এসএসসি(ভোকেশনাল) - ফ্রুট এন্ড ভেজিটেবল কাল্টিভেশন-২ - প্রথম পত্র (নবম শ্রেণি) | NCTB BOOK

ফসলের লাভজনক ফলন এবং তার গুণাগুণ শুধু উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে না। সাথে সাথে সঠিক সময়ে ফসল সংগ্রহ এবং সংগ্রহ প্রণালির ওপর ও তা অনেকটা নির্ভর করে। ফসল সংগ্রহ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফলকে উৎপাদন পর্যায় হতে ব্যবহারিক পর্যায় আনা হয় । যত্নের সাথে এ কাজের তদারকি এবং সঠিক সময়ে ফসল সংগ্রহের ফলে আমরা পাই আর্থিক মূল্য সম্পন্ন গুণগতমানের ফসল এবং এর বর্ধিত খাদ্য উপাদান । ফল অক্ষত অবস্থায় দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য এবং উৎকৃষ্ট মানের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য দ্রব্য তৈরি করার জন্য ফসল যথা সময়ে সতর্কতার সাথে সংগ্রহ করার প্রয়োজনীয়তা অনবীকার্য। বিভিন্ন ধরনের ব্যবহারের লক্ষ্য অনুযায়ী ফসল যখন নিজ নিজ জাতের সর্বোৎকৃষ্ট আকার, রং, স্বাদ এবং গুণাগুণ অর্জন করে, তখনই ফসল সংগ্রহ করা উচিত। অপরিপক্ক ফল সংগ্রহ করলে যেমন গুণাগুণ বজায় থাকে না তেমনি চাষী ফলের ন্যায্য মূল্য পায়না। আবার বেশি পরিপক্ক হলেও গুণগত মান তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে ফল দ্রবত পচেযায় । যার ফলে বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না। ফলের পরিপকৃত এমন একটি অবস্থা যখন ফলের আকার ও আয়তন এবং বয়সের সর্বশেষ অবস্থা, অর্থাৎ এরপর ফলের আকার ও আয়তন আর বৃদ্ধি পায় না । ফল পাকার অর্থ হলো পরিপকৃতার পর ফলের গুণাগুণের এমন পরিবর্তন, যার মাধ্যমে ফল ভক্ষণযোগ্য বা খাবার উপযোগী হয় । ফল পাকার সাথে সাথে ফলের রং, গন্ধ ও বুনটের পরিবর্তন হয়, যার দর”ন ফল ভোক্তার নিকট গ্রহণ যোগ্য হয় ।

ফলের পরিপক্বতা

ফলের পরিপক্কতা এমন একটি অবস্থা যখন ফল আকার, আয়তন এবং বয়সে সর্বশেষ অবস্থায় পৌছে অর্থাৎ এর পর ফল আর আকার ও আয়তনে বৃদ্ধি পায় না । কিছু লক্ষণ দেখে ফলের পরিপক্বতা নিরুপণ করা যায় । এই লক্ষণ গুলো কে ফলের পরিপকৃতার লক্ষণ বা (Maturity Index) বলা হয় । ফল ধারণ থেকে দিবস সংখ্যা, আকার, আকৃতি, রং, বুনট, আপেক্ষিক ঘনত্বের পরিমান, দ্রবনীয় শক্ত পদার্থ, চিনি, অস্ত্রের হার এবং চর্বির পরিমাণ ইত্যাদি পরিপক্বতার লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ফল সংগ্রহের পূর্বে ফলের পরিপক্কতা দেখে সংগ্রহ করা উচিত। ফল সংগ্রহের সময়ের ওপর নির্ভর করে ফলের বাহ্যিক সতেজতা, ফলের স্বাদ, গুণাগুণ, গন্ধ ও আকার ইত্যাদি । ফল বর্ধনের তিনটি ধাপ বিদ্যমান। যেমন—

১। বাড়ন্ত (ফুল হতে গুটি ধারন করে উপযুক্ত হওয়া পর্যন্ত) 

২। পরিপক্বতা (ফল উপযুক্ত হওয়ার পর সংগ্রহ করার পর্যায়ে পৌঁছা পর্যন্ত) এবং 

৩ । পরিপক্কতার পর পেকে উঠা বা ফিজিওলোজিক্যাল ম্যাচুরিটি ।

ফল তোলার জন্য ফলের পরিপক্বতা একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থা । কারণ ফল পাকা অবস্থাতেই খাওয়ার উপযুক্ত হয় । উদাহরণ- কলা, জাম, আনারস, পেয়ারা, বেল, পিচ, আঙ্গুর, লিচু ইত্যাদি একমাত্র পরিপক্ক অবস্থাতেই খাওয়া যায় । ফলের মধ্যে এমন অনেক ফল আছে যে গুলোর শ্বসন কাজ হল তালোর পর রুদ্ধ হয়ে যায় । শ্বসন কাজ বন্ধ হওয়ার ফলে তার মধ্যে সঞ্চিত শর্করা বা শ্বেতসার থেকে চিনিতে রূপান্তর ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় । যেমন- আংগুর, লেবু, জাম্বুরা, লিচু, ইত্যাদি ।

