নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় - অর্থনৈতিক নির্দেশকসমূহ ও বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রকৃতি | NCTB BOOK

কোনো দেশের অর্থনীতির উন্নত, অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল অবস্থা বুঝতে হলে প্রথমে আমাদের জানতে হবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কাকে বলে।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারণা

উন্নয়ন বলতে বুঝায় বিদ্যমান অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন। উন্নয়ন হলো সমৃদ্ধি বা সার্বিক মানোন্নয়ন। দেশের সম্পদ ও সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে আর্থ-সামাজিক সমৃদ্ধি ও বিকাশ সাধনকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলা যায়। সম্পদ বলতে দেশের প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদ উভয়কে বোঝায়। উন্নয়ন অর্জনের প্রক্রিয়ায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাহায্য, সহযোগিতা ও সমর্থনেরও প্রয়োজন হয়।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন

অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্বন্ধে সঠিক ধারণা পেতে হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিষয়টি বুঝতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন(Economic Development) ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (Economic Growth) এ দুটিকে অনেক সময় একই অর্থে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এ দুটি এক নয়, কিছুটা পার্থক্য আছে। কোনো দেশের জাতীয় আয়ের বার্ষিক বৃদ্ধির হারকে প্রবৃদ্ধির হার বলা হয়। প্রবৃদ্ধি হার হচ্ছে জাতীয় আয়ের পরিবর্তনের হার। প্রবৃদ্ধির হারের সাথে জনসংখ্যা ও দ্রব্যমূল্যস্তর বিবেচনায় নিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্ধারণ করা হয়। এখানে প্রকৃত মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হয়।

কোনো দেশের প্রবৃদ্ধির হার যদি ২% হয় এবং সে দেশের জনসংখ্যাও যদি ২% হারে বৃদ্ধি পায়, তাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে বলা যাবে না। কারণ, প্রবৃদ্ধির হার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার একই হলে মাথাপিছু আয় একই থাকবে। যদি প্রবৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি হয়, তাহলেই মাথাপিছু আয় বাড়বে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে বলা যাবে। তবে এর সাথে দ্রব্যমূল্যস্তর পরিবর্তনের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে।

ধরা যাক, কোনো নির্দিষ্ট বছরে কোনো দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় ৫% বেড়েছে। একই সময়ে সে দেশের দ্রব্যমূল্যও ৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও জনগণ পূর্বাপেক্ষা অধিকতর দ্রব্য ও সেবা ক্রয়করতে পারবে না। অর্থাৎ তাদের আর্থিক আয় বৃদ্ধি পেলেও তাদের প্রকৃত আয় বাড়েনি। এমতাবস্থায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জিত হয়েছে বলা যাবে না। দ্রব্যমূল্য স্থির থেকে যদি মাথাপিছু আয় বাড়ে অথবা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হার অপেক্ষা কম হয়, তাহলেই প্রকৃত মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাবে। প্রকৃত মাথাপিছু আয় দীর্ঘ সময় ধরে অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকলে তবেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে বলা যাবে।

কোনো দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন বা আয় বৃদ্ধির সাথে দীর্ঘ সময় ধরে মাথাপিছু প্রকৃত আয়ের বৃদ্ধিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলে। এই অব্যাহত প্রকৃত আয় বৃদ্ধি তখনই সম্ভব যখন কোনো দেশের অর্থনীতির কাঠামোগত এবং প্রকৃতিগত পরিবর্তন ঘটে। অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক অবকাঠামো এবং উৎপাদন ও কটন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন।

অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের আওতায় ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণদান কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নততর হয়। দ্রব্য ও সেবার বিপণন ব্যবস্থায় উন্নয়ন ঘটে।'প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন এক নয়।'- ফলে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়ে উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে যায়। উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা কর। উৎপাদিত সম্পদ বা জাতীয় আয় বন্টনে বৈষম্য বা অসমতা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। ফলে উৎপাদনের উপাদানসমূহ বিশেষত শ্রমিক তার ন্যায্য পারিশ্রমিক বা মজুরি লাভ করে। এতে জনগণের সার্বিক কল্যাণ বৃদ্ধি পায় ।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য দেশের সকল জনগণের সর্বাধিক কল্যাণ। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও আয়ের সুষম বন্টন এই কল্যাণ নিশ্চিত করে।

এছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়নে সামাজিক অবকাঠামোরও পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে সুশাসনের সুফল, শিক্ষার সুযোগ এবং স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা সকল জনগণের কাছে পৌঁছে যায়। এতে জনগণের জীবনমানে উন্নয়ন ঘটে। জনগণ উন্নত জীবনযাত্রার সুবিধা উপলব্ধি করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও কমে যায়। অর্থনীতির প্রকৃতিগত পরিবর্তন বলতে কৃষিপ্রধান অবস্থা থেকে শিল্পপ্রধান অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হওয়াকে বোঝায়। এর ফলে দেশ গ্রামীণ অর্থনীতি থেকে শহরভিত্তিক অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়। জনগণের আয় বৃদ্ধি পায় । সঞ্চয় ও মূলধন গঠনের হার এবং বিনিয়োগও বৃদ্ধি পায়। ফলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়, বেকারত্ব হ্রাস পায় এবং উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পায়। জীবনযাত্রার মানে ক্রমাগত উন্নতি হতে থাকে। এই সার্বিক উন্নত অবস্থাকে বলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি যে, প্রবৃদ্ধির হারের তুলনায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি বহুমাত্রিক বিষয়।

কোনো দেশের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোর ক্রমাগত উন্নয়ন ও অর্থনীতির প্রকৃতিগত পরিবর্তনের ফলে সে দেশের জনগণের মাথাপিছু প্রকৃত আয় বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থায় আয়ের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হলে তাকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলে। উন্নয়নের মাত্রার ভিত্তিতে বিশ্বের দেশসমূহকে তিনটি ভাগে বিন্যস্ত করা হয়। উন্নত দেশ, অনুন্নত দেশ ও উন্নয়নশীল দেশ।

উন্নত দেশ

অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে এবং এই উন্নয়ন দীর্ঘ মেয়াদে অব্যাহত আছে এমন দেশকে বলে উন্নত দেশ। উন্নত দেশগুলোর জনগণের মাথাপিছু আয় বেশি। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হারও বেশি এবং সে কারণে জীবনযাত্রা অত্যন্ত উন্নত। এসব দেশে আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো অত্যন্ত উন্নত শিল্পখাত সম্প্রসারিত, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থাউন্নত, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অর্থনীতির অনুকূল। দেশের সকল জনগণের আবাসন, শিক্ষাসুবিধা এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়। শিক্ষার প্রসারের ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানও দ্রুত প্রসার লাভ করে এবং নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপীয় দেশসমূহ, যেমন- ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ডস, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, নরওয়ে, এশীয় দেশসমূহের মধ্যে জাপান ইত্যাদি বিশ্বের উন্নত দেশ। এসব উন্নত দেশের নিম্নোক্ত সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।

১. জীবনযাত্রার উচ্চমান : উন্নত দেশসমূহের প্রধান লক্ষণ হলো এসব দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় অত্যন্ত বেশি। তাদের জীবনযাত্রার মানও অত্যন্ত উঁচু। ২০১৮ সালের বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের প্রধান কয়েকটি উন্নত দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় ছিল বার্ষিক ৩৮, ৪২৮ মার্কিন ডলার থেকে ৭৫,৫০৪ মার্কিন ডলারের মধ্যে।

২. শিল্পায়িত অর্থনীতি : উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতি শিল্পনির্ভর। দ্রুত শিল্পায়নের ফলেই এসব দেশ উন্নতি অর্জন করেছে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে এসব দেশ শিল্পপ্রধান দেশে পরিণত হয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প থেকে এসব দেশে ক্রমে মৌলিক ও বৃহদায়তন শিল্পের প্রসার ঘটেছে।

৩. সঞ্চয়, মূলধন গঠন ও বিনিয়োগের উচ্চহার উচ্চ মাথাপিছু আয়ের কারণে ভোগব্যয় করার পরও জনগণের কাছে উদ্বৃত্ত আয় থাকে যা সঞ্চয় হিসাবে জমা হয়। সঞ্চয়ের উচ্চহারের ফলে মূলধন গঠন ও বিনিয়োগের হারও উচ্চ। ফলে উৎপাদনের পরিমাণও ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়।

