নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - গার্হস্থ্য বিজ্ঞান - গৃহ ব্যবস্থাপক | NCTB BOOK

গৃহ ব্যবস্থাপকের নানাবিধ গুণ সম্পর্কে আমরা ইতোমধ্যে অবগত হয়েছি। পরিবারে বিভিন্ন রকম কাজ থাকে। একজন গৃহ ব্যবস্থাপক তার করণীয় কাজগুলো সম্পর্কে সচেতন হয়ে তার গুণাবলির প্রকাশ ও বিকাশ ঘটাতে পারেন। তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে তাকে সব সময় সচেষ্ট থাকতে হয়। গৃহ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব ও কর্তব্যে সামান্য অবহেলার কারণে পারিবারিক জীবনে অনেক বিপর্যয় ঘটতে পারে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য পরিবারের ছোট-খাটো কাজ থেকে বড় রকমের বিভিন্ন গুরুদায়িত্ব পালনের ভারও গৃহব্যবস্থাপকের উপর ন্যস্ত থাকে। তাকে পরিবারের সার্বিক কাজের দায়িত্বে থাকতে হয়। সকল কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করানো গৃহ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তার সঠিক নির্দেশনা পেলে অন্য সদস্যরাও কাজে আগ্রহী হয়ে উঠে।

পরিবারের সীমিত সম্পদের সদ্ব্যবহার করে কীভাবে প্রয়োজনীয় সকল চাহিদা মেটানো যায়, গৃহ ব্যবস্থাপককে তার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এ ছাড়া নির্ধারিত কাজগুলো কে করবে, কীভাবে করা হবে, কখন এবং কেন করা হবে এসব বিষয়ের প্রতি সচেতন হয়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করাটা গৃহ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। সদস্যদের মধ্যে কাজগুলো বণ্টন করে, তার সার্বিক তদারকি করাটাও তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের আওতাভুক্ত।

পরিবারে গৃহব্যবস্থাপকের দায়িত্ব ও কর্তব্য

  • গৃহে সুষ্ঠু কর্মব্যবস্থা সৃষ্টি করা
  • পরিবারের আয় ও ব্যয়ের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা
  • পরিবারের সদস্যদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা
  • পরিবারের সুষ্ঠু নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করা
  • পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সুষ্ঠু ভোগ আচরণ গড়ে তোলা
  • কাজের উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখা।

 

গৃহে সুষ্ঠু কর্ম ব্যবস্থা সৃষ্টি করা- পারিবারিক কাজগুলো সকল সদস্যের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া গৃহ ব্যবস্থাপকের অন্যতম দায়িত্বের অন্তর্গত । পরিবারে এমন অনেক কাজ আছে যা গৃহের মধ্যেই সম্পাদিত হয়। যেমন-রান্না ও পরিবেশন করা, ঘর-বাড়ি পরিষ্কার ও পরিপাটি রাখা, কাপড় ধোওয়া, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ায় সাহায্য করা, বয়স্ক বা অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করা, চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। আবার কিছু কাজ বাড়ির বাইরে করতে হয়। যেমন-বাজার করা, লন্ড্রিতে যাওয়া, বাগান করা, আত্মীয়স্বজনের খোঁজ খবর নেওয়া ইত্যাদি। গৃহ ব্যবস্থাপক পরিবারের সদস্যদের শক্তি, সামর্থ্য, বয়স, কর্মস্পৃহা ইত্যাদির ভিত্তিতে কাজগুলোকে বিভিন্ন সদস্যের মধ্যে বণ্টন করে থাকেন। কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাজগুলোর তদারকি করা ও সদস্যদের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব পোষণ করা গৃহ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব।

পরিবারের আয় ও ব্যয়ের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা- পরিবারে সকলের সব রকম চাহিদা পূরণের জন্য আয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয়। আয়ের মাধ্যমে পরিবার যে অর্থ উপার্জন করে তার দ্বারাই প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্য সামগ্রী ও সেবা ক্রয় করা হয়। আয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত থাকলে পরিবারে অভাব-অভিযোগ থাকে না। ফলে সেখানে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিরাজ করে। গৃহ ব্যবস্থাপকের এ বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হয়।

