নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - সাহিত্য কণিকা (বাংলা) - কৃষি শিক্ষা | NCTB BOOK

ঔষধি উদ্ভিদ
আমাদের চারপাশের পরিবেশে হরেক রকমের উদ্ভিদ রয়েছে। প্রাত্যহিক জীবনে আমরা বহুবিধ উপায়ে এসব উদ্ভিদ ও এর উৎপাদিত দ্রব্যাদি ব্যবহার করে থাকি। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনের সকল চাহিদা মেটানোর জন্য আমরা বিশাল উদ্ভিদরাজির উপর নির্ভরশীল। এসম্পর্কে ইতোমধ্যে আমরা প্রচুর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। আমরা দেখেছি বা শুনেছি বাড়িতে বিশেষ করে ছোটদের সর্দি কাশি হলে তুলসী পাতার রসের সাথে কয়েক ফোঁটা মধু মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। এর ফলে তাদের সর্দি-কাশি উপশম হয় এবং তারা আরাম পায় । হঠাৎ করে কারও শরীরের কোনো অংশ কেটে গেলে গাঁদা ফুলের পাতা বা দুর্বাঘাস ভালো করে ধুয়ে শীলপাটায় বেটে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলে সাথে সাথে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায় । দুই-তিন দিনের মধ্যে ক্ষত শুকিয়ে রোগী সুস্থ হয়ে যায়। এভাবে পরিবেশের যেসব উদ্ভিদ আমাদের রোগ ব্যাধির উপশম বা নিরাময়ে ব্যবহার হয়, সেগুলোকেই ঔষধি উদ্ভিদ বলা হয় ৷

ঔষধি উদ্ভিদ শনাক্তকরণ
আমাদের দেশ এক সময় ঔষধি উদ্ভিদে সমৃদ্ধ ছিল। মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর, বন-জঙ্গল সর্বত্র অসংখ্য ঔষধি উদ্ভিদে ভরপুর ছিল। বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত কারণে ভূমির বহুবিধ ব্যবহার বেড়েছে। এছাড়া অজ্ঞতা, অবহেলা ও অযত্নের কারণে বর্তমানে এসব ঔষধি উদ্ভিদের প্রধান উৎপত্তিস্থল প্রাকৃতিক উৎস বনভূমি কমে যাওয়ায় ঐসব মূল্যবান বৃক্ষ সম্পদ হ্রাস পেয়েছে । ইতোমধ্যে অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখনও আমাদের দেশের আনাচে-কানাচে যথেষ্ট ঔষধি উদ্ভিদ রয়েছে। সেগুলো আমরা চিনি না । এমনকি সেগুলোর ব্যবহার ও গুণাগুণ সম্পর্কেও আমাদের তেমন কোনো ধারণা নেই। চারপাশের এসব ঔষধি উদ্ভিদসমূহ শনাক্ত করতে পারা এবং সেগুলোর ব্যবহার ও গুণাগুণ সম্পর্কে আমাদের সচেতন হতে হবে। এর ফলে আমরা আমাদের দেশের আপামর জনসাধারণের রোগব্যাধি নিরাময়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারব।

 কাজ : শিক্ষক নমুনা ঔষধি উদ্ভিদ শ্রেণিতে নিয়ে আসবেন, সেগুলো শিক্ষার্থীরা দলগতভাবে পর্যবেক্ষণ ও শনাক্ত করবে। দলীয় আলোচনার মাধ্যমে ঔষধি উদ্ভিদের নামের তালিকা তৈরি করবে ।

ঔষধি উদ্ভিদ ও এর ব্যবহার
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ অতি প্রাচীনকাল থেকে রোগব্যাধি উপশমে বিভিন্ন রকম উদ্ভিদ ব্যবহার করে উপকৃত হচ্ছে । ঔষধ হিসাবে ব্যবহৃত হয় বলে এসব উদ্ভিদকে ঔষধি বা ভেষজ উদ্ভিদ বলা হয় । নিম্নে কয়েকটি ভেষজ উদ্ভিদের পরিচিতি ও ব্যবহার আলোচনা করা হলো ।

১। থানকুনি : থানকুনি একটি ছোট লতানো বীরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ । এর প্রতি পর্ব থেকে নিচে মূল এবং উপরে শাখা ও পাতা গজায় । পাতা সরল বৃক্কের মতো, একান্তর ।

ব্যবহার্য অংশ : সমস্ত উদ্ভিদ

ব্যবহার : ছেলে মেয়েদের পেটের অসুখ, বিশেষ করে বদহজম ও আমাশয় রোগ নিরাময়ে থানকুনি খুব বেশি ব্যবহৃত হয় । এছাড়া থানকুনি আয়ুবর্ধক, স্মৃতিবর্ধক, আমরক্ত নাশক, চর্মরোগনাশক ।

২। তুলসী : তুলসী অতিপরিচিত বীরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ । এটি সাধারণত ৩০ সেমি হতে ১ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে । পাতা সরল, প্রতিমুখ, ডিম্বাকার, সুগন্ধযুক্ত । শীতকালে ফুল ও ফল হয় ।

