এসএসসি(ভোকেশনাল) - শ্রিম্প কালচার এন্ড ব্রিডিং-২ - প্রথম পত্র (নবম শ্রেণি) | NCTB BOOK

লাভজনক চিংড়ি চাষের পূর্বশর্ত হচ্ছে পুকুরে সুস্থ ও সবল পোনা মজুদ করা। সুতরাং পলদার ভাল উৎপাদন পেতে হলে পোনা মজুদের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে সম্পাদন করা প্রয়াজেন। গলদা চিংড়ির পোনা মজুদের ক্ষেত্রে পোনা শনাক্তকরণ, পোনা সংগ্রহ ও পরিবহন পদ্ধতি, মজুদ হার নির্ধারণ ও মজুদ করার নিয়ম সম্পর্কে ধারণা থাকা উচিত।

Content added By

প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগৃহীত গলদা চিংড়ির পোনা অন্যান্য চিংড়ির পোনা থেকে পৃথক করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। গলদা চিংড়ির রোস্টামের উপরের দিকে ১২-২৫টি এবং নিচের দিকে ৮-১৪ টি খাঁজ থাকে। মাথার ক্যারাপেস অঞ্চলের খোলসে ২-৫টি কালচে আড়াআড়ি দাগ থাকে। এছাড়া প্রাকৃতিক উৎস থেকে গলদা চিংড়ির পোনা চেনার আরেকটি উপায় হচ্ছে গলদা চিংড়ির রেণু স্রোতের বিপরীত দিকে সাঁতার কাটতে থাকে এবং কখনও কখনও চিৎ হয়ে সাঁতার কাটতে থাকে। এই রেণু পোনার পিঠে কালো দাগ থাকে। সুস্থ ও সবল পোনা চেনার উপায় হলো-

  • সুস্থ ও সবল পোস্ট লার্ভার রং সাধারণত হালকা বাদামি বা স্বচ্ছ হয়ে থাকে। তবে দুর্বল ও পীড়িত পোনার রং লালচে বা নীল বর্ণের হয়ে থাকে।
  • সুস্থ ও সবল পোনা সক্রিয়ভাবে সাঁতার কাটতে পারে। এসব পোনা পাত্রের ছায়াযুক্ত স্থান ও ট্যাপের পানির প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হয়। রোগাক্রান্ত পোনা পাত্রের মধ্যে সাধারণত সক্রিয় থাকে না এবং পাত্রের মাঝখানে জমাট বেঁধে থাকে।
  • একটি প্লাস্টিক গামলা বা অ্যালুমিনিয়াম পাত্রের পানিসহ পোনা রেখে হাত দিয়ে পানিতে ঘূর্ণন সৃষ্টি করলে যদি পোনা পাত্রের মাঝখানে জমা হয় তবে বুঝতে হবে পোনা দুর্বল।
  • পোনা রাখা পাত্রের পায়ে টোকা দিলে সবল পোনা খুব দ্রুত সরে পড়ে এবং অনেক সময় লাফ দিয়ে পাত্রের বাইরে পড়ে যায়।
  • সুস্থ ও সবল পোনা নিয়মিতভাবে খোলস পাল্টায় ফলে গাত্রবর্ণ স্বচ্ছ ও পরিষ্কার দেখায়।
  • সবল পোনার পেটে খাদ্য দৃশ্যমান হয়।
  • দুর্বল পোনা নোংরা থাকে এবং মাঝে মধ্যে কালো দেখা যায়।
Content added By

প্রাকৃতিক উৎস বা হ্যাচারি থেকে সংগৃহীত পিএল সরাসরি পুকুরে মজুদ করা উচিত নয়। চিংড়ির পোনা সরাসরি উৎপাদন পুকুরে মজুদ করলে পোনার মৃত্যুহার অনেক বেড়ে যায় এবং সামগ্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এজন্য নার্সারিতে গলদা চিংড়ির পোনা প্রতিপালন করে কিশোর চিংড়ি বা বড় পোনা পুকুরে মজুদ করলে চিংড়ির সন্তোষজনক উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়।
চিংড়ি পোনা সাধারণত পরিবেশের সামান্য তারতম্যে অত্যন্ত স্পর্শকাতর হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবহন জনিত পীড়নের ফলে চিংড়ি পোনা অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং শ্বাসকষ্টে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সব অসুস্থ দুর্বল পোনা সরাসরি মজুদ পুকুরে ছাড়া হলে সাধারণত অধিকাংশ পোনা মারা যায়। মজুদ পুকুরে চিংড়ির উৎপাদন নিশ্চিত করতে নার্সারিতে পোনা প্রতিপালনের উপকারিতা নিম্নরূপ-

