নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - পৌরনীতি ও নাগরিকতা - জাতীয় চেতনা ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় | NCTB BOOK

তরুণ ও আদর্শিক শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার অধিকার সংশ্লিষ্ট এবং ন্যয়সঙ্গত সকল আন্দোলনে সক্রিয় থেকে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির প্রাণের নেতা। বিষয়টি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীরও নজর এড়ায়নি। ফলে সামনের সারির প্রবীণ নেতাদের চেয়েও শেখ মুজিবুর রহমানকে কঠোর গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের উপর সে সময়ের পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের গোপন নথি নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে 'সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্যা নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১ম ও ২য় খণ্ড। প্রথম খশুটির সময়কাল ১৯৪৮-১৯৫০ এবং দ্বিতীয় খণ্ডটির সময়কাল ১৯৫১-১৯৫২। খ দু'টোর গোয়েন্দা রিপোর্টেই ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সক্রিয় সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে।

১৯৪৮ সালের ২ মার্চ, বাংলাভাষা-বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশে ফজলুল হক মুসলিম হলে তমদ্দুন মজলিশ ও মুসলিম লীগের যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এখানেও সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান । ৪ মার্চ ঢাকা জেলা গোয়েন্দা তথ্যে বলা হয়, 'শেখ মুজিবুর রহমানসহ যারা মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনে কাজ করেছে তারাই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে লিফলেট ছাড়াচ্ছে।' রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনে ১১ মার্চের হরতাল কর্মসূচি চলাকালে তিনি গ্রেপ্তার হন। মোনায়েম সরকার সম্পাদিত বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন 'ও রাজনীতি' শীর্ষক গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটিই তাঁর প্রথম গ্রেপ্তার।' এদিন আরও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন শামসুল হক, অলি আহাদসহ অনেকেই।

১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বঙ্গবন্ধু ও মওলানা ভাসানীর প্রভাতফেরি গোপন দলিলে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কয়েকটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে আদালতের ভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ ও চালু করার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর একাধিক ভাষণে জোর দিয়েছেন। অর্থাৎ বাঙালির প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানী শাসকরা শুরুতেই চিহ্নিত করতে পেরেছিল। 

১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ ঢাকায় প্রথম সফরে এসে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহ ঘোষণা করেন, 'উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ।' ঐ ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদকারীদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অন্যতম। আন্দোলনের সূচনা ও তা সংগঠিত করতে তিনি কার্যত নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন । যে কারণে তাঁকে একাধিকবার কারাভোগ করতে হয় । জিন্নাহর ঢাকা সফরে আসার পূর্বে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে ছাত্র নেতৃবৃন্দের একটি ৮-দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্নাহ ভাষাসংক্রান্ত তার পূর্ব ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করেন । তার এ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় বা চূড়ান্ত পর্ব। গাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এর পূর্বে আব্দুল মতিনকে আহবায়ক করে গঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি । খাজা নাজিমুদ্দীন কর্তৃক ২৬শে জানুয়ারি, ১৯৫২ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার নতুন ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা' এবং রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে বন্দী অবস্থায় ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন, যা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত করে। ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে সমগ্র পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট ও বিক্ষোভ সমাবেশ পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় ।

এ সময়ে জাতীয় নেতা সোহরাওয়ার্দীর উর্দুর পক্ষে অবস্থান নিয়ে বিবৃতি (২৯ জুন, ১৯৫২, ইত্তেফাক) বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সে সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাষা সংক্রান্ত বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ায় আমরা বেশ অসুবিধায় পড়ি। তাই ঐ বছর জুন মাসে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য করাচি যাই এবং তাঁর কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বাংলার দাবির সমর্থনে তাকে একটি বিবৃতি দিতে বলি' ।

ভাষা সংক্রান্ত বিষয়ে সোহরাওয়ার্দীর অবস্থান পরিবর্তনে শেখ মুজিবুর রহমান সফল হয়েছিলেন। ১৯৫২ সালে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় মওলানা ভাসানীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি বলেন, “বাংলা ভাষার পক্ষে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত পরিবর্তনে মুজিব সক্ষম না হলে শুধু ভাষা আন্দোলন নয়—আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তো।”

সরকার কর্তৃক ২১শে ফেব্রুয়ারির আগের দিন ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয় । পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ছাত্ররা একুশে ফেব্রুয়ারির দিন ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে সমাবেশ অনুষ্ঠান ও মিছিল বের করে । মিছিলে পুলিশ গুলি চালায় । গুলিতে শহীদ হন সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকে। আন্দোলনের তীব্রতায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয় । ১৯৫৬ সালের সংবিধানে তা স্বীকৃত হয়। বাঙালিরাই পৃথিবীতে একমাত্র জাতি, যারা ভাষার দাবিতে জীবন দিয়েছে । অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে ভাষার অধিকার চেয়ে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন, এরপর আর থেমে থাকেননি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমৃত্যু তিনি বাংলা ভাষার গৌরব ও মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করেছেন। পৃথিবীর প্রথম বাঙালি হিসেবে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতা দেন।