আয়কে যথাযথভাবে ব্যবহারের প্রতিও গৃহব্যবস্থাপককে যথেষ্ট সচেতন থাকতে হয়। আয় অনুযায়ী ব্যয় করার জন্য তাকে অর্থ ব্যয়ের পূর্ব পরিকল্পনা করতে হয়, যা বাজেট হিসেবে পরিচিত। পরিবারের সীমিত আয়ের মধ্যে সুষ্ঠু ব্রুয় নীতি অনুসরণ করে পরিবারের সব রকম চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করতে হয়। এর পাশাপাশি ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য আয়ের কিছু অংশ সঞ্চয় করে রাখার ব্যবস্থা করাও গৃহ ব্যবস্থাপকের কাজ। তার সুষ্ঠুভাবে অর্থ ব্যবস্থাপনার ফলে, পরিবারের সকল সদস্যের মধ্যে ব্যয় করার সদভ্যাস গড়ে উঠে, তারা মিতব্যয়ী ও সঞ্চয়ী মনোভাব সম্পন্ন হতে পারে।

পরিবারের সদস্যদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা- পরিবারে বিভিন্ন বয়স ও সম্পর্কের সদস্যরা অবস্থান - করে। গৃহ ব্যবস্থাপনার সাথে একাধিক কাজ সম্পৃক্ত থাকে। পরিবারের সকল সদস্যের মিলিত প্রচেষ্টায় কাজগুলো সম্পন্ন হয়। সদস্যদের মধ্যে আন্তসম্পর্ক যদি ভালো হয়, তাহলে সেখানে সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করে। গৃহ ব্যবস্থাপক নিজে অন্যান্য সদস্যদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখবেন। এ ছাড়াও অন্য সদস্যরাও যেন একে অন্যকে শ্রদ্ধা করেন, মর্যাদা দেন সে বিষয়েও তাকে সচেতন থাকতে হবে। পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজন ও চাহিদার কথা বিবেচনা করে, সেগুলো সম্ভাব্য সহজ উপায়ে মিটানোর পদক্ষেপ নিতে হয়। অনেক সময় পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তির সাথে নবীনদের মতের অমিল থেকে মনোমালিন্যর সৃষ্টি হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রবীণ ও নবীনদের প্রকৃতি অনুধাবন করে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার দায়িত্ব গৃহ ব্যবস্থাপকের। সকল সদস্যের যুক্তিসংগত চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারলে গৃহ ব্যবস্থাপকের সাথে তাদের সম্পর্কের উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটতে থাকে।

পরিবারের সুষ্ঠু নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গৃহ ব্যবস্থাপককে পরিবারের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে বিশেষভাবে যত্নবান হতে হবে। গৃহ, গৃহের সদস্যগণ এবং পণ্যসামগ্রীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয়। গৃহ যাতে নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে। বাসস্থানের নিরাপত্তার জন্য অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা, পয়ঃনিষ্কাশনের সুব্যবস্থা ও ময়লা আবর্জনা যথাযথ স্থানে অপসারণ করা, গৃহকে দূষণমুক্ত রাখা ইত্যাদি গৃহের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব গৃহব্যবস্থাপকের। গৃহের সকল সদস্যের দৈহিক ও মানসিক নিরাপত্তার বিষয়টির প্রতি যত্নবান হতে হবে। বাড়িতে সদস্যরা কোনো দুর্ঘটনায় পড়লে, তাকে সাময়িক আরাম দেওয়ার জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা সামগ্রীর ব্যবস্থা রাখতে হবে। বিপজ্জনক দ্রব্যসামগ্রী নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। অসুস্থ ব্যক্তির সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করে তার সুস্থতা নিশ্চিত করতে হবে। পণ্যসামগ্রীর নিরাপত্তার জন্য গৃহে সুষ্ঠু সংরক্ষণ কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা গৃহ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব।

পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সুষ্ঠু ভোগ আচরণ গড়ে তোলা – বর্তমান যান্ত্রিক জীবন ও বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে গৃহ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব ও কর্তব্য আরও বেড়েছে। পরিবর্তনশীল জগতের সাথে মিল রেখে সন্তানদের মানসিক বিকাশ হচ্ছে কি না তা লক্ষ রাখতে হয়। সেজন্য বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সুযোগ- সুবিধা সমূহ পরিবারের ছেলেমেয়েরা যাতে ভোগ করতে পারে, তার যথাযথ ব্যবস্থা করাও গৃহ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব। এ ছাড়া সদস্যদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদির চাহিদা পূরণে সঠিক পণ্য নির্বাচন ও ব্যবহারের প্রচেষ্টা থাকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ খাদ্য নির্বাচন সুষম হতে হবে, বস্ত্র নির্বাচন প্রয়োজন ও সামাজিক রীতিনীতি অনুসারে হতে হবে, বাসস্থান স্বাস্থ্যকর হওয়া প্রয়োজন। এ সকল লক্ষ্য অর্জনে গৃহ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া, যাতে সাধ্যের মধ্যে সদস্যদের চাহিদাগুলো পূরণ হয়। গৃহের সীমিত সম্পদের উপযোগ বা অভাব পূরণের ক্ষমতা বাড়িয়ে কীভাবে প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটানো যায়, সে প্রচেষ্টা গৃহ ব্যবস্থাপককে নিতে হবে।

কাজের উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখা পরিবারের সকল সদস্য যেন তাদের করণীয় কাজগুলো ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারে, সেজন্য কাজের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা গৃহ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব। কাজের পরিবেশ উন্নত ও আরামদায়ক হলে উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে কাজ করা সম্ভব হয়। যেমন লেখাপড়া করার জন্য যথেষ্ট আলো-বাতাস পূর্ণ এবং কোলাহলমুক্ত একটি স্থানের প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া বই-খাতা, কলম, পেনসিল ইত্যাদি শিক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো সঠিকভাবে নির্দিষ্ট স্থানে গোছানো থাকলে সহজেই সেগুলো ব্যবহার করা যায়। এ রকম পরিবেশে নির্বিঘ্নে ও আরামদায়ক অবস্থায় লেখাপড়া করা যায়। একইভাবে প্রতিটি কাজ অনুযায়ী কাজের ভালো পরিবেশ বজায় রাখার ব্যপারে গৃহ ব্যবস্থাপককে দায়িত্ব নিতে হয়।

উপরোক্ত কাজের দায়িত্ব পালন ছাড়াও গৃহ ব্যবস্থাপককে পরিবারে আরও অনেক অনুষ্ঠান, উপলক্ষ ও বিভিন্ন ঋতুর সাথে সম্পর্কিত নানাবিধ কর্মকান্ডের আয়োজন করতে হয়। আর সেসব কর্মকান্ডের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতি স্তরে ব্যবস্থাপককে বিভিন্নমুখী গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়।

একথা মনে রাখতে হবে যে, গৃহ ব্যবস্থাপক গৃহের সার্বিক ব্যবস্থাপনার গুরুদায়িত্ব বহন করেন। তাকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করা প্রত্যেক সদস্যের কর্তব্য। তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে, তার আদেশ, নির্দেশ পালন করে সবাই মিলে পারিবারিক কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে। পরিবারের কর্মকান্ডগুলো গৃহ ব্যবস্থাপকের সুচারু ব্যবস্থাপনার দ্বারা সম্পাদিত হয়। তিনি যাতে এ রকম দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সফল হতে পারেন সেজন্য প্রত্যেক সদস্যকে যার যার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে নিষ্ঠাবান হতে হবে। তাহলেই আশা করা যাবে যে, সুষ্ঠু গৃহ ব্যবস্থাপনার দ্বারা পরিবার তার লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে।

কাজ – তোমার পরিবারের গৃহ ব্যবস্থাপককে তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে তুমি কীভাবে সহযোগিতা করতে পার? তা ক্রমানুসারে সাজিয়ে লেখ।

Content added || updated By