  • নতুন পরিবেশের সাথে পোনা সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে,
  • পোনার মৃত্যুর হার কমানো যায়,
  • পরিবেশের তারতম্যের কারণে সৃষ্ট পীড়ন বা শ্বাসকষ্ট রোধ করা যায়,
  • অল্প সময়ে পোনাকে সবল ও বড় করা যায়,
  • ক্ষতিকর ও রাক্ষুসে প্রাণির আক্রমণ থেকে পোনাকে রক্ষা করা যায়, 
  • অন্যান্য ছোট প্রজাতির চিংড়ি থেকে গলদা চিংড়ির পোনা সহজেই বাছাই করা যায়,
  • পোনার বেঁচে থাকার হার সহজেই অনুমান করা যায় ও
  • মজুদ পুকুরের উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়।

নার্সারি পুকুর: খামারের মোট আয়তনের সাধারণত ১০-১৫% এলাকায় নার্সারি পুকুর করা উচিত। সাধারণত মজুদ পুকুরের মধ্যে বাঁধ দিয়ে অথবা ঘন জালের বেড়া দিয়ে ছোট আকারের নার্সারি পুকুর তৈরি করা যায়। নার্সারি পুকুর অপেক্ষাকৃত ছোট হলে ভালো হয়। নার্সারি পুকুরের আয়তন ২-৩ বিঘা হলে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অনেক বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। এঁটেল মাটি, এঁটেল দো-আঁশ কিংবা বেলে দো-আঁশ মাটি নার্সারি পুকুর নির্মাণের জন্য সবচেয়ে ভালো। অ্যাসিড সালফেট যুক্ত কিংবা বেলেযুক্ত মাটি নার্সারি পুকুর নির্মাণের জন্য উপযুক্ত নয়। পাড়ের উচ্চতা বন্যামুক্ত হতে হবে এবং পাড়ের ঢাল ২:১ অথবা ৩:১ এর মধ্যে রাখতে হবে। পুকুরের গভীরতা বর্ষাকালে ৯০-১০০ সেমি এবং শুকনা মৌসুমে ৭০-৮০ সেমি হলে ভালো হয়। পুকুরের তলদেশ সমতল হওয়া বাঞ্ছনীয়।

নার্সারি পুকুরের পানির গুণাবলিঃ পুকুর প্রস্তুতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে চিংড়ির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ ও প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরির প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। চিংড়ি সাধারণত প্রাকৃতিক পরিবেশে প্লাংকটন, ছোট পোকা-মাকড় ও পচা জৈব পদার্থ খেয়ে বড় হয়। এ সব অণুজীব ও ছোট প্রাণী পানিতে একটি বিশেষ পরিবেশে জন্মায়। এই উপযুক্ত পরিবেশের জন্য পানিতে নিম্নবর্ণিত গুণাবলি থাকা বিশেষভাবে প্রয়াজেন।

পানির গুণাগুণমাত্রা
তাপমাত্রা২৫-৩০ সেমি
অক্সিজেন৫.০-৮.৫ পিপিএম
পিএইচ৭.৫-৮.৫
পানির স্বচ্ছতা২৫-৩৫ সেমি

নার্সারি পুকুর প্রস্তুতির নিয়মাবলি: পোনা মজুদের পূর্বে পুকুর প্রস্তুতির পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলো নিচে বর্ণনা করা হলোঃ

  • সমস্ত জলজ আগাছা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।
  • রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত প্রাণী দমন করতে হবে। 
  • পুকুরের পুরাতন পানি নিষ্কাশন করে পুকুরের তলদেশ ৬-৭ দিন রোদে শুকাতে হবে।
  • পুকুরের পাড় ভালোভাবে মেরামত করতে হবে এবং পাড়ে কোনো গর্ত থাকলে তা ভালোভাবে বন্ধ করতে হবে।
  • পুকুরের তলদেশে হালকা চাষ দিতে হবে।
  • চাষ দেওয়ার পর প্রতি শতকে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে।

পুকুরে চিংড়ির পোনার আবাসস্থলের উন্নয়ন করতে হবে। আবাসস্থল উন্নয়নের লক্ষ্যে পুকুরের তলায় বাঁশের কঞ্চি বা নারকেল গাছের ডাল কাত করে পুঁতে দিতে হবে। চিংড়ির পোনা ছোট অবস্থায় ডালপালার সাথে আকড়িয়ে থাকতে পছন্দ করে। তাছাড়া গাছের ডালপালা খাদ্য যোগাতে সহায়তা করে থাকে। সার প্রয়োগের ৫-৭ দিন পর নির্ধারিত হারে পোনামজুদ করতে হবে। নার্সারি পুকুরে ৭০-৯০ সেমি পানি রাখতে হয়।

পোনা মজুদের হার: চিংড়ি খামারের মাটির উর্বরতা, পানির গুণাগুণ, সম্পূরক খাবার প্রয়োগ ও পানি ব্যবস্থাপনার ওপর ভিত্তি করে পুকুরে পোনামজুদের হার নির্ধারণ করা হয়। চাষ পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে পোনা মজুদের হার নিচে বর্ণনা করা হলো-

চাষ পদ্ধতিপ্রতি শতাংশে পোনা মজুদের হার
প্রচলিত চাষ পদ্ধতি১০,০০০-৩০,০০০ টি
সম্প্রসারিত চাষ পদ্ধতি৪০,০০০ ৮০,০০০ টি
আধা নিবিড় চাষ পদ্ধতি৯০,০০০-১,৫০,০০০ টি