ব্যবহার্য অংশ : পাতা

ব্যবহার : সাধারণ সর্দি-কাশিতে তুলসী পাতার রস বেশ উপকারী। ছোট ছেলেমেয়েদের তুলসী পাতার রসের সাথে আদার রস ও মধু মিশিয়ে খাওয়ানো হয় ।

৩। কালোমেঘ : এটি একটি ছোট বীরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ । সাধারণত ২০ সেমি থেকে ১ মিটার উঁচু হয় । পাতা সরল, প্রতিমুখ, কিছুটা লম্বা ধরনের । পাতা তিতা । বর্ষার শেষ হতে শীতকাল পর্যন্ত ফুল ও ফল হয় ।

ব্যবহার্য অংশ : সমস্ত গাছ, বিশেষ করে পাতা

ব্যবহার : ছোট ছেলে-মেয়েদের জ্বর, অজীর্ণ ও লিভার দোষে এর রস একটি অত্যন্ত ভালো ঔষধ ।

৪ । বাসক : গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ । পাতা সরল, প্রতিমুখ, লম্বাকৃতি ।

ব্যবহার্য অংশ : পাতার নির্যাস

ব্যবহার : কাশি নিরাময়ে অধিক ব্যবহৃত হয়। সমপরিমাণ আদার রস ও মধুসহ বাসক পাতার রস খেলে কার্যকরী হয় ।

৫। সর্পগন্ধা : সর্পগন্ধা একটি বহুবর্ষজীবী বিরুৎ । প্রতিপর্বে সাধারণত ৩টি পাতা থাকে । বর্ষায় ফুল ও ফল হয় । ফল পাকলে কালো হয় ।

ব্যবহার্য অংশ : মূল বা ফলের রস

ব্যবহার : সর্পগন্ধার মূলের বা ফলের রস উচ্চ রক্তচাপে ব্যবহৃত হয়। পাগলের চিকিৎসায়ও এটি ব্যবহৃত হয় ।

৬। অর্জুন : অর্জুন মাঝারি থেকে বৃহদাকৃতির বৃক্ষ । কাণ্ড সরল উন্নত, মসৃণ এবং আকর্ষণীয় হয়ে থাকে । গাছ থেকে সহজে ছাল উঠানো যায়। পাতা সরল, লম্বা, ডিম্বাকৃতির । ফুল হলুদাভ ক্ষুদ্রাকৃতির, উগ্র গন্ধবিশিষ্ট ।

ব্যবহার্য অংশ : পাতা, ছাল, ফল ও কাঠ

ব্যবহার : কাঁচা পাতার রস আমাশয় রোগ উপশমে ব্যবহৃত হয় । অর্জুনের ছাল ভালোভাবে বেটে তার রস চিনি ও দুধের সাথে প্রত্যহ সকালে সেবনে যাবতীয় হৃদরোগ আরোগ্য হয় । নিম্ন রক্তচাপ থাকলে অর্জুনের ছাল সেবনে উপকার হয় । ছালের রস সেবনে উদরাময় ও অর্শ রোগের উপশম হয় । রক্ত আমাশয়ে অর্জুনের ছালের চূর্ণ দুধের সাথে মিশিয়ে খেলে নিরাময় হয় । অর্জুনের ছালের মিহি গুঁড়া মধুর সাথে মিশিয়ে মুখে লাগালে মেচতার দাগ মিলিয়ে যায় ।

৭। হরিতকী : বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ । পাতা সরল, একান্তর, উপবৃত্তাকার, সবৃন্তক । ফুল শ্বেতবর্ণ ও ছোট হয় । ফল লম্বাকার হালকা খাঁজযুক্ত ।

ব্যবহার্য অংশ : ফল ও কাঠ

ব্যবহার : আয়ুর্বেদিক ঔষধ ত্রিফলার অন্যতম ফল হরিতকী। হরিতকী ফল চূর্ণ করে একটু লবণ মিশিয়ে সেবন করলে অর্শ্বরোগ নিরাময় হয়। হরিতকী চূর্ণ পাইপে ভরে ধূমপান করলে হাঁপানি উপশম হয় । যে কোনো ক্ষতে হরিতকী পোড়া ছাইয়ের সাথে মাখন মিশিয়ে লাগালে ঘা সেরে যায় । চিনি ও পানির সাথে হরিতকী চূর্ণ ব্যবহার করলে চোখ উঠা ভালো হয় । কাঁচা ফল আমাশয় এবং পাকাফল রক্তশূন্যতা, পিত্তরোগ, হৃদরোগ, গেটেবাত ও গলা ক্ষতে ব্যবহার্য । ফলচূর্ণ দন্তরোগ উপশমে ব্যবহৃত হয় । হরিতকী বলবৃদ্ধিকারক, জীবনীশক্তি বৃদ্ধিকারক ও বার্ধক্য নিবারক ।

৮। আমলকী : মাঝারি আকারের বৃক্ষ । পাতা যৌগিক, উপপত্র বিপরীতভাবে বিন্যস্ত । ফুল ছোট, সবুজাভ হলুদ । ফল রসাল, মাংসল, সবুজ, গোলাকৃতি, মুখরোচক ও উপাদেয় । মার্চ থেকে মে মাসে ফুল আসে।

