On This Page
এসএসসি(ভোকেশনাল) - শ্রিম্প কালচার এন্ড ব্রিডিং-১ - প্রথম পত্র (নবম শ্রেণি) | NCTB BOOK

চিংড়িকে জীবন্ত অবস্থায় ফাঁদের অভ্যন্তরে আটকে রেখে পানির উপরিভাগে তুলে চিংড়ি আহরণ করা হয়। সাধারণত অগভীর জলাশয়ে বা জোয়ার-ভাটার অঞ্চল বা জলাশয়ে পানি প্রবেশের মুখে ফাঁদ পেতে মাছ বা চিংড়ির পরিভ্রমণ পথে বাঁধা সৃষ্টি করা হয়। ফাঁদ তৈরির মৌলিক দিক হিসেবে ফাঁদের মধ্যে চিংড়ি পানির গতির মাধ্যমে সহজেই ফাঁদের মুখ দিয়ে ফাঁদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু চিংড়ি পুনরায় উক্ত প্রবেশ পথ দিয়ে বের হতে পারে না। উল্লেখ্য, ফাঁদের পশ্চাৎভাগ বন্ধ থাকে এবং চিংড়ি সংগ্রহের সময় ফাঁদের পিছন দিক খুলে বা নির্দিষ্ট পথে চিংড়ি সংগ্রহ করা হয়। ফাঁদের মাধ্যমে সাধারণত স্বল্প পরিমাণে বা পারিবারিক চাহিদা মিটানোর জন্য চিংড়ি আহরণ করা হয়। চিংড়ির প্রাপ্যতার ওপর ভিত্তি করে কখনো কখনো তা সংশ্লিষ্ট আহরণকারীর পেশা হিসেবেও গণ্য হয়।

বাংলাদেশে ব্যবহৃত অধিকাংশ ফাঁদই বাঁশের তৈরি। তবে অনেক দেশেই বর্তমানে প্লান্টিক নির্মিত সরু দন্ডের মাধ্যমে ফাঁদ নির্মাণ করা হয়। এলাকা বা অঞ্চলভেদে এবং চিংড়ির আহরণ উৎসের ধরন অনুসারে ফাঁদের আকৃতি ও প্রকৃতি বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। বাংলাদেশে চিংড়ি ধরার জন্য প্যারন, ডারকি, বেনকি, ইচা চাই, আহকা প্রভৃতি ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। নিচে চিংড়ি ও অন্যান্য ছোট আকৃতির মাছ আহরণের ফাঁদের বিবরণ দেয়া হলো:

ক. অ্যান্টা (Anta)

গঠন প্রকৃতি: আকৃতিতে আয়তাকার এবং সাধারণত উচ্চতা প্রস্থের কিছুটা বেশি। মুলত বাঁশ দিয়ে অ্যান্টা তৈরি করা হয়। ফাঁদের উচ্চতা অংশের একদিকে চিংড়ি ও অন্যান্য জলজ প্রাণী প্রবেশের জন্য এমনভাবে প্রবেশ পথ তৈরি করা হয়, যাতে অতি সহজেই পানির গতির মাধ্যমে চিংড়ি ফাঁদের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু সহজে বের হতে পারে না। প্রবেশ পথ লম্বায় প্রায় অ্যান্টার মোট দৈর্ঘ্যের সমান হয়ে থাকে। ফাঁদের একাংশে চিংড়ি আহরণের জন্য নির্দিষ্ট স্থান রাখা হয়। নির্দিষ্ট স্থান বন্ধ ও খোলার জন্য সহজ ব্যবস্থা রাখা হয়।

ব্যবহার পদ্ধতি: সাধারণত এ ধরনের ফাঁদের মাধ্যমে ছোট মাছ ও চিংড়ি ধরা হয়। গতিশীল পানিতে চিংড়ি ধরার জন্য এ ধরনের ফাঁদ জলাশয়ে পানি প্রবেশের মুখে বা মোহনাঞ্চলের নদী-নালা বা মুক্ত জলাশয়ে পানির গতির বিপরীত দিকে মুখ করে প্রতিস্থাপন করা হয়। নির্দিষ্ট সময় পরে ফাঁদ পানির উপরে তুলে চিংড়ি আহরণ করা হয়। মুক্ত জলাশয়ে ফাঁদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাঁশের খুঁটির মাধ্যমে নির্দিষ্ট গভীরতায় স্থাপন করা হয়। কোথাও কোথাও চিংড়ির গতি নির্দিষ্ট পথে পরিচালনার জন্য ফাঁদের দু'পাশে ১২০ ডিগ্রি কোণ করে বানার ব্যবস্থা করা হয়। এ ক্ষেত্রে একই সাথে অনেকগুলো ফাঁদ বিভিন্ন গভীরতায় স্থাপন করা হয়।