৪. উন্নত উৎপাদন পদ্ধতি ও বণ্টন প্রক্রিয়া উন্নত দেশসমূহ যতই উন্নতির পথে অগ্রসর হয় ততই তাদের উৎপাদন পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা উন্নত হয়। উন্নত উৎপাদনের একটি বড় কারণ প্রযুক্তির (Technology) উন্নয়ন। উন্নত প্রযুক্তির কারণে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং উৎপাদন বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। উন্নত দেশে জাতীয় আয় বন্টন ব্যবস্থাও উন্নত। উৎপাদনের উপাদানসমূহ বিশেষত শ্রমিক তার ন্যায্য মজুরি পায়। ফলে আয়বণ্টনে বৈষম্য হ্রাস পায়। এতে জনগণের সার্বিক কল্যাণ বৃদ্ধি পায়।

৫. উন্নত আর্থ-সামাজিক অবস্থা উন্নত দেশসমূহের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এসব দেশের উন্নত আর্থ-সামাজিক কাজ অবকাঠামো। এর মধ্যে রয়েছে-

- উন্নত ব্যাংক ব্যবস্থা ও ঋণদান ব্যবস্থাপনা

- উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা - জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বেকারত্বের অত্যন্ত নিম্নহার

- বিদ্যুৎ, পানি ও জ্বালানির পর্যাপ্ততা

- শিক্ষার উচ্চহার, সকলের জন্য শিক্ষাসুবিধা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ ও সকলের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

৬. উন্নত ও আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা উন্নত দেশগুলোতে কৃষি একটি অপ্রধান খাত হলেও কৃষি উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত। উৎপাদনের পরিমাণ ও কৃষিপণ্যের গুণগত মান উভয়ই উচ্চ।

৭. নিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা ও উন্নত মানবসম্পদ : উন্নত দেশসমূহের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রিত। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে কম হওয়ায় মাথাপিছু আয় অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পায়। এছাড়া শিক্ষার উচ্চহার, যথাযথ প্রশিক্ষণ ও উন্নত স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির কারণে জনগণ মানবসম্পদে পরিণত হয়। এই জনসম্পন্ন দেশের উৎপাদন ও উন্নয়নে প্রভূত অবদান রাখে।

৮. অনুকূল বৈদেশিক বাণিজ্য : উন্নত বিশ্বের কৃষি এবং শিল্পপণ্য উভয়েরই পরিমাণ এবং গুণগতমান উন্নত। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এসব দেশ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাথে অনুকূল বাণিজ্য সম্পর্ক গড়তে পারে। এই সম্পর্কও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক হয়।

৯. ব্যাপক নগরায়ণ । কৃষিপ্রধান অবস্থা থেকে ক্রমশ শিল্পায়ন ঘটার ফলে এবং পথ-ঘাট, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে উন্নত বিশ্বে গ্রামীণ অর্থনীতি শহুরে রূপ লাভ করে। ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী শহরে আসতে থাকে এবংগ্রাম গুলোও ক্রমশ শহরে রূপান্তরিত হয়। 

১০. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা : উন্নত দেশসমূহে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে। এখানে প্রশাসনযন্ত্র স্বচ্ছতার সাথে কাজ করে। দুর্নীতির পরিমাণ খুবই কম। রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ স্থিতিশীল ও উন্নত। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক পরিবেশ গড়ে ওঠে ও তা বজায় থাকে।

অনুন্নত দেশ

প্রধানত মাথাপিছু প্রকৃত আয়ের নিরিখে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। যেসব দেশের জনগণের মাথাপিছু প্রকৃত আয় উন্নত দেশ, যথা- যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং পশ্চিম ইউরোপীয় দেশসমূহের জনগণের মাথাপিছু আয়ের তুলনায় অনেক কম, সেসব দেশকে অনুন্নত দেশ বলা হয়। তবে শুধু মাথাপিছু প্রকৃত আয়ের ভিত্তিতে একটি দেশকে অনুন্নত বলা ঠিক নয়। অনুন্নত দেশ বলতে সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার করতে সক্ষম নয়, এমন দেশকেও বোঝায়। অর্থনীতিবিদদের মতে, যেসব দেশে প্রচুর জনসংখ্যা এবং অব্যবহৃত প্রাকৃতিক সম্পদের সহাবস্থান, সেসব অনুন্নত দেশ। অধ্যাপক র্যাগনার নার্কস বলেন, 'অনুন্নত দেশ হচ্ছে সেসব দেশ যেগুলোতে জনসংখ্যা অত্যধিক ও প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় পুঁজি বা মূলধন কম। এসব দেশে প্রাথমিক পেশার প্রাধান্য, পুঁজির স্বল্পতা ও ব্যাপক বেকারত্ব বিদ্যমান। অনুন্নত দেশের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য নিম্নে আলোচনা করা হলো।

