নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - সাহিত্য কণিকা (বাংলা) - কৃষি শিক্ষা | NCTB BOOK

মাছের খাদ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

মাছ চাষকে লাভজনক করতে হলে প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি মাছকে বাইরে থেকে দেওয়া সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হয় । আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষে যা খরচ হয় তার প্রায় শতকরা ৬০ ভাগই খরচ হয় খাদ্য ক্রয় করতে । সম্পূরক খাদ্য হিসাবে আমাদের দেশে সচরাচর যে উপাদানগুলো ব্যবহার করা হয় তা হলো- চালের কুঁড়া, গমের ভুসি, সরিষার খৈল, তিলের খৈল, ফিশমিল, গরু-ছাগলের রক্ত ও নাড়ি-ভুঁড়ি, জলজ উদ্ভিদ যেমন-কচুরিপানা, খুদিপানা ইত্যাদি । এসব উপাদান প্রয়োজনমতো মিশ্রিত করে চাষিরা মৎস্য খাদ্য তৈরি করে । কারখানায় তৈরি বাণিজ্যিক খাদ্যও মৎস্য খামারে ব্যবহার করা যায়। যে ধরনের খাদ্যই মাছ চাষের পুকুরে ব্যবহার করা হোক না কেন তার গুণগতমান ভালো হওয়া আবশ্যক। খাবারের গুণগতমান ভালো না হলে সুস্থসবল পোনা ও মাছ হবে না, মাছ সহজেই রোগাক্রান্ত হবে এবং মাছের মৃত্যুহার অনেক বেড়ে যাবে । আবার মাছের বৃদ্ধিও আশানুরূপ হবে না। খাদ্যের গুণগতমান ভালো রাখার জন্য যথাযথ নিয়মে খাদ্য উপকরণ বা তৈরি খাদ্য সংরক্ষণ ও গুদামজাতকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । নিম্নলিখিত নিয়ামকসমূহ খাদ্য সংরক্ষণ ও গুদামজাতকরণের সময় খাদ্যের গুণগতমান এবং ওজনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে-

  1. খাদ্যের আর্দ্রতা: খাদ্যে আর্দ্রতার পরিমাণ ১০% এর বেশি থাকলে ছত্রাক বা পোকা-মাকড় জন্মাতে পারে ।
  2.  বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা: বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৬৫% এর বেশি থাকলে খাদ্যে ছত্রাক বা পোকা-মাকড় জন্মাতে পারে ।
  3.  তাপমাত্রা: অতিরিক্ত তাপমাত্রায় খাদ্যের পুষ্টিমান নষ্ট হয় । পোকা-মাকড়সমূহ ২৬-৩০° সে. তাপমাত্রায় খুব ভালো জন্মাতে পারে এবং এরা খাদ্য খেয়ে ফেলে ও তাদের মলমূত্র দ্বারা ব্যাকটেরিয়া ছড়াতে পারে ।
  4.  সূর্যালোকঃ সূর্যালোকে খোলা অবস্থায় খাদ্য রাখলে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে কিছু কিছু ভিটামিন নষ্ট হয়ে যায় ।
  5.  অক্সিজেন: খোলা অবস্থায় খাদ্য রাখলে বাতাসের অক্সিজেন খাদ্যের রেন্সিডিটি (চর্বির জারণ ক্রিয়া) ঘটাতে পারে যা খাদ্যের গুণগতমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে । অক্সিজেন ছত্রাক ও পোকা-মাকড় জন্মাতেও সহায়তা করে ।

সঠিক খাদ্য সংরক্ষণ পদ্ধতি

ক) শুকনো খাদ্য ও খাদ্য উপাদান

  1.  খাদ্য বায়ুরোধী পলিথিনের বা চটের অথবা কোনো মুখ বন্ধ পাত্রে ঠাণ্ডা ও শুষ্ক জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে । মাঝে মাঝে এই খাদ্য পুনরায় রোদে শুকিয়ে নিলে ভালো হয় ।
  2.  খাদ্য পরিষ্কার, শুকনো, নিরাপদ এবং পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ঘরে রাখতে হবে ।
  3. গুদাম ঘরে সংরক্ষিত খাদ্য মেঝেতে না রেখে ১২ থেকে ১৫ সেমি উপরে কাঠের পাটাতনে রাখতে হবে ।
  4.  পোকা-মাকড় নিয়ন্ত্রণের জন্য খাদ্যের বস্তার নিচে এবং আশপাশে ছাই ছিটিয়ে দেওয়া যেতে পারে ।
  5. খাদ্য তিন মাসের বেশি গুদামে রাখা যাবে না । এর মধ্যেই এটি ব্যবহার করে ফেলা উচিত ।
  6.  ইঁদুর বা অন্যান্য প্রাণীর উপদ্রবমুক্ত স্থানে খাদ্য সংরক্ষণ করতে হবে ।
  7.  খাদ্য কীটনাশক ও অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থের সাথে রাখা যাবে না ।

খ) আর্দ্র/ভেজা খাদ্য উপাদান

  1.  খাদ্য তৈরির জন্য তাজা ছোট মাছ হলে তাৎক্ষণিক খাওয়াতে হবে, অন্যথায় রেফ্রিজারেটরে রেখে দিতে হবে ।
  2.  তৈলাক্ত/চর্বিযুক্ত খাদ্য কালো রঙের বা অস্বচ্ছ পাত্রে নির্ধারিত তাপমাত্রায় রেখে দিতে হবে ।