আবার ফলের মধ্যে এমন অনেক ফল আছে যে গুলার শ্বসন কাজ ফল তোলার পরও চলতে থাকে। এমনকি ফলের পরিপক্কতার সাথে সাথে শ্বসন কাজ বাড়তে থাকে এবং ফলের মধ্যে সঞ্চিত শর্করা বা শ্বেতসার চিনিতে রূপান্তরিত হতে থাকে । যেমন- আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে বেল, কামরাঙ্গা, আমড়া, ইত্যাদি । তাই এ জাতীয় ফল পরিপক্ক অবস্থা হতে খাওয়ার উপযোগী বা উপযুক্ত হওয়ার সময়ের মধ্যে পড়তে হবে । এরপর পরিবহন ও বাজারজাতকরণের কাজ দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করতে হবে। 

বিভিন্ন লক্ষণ দেখে ফলের পরিপক্কতা নিরূপণ করা হয়। বিশেষ অবস্থায় ফলের পরিপক্বতা নিরূপণ করা কষ্টসাধ্য । যেমন- 

ক) বাড়ন্তবস্থায় ফল রোগাক্রান্ত হলে অপরিপক্ক অবস্থায় পরিপক্ক ফলের মত রং ধারণ করে । 

খ) জমিতে রস ও পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি থাকলে অপরিনত বয়সের ফল পরিপক্ক দেখায় । 

গ) জমিতে রসের ও পুষ্টি উপাদানের পরিমান বেশি থাকলে এবং তাপমাত্রা কমে গেলে ফলের পরিপক্বতা বিলম্ব হয় । 

ঘ) পোকা মাকড়ের আক্রমণ হলে ফল অপরিণত বয়সে পেকে যায় । 

ঙ) হঠাৎ অতিরিক্ত ঠান্ডা আবহাওয়ায় পরিণত বয়সেও ফল পরিপক্ক হয় না । 

ফলের পরিপক্বতা নিরূপণ করা যায় দু'ভাবে যথা- 

১। বাহ্যিক অবস্থা দেখে ও । 

২। অভ্যন্তররীণ পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে

১। বাহ্যিক অবস্থা: ফল ধারণ থেকে দিনের হিসাব, ফলের আকার ও আকৃতি, ফলের রং, ফলের ওজন, ফল শক্ত বা নরম, ফলের ত্বকের গন্ধ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে ।

২। অভ্যন্তরীণ: শর্করা বা শ্বেত সারের পরিমাণ, মিষ্টতার পরিমান, ফলের কষ বা রসের ঘনত্ব, বীজের পরিপুষ্টতা, ভক্ষণযোগ্য অংশের ঘনত্ব (শক্ত বা নরম অবস্থা), আঁশের পরিমাণ, আঁশের দৃঢ়তা ও স্পষ্টতা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে ।

ছক: বাহ্যিক পরিবর্তন দেখে ফলের পরিপক্কতা নিরুপণ :

ফলের নাম

ফুল ধরা হতে পরিপক্ক অর্থাৎ উপযুক্ত হওয়ার সময় (দিন)

ফলের শরীর তাত্বিক পরিবর্তন/বাহ্যিক পরিবর্তন

(ক) আম৯০-১২০ দিন

১ । ফলের চামড়া ফিকে সবুজ রং ধারণ করে । 

২। পরিপক্ক সবুজ আমের বোটা ছিড়লে কষ বের হতে থাকে এবং | তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায় । 

