নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - পৌরনীতি ও নাগরিকতা - বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা | NCTB BOOK

বাংলাদেশে শহর ও গ্রামীণ নাগরিকদের সাথে স্থানীয় সরকারের যোগাযোগ ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । নাগরিকতার বিকাশে স্থানীয় সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে । নিচে তা আলোচনা করা হলো ।

১. নাগরিক সেবা প্রদানে স্থানীয় সরকার : সকল শ্রেণির মানুষ তাদের নানা প্রয়োজনে স্থানীয় সরকার দপ্তরে যোগাযোগ করে । যেমন- শিক্ষার্থীদের পিতার আয়ের সনদপত্র সত্যায়িতকরণে এবং জন্মনিবন্ধনের সার্টিফিকেট তোলার প্রয়োজনে ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে যেতে হয়। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন নাগরিকদেরকে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সেবা প্রদান নিশ্চিত করার বিবরণ প্রকাশ করে, যা ‘নাগরিক সনদ' নামে পরিচিত ।

নাগরিক সেবা সহজলভ্য করার জন্য স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে ই-সার্ভিস প্রদান করা হয়। স্থানীয় সরকারের ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণ বিভিন্ন প্রকার সনদ, বিল প্রদান ও সরকারি সেবা লাভ করেন । স্থানীয় সরকারের ক্ষেত্রে নতুন এই সংযোজন এক যুগান্তকারী ঘটনা ।

২. স্থানীয় শাসনে জনগণের অংশগ্রহণ : গ্রামে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা গ্রামের মানুষদেরকে সরকারের সাথে সংযুক্ত করে । স্থানীয় পর্যায়ে (ইউনিয়ন পরিষদের) বাজেট প্রণয়ন, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রকল্প/কর্মসূচি বাস্তবায়নে জনগণ ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করে থাকে । এছাড়া স্থানীয় কর নিরূপণ ও আদায়ে নাগরিকদেরকে সম্পৃক্ত করা হয়।

৩. বিবাদ নিষ্পত্তি: গ্রামাঞ্চলে ছোট ছোট বিরোধ ও বিবাদের সহজ ও দ্রুত নিষ্পত্তি জন্য ইউনিয়ন পরিষদকে আদালত গঠন করে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে । ইউনিয়ন পরিষদের আওতায় গঠিত এ আদালতের নাম ‘গ্রাম আদালত’ । আইন অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও বিবাদমান দুই গ্রুপের দুই জন করে সদস্যসহ মোট ৫ জনকে নিয়ে গ্রাম আদালত গঠিত হয় । যে ইউনিয়নে অপরাধ সংঘটিত হয় বা বিরোধ সৃষ্টি হয় সেই ইউনিয়ন পরিষদের আওতায় এই আদালত গঠিত হয় । আইন অনুযায়ী গ্রাম আদালত একজন ব্যক্তিকে অনধিক ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারে । কিন্তু কোনো ব্যক্তিকে সাজা প্রদান করার এখতিয়ার গ্রাম আদালতের নেই । কোনো আইনজীবীর সহায়তা ছাড়াই গ্রাম আদালতে ছোট ছোট বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ থাকায় বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন হয় না । ফলে গ্রামের মানুষ শহরে না এসেই গ্রাম আদালতের মাধ্যমে সহজে বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ লাভ করে ।

৪. নারীর ক্ষমতায়ন: বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক হলো নারী। সমাজের অর্ধেক অংশকে অধিকারবঞ্চিত রেখে কোনো সমাজ উন্নতি লাভ করতে পারে না। তাই বর্তমানে সারা বিশ্ব নারীর ক্ষমতায়নকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। পরিবার, সমাজ ও জাতীয় ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ, মতামত প্রকাশ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাই নারীর ক্ষমতায়ন । নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রে নারী- পুরুষের অধিকারের সমতা বজায় রাখতে হবে । এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে এবং নারী উন্নয়নে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে । ১৯৫১ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) কর্তৃক একই ধরনের কাজের জন্য নারী ও পুরুষ শ্রমিকের জন্য একই বেতন এবং ১৯৫২ সালে নারীর রাজনৈতিক অধিকারের কথা ঘোষণা করে । যার ফলে, নারী নির্বাচনে ভোট দান ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। ১৯৬০ সালে নারীর কর্মসংস্থান ও পেশার ক্ষেত্রে বৈষম্য বিলোপ সনদ প্রদান করা হয় যা ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয় । বাংলাদেশসহ মোট ১৩২টি দেশ বর্তমানে এ সনদ সমর্থন করেছে ।

স্থানীয় সরকারে নারীর অংশগ্রহণ আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। নারীরা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন সর্বত্র নির্বাচনে জয়লাভ করে নাগরিক হিসেবে স্থানীয় সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হচ্ছে ।

উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সালের প্রণীত আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে ৪৪৯৮টি ইউনিয়ন পরিষদে ১৩,৪৫২টি নারী সদস্য পদ সৃষ্টি করা হয় । এই আইনের মাধ্যমে প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে ৩টি করে সংরক্ষিত নারী আসনের ব্যবস্থা রাখা হয়, যারা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয় । স্থানীয় সরকারের অন্যান্য স্তরেও নারীর অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়েছে । এর ফলে নারীর ক্ষমতায়নের পথ সুগম হয়েছে ।

৫. সংখ্যালঘুর অধিকার প্রতিষ্ঠা: জাতিগত পরিচয়, ধর্মীয় বা লিঙ্গ পার্থক্য নাগরিক অধিকার অর্জনে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা নয় । পার্বত্য তিন জেলায় বিশেষ ধরনের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ঐ অঞ্চলে বসবাসকারী ১৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা হয়েছে । ফলে ঐ অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষা-দীক্ষা এবং অন্যান্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উন্নয়নের মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে যোগ্য মর্যাদা অর্জন করতে পারছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে (জুলাই ২০১১) পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র পরিচয়কে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের নাগরিক অধিকারের মর্যাদা আরও শক্তিশালী করা হয়েছে ।

৬. গণতান্ত্রিক মনোভাব এবং নেতৃত্বের বিকাশ: জাতীয় পর্যায়ে যেমন নাগরিকরা ভোটাধিকার ভোগ করে থাকে, তেমনি স্থানীয় পর্যায়েও নাগরিকরা এই অধিকার ভোগ করে । স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনগণের ভোট প্রদানের হার জাতীয় নির্বাচনের চেয়েও বেশি । এই নির্বাচনে ভোট দিয়ে মানুষ তাদের স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি নির্বাচন করে । জাতীয়ভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের থেকে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধির পার্থক্য হচ্ছে তাদেরকে মানুষ বেশি কাছে পায় । কারণ তারা স্থানীয় জনগণের কাছাকাছি থাকে । ফলে স্থানীয় নাগরিকরা তাদের জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে পারে । বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষেত্রে এটি অধিকতর কার্যকর। স্থানীয় পর্যায়ে এই ভোটাধিকার চর্চা নাগরিকদের গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন করে । এর ফলে স্থানীয় নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে যা পরবর্তীতে জাতীয় নেতৃত্বেও অবদান রাখে ।