এসএসসি(ভোকেশনাল) - শ্রিম্প কালচার এন্ড ব্রিডিং-১ - প্রথম পত্র (নবম শ্রেণি) | NCTB BOOK

জাতীয় আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে চিংড়ি সম্পদ বাংলাদেশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে। সত্তর দশকের দিকে বিশ্ব বাজারে চিংড়ির চাহিদা ও মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে চিংড়ির উৎপাদন ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পায়। এ সময়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক নির্মিত বেড়ি বাঁধের অভ্যন্তরে প্রথমে চিংড়ি চাষ শুরু হয়। এর পূর্বেও বাংলাদেশে সনাতন পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করা হত। চাষ প্রযুক্তি হিসেবে খামারের অভ্যন্তরে উপযুক্ত সময় অর্থাৎ প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত ও প্রতিপালিত অধিক পোনা সমৃদ্ধ মোহনা অঞ্চলের পানি নালা কেটে প্রবেশ করিয়ে চিংড়ির পোনা পালনের জন্য সংরক্ষণ করা হতো। খামারে নির্দিষ্টভাবে বা নির্দিষ্ট সংখ্যক পোনা মজুদ না করে মূলত জোয়ারের পানির সাথে ভেসে আসা পোনা সংরক্ষণের মাধ্যমেই চিংড়ি চাষ করা হত। এ কার্য সম্পাদনে বাগদা চিংড়ির প্রজনন মৌসুমে (মার্চ- নভেম্বর) পূর্ণিমার সময়ে জোয়ারের পানি খামারে প্রবেশ করানো হত এবং তিন-চার মাস পর খামারের পানি বের করে দিয়ে চিংড়িসহ অন্যান্য মাছ আহরণ করা হত। এ সময়ে হেক্টর প্রতি চিংড়ির গড় উৎপাদন ছিল। প্রায় ২০ থেকে ৫০ কেজি।

মূলত সত্তর দশকে চিংড়ির বাজার মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বাংলাদেশে সত্তর থেকে আশি দশকের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে চিংড়ি চাষি ও খামার স্থাপনের সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সত্তর দশকের শেষের দিকে খুলনা অঞ্চলের সাতক্ষীরা সদর, দেবহাটা, কালীগঞ্জ ও শ্যামনগর উপজেলায় গতানুগতিক পদ্ধতিতে প্রথমে চিংড়ি চাষ শুরু হয়। অধিক লাভজনক শিল্প হিসেবে চিংড়ি সম্পদ জনসাধারণের কাছে বিবেচিত হওয়ার কারণে ধীরে ধীরে চিংড়ির চাষ খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী ও যশোর অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে বিস্তার লাভ করে ।

বিগত ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে বাংলাদেশে বাগদা চিংড়ি চাষে মোট জমির পরিমাণ ছিল প্রায় ৫১.৮১ হাজার হেক্টর এবং হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন ছিল প্রায় ৮৫ কেজি/উৎপাদন চক্র। পঞ্চাশ দশকের দিকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বাদুপানিতে গলদা চিংড়ির চাষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শুরু হলেও আমাদের দেশে শুরু হয় সত্তর দশকের শেষ দিকে। এ সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে জাপান, হাওয়াই, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও তাইওয়ানে গলদা চিংড়ি চাষের উপর উল্লেখযোগ্য গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের পূর্বে গলদা চিংড়ির চাষের কোনো স্বতন্ত্র এলাকা ছিল না বললেই চলে এবং বাগদা চিংড়ি মাত্র আড়াই হাজার হেক্টর জমিতে চাষ করা হত। এ সময় গলদা চিংড়ির গড় উৎপাদন ছিল হেক্টর প্রতি ৪০ থেকে ১০০ কেজি। বাংলাদেশে সমগ্র উপকূলীয় ও অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে চিংড়ি চাষ ব্যাপক প্রসার লাভ করে মূলত আশি থেকে নব্বই দশকের দিকে। বর্তমানে বেশিরভাগ খামারে সনাতন পদ্ধতি পরিহার করে অনেকটা উন্নত চাষ প্রযুক্তির মাধ্যমে চিংড়ি চাষাবাদ হচ্ছে।

চিত্র- ১.১ একটি আদর্শ ঘের

উপকূলীয় এলাকার প্রায় ১,৭০,০০০ হেক্টর জমিতে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে চিংড়ির চাষ হচ্ছে। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট ও কক্সবাজার এলাকায় বাগদা চিংড়ি চাষের ব্যাপকতা লক্ষণীয়। সনাতন পদ্ধতির পাশাপাশি বর্তমানে এ ৪টি জেলার বিভিন্ন এলাকায় আধা-নিবিড় এবং নিবিড় পদ্ধতির খামার গড়ে উঠছে এবং প্রতি নিয়ত বাগদা চিংড়ি চাষের প্রযুক্তি নির্ভরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, হেক্টর প্রতি ৫-৮ মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদিত হচ্ছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতা সাধনের সাথে সাথে চাষ পদ্ধতির পরিবর্তন, উন্নত মানের পোনা উৎপাদন ও সরবরাহ, সময়মত লবণপানি সরবরাহের ব্যবস্থাকরণ, প্রদর্শনী খামার স্থাপন এবং বিশ্ব বাজারে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির জন্য গুণগত মানসম্পন্ন বাগদা উৎপাদন এবং বিপণনের ব্যবস্থা গ্রহণ বর্তমান সময়ের দাবী।

রপ্তানি বাণিজ্যে পোশাক শিল্পের পরেই চিংড়ি শিল্পের অবদান। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত হিমায়িত মৎস্য ও মৎস্য পণ্যের মধ্যে চিংড়ির অবদান প্রায় ৭০ শতাংশ। আমাদের জাতীয় আয়ের ৩.৫৭ শতাংশ ও কৃষি আয়ের ২৬ শতাংশ আসে মৎস্য খাত থেকে। বাংলাদেশে এই শিল্পে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরাক্ষেভাবে মৎস্য পেশা, যেমন- আহরণ, চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রপ্তানি বাণিজ্য এবং অন্যান্য মৎস্য বিষয়ক সহায়ক কাজে নিয়োজিত।

বাংলাদেশ হতে মোট রপ্তানির প্রায় ৯৫ শতাংশ চিংড়ি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে রপ্তানি করা হয়। বিগত ১০ বছরের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, চিংড়ি রপ্তানির পরিমাণ এবং অর্জিত আয় প্রতি বছর ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সাথে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৫ সালে হিমায়িত কারখানার সংখ্যা ৯৭ থাকলেও বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১৩৩টি। প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাগুলোতে নারীদের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সামুদ্রিক জলজসম্পদের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। চাষের এলাকা বৃদ্ধির সাথে সাথে বেসরকারিভাবে হ্যাচারির সংখ্যা ও শ্রিম্প খাদ্য কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

Content added || updated By