বিস্তৃতি: বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলায় এ ধরনের ফাঁদ ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। এছাড়া ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা প্রভৃতি দেশে এ ধরনের ফাঁদের প্রচলন রয়েছে।

 

খ. বেনকি (Benki)

গঠন প্রকৃতি: আকৃতিতে আয়তকার, নিচের অংশ বেশ চ্যাপ্টা, তবে উপরের অংশ সরু হয়ে থাকে। অগ্রবর্তী ও পশ্চাৎবর্তী অংশ কিছুটা লম্বা এবং চিংড়ি প্রবেশের জন্য এক বা একাধিক প্রবেশ পথ থাকে। ফাঁদের উপরের অংশ কিছুটা লম্বা এবং চিংড়ি প্রবেশের অংশে চিংড়ি আহরণ পথ এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে পথের ঢাকনা সহজেই খোলা এবং বন্ধ করা যায়।

ব্যবহার পদ্ধতি: বেনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সহজপ্রাপ্য বাঁশের ফালি দিয়ে বিভিন্ন আকারের তৈরি করা হয়। ফাঁদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে জলাশয়ের ধরন ও প্রকৃতি অ্যান্টা ফাঁদের অনুরুপ। তবে এ ধরনের ফাঁদ এককভাবে বা একাধিক ফাঁদ কৌণিকভাবে সংযোগ করে একত্রে মাছ আহরণের জন্য স্থাপন করা হয়। সাধারণত এ ফাঁদের মাধ্যমে চিংড়ি ও ছোট প্রজাতির মাছ ধরা হয়।

বিস্তৃতি: বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলায় এ ধরনের ফাঁদ ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলে বেনকি ফাঁদের বিভিন্ন নাম লক্ষ্য করা যায়, যেমন- বেঞ্চি (benchi), দেউর ( dheur), ধাইর (dhiar) ইত্যাদি।

 

গ. ডারকি (Darki)

গঠন প্রকৃতিঃ আকৃতিগত দিক থেকে এটি আয়তাকার হয়ে থাকে এবং এলাকাভেদে বিভিন্ন আকারের ডারকি প্রধানত বাঁশের চঞ্চুর সাহায্যে তৈরি করা হয়। ফাঁদের দরজা এর বক্ষ পাশের (উভয়দিকে) তলদেশে অবস্থিত। ফলে উভয়দিক থেকেই অর্থাৎ পানির গতিপথ পরিবর্তীত হলেও এ ফাঁদ লম্বালম্বিভাবে তলদেশ থেকে উপরিভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। পার্শ্বভাগে মাছ আহরণের দরজা বিদ্যমান।

ব্যবহার পদ্ধিতি: হাওর-বাঁওড়, নদী-নালা, খাল-বিল প্রভৃতি জলাশয়ে পানি প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে এই ফাঁদ পেতে চিংড়ি সংগ্রহ করা হয়। প্রবাহমান পানিতে চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ ধরার ক্ষেত্রে এ ফাঁদের ব্যাপক প্রচলন দেখা যায়।

বিস্তৃতি: বাংলাদেশের সকল জেলায় এ ধরনের ফাঁদ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে বরিশাল, খুলনা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, গোপালগঞ্জ প্রভৃতি জেলাসমূহে এ ফাঁদের প্রচলন বেশি দেখা যায়।

 

ঘ. দোয়ার (Doir).

গঠন প্রকৃতি: দেখতে অনেকটা আয়তাকার, তলদেশ প্রশস্ত ও শীর্ষদেশ সরু এবং পাশের দুই প্রাপ্ত একই রেখা বরাবরে অবস্থান করে। এ ধরনের ফাঁদে দু'টি ফাঁদ দরজা থাকে। ফাঁদ দরজা দু'টি একই পাশে বা উভয় পাশে হতে পারে। ফাঁদ দরজা ফাঁদের তলদেশ থেকে শীর্ষদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। ফাঁদের উপরিভাগে মাছ আহরণের একটি ছিদ্র থাকে, যা অতি সহজেই খোলা ও বন্ধ করা যায়।

ব্যবহার পদ্ধতি: সাধারণত প্রবাহমান পানি এবং প্লাবনভূমি থেকে চিংড়ি আহরণের ক্ষেত্রে দোয়ার ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ফাঁদ নালা বা জলাশয়ে পানি উঠা-নামার স্থানে প্রতিস্থাপন করা হয়। ফাঁদের সম্মুখভাগের দিকে গাছের ডাল-পালা বা বানা দিয়ে এমনভাবে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়, যাতে মাছ ও চিংড়ি প্রবাহমান পানির গভির মাধ্যমে ফাঁদে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়। গ্রাম্যঞ্চলে বানার পরিবর্তে খেজুর গাছের শাখা-প্রশাখাও ব্যবহার করা হয়।