১. নিম্ন মাথাপিছু আয় এবং জীবনযাত্রার নিম্নমান : অনুন্নত দেশের প্রধান বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণ হলো উন্নত দেশের তুলনায় জনগণের অত্যন্ত কম মাথাপিছু আয় এবং জীবনযাত্রার নিম্নমান। জনগণের বৃহত্তর অংশেরই মৌলিক চাহিদাসমূহ, যেমন- খাদ্য, কত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধা ইত্যাদি পূরণ করার সামর্থ্য থাকে না । প্রধান প্রধান উন্নত দেশসমূহে যেখানে মাথাপিছু আয় ৩৮,৪২৮ থেকে ৭৫,৫০৪ মার্কিন ডলার এর মধ্যে (ওয়ার্ল্ড ব্যাংক রিপোর্ট ২০১৮), সেখানে অনুন্নত দেশসমূহের মধ্যে ২০০ ডলারের কম মাথাপিছু আয়ের দেশও রয়েছে।

২. কৃষির ওপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা : অনুন্নত দেশের জনগণের বৃহদাংশ খাদ্য, জীবিকা ও অন্যান্য প্রয়োজন পূরণের জন্য কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কৃষি জাতীয় উৎপাদনের একক বৃহত্তম খাত।

৩. অনুন্নত কৃষি উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা : অনুন্নত দেশে অধিকাংশ জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তবে এসবদেশে কৃষি উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা অনুন্নত। সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ, ত্রুটিপূর্ণ মালিকানা, স্বল্প বিনিয়োগ, কৃষি উপকরণ ও কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও উপাদান, যথা- সার, বীজ, সেচ ও বিপণন সুবিধার অভাব, কৃষির প্রকৃতি নির্ভরতা প্রভৃতি কারণে কৃষি অত্যন্ত অনুন্নত।

৪. ক্ষুদ্র ও অনুন্নত শিল্প খাত পুঁজি এবং দক্ষ জনশক্তির অভাবের কারণে অনুন্নত দেশে শিল্প খাত অত্যন্ত ক্ষুদ্র ও সীমিত। এসব দেশে মৌলিক বা ভারী শিল্প নেই। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্পেরই প্রাধান্য দেখা যায়। সাধারণত মোট জাতীয় উৎপাদনে শিল্প খাতের অবদান শতকরা মাত্র ৮ থেকে ১০ ভাগ।

৫. মূলধন গঠন ও বিনিয়োগের নিম্নহার এবং ব্যাপক বেকারত্ব : অনুন্নত দেশে মাথাপিছু আয় কম বলে জনগণের আয়ের সবটাই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ভোগের জন্য ব্যয় করতে হয়। এ কারণে জনগণের সঞ্চয়ের হার অত্যন্ত কম। ফলে মূলধন বা পুঁজির স্বল্পতা দেখা দেয় এবং বিনিয়োগের হার নিম্নমুখী হয়। বিনিয়োগ খুব কম বলে নতুন উৎপাদন বা শিল্প স্থাপনের গতি খুব মন্থর। ফলে নতুন কর্মসংস্থান হয় না। বেকারত্ব বেড়ে যায়। মাথাপিছু আয় কম হতে থাকে। এইভাবে দারিদ্র্যের চক্রে দেশটি আবর্তিত হয়।

৬. প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনশক্তির অসম্পূর্ণ ব্যবহার : প্রাকৃতিক সম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন মূলধন বা পুঁজি এবং দক্ষ জনশক্তি। অনুন্নত দেশে পুঁজি এবং কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তির এতই অভাব যে, দীর্ঘকাল ধরেও দেশে কী কী খনিজ সম্পদ কী পরিমাণে আছে তা নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না। ফলে সম্পদ থাকা সত্ত্বেও এসব দেশ দরিদ্র থেকে যায়।

