নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় - বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যা ও এর প্রতিকার | NCTB BOOK

সাধারণভাবে সমাজের জন্য ক্ষতিকর ও অসুবিধাজনক অবস্থা বা পরিস্থিতিকেই সামাজিক সমস্যা বলে। সামাজিক সমস্যা সাময়িক সময়ের জন্য সৃষ্টি হয় না। এটি কমবেশি স্থায়ী হয় এবং এর সমাধানের লক্ষ্যে যৌথ উদ্যোগের প্রয়োজন অনুভূত হয়। সুতরাং সামাজিক সমস্যা হলো সমাজ জীবনের এমন এক অবস্থা, যা সমাজবাসীর বৃহৎ অংশকে প্রভাবিত করে, যা অবাঞ্ছিত এবং এর প্রতিকার ও প্রতিরোধের জন্য সমাজবাসী ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাতে উদ্যোগী হয় ।

সামাজিক বৈষম্য এবং বিশৃঙ্খলা হতে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। সমাজের প্রচলিত আচার-আচরণ, রীতি-নীতি, প্রথা প্রভৃতির নিয়ন্ত্রণের ব্যতিক্রমই সামাজিক বিশৃঙ্খলা। সামাজিক বিশৃঙ্খলা তখনই দেখা দিবে যখন ব্যক্তির উপর সামাজিক রীতিনীতির প্রভাব হ্রাস পাবে। সামাজিক রীতিনীতি যখন ব্যক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় তখন মানুষের নৈতিক অবনতি শুরু হয়। নৈতিক অবনতি ব্যাপক আকার ধারণ করলে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভাঙন শুরু হয়। সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভাঙনের ফলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য দেখা দেয়। এসব পরিস্থিতিতে সমাজে নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হতে থাকে।

সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের উল্লেখযোগ্য লক্ষণ হলো— অপরাধ, কিশোর অপরাধ, মাদকাসক্তি, অপহরণ, আত্মহত্যা, নারী নির্যাতন, বিবাহ বিচ্ছেদ, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ঘুষ, ছিনতাই, সন্ত্রাস, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, স্বজনপ্রীতি, যৌন আচরণ, যৌনব্যাধির প্রাদুর্ভাব, স্বেচ্ছাচার, শিশুশ্রম, শিশুদের প্রতি অবহেলা, হত্যা প্রভৃতি ।

সামাজিক নৈরাজ্যের ধারণা
সামাজিক বিশৃঙ্খলার চরম রূপ হচ্ছে সামাজিক নৈরাজ্য। রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্র যখন আর কাজ করে না এবং শাসনযন্ত্র ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না তখন সমাজে নৈরাজ্য দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপ ঘুষ, নারী নির্যাতন, অপহরণ, যৌন আচরণ ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা যায়।

সামাজিক নৈরাজ্যের কারণ
সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টির পিছনে বহু কারণ দায়ী। সামাজিক মূল্যবোধের যথাযথ অনুশীলন সুন্দর সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। সমাজে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ও শিথিলতা ঘটলে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। তাছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সাহায্যপ্রার্থী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও অবহেলা সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। সমাজের সংস্কৃতি পরিপন্থি কর্মকাণ্ড, অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি প্রভৃতির কারণে সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়।

সামাজিক মূল্যবোধ অবক্ষয়ের ধারণা
যে কোনো সমাজের রীতিনীতি, মনোভাব এবং সমাজের অন্যান্য অনুমোদিত আচার-আচরণের সমন্বয়ে সামাজিক মূল্যবোধের সৃষ্টি হয়। বস্তুত যেসব ধ্যানধারণা, বিশ্বাস, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, সংকল্প মানুষের আচার-আচরণ এবং কার্যাবলিকে পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, সেগুলোর সমষ্টিই হলো মূল্যবোধ। বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো, অতিথির প্রতি সম্মান প্রদর্শন, ছোটদের প্রতি স্নেহ, মায়া-মমতা প্রভৃতি সামাজিক মূল্যবোধের উদাহরণ। এসব মূল্যবোধের অবনতিই সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। এর ফলে সৃষ্টি হয় সামাজিক অসঙ্গতি ।

সামাজিক মূল্যবোধ অবক্ষয়ের কারণ
সমাজ পরিবর্তনের সাথে মূল্যবোধ পরিবর্তনের সম্পর্ক রয়েছে। সমাজে যখন শিক্ষা উন্নয়ন, শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও প্রযুক্তির বিকাশ ঘটে তখন মূল্যবোধেরও পরিবর্তন ঘটে। মূল্যবোধের এই পরিবর্তন ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়ই হতে পারে। মূল্যবোধের ইতিবাচক পরিবর্তন সমাজ অনুমোদিত। মূল্যবোধের নেতিবাচক পরিবর্তন সমাজ অনুমোদিত নয়। এটি মূল্যবোধের অবক্ষয়।

সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অভাব দেখা দিলেও সামাজিক বিশৃঙ্খলা বা অসঙ্গতি বেড়ে যায়। ফলে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটবে। তাছাড়া সমাজে আইনের শাসনের দুর্বলতা ও অভাব, মানুষের সহনশীলতার অভাব এবং বিশৃঙ্খল পরিবেশের কারণেও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে। ধর্মীয় অপব্যাখ্যাও মানুষকে মূল্যবোধহীন পথে পরিচালিত করতে পারে, যেমন—কোনো বিষয়ে মনগড়া ফতোয়াজারির মাধ্যমে দোররা মারা মূল্যবোধ পরিপন্থি কাজ ।

সামাজিক নৈরাজ্য ও মূল্যবোধ অবক্ষয়ের প্রভাব
সমাজ জীবনে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নৈরাজ্য ও মূল্যবোধ অবক্ষয়ের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় ও নৈরাজ্যপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে মানুষের অধিকারের বঞ্চনা বেড়ে যায় ঘুষ,দুর্নীতিতে গোটা সমাজ অচল হয়ে পড়ে। অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ অপরাধী শাস্তি পায় না। সমাজ জীবনে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দেশের সকল সেবা খাতের মান নিম্নগামী হয়। সমাজে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা বেড়ে যায়।

কাজ:

দলগত: সমাজে মূল্যবোধের কয়েকটি অবক্ষয় চিহ্নিত কর এবং এর প্রতিরোধ পদক্ষেপ লেখ 

একক: সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও সামাজিক নৈরাজ্যের পার্থক্য উদাহরণের মাধ্যমে দেখাও।

 

সামাজিক নৈরাজ্য ও মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রতিরোধে গৃহীত পদক্ষেপ
সামাজিক নৈরাজ্য ও মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে—

  • ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ;
  • আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা আনয়ন;
  • অপসংস্কৃতি রোধে ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ;
  • দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি রোধে কর্মক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ;                                                                                                      ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনয়ন;
  • সমাজের হিংসাত্মক কার্যক্রম রোধে সচেতনতা সৃষ্টি;
  • আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি।
Content added By