৩ । আম পরিপক্ক অবস্থায় পানিতে ডুবে যায় । 

৪ । স্বাভাবিক অবস্থায় গাছ থেকে দুএকটা আধাপাকা আম ঝরে পড়ে । 

৫ । আমের বোটার কষ স্বচ্ছ বিন্দুর মতো দেখায় ।

(খ) কলা৯০-১২০ দিন

১ । কলা পরিপুষ্ট হলে শিরাগুলো সমান হয়ে মোটামুটি গোলাকার হয়ে যায় । 

২। কলার খোসা মসৃণ হয় ও হালকা সবুজ রং দেখা দেয় । 

৩ । কলার কাদির গোড়ার দিকের কলায় হলদে রং দেখা দেয় । 

৪ । কলার পিছনের ফুল শুকিয়ে যায় ।

(গ) আমড়া৬০

১ । আমড়া পরিপুষ্ট হলে চামড়া টান টান ও মসৃণ হয় ।

২। আমড়ার বোটার চারদিকে সামান্য দূরে ফিকে হলদে ও উজ্জ্বল বর্ণ হয় । 

৩ । পরিপুষ্ট আমড়ার গায়ে ফোটা ফোটা কালচে চিহ্ন দেখা দেয় ।

(ঘ) কামড়াঙ্গা৬০

১। পরিপুষ্ট ফল সামান্য হলদে হয় ও ফলের ত্বক উজ্জ্বল হয় । 

২। শিরাগুলোর মাঝের গভীরতা কমে যায় অর্থাৎ শিরা গুলো নিচের দিকে মোটা হয়ে যায় । 

৩ । হাতে নিলে ভারি অনুভূত হয় ।

(ঙ) বেল১ বৎসর

১। পরিপক্ক ফলের গায়ের রং হালকা হলদে ভাব হয় । 

২। বোটায় চাপ দিলে বোটা খসে যায় এবং বোটার সংযোগস্থানে সামান্য ঢেউ খেলানো গর্ত হয়ে যায় । 

৩ । ফলের গায়ে টোকা দিলে টন টন শব্দ করে । 

৪। সামান্য জোরে আঘাত করলে ফলের চামড়া ফেটে যায় । 

৫ । হাতে নিলে হালকা অনুভূত হয় ।

(চ) পেঁপে২০

১। পেঁপের রং ঘন সবুজ থেকে হালকা সবুজাভ হলুদ হতে থাকে ।

২। পেঁপের কষ স্বচ্ছ পানির মত হতে থাকে ।

৩ । বোটার চারদিকে হালকা হলুদ রঙের উজ্জ্বল আভা দেখা যায় । 

৪ । পেঁপের গায়ে নখ দিয়ে চাপ দিলে কষ বের হয়ে সঙ্গে সঙ্গে জমে যায় ।

(ছ) আনারস১১০

১ । আনারসের চোখগুলো সামান্য হলুদ রং ধারণ করে 

২। চোখের মধ্যস্থল চ্যাপ্টা দেখায় এবং চারপাশে সামান্য ফুলে উঠে 

৩ । আনারসের নিচের দিকে হালকা হলুদ রং ধারণ করে। 

৪ । চোখের উপরের খোসাগুলো ধীরে ধীরে শুকায়ে যায় ।

ফল সংগ্রহের বিভিন্ন পদ্ধতি

মানুষের শরীর সুস্থ, সবল ও রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে ফলের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ । ফলের গুণগত মান বজায় রাখার জন্য সঠিক সময়ে গাছ থেকে ফল পাড়া অতীব জরুরি । ফলের ভালো ফলন এবং তার গুণাগুণ শুধু উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদের ওপর নির্ভর করে না । সঠিক সময়ে এবং সঠিক পদ্ধতিতে ফল সংগ্রহ করার উপরও ফলের গুণাগুণ এবং লাভ নির্ভর করে । অনেক সময় অনেক বেশি মূল্যে বিক্রির জন্য কাঁচা ফলই বাজারে উঠায় । এটা মোটেই উচিত নয় । মাঝে মাঝে কঁচা ফলকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় পাকা রঙ ধারণ করায়ে বাজারে বিক্রয় করে । এতে অনেকে প্রতারিত হয় । লোকে জানাজানি হলে এ ধরনের ফল আর ক্রয় করতে চায় না । এতে উৎপাদক, বিক্রেতা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয় । তাই ফল এমন অবস্থায় পড়তে হবে যাতে পাড়ার পর অতি অল্প সময়ে পাকে এবং কেউ প্রতারিত না হয় ।

ফল তরতাজা রাখার জন্য সংগ্রহের সময় বিশেষ যত্নবান হতে হবে। সংগ্রহের সময় ফল ক্ষতিগ্রস্থ বা আঘাতপ্রাপ্ত হলে বাজার মূল্য ও পুষ্টিমান কমে যায় । অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে আর্থিক ক্ষতি হবে । তবে ফলের মান বজায় রাখার জন্য পরিপুষ্ট অবস্থায় ফল সংগ্রহ করা উচিত । ফল সংগ্রহের জন্য কিছু উপকরনের প্রয়োজন হয়, যেমন- কঁচি, ছুরি, মই, রশি, ব্যাগ, ধারালো দা ইত্যাদি। ফল সংগ্রহের প্রাককালে নিম্নোক্ত বিষয়াদি বিবেচনায় রাখতে হবে, যেমন-

