নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - গার্হস্থ্য বিজ্ঞান - কৈশোরের মনোসামাজিক সমস্যা-প্রতিকার ও প্রতিরোধ | NCTB BOOK

১৮ বছরের মেয়ে রিদিতা। মা-বাবার একমাত্র সন্তান রিদিতা, মেধাবী প্রতিভাবান। মা-বাবা থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন সবাই রিদিতার বড় ধরনের সফলতা আশা করে। বাবা-মা তাদের একমাত্র সন্তানের সকল চাহিদা পূরণ করেন, শ্রেষ্ঠ হওয়ার সব রকম সুযোগ তৈরি করে দেন তারা। রিদিতা এখন প্রচণ্ড দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। মা-বাবার স্বপ্ন সে কি পূরণ করতে পারবে? সে কি পারবে সামনের ভর্তি পরীক্ষায় সফলতা আনতে? কিছুই ভালো লাগে না তার। অল্পতেই রেগে যায়, অল্পতেই তার ক্লান্তি আসে। ইদানীং রাতের বেলায়ও ঘুম আসতে চায় না। প্রচণ্ড মাথা ব্যথায় সে ছটফট করে।

উপরের ঘটনাটিতে একটি কিশোরী মেয়ের শারীরিক মানসিক সমস্যার কথা বলা হয়েছে। ধরনের সমস্যাগুলোর মধ্য দিয়ে কৈশোরের মনোসামাজিক সমস্যার চিত্র ফুটে উঠেছে। তোমরা কি জানো মনোসামাজিক সমস্যা অর্থ কী? এসো আমরা বিস্তারিতভাবে সমস্যা সম্পর্কে জেনে নেই

বেশির ভাগ কিশোর-কিশোরীরা বড় ধরনের সমস্যা ছাড়াই বয়ঃসন্ধিক্ষণ বয়স পার করে দেয়। কিন্তু কেউ কেউ আছে যারা সাংঘাতিকভাবে তাদের জীবনকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং তাদের সমস্যা তাদের পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী, সহপাঠী সবার জন্যই সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এগুলো পরোক্ষভাবে সমাজের সবাকেই প্রভাবিত করে। সমস্যাগুলোই মনোসামাজিক সমস্যা। কৈশোরের মনোসামাজিক সমস্যার মধ্যে পড়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ প্রবণতা, মাদকাসক্তি, বিষণ্ণতা, স্কুল পলায়ন ইত্যাদি। যে ছাত্রটি স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার আগেই স্কুল ত্যাগ করে, সে শুধু নিজের ভবিষ্যতই নষ্ট করে না, সমাজের জন্যও সে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়

কৈশোরের মনোসামাজিক সমস্যা দুই ধরনের হয়। একটি অন্তর্মুখী অপরটি বর্হিমুখী। অন্তর্মুখী সমস্যায় সমস্যাগ্রস্ত ছেলেমেয়েরা নানা ধরনের মানসিক আবেগীয় জটিলতায় ভোগে। যেমন- হতাশা, উদ্বেগ ইত্যাদি। বাইরে থেকে ধরনের সমস্যার প্রকাশ কম থাকে অর্থাৎ তাদের দেখে হয়তো মনে হবে, সে খুবই স্বাভাবিক অবস্থায় আছে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে খুব যন্ত্রণায় ভুগছে। আবেগীয় এসব সমস্যা পরবর্তীতে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার উদ্ভব ঘটায়। যেমন- হতাশা বিষণ্ণতা থেকে খাদ্যে অনীহা, ঘুমের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।

বহির্মুখী সমস্যার ক্ষেত্রে সমস্যাগ্রস্ত ছেলেমেয়েদের সমস্যা তার আচরণে প্রকাশ পায়। বহির্মুখী মনোসামাজিক সমস্যা হলো মাদকাসক্তি, বিভিন্ন ধরনের অপরাধ প্রবণতা ইত্যাদি। সাধারণত পারিবারিক বন্ধনের অভাব বা পরিবারের অতিরিক্ত প্রশ্রয় বহির্মুখী সমস্যার উদ্ভব ঘটায়। অপর দিকে মা-বাবার অতিরক্ষণশীলতা অন্তর্মুখী সমস্যার প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত। সব কিছুতেই শাসন, সন্তানকে সব সময় চোখে চোখে রাখা অতিরক্ষণশীল মা-বাবার বৈশিষ্ট্য। বহির্মুখী অন্তর্মুখী উভয় ধরনের সমস্যা একটির সাথে অন্যটি সম্পর্কিত। যেমন- অনেকে অপরাধপ্রবণ বিষণ্নতায় ভোগে, আবার হতাশাগ্রস্থ কিশোর মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।

কিশোর অপরাধ-

মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হলো কৈশোরকাল। সময়ে শারীরিক মানসিক পরিবর্তন খুব দ্রুত হয়। কৈশোরের একটি ছেলে বা মেয়েকে এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে হয়। কৈশোরকাল প্রাপ্ত বয়সে যাওয়ার সময়কাল। সাধারণত ১১ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত কৈশোরকাল