 ভিটামিন ও খনিজ লবণসমূহ বাতাস এবং আলোকবিহীন পাত্রে রেফ্রিজারেটরে রেখে দিতে হবে ।

কাজ :শিক্ষার্থীরা খাদ্য সংরক্ষণ পদ্ধতি আলোচনা করবে এবং পোস্টার পেপারে উপস্থাপন করবে ।

নতুন শব্দ: রেন্সিডিট

পশুপাখির খাদ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা ও সংরক্ষণ পদ্ধতি

কোনো খাদ্যের গুণাগুণ ও পুষ্টিমান ঠিক রেখে ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য খাদ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে রেখে দেওয়াকে খাদ্য সংরক্ষণ বলে । আবার তৈরি করা পশুখাদ্যের গুণাগুণ ঠিক রাখার জন্যও গুদামজাত করার মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয় ।

খাদ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশে প্রাপ্ত গবাদিপশুর খাদ্যের বেশির ভাগ কৃষি শস্যের উপজাত । এসব উপজাত শস্য মাড়াই বা শস্যদানা প্রক্রিয়াজাত করার পর পাওয়া যায় । বর্ষা মৌসুমে অনেক ঘাস উৎপাদিত হওয়ায় তা গবাদিপশুকে খাওয়ানোর পরও অতিরিক্ত থেকে যায় । আবার শীতকালেও অতিরিক্ত শিম গোত্রীয় ঘাস উৎপাদন হয় । তাই এই অতিরিক্ত ঘাস সংরক্ষণের প্রয়োজন হয় । যখন ঘাসের অভাব হয় তখন এই সংরক্ষিত ঘাস গবাদিপশুকে সরবরাহ করা হয় । খাদ্য সংরক্ষণের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে খাদ্যকে রোগজীবাণু ও পচনের হাত থেকে রক্ষা করা । পশুপাখির দানাদার খাদ্যকে আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রিত কক্ষে সংরক্ষণ করে বেশি দিন গুণাগুণ ঠিক রেখে সংরক্ষণ করা যায় । খাদ্যের আর্দ্রতা বেশি হলে এতে ছত্রাক জন্মায় । ছত্রাক জন্মানো খাদ্য খেলে পশুপাখির দেহে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয় । ফলে অনেক সময় পশু অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করে।

খাদ্য সংরক্ষণের উপায়ের বিভিন্ন ধাপসমূহ

ক) হে তৈরির মাধ্যমে সবুজ ঘাস সংরক্ষণ করা হয় । দ্বিতীয় অধ্যায়ে হে তৈরি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে । তবুও নিম্নে হে তৈরির বিভিন্ন ধাপগুলো দেওয়া হলো-

১। হে তৈরির জন্য শিম গোত্রীয় ঘাস যেমন, সবুজ খেসারি, মাসকলাই বেশি উপযোগী ।

২। ফুল আসার সময় ঘাস কাটতে হয় ।

৩। ঘাস রোদে শুকিয়ে আর্দ্রতা ১৫-২০% এর মধ্যে রাখা হয় ।

৪। ঘাস শুকিয়ে মাচার উপর স্তূপাকারে বা চালাযুক্ত ঘরে সংরক্ষণ করা হয় ।

খ) সাইলেজ তৈরির মাধ্যমে সবুজ ঘাস সংরক্ষণ করা হয় । দ্বিতীয় অধ্যায়ে সাইলেজ তৈরি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তবুও নিম্নে সাইলেজ তৈরির ধাপগুলো দেওয়া হলো-

১। সাইলেজ তৈরির জন্য ভুট্টা, নেপিয়ার, গিনি ঘাস বেশি উপযোগী।

২। ফুল আসার সময় রসাল অবস্থায় ঘাস কাটতে হয় ।

৩। ঘাস কেটে বায়ুনিরোধক স্থানে বা সাইলো পিটে রাখা হয় ।

৪। সাইলো পিটে ঘাস রাখার সময় ঝোলাগুড়ের দ্রবণ ছিটিয়ে দিতে হয় ।

৫ । তারপর বায়ু চলাচল বন্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় ।

গ) খড় তৈরির মাধ্যমে ফসলের বর্জ্য সংরক্ষণ করা হয় । আমাদের দেশে বেশিরভাগ কৃষক পরিবারে গরুর জন্য খাদ্য হিসাবে খড় ব্যবহার করা হয়। গরুকে দৈনিক ৩-৪ কেজি শুকনো খড় দেওয়া হয়। এটি আঁশজাতীয় খাদ্য । নিম্নে খড় তৈরির ধাপগুলো দেওয়া হলো-

১। শস্যগাছ (ধান, ভুট্টা, খেসারি ইত্যাদি গাছ) ক্ষেত থেকে কাটার পর সেগুলো মাড়াই করে শস্যদানা আলাদা করে ফেলা হয় ।

২। বর্জ্য গাছগুলো রোদে শুকিয়ে আর্দ্রতা ১৫-২০% এর মধ্যে এনে খড় তৈরি করা হয় ।

৩। খড় সাধারণত গাদা করে রাখা হয় ।

ঘ) দানাশস্য ও তৈলবীজের উপজাত সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা হয় । ধান, গম, ভুট্টা, খেসারি, কলাই ইত্যাদি দানাশস্যের উপজাতসমূহ যেমন, চালের কুঁড়া, গমের ভুসি, ডালের খোসা, খৈল ইত্যাদি সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা হয় ।

ঙ) কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করে খাদ্য সংরক্ষণ করা হয়। যেমন, পোল্ট্রির জন্য দানাদার খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করে মেশ, পিলেট ও ক্রাম্বল ফিড তৈরি করা হয়।

Content added By