ক) ফলের পরিপক্কতার উপযুক্ত বয়সে সংগ্রহ করতে হবে । 

খ) পরিষ্কার আবহাওয়ার সময় ফল পাড়তে হবে । 

গ) ফল পাড়ার সময় সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে যাতে ফল আঘাত না পায় বা থেতলিয়ে না যায় । 

ঘ) সাবধানতার সাথে ফলগুলো এক জায়গায় জড়ো করতে হবে । 

ঙ) ফল জড়ো করার শানটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও ছায়াযুক্ত হতে হবে ।

৬) ফল পাড়ার জন্য ব্যবহৃত উপকরণ ও যন্ত্রপাতি ভালোভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে । সাধারণত দু'ভাবে ফল সংগ্রহ করা যায়। যথা-

১। হাত দিয়ে তোলা বা পাড়া এবং 

২। মেশিনের সাহায্য পাড়া ।

১। হাত দিয়ে তোলা বা পাড়া: উন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশেই বেশির ভাগ ফল সতেজ অবস্থার বিক্রির জন্য হাত দিয়ে পাড়া হয় । হাত দিয়ে ফল পাড়ার কতগুলো সুবিধা আছে। যেমন-

  • অনেক বেশি যত্ন সহকারে ফল পাড়া যায় ।
  • একসাথে অনেক লোককে কাজে লাগানো যেতে পারে।
  • হাত দিয়ে ফল পাড়তে এক সাথে বেশি অর্থের প্রয়োজন হয় না ।
  • অপরিপুষ্ট বা যে ফল আরও কিছু সমর গাছে রাখা যাবে সেগুলো বাদ দিয়ে সংগ্রহ করা যায়।
  • ফল পাড়ার সময় সহজেই চারদিকে ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করে ফল পাড়া যায় ।

হাত দিয়ে পাড়ার অসুবিধাগুলো

ফল পাড়তে বেশি সময় লাগে ।

জরুরি ভিত্তিতে বেশি লাকে দরকার হলে অনেক সময় চাহিদামত লোক পাওয়া যায় না।

কোন ফল কোন বয়সে সংগ্রহ করতে হবে সে বিষয়ে সকল শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রয়োজন হয়।

২। মেশিনের সাহায্যে ফল পাড়া। হাত দিয়ে ফল পাড়া বেশি পছন্দনীয় হলেও অনেক সময় মেশিনের সাহায্যে ফল সংগ্রহ করতে হয়। মেশিনের সাহায্যে ফল সংগ্রহের কতগুলো সুবিধা আছে। যেমন-

সুবিধাগুলো-

তাড়াতাড়ি ফল সংগ্রহ করা যায় বা পাড়া যায়

কাজের পরিবেশ আধুনিক ও উন্নত মনে হয়।

কাজে নিয়োজিত লোকদের কাজ তদারকি করা সুবিধা জনক হয় ।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা থাকলে তাড়াতাড়ি ফল পাড়া যায় ।

মেশিনে ফল পাড়ার অসুবিধাগুলোঃ

ফল পাড়ার সময় পাছের ক্ষতি হতে পারে।

যন্ত্র বা মেশিনের দাম অনেক বেশি যা সকলের পক্ষে ক্রয় করা সম্ভব হয় না ।

ছোট বাগান বা অল্প সংখ্যক পাছের জন্য মেশিন দিয়ে ফল সংগ্রহ করা লাভজনক হয় না ।

যেখানে শ্রমিক সহজলভ্য সে এলাকার মেশিন ব্যবহারের ফলে লোকের কাজ করার সুযোগ কমে যাবে, ফলে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে ।

মেশিন ব্যবহারের জন্য বড় বড় বাগান তৈরি করতে হয় ।

মেশিনে উপযুক্ত বা অনুপযুক্ত, ছোট/বড়, উত্তম/খারাপ সব ফলই এক সাথে সংগ্রহ হয়ে যায় ।

ফল পাড়ার সময় বা ছিড়ার সময় যে সব ফল আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেগুলো কাচি দিয়ে কেটে পাড়া উচিত। যে সব ফল হাতের নাগালের মধ্যে থাকে না সে গুলো গাছে উঠে অথবা জালি ৰাধা বাঁশের লাঠির সাহায্যে পারা উচিত। ভাতে লাঠির মাথার জানির মধ্যে করে আস্তে আস্তে ফল পাড়া যায়। আবার লাঠির মাথার ছুরি বা কাচি বেধে বোটা কেটে ফল পাড়া যেতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে ফল যে পাড়তে উঠে তার কাঁধে এলে বা ঝুড়ি ঝুলারে রাখলে সুবিধাজনক হয়।

