এসএসসি(ভোকেশনাল) - শ্রিম্প কালচার এন্ড ব্রিডিং-১ - দ্বিতীয় পত্র (দশম শ্রেণি) | NCTB BOOK

পানির গুণাগুণ রক্ষায় নিম্নবর্ণিত বিষয়ের ওপর বিশেষ নজর রাখা প্রয়োজন:

ক) তাপমাত্রা: যে কোনো প্রাণীর ক্ষেত্রেই বিপাক ক্রিয়ায় তাপমাত্রা পুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তেমনি চিংড়ির বিপাক ক্রিয়ায়ও তাপামাত্রার গুরুত্ব অপরিসীম। চিংড়ির বৃদ্ধির জন্য আদর্শ তাপমাত্রা হল ২৮-৩২ ডিগ্রি সে.। ৩৫ ডিগ্রি সে. এর বেশি ও ২৫ ডিগ্রি সে. এর কম তাপমাত্রায় চিংড়ি দুর্বল হয়ে মৃত্যুবরণ করে। পানির তাপমাত্রা যদি ১৩ ডিগ্রি সে. এর নীচে ও ৩৪ ডিগ্রি সে. এর উপরে হলে চিংড়ির ব্যাপক মহামারী দেখা যায়। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে খাবার ও সার প্রয়োগ কম বা বেশি করতে হবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পানি পরিবর্তন করে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সনাতন ও হালকা উন্নত পদ্ধতির চাষের পুকুরে গভীরতা সর্বদা ঠিক রাখা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে পানির তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে। তাই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য খামারের ভেতরে চারদিকে কোনাকুনি নালা থাকা প্রয়োজন। নার্সারির পানির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ৪-৬% এলাকায় কচুরিপানা রাখা যেতে পারে।

খ) দ্রবীভূত অক্সিজেন: বাগদা চিংড়ির অক্সিজেন চাহিদা বেশি হওয়ায় চিংড়ি চাষের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চিংড়ি চাষের জন্য অক্সিজেনের আদর্শ পরিমাপ হল ৫-৭ পিপিএম।

সারণি: বাগদা চিংড়ি চাষে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের প্রভাব

তাপমাত্রা, লবণাক্ততা ও বায়ুচাপের ওপর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ নির্ভর করে। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের উৎস হল বাতাস ও সালোকসংশ্লেষণ। রাত্রিকালে উদ্ভিদের শ্বাস গ্রহণ, প্রাণীকূলে শ্বাস গ্রহণ ও পচনশীল জৈব পদার্থের পচন এর কারণে পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়ে থাকে। পানিতে অক্সিজেন হ্রাসের কারণে চিংড়ির ক্ষুধামন্দা, দৈহিক ক্লেশ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস, দৈহিক বৃদ্ধির ব্যাঘাত, শ্বাস প্রশ্বাসের হার বৃদ্ধি এবং মারা যায়। সাধারণত মেঘলা দিনে, খুব গরম পড়লে এবং মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত পুকুরে অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দেয়। পুকুরে অক্সিজেন হ্রাসের লক্ষণসমূহ নিম্নরূপ-

১। চিংড়ি পানির উপরিভাগে এসে খাবি খাবে।

২। পুকুরে বুদবুদ আকারে গ্যাস উঠতে দেখা যায়।

৩। পানির উপর স্বরের মতো বুদবুদ জমা হয়।

৪। চিংড়ি এদিক ওদিক ছুটাছুটি করবে।

৫। মরা মাছের মত চিংড়ি পানির উপরে ভেসে উঠবে ও ফুলকা ছেড়ে যাবে।

সারণি: বিভিন্ন তাপমাত্রায় পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ

রাতের বেলায় আলো না থাকায় সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকে কিন্তু চিংড়ি অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে। তাই ভোরের দিকে অক্সিজেন সংকট দেখা যায়। আবার যে পুকুরে ফাইটোপ্লাংকটন বেশি থাকে সেখানে দিনের ভাগে আলোর উপস্থিতিতে সালোকসংশ্লেষণ বেশি হওয়ায় বিকালের দিকে অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি থাকে।
নিম্নোক্ত উপায়ে পুকুরের পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায়-

  • পানির উপরিভাগে ঢেউ সৃষ্টি করে বা পানি আন্দোলিত করে।
  • সাঁতার কেটে বা বাঁশ পিটিয়ে বা হাত দিয়ে পানি ছিটিয়ে।
  • পাম্প দিয়ে নতুন পানি সরবরাহ করে।
  • প্যাডেল হুইল এ্যারেটর স্থাপন করে কৃত্রিম বাতাস সরবরাহ করে। এক্ষেত্রে ঘেরের চার কর্ণারে একটি থেকে অন্যটি ৩০-৩৫ মিটার দূরে স্থাপন করতে হবে। 

গ) পানির লবণাক্ততা: লবণাক্ততার কারণে দক্ষিণাঞ্চল চিংড়ি চাষের উপযোগী। লোনা পানিতে চিংড়ির ভাল উৎপাদন হয়। সাধারণত ৮-১৪ পিপিটি লবণাক্ত পানি বাগদা চিংড়ি চাষের জন্য উপযোগী। একটানা প্রখর সূর্যতাপের কারণে পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ অনেক বেশি হয়। পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ২৫ পিপিটি এর বেশি হলে পানি সরবরাহ করে লবণাক্ততার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। রিফ্লাক্টোমিটারের সাহায্যে পানির লবণাক্ততার পরিমাণ নির্ণয় করা হয়।