নার্সারি পুকুরে খাবার সরবরাহ: প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি পোনা মজুদের প্রথম সপ্তাহে পুকুরে সম্পূরক খাবার প্রয়োগ করা উচিত। কারণ এই সম্পূরক খাবার চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত সহায়ক। তবে কোনাক্রমেই পুকুরে যাতে অতিরিক্ত খাবার সরবরাহ করা না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। কারণ অতিরিক্ত খাবারের পচন ক্রিয়ার ফলে পানি দূষিত হয়ে পড়ে এবং পীড়ন ও অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে পোনা অতি অল্প সময়ে মারা যায়। চাউলের কুঁড়া, গমের ভুষি, মাছের চূর্ণ, ছোট আকারের চিংড়ির শুটকি, ছোট প্রজাতির মাছ, জীবের রক্ত, সরিষার খৈল, সয়াবিনের খৈল, ভিটামিন ইত্যাদি একত্রে মিশিয়ে চিংড়ির সম্পূরক খাবার তৈরি করা যায়।

খাবার পিলেট, সেমাই অথবা মন্ড তৈরি করে পুকুরে প্রয়োগ করলে খাবারের অপচয় কম হয় এবং খাদ্যের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। ফিডিং ট্রে বা অন্য যে কোনো পাত্রের মাধ্যমে খাদ্য প্রয়োগ করলে খাদ্য প্রয়োগের সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করা সহজ হয়। চিংড়ি যদিও সর্বভুক প্রাণী তথাপি এরা প্রাণিজ আমিষ জাতীয় খাদ্য বেশি পছন্দ করে। চিংড়ির খাদ্যে নিম্নবর্ণিত হারে বিভিন্ন খাদ্য উপাদান থাকা আবশ্যক :

উপাদানের নামশতকরা পরিমাণ
আমিষ৩০-৪০ ভাগ
স্নেহ চর্বি৫-৭ ভাগ
শর্করা৩০-৩৫ ভাগ
ভিটামিন/মিনারেলস১-২ ভাগ।

খাদ্য প্রয়োগের পরিমাণ: ১ বিঘা বা ৩৩ শতাংশের একটি নার্সারি পুকুরে ৩৩,০০০-৩৫,০০০ পোনা (পিএল ১২-১৫) মজুদ করা যায়। পোনা মজুদের ১ম সপ্তাহে নিম্নবর্ণিত হারে সম্পূরক খাবার প্রয়োগ করতে হবে।

লালনকালপ্রতিদিন
১ম সপ্তাহে৪০০ গ্রাম
২য় সপ্তাহে৮০০ গ্রাম
৩য় সপ্তাহে১০০০ গ্রাম
৪র্থ সপ্তাহে১৩০০ গ্রাম

এক মাসের পোনার নমুনা সংগ্রহ করে মোট ওজনের শতকারা ৪-৫ ভাগ হিসেবে খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। মোট পোনার পরিমাণ বেঁচে থাকার হার (৭৫%) – ২৪,৭৫০ টি (প্রায়)

প্রতিটির গড় ওজন - ১.৭৫ গ্রাম (প্রায়)
মোট পোনার ওজন - ৪৫ কেজি (প্রায়)
পোনার মোট ওজনের- ৪-৫% হিসেবে প্রতিদিন
খাদ্যের প্রয়োজন - ২.২৫ কেজি

এভাবে সপ্তাহভিত্তিক খাবার সরবরাহের পরিমাণ নিম্নরূপঃ

লালনকালপ্রতিদিন
১ম সপ্তাহে৪০০ গ্রাম
২য় সপ্তাহে৮০০ গ্রাম
৩য় সপ্তাহে১০০০ গ্রাম
৪র্থ সপ্তাহে১৩০০ গ্রাম

এভাবে ১ বিঘার নার্সারি পুকুরে ৩৩-৩৫ হাজার পোনা ছেড়ে ৬০ দিন লালন করতে প্রায় ১৪০ কেজি সম্পূরক খাদ্যের প্রয়াজেন হয়। এই দুই মাস প্রতি পালনের পর পোনা বিক্রয় যোগ্য হয় অথবা মজুদ পুকুরে ছাড়ার উপযুক্ত হয়। নার্সারি পুকুরে পোনা প্রতিপালনের সময় নিম্নবর্ণিত বিষয়ের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখা একান্ত দরকার।

  • ক্ষতিকর ও রাক্ষুসে প্রাণির অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা,
  • পানির গভীরতা ঠিক রাখা,
  • নিয়মিতভাবে পানির গুণগতমান পরীক্ষা করা,
  • নিয়মতিভাবে পোনার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা,
  • প্রয়োজনে পুকুরের পানি পরিবর্তন করা,
  • বিভিন্ন প্রাণী কর্তৃক পুকুরের পাড়ে সৃষ্ট গর্ত তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করা,
  • গ্রীষ্মকালে পানির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা করা ও
  • পোনা যাতে চুরি না হয় সেদিকে কড়া নজর রাখা।
Content added By