এসএসসি(ভোকেশনাল) - পোল্ট্রি রিয়ারিং অ্যান্ড ফার্মিং-২ - প্রথম পত্র (নবম শ্রেণি) | NCTB BOOK

১.১ হাঁস পালন পদ্ধতি 

নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাওড় ও অজস্র পুকুর আর জলাশয়ে সমৃদ্ধ আমাদের এ বাংলাদেশ। দেশের ভৌগলিক অবস্থা বিবেচনায় নিম্নাঞ্চলে অর্থাৎ যেখানে নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাওড় আছে সে সব এলাকার মানুষ কম পুঁজিতে হাঁস পালন করে অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। আজকাল আমাদের দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য হাঁস পালন জীবিকার অন্যতম উপায়। আমাদের দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তেমনভাবে হাঁসের খামার গড়ে না উঠলেও গ্রামের কৃষকেরা প্রচলিত পদ্ধতিতে হাঁস পালন করে থাকেন।

সাধারনত হাঁস পালনে নিম্নের পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা হয়ে থাকে । যথা: 

ক) উন্মুক্ত পদ্ধতি (Open Method) 

খ) অর্ধ-আবদ্ধ পদ্ধতি (Semi-intensive Method) 

গ) আবদ্ধ পদ্ধতি (Intensive Method) 

ঘ) হার্ডিং পদ্ধতি (Herding Method) 

ঙ) লেন্টিং পদ্ধতি (Lenting Method)

 

শ্রেণির তাত্ত্বিক কাজ 

  • হাঁস পালনের জন্য বাংলাদেশ উপযুক্ত কেন? 
  • হাঁস পালনের পদ্ধতিগুলোর নাম লেখ ।

ক) উন্মুক্ত পদ্ধতিতে হাঁস পালন 

এটি হাঁস পালনের সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি। আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে এ পদ্ধতিতে হাঁস পালন করা হয়ে থাকে। এ পদ্ধতিতে দিনের বেলা হাঁসগুলোকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করে খায়। সন্ধ্যা বেলায় যখন হাঁসগুলো ঘরে ফিরবে তখন প্রতিদিন কিছু তৈরি সুষম খাবার সরবরাহ করতে হবে। সন্ধ্যা বেলায় কিছু খাবার সরবরাহ করার নিয়ম চালু রাখলে খাবার ও আরামদায়ক বাসস্থানের লোভে এরা ঘরে ফিরে আসবে। রাতে বাড়িতে নির্দিষ্ট জায়গায় আবদ্ধ করে রাখা হয়। এই পদ্ধতিতে হাঁসকে অতিরিক্ত তেমন খাবার দেয়া হয় না বললেই চলে।

এ পদ্ধতিতে বাড়ন্ত ও পূর্ণবয়স্ক হাঁস পালন করা সুবিধাজনক। যেসব অঞ্চলে পতিত জলাশয় রয়েছে এবং খালবিল বেশি সেখানে এ পদ্ধতিতে হাঁস পালন সবচেয়ে ভালো। ডিমপাড়া হাঁসগুলোকে সকাল ৯.০০ টা পর্যন্ত ঘরে আবদ্ধ করে রাখতে হয় কারণ হাঁস সকাল বেলায় ডিম পাড়তে পছন্দ করে ।

উন্মুক্ত পদ্ধতির সুবিধাসমূহ-

  • এ পদ্ধতিতে হাঁস পালনে খাদ্য খরচ কম হয় । 
  • বাসস্থানের জন্য খরচ কম হয়। 
  • ব্যবস্থাপনায় কম শ্রমিকের প্রয়োজন হয় ৷ 
  • মুক্ত আলো বাতাসে চলাচল করতে পারে বিধায় আবদ্ধ পদ্ধতির তুলনায় এ পদ্ধতিতে হাঁসের বৃদ্ধি ভালো হয়।

উন্মুক্ত পদ্ধতির অসুবিধাসমূহ-

  • হাঁসগুলোকে বিভিন্ন শিকারী প্রাণি খেয়ে ফেলতে পারে। 
  • খারাপ আবহাওয়ায় হাঁসের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে। 
  • সব সময় পর্যবেক্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। 
  • মুক্ত জায়গায় ডিম পাড়লে ডিমের সংখ্যা কম হতে পারে ।

 