ব্যবহার্য অংশ : ফল

ব্যবহার : আমলকী পাতার রস আমাশয় প্রতিষেধক এবং টনিক । ফল ভিটামিন সি সমৃদ্ধ এবং ত্রিফলার একটি ফল । ফলের রস যকৃৎ, পেটের পীড়া, অজীর্ণতা, হজম ও কাশিতে বিশেষ উপকারী । আমলকীর ফল ত্রিফলার সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করলে রক্তহীনতা, জন্ডিস, চর্মরোগ, ডায়াবেটিস, চুল পড়া, প্রভৃতি রোগের উপশম হয় ।

৯। বহেড়া : এটি একটি শাখা-প্রশাখাযুক্ত বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদ। পাতা একক, বোঁটা লম্বা। ফুল সবুজাভ সাদা, ডিম্বাকৃতির । ফলে একটি করে বীজ থাকে । ফল গোলাকৃতির বা ঈষৎ লম্বাটে ।

ব্যবহার্য অংশ : ফল

ব্যবহার : ত্রিফলার অন্যতম ফল বহেড়া। বীজের শাঁস (বাদামের মতো) দুইএকটি করে দুঘণ্টা অন্তর এবং দিনে দুইটি করে চিবিয়ে খেলে হাঁপানি রোগ আরোগ্য হয় । বহেড়া চূর্ণ সকাল-বিকাল পানিসহ খেলে উপকার হয় । ফল পেটের পীড়া, অর্শ্ব, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া ও জ্বরে ব্যবহার্য । ফল হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, নাসিকা, গলার রোগ ও অজীর্ণতার ভালো ঔষধ । বীজ থেকে প্রাপ্ত তেল মাথা ঠাণ্ডা রাখে এবং চুল পড়া বন্ধ করে ।

১০। ঘৃত কুমারী : বীরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ । পাতা লম্বা, কিনারা খাঁজ কাটা, রসাল ।

ব্যবহার্য অংশ : পাতা থেকে নির্গত ঘন পিচ্ছিল রস ।

ব্যবহার : পাতা থেকে নির্গত ঘন পিচ্ছিল রস কোষ্ঠকাঠিন্য রোগের ফলপ্রসু ঔষধ। এটি ক্ষুধামন্দা, জন্ডিস, লিউকোমিয়া, অর্শ্বরোগ, কাটা-পোড়া ও ক্ষতের চিকিৎসায় ফলপ্রসূ অবদান রাখে । প্রসাধন দ্রব্যে এর মিশ্রণে প্রসাধনের মান উন্নত হয় ।

১১। তেলাকুচা : এটি লতানো বীরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ । বন বাদাড়ে আপনা-আপনি এ গাছ, জন্মাতে দেখা যায় ।

ব্যবহার্য অংশ : কাণ্ড ও পাতা

ব্যবহার : এ উদ্ভিদের কাণ্ড ও পাতার নির্যাস ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হয় । এর নির্যাস সর্দি, জ্বর, হাপানি ও মূর্ছারোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় । চর্মরোগে এর পাতা বাটার প্রলেপ বেশ উপকারী ।

 কাজ : ঔষধি উদ্ভিদের নাম ও ব্যবহার নিয়ে দলীয় আলোচনা উপস্থাপন কর ।

ঔষধি গুণসম্পন্ন বিভিন্ন উদ্ভিদের প্রয়োজনীয়তা
অতি প্রাচীনকাল থেকে ঔষধি গুণসম্পন্ন বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ রোগ নিরাময় উপশমে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে আসছে । আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের ব্যাপক উন্নতির পিছনে ঔষধি উদ্ভিদের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষের নিকট ঔষধি উদ্ভিদের মাধ্যমে রোগ নিরাময় খুবই জনপ্রিয়। কারণ ঔষধি উদ্ভিদের চিকিৎসা ব্যবস্থা সহজলভ্য, সস্তা এবং তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই । এ কারণে বর্তমানে ঔষধি গুণসম্পন্ন আয়ুর্বেদী ও ইউনানি চিকিৎসা ব্যবস্থাও আমাদের দেশে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার উৎকর্ষ চরমে পৌঁছালেও মানুষ আবার সেই প্রাচীন ঔষধি গুণসম্পন্ন উদ্ভিদের ঔষধ দ্বারা চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছে। পৃথিবীর বহুদেশ ভেষজ ঔষধের উৎকর্ষ সাধনের জন্য ব্যাপক গবেষণা শুরু করেছে । বাংলাদেশে ভেষজ উদ্ভিদের ব্যাপক চাষাবাদ ও যত্নের মাধ্যমে ঔষধশিল্পের ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল ।

 কাজ : ‘রোগ নিরাময়ে ঔষধি গাছপালা' এ বিষয়ের উপর শিক্ষার্থীরা একটি প্রতিবেদন তৈরি করে জমা দিবে ।


 

Content added By