৭. জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার এবং অদক্ষ জনশক্তি : অশিক্ষা, কুসংস্কার এবং যথাযথ নিয়ন্ত্রণের অভাবে অনুন্নত দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উচ্চ। দেশের পরিপোষণ ক্ষমতার চেয়ে জনসংখ্যার আয়তন বড়। এই জনসংখ্যাকে সাধারণ শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং স্বাস্থ্য সুবিধা সরবরাহের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করার ব্যবস্থাও নগণ্য।

৮. দুর্বল আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো : অনুন্নত দেশের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক উভয় প্রকার অবকাঠামোর দুর্বলতা। কৃষি ও শিল্পে ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ অপর্যাপ্ত। এগুলোর ব্যবস্থাপনা দুর্বল। পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থাও অনুন্নত ও অপর্যাপ্ত। জনগণের বৃহত্তর অংশই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ অত্যন্ত অপ্রতুল।

৯. প্রতিকূল বৈদেশিক বাণিজ্য অনুন্নত দেশগুলো জনগণের মৌলিক চাহিদা এমনকি খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসার চাহিদা পূরণের জন্যও আমদানিনির্ভর। এসব দেশ প্রধানত কৃষিপণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল রপ্তানি করে এবং শিল্পপণ্য আমদানি করে। রপ্তানি আয় সবসময়ই আমদানি ব্যয়ের চেয়ে কম। ফলে এসব দেশের আন্তর্জাতিক লেনদেনের ভারসাম্যে সবসময়ই ঘাটতি থাকে।

১০. বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরতা পুঁজির স্বল্পতার কারণে অনুন্নত কাজ দেশসমূহ বিনিয়োগের লক্ষ্যে পুঁজি সংগ্রহের জন্য বিদেশি সাহায্যের ওপর একক কোনো দেশের অনুন্নত অবস্থা অত্যধিক নির্ভরশীল থাকে।  দুর্যোগ ও আপৎকালীন সময়েও প্রয়োজনীয় অর্থ ও অন্যান্য সামগ্রীর জন্য এসব দেশ অতিমাত্রায় বিদেশি সাহায্যের উপর নির্ভরশীল।

১১. উদ্যোগ ও ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতার অভাব : অনুন্নত দেশগুলোতে জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো জনশক্তির অভাব পরিলক্ষিত হয়। অর্থনৈতিক কার্যাবলির অগ্রগতি যেমন পুঁজির ওপর নির্ভরশীল, তেমনিদক্ষ উদ্যোক্তাও এর জন্য অপরিহার্য। এছাড়া দুর্বল অবকাঠামো এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে পুঁজিপতিরা বিনিয়োগে আগ্রহী হন না। গতানুগতিক ধারায় বিনিয়োগ শুরু হয়। নতুন উৎপাদন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করার উদ্যোগ ও ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতার অভাব রয়েছে। ফলে অর্থনীতিতে নতুন প্রাণসঞ্চার হয় না এবং অনুন্নয়ন দীর্ঘমেয়াদি হয়।

উন্নয়নশীল দেশ

বিশ্বের উন্নত ও অনুন্নত দেশসমূহের মধ্যপর্যায়ে আরেক ধরনের দেশ আছে যেগুলোকে বলা হয় উন্নয়নশীল দেশ। এসব দেশে মাথাপিছু প্রকৃত আয় উন্নত দেশসমূহের তুলনায় অনেক কম। উন্নয়নশীল দেশসমূহে অনুন্নত অর্থনীতির অধিকাংশ বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কৃষি খাতের প্রাধান্য, শিল্প খাতের অনগ্রসরতা, ব্যাপক বেকারত্ব, পরিবহন, যোগাযোগ ও বিদ্যুতের অপর্যাপ্ততা, শিক্ষার নিম্নহার, মূলধন গঠন ও বিনিয়োগের নিম্নহার, নিম্ন মাথাপিছু আয় ও দারিদ্র্য, জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার ইত্যাদি। তবে অনুন্নত দেশসমূহের সাথে এ দেশগুলোর পার্থক্য এই যে, এসব দেশ পরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের

প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনসংখ্যাকে ব্যবহার করে মোট জাতীয় উৎপাদন তথা মাথাপিছু প্রকৃত আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এর ফলে দীর্ঘ সময় ধরে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির একটি প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে।

পরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় এসব দেশ আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন ও দেশের দ্রুত শিল্পায়ন করার প্রচেষ্টা নেয়। ফলে পুঁজিগঠন ও বিনিয়োগের হার বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা দেয়। জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে পরিণত করার জন্য শিক্ষার প্রসার ঘটানো হয় এবং সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এইসব উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার ফলে অর্থনীতিতে বিরাজমান উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়।

উন্নয়নশীল দেশসমূহের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য নিম্নে আলোচনা করা হলো ।

১. অর্থনৈতিক অবস্থা বিষয়ে সচেতনতা ও পরিকল্পিত উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ উন্নয়নশীল দেশ হচ্ছে সেসব দেশ যারা নিজেদের অর্থনীতির উন্নয়নের অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হয়ে তা পরিবর্তনের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এই পদক্ষেপের সূচনা হয় সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে। উন্নয়নশীল দেশসমূহে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে নানারকম বাধাবিঘ্ন থাকে। বস্তুত জনসংখ্যাধিক্য ও সম্পদের স্বল্পতার কারণে পরিকল্পিত কর্মসূচি ছাড়া উন্নয়ন অর্জন করা যায় না।

২. প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাপ্যতা ও উন্নয়নের সম্ভাবনা: উন্নয়নশীল দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ, যেমন- ভূমি, খনিজসম্পদ, পানিসম্পদ প্রভৃতি রয়েছে। জনসংখ্যার আয়তনও বড়। এসব প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনসংখ্যাকে কাজে লাগিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় ।

৩. কৃষির ওপর নির্ভরতা হ্রাস ও দ্রুত শিল্পায়ন কৃষিপ্রধান অবস্থা থেকে ক্রমশ শিল্পপ্রধান দেশে পরিণত হওয়ার ধারা উন্নয়নশীল দেশের লক্ষণ। এ উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত কর্মসূচির মাধ্যমে দেশে মৌলিক শিল্পস্থাপন ও শিল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

৪. কৃষির ক্রমোন্নতি : উন্নয়নশীল দেশসমূহে কৃষির আধুনিকায়ন করা হয়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ, কৃষির অবকাঠামো উন্নয়ন, উন্নতমানের বীজ, সার ও সেচসুবিধা সরবরাহ ইত্যাদির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ফলে কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়ে। কৃষিতে ক্রমোন্নতির সূচনা হয়।

৫. অবকাঠামো উন্নয়ন : কৃষি ও শিল্পের প্রসার ঘটানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় বিধায় উন্নয়নশীল দেশে আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোর উন্নয়ন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তাই এসব দেশে উন্নয়ন শুরুর পর্যায়েই অর্থনৈতিক অবকাঠামো, যেমন- পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, মূলধন গঠন ও সরবরাহ এবং সামাজিক অবকাঠামো, যেমন-শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই উন্নয়ন অর্জনের ধারায় ক্রমশ সামাজিক পরিবেশেরও উন্নতি ঘটে।

৬. জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস ও মানবসম্পদ উন্নয়ন উন্নয়নশীল দেশে জনসংখ্যাধিক্য রয়েছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ধীরে হলেও ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। দেশের জনগোষ্ঠীকে জনশক্তি বা মানবসম্পদে পরিণত করার জন্য সাক্ষরতা প্রকল্প গ্রহণ, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের বিস্তার এবং প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষা প্রবর্তনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এছাড়া স্বাস্থ্যসুবিধা ও সেবার সম্প্রসারণ ঘটে। এসব কারণে জনগণ মানবসম্পদে রূপান্তরিত হয়। তাদের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় ।

৭. বেকারত্ব হ্রাস ও দারিদ্র্য বিমোচন: উন্নয়নশীল দেশেও ব্যাপক বেকারত্ব বিদ্যমান। তবে কৃষিতে আধুনিক পদ্ধতির প্রয়োগ ও দ্রুত শিল্পায়ন এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্বের হার কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। সাধারণত উন্নয়ন পরিকল্পনার আওতায় নানারকম প্রকল্পের মাধ্যমে বেকারত্ব হ্রাস করার ও দারিদ্র্য নিরসনের ব্যবস্থা করা হয়।