খ) অর্ধ-আবদ্ধ পদ্ধতিতে হাঁস পালন 

এই পদ্ধতিতে হাঁসগুলো রাতের বেলায় ঘরে আবদ্ধ থাকে এবং দিনের বেলায় ঘর সংলগ্ন একটি নির্দিষ্ট ফাঁকা জায়গার মধ্যে ছেড়ে দেয়া হয়। এটি তারের জাল দ্বারা ঘেরা থাকে। এ নির্দিষ্ট গন্ডিকে রেঞ্জ বা রান বলে। এ গন্ডির ভেতরে প্রতিটি হাঁসের জন্য প্রায় ১০ বর্গফুট জায়গার প্রয়োজন হয়। এ পদ্ধতি বাড়ন্ত ও প্রাপ্তবয়স্ক হাঁসের জন্য উপযোগী। রেঞ্জ বা গন্ডির ভেতরে সিমেন্ট দিয়ে বড় ধরনের পানির পাত্র তৈরি করা হয়। এখানে হাঁসগুলো সাঁতার কাটতে পারে এবং খাবার পানি খেতে পারে। প্রতিটি হাঁসকে দৈনিক ১৪০-১৬০ গ্রাম খাদ্য সরবরাহ করতে হয় ।

অর্ধ-আবদ্ধ পদ্ধতির সুবিধাসমূহ-

  • বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হাঁস পালন করা সুবিধাজনক । 
  • হাঁসের যত্ন নেওয়া সহজ । 
  • খাদ্য গ্রহণ সমভাবে হয় ।
  • শিকারী প্রাণির কোনো ভয় থাকে না। 
  • স্বাস্থ্যকর পরিবেশ প্রদান করা যায় ।

অর্ধ-আবদ্ধ পদ্ধতির অসুবিধাসমূহ-

  • বেশি পরিমাণ খাবার সরবরাহ করতে হয় । 
  • যন্ত্রপাতি ও নির্মাণ খরচ বেশি হয়। 
  • মুক্তভাবে চলাচলের সীমাবদ্ধতা থাকে।

 

গ) আবদ্ধ পদ্ধতি 

এই পদ্ধতিতে পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত ঘরে হাঁসগুলোকে সবসময় আবদ্ধ অবস্থায় রাখা হয়। বাচ্চা হাঁস (৪-৬ সপ্তাহ) পালনের জন্য এই পদ্ধতি খুবই উপযোগী। আবদ্ধ পদ্ধতি তিন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন- 

i. মেঝে পদ্ধতি 

ii. খাঁচা পদ্ধতি বা ব্যাটারি পদ্ধতি 

iii. তারজালির মেঝে পদ্ধতি

 

i. মেঝে পদ্ধতি: 

এই পদ্ধতিতে হাঁসের বাচ্চাগুলো আবদ্ধ অবস্থায় মেঝেতে পালন করা হয়। এ ধরনের মেঝেতে লিটার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। খাবার এবং পানি দিয়ে লিটার যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য ঘরের এককোণে তারজালের উপর পানি পাত্র ও খাদ্য পাত্র রাখা হয়।

মেঝেতে হাঁস পালনের সুবিধাসমূহ-

  • হাঁসগুলোকে ভালোভাবে পরিচর্যা করা যায় । 
  • এই পদ্ধতিতে খরচ কম লাগে । 
  • এই পদ্ধতিতে শ্রমিক কম লাগে ।

মেঝেতে হাঁস পালনের অসুবিধাসমূহ-

  • ঘরের লিটার ঘন ঘন পরিবর্তন করতে হয়। 
  • বাসস্থান সহজেই স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যায় তাই বাসস্থান সহজেই কলুষিত হয়।

 

ii. খাঁচা বা ব্যাটারি পদ্ধতি 

খাঁচা পদ্ধতিতে হাঁসের বাচ্চাগুলো আবদ্ধ অবস্থার মাচায় পালন করা হয়। এ ধরনের বাঁচার খাদ্য ও পানি দেয়ার আলাদা ব্যবস্থা থাকে। খাবার এবং পানি দিয়ে লিটার যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য ঘরের এককোণে তারুজ্জালের উপর পানি পাত্র ও খাদ্য পাত্র রাখা হয়। এ পদ্ধতিতে হাঁসের বাচ্চাগুলোকে খাঁচায় পালন করা হয়ে থাকে। প্রতিটি বাচ্চার জন্য ০.৭৫ বর্গফুট জারগার প্রয়োজন হয়। বাচ্চা পালনের জন্য এ পদ্ধতি খুবই সুবিধাজনক ।

খাঁচায় হাঁস পালনের সুবিধাসমূহ-

  • এই পদ্ধতিতে বাচ্চা হাঁস পালন করা সহজ। 
  • অনেকগুলো বাচ্চা একসাথে পালন করা যায়। 
  • সহজে বর্জ্য পদার্থ পরিষ্কার করা যায়।

