের। কাহন- ষোলোপণ, টাকা ।
বাড়- বাড়া, বেশি। দোসর- দ্বিতীয়। মোহার- আমার। সপুটে- করজোড়ে। সভান- সবার । সভানক- সবার। বসুধায়- পৃথিবীতে। তিঁহ- তিনিও। আহ্মার- আমার। বিদিত- জানা। পিঁপিড়ার ভয়ে মাও না ধুইলা মাটিত- মায়ের স্নেহ মমতার তুলনা নেই। মায়ের সদাজাগ্রত কল্যাণদৃষ্টি সন্তানের জীবনপথের পাথেয় স্বরূপ। শিশুকে মা বহু যত্নে লালন-পালন করেন। পিঁপড়ার ভয়ে মা সন্তানকে মাটিতে রাখে নি- এই কথা উল্লেখ করে কবি মায়ের সেই স্নেহ মমতা ও কল্যাণ দৃষ্টিকেই বড় করে তুলেছেন। অশক্য আছিলঁ মুই দুর্বল ছাবাল-এখানে কবি মানব শিশুর শৈশবকালীন অসহায় অবস্থার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। মায়ের আদর-যত্ন ও পরিচর্যা লাভ করে শিশু ধীরে ধীরে পরিণত মানুষ হয়ে উঠে। কবি তাঁর স্নেহময়ী মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে এই পঙ্ক্তিটি ব্যবহার করেছেন।

Content added || updated By

শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা কাব্যের বন্দনা পর্ব থেকে গৃহীত এই কবিতাংশ ‘বন্দনা’ নামে সংকলিত হয়েছে। ‘বন্দনা' পর্ব যথেষ্ট বড়, এখানে শুধু গুরুজনদের প্রতি বন্দনার অংশটুকু স্থান পেয়েছে। কবি তাঁর মূল কাব্যের প্রারম্ভে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রশংসা করেছেন। সংকলিত এই কবিতাংশে জন্মদাতা পিতামাতার ও জ্ঞানদাতা শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন । পিতামাতা অশেষ দুঃখকষ্ট স্বীকার করে পরম যত্নে সন্তানকে বড় করে তোলেন। শিক্ষক জ্ঞানদান করে তাকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। তাই তাঁদের প্রতি অফুরন্ত শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। কবি তাঁর কাব্য রচনায় সাফল্য লাভের জন্য সবার কাছে দোয়া কামনা করেছেন। শ্রদ্ধাবোধ ও কৃতজ্ঞতা মনুষ্যত্বের প্রধান ধর্ম । কবিতাংশে তা-ই প্রকাশিত হয়েছে।

Content added By