৮. বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরতা হ্রাস : উন্নয়নশীল দেশসমূহে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রচুর অর্থ ও মূলধনের প্রয়োজন হয়। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পর্যাপ্ত তহবিল সংগ্রহ করা সম্ভব না হওয়ায় এসব দেশ বিদেশি ঋণ, সাহায্য ও অনুদানের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ নির্ভরশীলতা সাধারণত দীর্ঘদিন চলতে থাকে। তবে উন্নয়ন অর্জনের এক পর্যায়ে এ নির্ভরতা কমে আসে।

৯. জনগণের আর্থিক কল্যাণ নিশ্চিত করা অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল লক্ষ্য সকল জনগণের সর্বাধিক আর্থিক ও সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে আয়ের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে পারলে আর্থিক ও সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত হয়। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশসমূহে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সূচিত হলেও বণ্টন ব্যবস্থায় ত্রুটি দীর্ঘসময় থেকে যায়। ফলে আয় বণ্টনে বৈষম্য প্রলম্বিত হয়।

১০. নগরায়ণের হার বৃদ্ধি : উন্নয়নশীল দেশসমূহে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে একটি ক্রমোন্নতির ধারা সৃষ্টি হয়। কোনো কোনো দেশে এ ধারা খুব বেগবান। কোনো কোনো দেশে ততটা নয়। তবে এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে ক্রমশ একক কোনো দেশকে উন্নয়নশীল গ্রামীণ অর্থনীতির আধুনিকায়ন ও অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটে। শিল্পায়নের ফলে কাজের সন্ধানে গ্রাম থেকে জনগণ শহরমুখী হয়। এসব কিছুর ফলে দেশে নগরায়ণ ঘটে।

১১. সামাজিক পরিবেশের উন্নয়ন উন্নয়নশীল দেশসমূহে ধীরগতিতে হলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদন ব্যবস্থা, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান (যেমন- ব্যাংক ও বিমা), আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ইত্যাদি উন্নত ও সম্প্রসারিত হয়। এর ফলে কুসংস্কার ও গোঁড়ামি দূর হয়। উন্নত জীবনযাত্রার সাথে পরিচিত হওয়ার ফলে মানুষ উন্নয়ন অর্জনে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

১২. মাথাপিছু আয় ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি : উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি প্রধানত পরিকল্পনার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা থাকলেও তা বাস্তবায়নের ফলে উন্নতির একটি প্রবণতা সৃষ্টি হয়। ফলে এসব দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। জীবনযাত্রার মানে উন্নয়ন সূচিত হয়।

উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আমরা জেনেছি যে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাত্রা বা স্তর অনুসারে বিশ্বের দেশগুলোকে উন্নত, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ভাগ করা হয়। এ ভাগ অনুসারে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের অন্তর্ভুক্ত। তবে অব্যাহত উন্নয়ন প্রচেষ্টা ও কার্যক্রম এবং আর্থ-সামাজিক কিছু সূচকের (যেমন- শিক্ষায় জেন্ডার সমতা, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি প্রভৃতি) উচ্চমানের কারণে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ভুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

আমরা জানি যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ইউরোপের দেশগুলোর অধিকাংশই উন্নত দেশের শ্রেণিভুক্ত। দক্ষিণ এশিয়া এবং সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলো প্রধানত নিম্ন আয়ের দেশ। এছাড়া পূর্ব ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো, ল্যাটিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকান দেশগুলো প্রধানত মধ্য আয়ের দেশ'। এসবের মধ্যে "নিম্ন মধ্য আয়' ও উচ্চ মধ্য আয়' উভয়ই অন্তর্ভুক্ত।

পৃথিবীতে কোনো দেশই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণেও প্রতিটি দেশকে প্রতিবেশী দেশসহ অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। আমরা এ পাঠে পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহের সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি আলোচনা করব।

অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি আমরা দু'টি প্রধান শিরোনামে আলোচনা করতে পারি : 