কৈশোরকালে কোনো ছেলে বা মেয়ে আইনবিরোধী কাজে লিপ্ত হলে তাদেরকে কিশোর অপরাধী বলা হয়। বাংলাদেশ শিশু আইন ১৯৭৪ অনুসারে কিশোর অপরাধীর ক্ষেত্রে ছেলেদের থেকে ১৬ বছরের মধ্যে এবং মেয়েদের ১৮ বছরের মধ্যে কেউ সমাজবিরোধী কাজ করলে তাকে সংশোধনের জন্য বিশেষ বিচারের সামনে হাজির হতে হয়। কিশোর অপরাধ হলো অপরিণত বয়সে প্রচলিত সমাজব্যবস্থা, আইনকানুনবিরোধী আচরণ। প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য যে ধরনের কাজ শাস্তিযোগ্য অপরাধ, সে ধরনের কাজ ১৬ বছরের নিচে ছেলেরা এবং ১৮ বছরের নিচে মেয়েরা সংঘটিত করলেই তা কিশোর অপরাধ। কিশোর অপরাধ প্রমাণিত হলে শাস্তির ব্যবস্থা থাকে না। তাদের আচরণ সংশোধনের জন্য সংশোধনী কেন্দ্রে রাখা হয়।

বয়স্কদের অপরাধ যেমন পরিকল্পিত থাকে কিশোরদের অপরাধ থাকে অপরিকল্পিত এবং সংখ্যায় অনেক বেশি। কিশোর অপরাধের যে ধরনগুলো আমাদের দেশে বেশি দেখা যায় তা হলো- স্কুল পলায়ন, মেয়েদের প্রতি অশোভন আচরণ, চুরি, ছিনতাই, খুন, ডাকাতি, মারামারি, মাদকদ্রব্য সেবন ইত্যাদি।

মনোস্তাত্ত্বিকেরা কিছুটা ভিন্নভাবে কিশোর অপরাধীদের চিহ্নিত করেন। যেকোনো অগ্রহণযোগ্য কাজ তা আইনের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ না হলেও তা কিশোর অপরাধের মধ্যে পড়ে। যেমন- কারও জিনিস অন্যায়ভাবে নিজের দখলে রাখা, অন্যের সম্পত্তির ক্ষতি করা, অন্যের জীবনের জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা ইত্যাদি। এটা হতে পারে কোনো গাড়িকে ঢিল মেরে পালিয়ে যাওয়া, বিনা কারণে আগুন ধরিয়ে দেওয়া, শুধু মজা করার জন্য কোনো ক্ষতি করা, যে কোনো ধরনের অন্যায় আচরণ করাই কিশোর অপরাধের মধ্যে পড়ে।

অনেকে বয়ঃসন্ধি বয়সের আগে থেকেই অপরাধমূলক কাজ করে থাকে। তারা সাধারণত / বছর বয়স থেকে ধারাবাহিকভাবে অপরাধ করে। যেমন- মারামারি করা, অন্যের জিনিস নষ্ট করা, চুরি করা ইত্যাদি। ধরনের অপরাধের কারণ হিসেবে মানসিক সমস্যা বা বিপর্যয়কে দায়ী করা হয়। কিশোর অপরাধের উপর দীর্ঘদিনের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, যারা ছোট বেলা থেকে অপরাধমূলক কাজে অভ্যস্ত থাকে তারা বড় হয়েও অপরাধমূলক কাজ করে থাকে। তাদের সম্পর্কে গবেষকদের আরও অভিমত -

  • এই ধরনের অপরাধীদের মধ্যে মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের সংখ্যা বেশি থাকে
  • এদের মধ্যে বেশির ভাগ পরিবার দরিদ্র কিংবা ভগ্ন পরিবার অর্থাৎ পরিবারে মা-বাবার বিবাহ বিচ্ছেদ বা পৃথক বসবাস করা।
  • এইসব কিশোর অপরাধীর মা-বাবার শিশু প্রতিপালন পদ্ধতি সঠিক না। তাদের পরিবারের শৃংখলার অভাব, সন্তানদের প্রতি মা-বাবার অবহেলা থাকে
  • ধরনের অপরাধের জন্য বংশগত কারণকেও দায়ী করা হয়; অর্থাৎ পরিবারের বাবা বা অন্য সদস্যরাও
  • অপরাধী হয়ে থাকে
  • অনেক সময় অপরাধীরা অপরাধ জগৎ থেকে বের হতে পারে না। সে জন্য তা স্থায়ী হয়ে যায়

যারা কৈশোরের আগে থেকে অপরাধমূলক কাজের সাথে জড়িত তাদের ছোটবেলা থেকেই কিছু লক্ষণ থাকে। তারা সমবয়সীদের তুলনায় স্কুলে অমনোযোগী থাকে, তাদের বুদ্ধাংক বা আই কিউ কম থাকে, তাদের সমবয়সীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকে না। এসব লক্ষণ একটি ছোট শিশুর কিশোর অপরাধী হওয়ার আশঙ্কা বাড়ায়৷

আরেক ধরনের অপরাধী আছে যারা কিশোর বয়সে এসে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে। তারা সমবয়সী দলের চাপে পড়ে অপরাধী হয়। এদের অপরাধ প্রবণতা ততটা গুরুতর হয় না। এরা সমবয়সীদের সাথে দলে অপরাধমূলক কাজ করে

এদের সম্পর্কে গবেষণার ফলাফল হলো

  • ধরনের কিশোরদের মা-বাবা তাদের সন্তানদের পরিচালনায় ততটা সচেতন না।
  • দলে থেকে তারা অপরাধ ঘটায়
  • মধ্য কৈশোরে অপরাধের মাত্রা খুব বেশি থাকে।
  • কৈশোরের শেষের দিকে তা চলে যায়।
Content added || updated By