বিস্তৃতি: বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে এ ধরনের ফাঁদের সাহায্যে প্লাবনভূমির মাছ ও চিংড়ি আহরণ করা হয়।

 

ঙ. ইচা- চাই (Icha Chai )

গঠন প্রকৃতি; ইচা চাই অনেকটা ড্রাম আকৃতির এবং স্থানীয়ভাবে এটি বাঁশের চক্ষু দিয়ে তৈরি করা হয়। পশ্চাৎভাগ অগ্রভাগের চেয়ে কিছুটা সরু। এ ফাঁদে পর পর দু'টি ফাঁদ দরজা থাকে। ফাঁদের পশ্চাৎ দিকে মাছ আহরণের দরজা থাকে। 

চিত্ৰ ৪.৩ ইচা- চাই

ব্যবহার পদ্ধতি: সাধারণত প্রবাহমান পানি ও প্লাবনভূমি থেকে চিংড়ি আহরণ করার ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করা হয়। নালা ও জলাশয়ের পানি উঠানামার স্থানে এ ধরনের ফাঁদ ব্যবহার হয়। ফাঁদের সম্মুখভাগের দিকে গাছের ডালপালা বা বানা দিয়ে এমনভাবে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয় যাতে চিংড়ি ও অন্যান্য প্রাণী প্রবাহমান পানির পতির মাধ্যমে ফাঁদে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়।

বিস্তৃপ্তি: বাংলাদেশের সকল জেলায় এ ফাঁদের ব্যবহার দেখা যায়। তবে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে এ চাইয়ের প্রচলন বেশি। সাধারণত এ চাইয়ের মাধ্যমে ইচা ও অন্যান্য ছোট মাছ ধরা হয়।

 

চ. আকা (Ahuka)

স্থানীয় নাম: বরিশাল, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, ঢাকা, ফরিদপুর, যশোর এবং কুষ্টিয়া, অঞ্চলে হোনচা (honcha), ময়মনসিংহ অঞ্চলে উচা (ucha), নোয়াখালী এবং রংপুর অঞ্চলে ঝাওই (jhari) নামে পরিচিত।

গঠন প্রকৃতি: আকৃতিগত দিক থেকে ত্রিকোণাকৃতির এবং বাঁশের মাদুরের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। এটি সাধারণত লম্বায় ১.২ থেকে ৩.০ মিটার এবং গ্রন্থে ০.৮ থেকে ১.২ মিটার হয়ে থাকে। মূল ফাঁদের পশ্চাৎভাগ বন্ধ থাকে। ফাঁদ হাতের মাধ্যমে পরিচালনার জন্য এক খন্ড বাঁশ মূল ফাঁদের সম্মুখভাগের মধ্যবর্তী অংশে এবং পশ্চাৎভাগের সাথে সংযুক্ত থাকে। বাঁশ খণ্ডের পিছনের অংশ ফাঁদের হাতল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফাঁদের হাতা ফাঁদের মোট দৈর্ঘ্যের প্রায় অর্ধেকের সমান।

ব্যবহার পদ্ধতি: স্বল্প গভীর জলাশয়ে চিংড়ি ধরার ক্ষেত্রে এ ধরনের ফাঁদ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ ফাঁদের মাধ্যমে চিংড়ি ধরার ক্ষেত্রে প্রধানত হাতের মাধ্যমে ফাঁদ পরিচালনা করা হয়। ফাঁদের অগ্রভাগ মাটির সাথে বা পানির তলদেশে পানির কাছাকাছি স্থাপন করে দ্রুত গতিতে সম্মুখের দিকে টানা হয় এবং কিছু সময় পর পর ফাঁদের মাথা পানির উপরিভাগে তুলে ফাঁদে চিংড়ি বা মাছ পড়েছে কি-না তা পরীক্ষা করে দেখা হয়। সাধারণত ছোট আকৃতির চিংড়ি ধরার জন্য এ ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করা হয়। পারিবারিক পর্যায়ে চিংড়ি বা মাছ আহরণের ক্ষেত্রে এ ধরনের ফাঁদ ছোট-বড় সকলেই ব্যবহার করতে সক্ষম।

বিস্তৃত: বরিশাল, পটুয়াখালী, বগুড়া, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, পাবনা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী এবং রংপুর অঞ্চলে এটি পাওয়া যায় ।

Content added By

আরও দেখুন...

Promotion