১. বৈদেশিক বাণিজ্যের সম্পর্ক ও

২. ঋণ সহায়তা ও অনুদান দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক।

১. বৈদেশিক বাণিজ্যের সম্পর্ক

বাণিজ্যের দুটি দিক আছে- রপ্তানি ও আমদানি। রপ্তানি হচ্ছে কোনো দেশের আয়ের উৎস আর আমদানি ব্যয়ের খাত। বাংলাদেশের রপ্তানি আয় দীর্ঘ সময় ধরেই আমদানি ব্যয়ের চেয়ে কম। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবসময়ই একটি ঘাটতির দেশ। তবে সাম্প্রতিককালে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি, প্রবাসীদের আয়প্রবাহ বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে ঘাটতি হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাকও নিটওয়্যার, কাঁচা পাট, পাটজাত পণ্য, চিংড়িমাছ, হিমায়িত খাদ্য, চা, চামড়া, কৃষিজাত পণ্য, সিরামিক ইত্যাদি। দেশভিত্তিক রপ্তানি বাণিজ্যের পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, বিগত এক দশক যাবত বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এর পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, বেলজিয়াম ইত্যাদি দেশ। এছাড়া ইতালি, নেদারল্যান্ডস, কানাডা এসব দেশেও আমাদের পণ্য রপ্তানি হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য প্রধানত উন্নত দেশগুলোতেই বিস্তৃত।

আমাদের রপ্তানির একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো আমরা একটি জনশক্তি রপ্তানিকারক দেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমরা অদক্ষ ও আধা-দক্ষ শ্রমিক রপ্তানি করি। এসব দেশে নানারকম কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে। যেসব দেশেবাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হয়েছে সেগুলোর মধ্যে প্রধান দেশগুলো হচ্ছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, যেমন- সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, বাহরাইন ও কুয়েত। এছাড়া আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশসমূহে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি করার লক্ষ্যে কূটনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

উন্নত দেশসমূহ ছাড়া সার্ক (SAARC : South Asian Association for Regional Cooperation) দেশসমূহের ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশী পণ্য রপ্তানীর পরিমাণ ছিল ৮৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ২০১৬-২০১৭ সাথেও বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে।অর্থবছরে ছিল ৬৭২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। [EPB এর সূত্র অনুসারে] ভারত ছাড়াও সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশ, যেমন- ভুটান, মালদ্বীপ, নেপাল, শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে আমাদের পণ্য রপ্তানি হয়। আমাদের প্রধান আমদানি পণ্যের তালিকায় আছে মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল, খাদ্যপণ্য, পেট্রোলিয়াম ও পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য, তুলা, ভোজ্যতেল, সার, সূতা ইত্যাদি।

দলগত উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের নির্ভরতা নিয়ে একটি দেশভিত্তিক আমদানি পণ্যের পর্যালোচনা থেকে দেখা যায় যে, জুলাই-ডিসেম্বর সময়কালে দেশের আমদানি ক্ষেত্রে চীনের অবস্থান শীর্ষে। এ সময়ে দেশের মোট আমদানির শতকরা ২১.৭২ ভাগ চীন থেকে এসেছে। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে ভারত ১৫.১৯, জাপান ৪.১১ ও সিঙ্গাপুর ৩.৮৩%। (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৮) বিগত এক দশকের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, বাংলাদেশ পণ্য আমদানি করে এমন দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে কখনো চীন কখনো ভারত। বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানিকারক অন্যান্য দেশের মধ্যে রয়েছে সিঙ্গাপুর, জাপান, হংকং, তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্র ও মালয়েশিয়া।

২. বৈদেশিক ঋণ সহায়তা ও অনুদান

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জনের জন্য এদেশ পরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রচুর অর্থ দরকার হয়। এই অর্থের সবটা দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে জোগান দেওয়া সম্ভব হয় না। উন্নয়ন তহবিল সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে ঋণ সহায়তা ও অনুদান গ্রহণ করে। উন্নয়ন কার্যক্রমে ঋণ সহায়তা ও অনুদান দানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন- বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (IMF), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB), ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (EU), জাতিসংঘ সংস্থাসমূহ, ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (IDA) প্রভৃতি থেকেও বাংলাদেশ ঋণ ও অনুদান গ্রহণ করে।

বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে বৈদেশিক সাহায্য পায়, সেগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, নরওয়ে ও ডেনমার্ক। এশীয় দেশগুলোর মধ্যে সাহায্যদাতা দেশ হিসেবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জাপান। চীন ও ভারত থেকেও সাহায্য পাওয়া যায়।

Content added By