খাঁচায় হাঁস পালনের অসুবিধাসমূহ-

  • এই পদ্ধতিতে বড় হাঁস পালন করা যায় না । 
  • এই পদ্ধতির প্রাথমিক খরচ বেশী হয়।

 

iii. তারের জালের মেঝেতে হাঁস পালন 

এক্ষেত্রে হাঁসের বাচ্চাগুলোকে তারের জাল দিয়ে নির্মিত মেঝেতে পালন করা হয়ে থাকে। প্রতিটি বাচ্চার জন্য ০.৫-০.৭৫ বর্গফুট জায়গার প্রয়োজন হয়। এ পদ্ধতিতে ঘরের মেঝে থেকে উঁচু করে তারের জাল দেয়া হয় এবং তারের জালের ফাঁক যাতে ১.৫ বর্গ ইঞ্চির বেশি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মাচার চারপাশে ১-২ ফুট উঁচু করে বেড়া দিতে হবে যেন হাঁসের বাচ্চা বাইরে পড়ে না যায়। এই পদ্ধতিতে হাঁস পালন করলে প্রাথমিক খরচ একটু বেশি হয়।

তারের জালের মেঝেতে হাঁস পালনের সুবিধাসমূহ-

  • বাচ্চা হাঁস পালনের জন্য এ পদ্ধতি সুবিধাজনক । 
  • হাঁসের ঘর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে সুবিধা হয় । 
  • খাদ্য ও পানি সরবরাহের সুবিধা হয়।

তারের জালের মেঝেতে হাঁস পালনের অসুবিধাসমূহ-

  • তারের জাল বাবদ খরচ বেশি হয়। 
  • সাধারণত বেশি বয়স্ক হাঁস পালন করা যায় না ।

ঘ) লেন্টিং পদ্ধতি 

যে সব এলাকায় বড় বড় হাওড়-বাওড়, বিল-ঝিল থাকে সে সব এলাকায় এই পদ্ধতিতে হাঁস পালন করা হয়ে থাকে। এ পদ্ধতিতে হাওড়, বিলে ভাসমান ঘর তৈরি করে হাঁস পালন করা হয়। প্রতিটি ফ্লকে বা দলে ১০০- ২০০ টি হাঁস পালন করা হয়ে থাকে। এ পদ্ধতিতে হাঁস মুক্ত জলাশয় থেকে নিজেদের খাদ্য সংগ্রহ করে খেয়ে থাকে। তবে অল্প পরিমাণ অতিরিক্ত খাদ্য সরবরাহ করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিতে হাঁসের ডিম উৎপাদন ভালো হয়। হাঁসগুলো সঠিক সংখ্যায় ও সময়মত ফিরছে কিনা সে দিকে লক্ষ্য করার জন্য একজন পাহারাদার প্রয়োজন হয়।

লেন্টিং পদ্ধতির সুবিধাসমূহ-

  • এই পদ্ধতিতে হাঁসের ডিম উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। 
  • খাবার খরচ কম লাগে। 
  • বাসস্থান নির্মাণ বাবদ খরচ কম হয়।

লেন্টিং পদ্ধতির অসুবিধাসমূহ-

  • এই পদ্ধতিতে বাচ্চা হাঁস পালন করা যায় না। 
  • কিছু অতিরিক্ত খাদ্য সরবরাহ করতে হয় । 
  • হাঁস হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

 

ঙ) হার্ডিং পদ্ধতি 

বাড়ন্ত এবং পূর্ণ বয়স্ক হাঁস পালনের জন্য এ পদ্ধতি বেশ ভালো। এ পদ্ধতিতে হাঁস পালনের জন্য কোনো রকম ঘরের প্রয়োজন হয় না। হাঁসগুলোকে সবসময় গতিশীল রাখা হয় অর্থাৎ যে সমস্ত জলাশয়ে খাদ্য আছে হাঁসগুলোকে পর্যায়ক্রমে সে সমস্ত জলাশয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সারা দিন খাদ্য খাওয়ার পরে রাতের বেলা হাঁসগুলোকে কোনো একটি উঁচু জায়গায় সকাল ৯টা পর্যন্ত আটকিয়ে রাখা হয় কারণ হাঁসগুলো সকাল বেলায় ডিম পাড়ে। একটি নির্দিষ্ট এলাকায় কিছু দিন প্রাকৃতিকখাদ্য খাওয়ানোর পর অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ পদ্ধতিতে একজন লোক ১০০-৫০০ টি হাঁস রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে ।

হার্ডিং পদ্ধতিতে হাঁস পালনের সুবিধাসমূহ-

  • খাদ্য খরচ নেই। 
  • ঘর নির্মাণের প্রয়োজন হয় না ।

হার্ডিং পদ্ধতিতে হাঁস পালনের অসুবিধাসমূহ-

  • দলচ্যুত হয়ে হারিয়ে যেতে পারে । 
  • শিকারি প্রাণির কবলে পড়তে পারে। 
  • ঝড়ের কবলে পড়লে প্রানহানি ঘটতে পারে।

 

 

 

Content added By