ঘ) অ্যামোনিয়া (NH3): জলজ প্রাণীর বিপাক ক্রিয়া ও পুকুরে পুঞ্জিভূত জৈব পদার্থের পচন থেকে অ্যামোনিয়ার সৃষ্টি হয়। উচ্চ অ্যামোনিয়া জলজ প্রাণির জন্যে সব থেকে বিষাক্ত পদার্থ। পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ ০.০৫ মিলিগ্রাম/ লিটার এর বেশি হলে মাছের ফুলকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আয়নিত অ্যামোনিয়ার পরিমাণ ০.১ পিপিএম এর বেশি হলে বৃদ্ধির হার অর্ধেক এ নেমে আসে। পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ পানির পিএইচ এর সঙ্গে সম্পর্কিত। যেমন- পানির পিএইচ বৃদ্ধির সাথে সাথে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। অ্যামোনিয়া বেড়ে গেলে পানির রং তামাটে বা কালচে রংয়ের হয় ফলে চিংড়ির ছোটাছুটি বেড়ে যায় এবং চিংড়ি মারা যায়। অ্যামোনিয়া নিয়ন্ত্রণে চিংড়ির মজুদ ঘনত্ব কমাতে হবে। সার ও খাদ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করতে হবে। প্রতিকার হিসেবে প্রতি শতাংশে ২০০-২৫০ গ্রাম জিওলাইট দিতে হবে।

ঙ) নাইট্রাইট (NO2); নাইট্রাইটের পরিমাণ বেড়ে গেলে চিংড়ির দেহে অক্সিজেন সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হয় এবং বিষাক্ততার সৃষ্টি করে। এতে চিংড়ি বাদামী রং ধারণ করে এবং খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করে দেয়। নিরাপদ চিংড়ি চাষের জন্য নাইট্রাইটের মাত্রা ০.১ পিপিএম এর নীচে রাখা জরুরি। প্রতিকার হিসেবে চিংড়ির ঘনত্ব হ্রাস ও পানি পরিবর্তন করে ২৫০ মিলিগ্রাম/লিটার হারে লবণ দিতে হবে।

চ) নাইট্রেট (NO3): নাইট্রেট খুব বিষাক্ত নয় বরং শেওলার পুষ্টি হিসেবে কাজ করে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে নাইট্রেটের উচ্চ ঘনত্বের সংস্পর্শে থাকলে চিংড়ির অ্যান্টেনার দৈর্ঘ্য ছোট হয়, ফুলকা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং হেপাটোপ্যানক্রিয়াস এ ক্ষত সৃষ্টি হয়। নাইট্রেটের পরিমাণ ২০ পিপিএম এ রাখা চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে উত্তম।

ছ) খরতা ও ক্ষারত্ব: খরতা ও ক্ষারত্বের মধ্যে সামঞ্জস্যতা নষ্ট হলে পানির নিরপেক্ষকরণ ক্ষমতা কমে যায় এবং পিএইচ এর স্থিতিশীলতা নষ্ট হয় ফলে পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎপাদন বাধ্যগ্রস্ত হয় এবং চিংড়ির বৃদ্ধি কমে যায়। খরতা ও ক্ষারত্বের মান ৪০-২০০ মিলিগ্রাম/লিটার চিংড়ি চাষের জন্য উত্তম। ঘের/পুকুর তৈরির সময় গড়ে শতাংশ প্রতি ১-২ কেজি চুন প্রয়োগ করতে হয়। এছাড়া ছাই ব্যবহারে পানির ক্ষারত্ব নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

জ) পিএইচ (pH): চিংড়ি চাষে পুকুরের পানির পিএইচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। ঘেরের পানির পিএইচ সকালের দিকে ৭.৫-৮.৫ চিংড়ি চাষের জন্য খুবই উপকারী।

সারণি: চিংড়ির ওপর পানির পিএইচ এর প্রভাব

ঝ) কার্বন-ডাই অক্সাইড: দিনের বেলায় কার্বন ডাই অক্সাইড কম থাকে কারণ সালোকসংশ্লেষণে কার্বন ডাই অক্সাইড ব্যবহৃত হয় এবং রাতের বেলায় বৃদ্ধি পায়। পানিতে ৬০ মিলিগ্রাম/লিটার কার্বন ডাই অক্সাইড থাকলে চিংড়ি বাঁচতে পারে। কার্বন ডাই অক্সাইড বৃদ্ধি পেলে অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস পায়।

ঞ) হাইড্রোজেন সালফাইড হাইড্রোজেন সালফাইড যেকোন জলজ প্রাণীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। হাইড্রোজেন সালফাইডের যে কোন পরিমাণ চিংড়ির জন্য ক্ষতিকর। সাধারণত যখন পানির পিএইচ কম থাকে তখন হাইড্রোজেন সালফাইড বিষাক্ত হয়। পানি পরিবর্তন ও মাঝে মাঝে চুন প্রয়োগের মাধ্যমে হাইড্রোজেন সালফাইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। 

Content added By