ফল পাড়ার আগে অবশ্যই চিন্তা করতে হবে যে ফল কি উদ্দেশ্যে পাড়া হচ্ছে। কেননা আচার বা টক জাতীয় খাদ্য দ্রব্য হিসেবে ফল সংরক্ষণ করতে হলে অপরিপক্ক অবস্থায় অনেক সময় ফল পাড়তে হয়। অন্যদিকে ফুস জাতীয় খাদ্য দ্রব্য তৈরি করতে হলে বেশি পাকানোর প্রয়োজন হয় । ফল টাটকা অবস্থায় দূরে পাঠাতে হলে সম্পূর্ণ পরিপুষ্ট অবস্থায় পড়তে হয়। অনেক সময় বেশি দুরে পাঠাতে হলে ফল পাকার ৪-৫ দিন আগেও পাড়তে হয়। ফল পরিপুষ্ট হলে বিভিন্ন ফলের জাত বিশেষে সর্বোৎকৃষ্ট আকার, রং, স্বাদ, গন্ধ এবং গুণাগুণ অর্জন করে। আর তা ক্রেতার নিকট সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হয়

ফল পাড়ার পূর্বে বিবেচ্য বিষয় বা গাছ থেকে ফল পাড়ার সতর্কতা

১। পুষ্টতা সঠিকভাবে নির্ধারণে করে ফল পাড়ার কাজ শুর করতে হবে। কারণ অপুষ্ট ফল পাড়লে তা ঠিকমত এবং স্বাদ, রং, সুবাস ইত্যাদির ঠিকমতো উন্নয়ন ঘটে না।

২। ফলের যাতে কোন ক্ষতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ফল সংগ্রহের কাজে শ্রমিকরা সতর্কতা ও করছে কি না তা নিশ্চিত হতে হবে। এ ছাড়া গাছে ঝাঁকি দিয়ে ফল পাড়া ঠিক নয় ।

৩ । গাছ মোচড়ানো, ফল মাটিতে ফেলে দেয়া, ফলের গায়ে আঘাত দেয়া, ফলের গায়ে মাটি লাগানো, সংগৃহিত ফলে সূর্যের তাপ লাগানো পরিহার করতে হবে । 

৪ । ফল বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে । এতে রোগ ও পোকার আক্রমণ কম হয় । 

৫ । গাছ থেকে ফল পাড়ার পর দীর্ঘক্ষণ গাছের নিচে জমা করে রাখা ঠিক নয় । কারণ বাতাসে ভাসমান সে জীবাণু এ সময় আমের বোটায় আক্রমণ করার সুযোগ পায় ও বোটা পচা রোগের সৃষ্টি করে । 

৬ । সকাল বেলা ফল পাড়া ভালা, কারণ তখন আবহাওয়া ঠান্ডা থাকে, বৃষ্টি বাদলার দিনে ফল পাড়া পরিহাস, রতে হবে । 

৭ । কিছু বোটা সহ ফল সংগ্রহ করা ভালো । আমের ক্ষেত্রে ৩-৪ সে.মি. বোটাসহ আম পাড়তে পারলে বোঁটা পচা রোগের প্রকোপ অনেক কমে যায় । অবশ্য গাছ ছোট হলে এ কাজ সহজ হয় । 

৮ । ফল পাড়ার জন্য সব সময় ধারালো ছুরি ব্যবহার করতে হবে । ছোট গাছের ফল পাড়ার জন্য সিকেচার ব্যবহার । করা সুবিধাজনক । 

৯ । প্রত্যেক ফলের বোটায় একটি নরম জায়গা থাকে, সেখানে চাপ দিলে বোটা সহজেই ভেঙে যায় । 

১০ । আম পাড়ার পর কিছুক্ষণ উপুড় করে রাখা ভালো, এতে ফলের আঠা আমের গায়ে লাগতে পারে না ।

ফল বাছাইকরণ 

ফল গাছ হতে সংগ্রহ করা সব ফল একই মান ও আকার সম্পন্ন হয় না । একই জাত হওয়া সত্ত্বেও ফল আকার আকৃতিতে বিভিন্ন ধরনের হয় । এদের মাঝে আবার কতগুলো রোগাক্রান্ত বা পোকায় খাওয়া হতে পারে । উলিখিত সব ধরনের ফল বাজারজাত করার পূর্বে ফলকে বাছাই বা শ্রেণিভুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন । আকার আকৃতি ও অন্যান্য গুণাগুণ বিবেচনায় বাজারজাত করা হলে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে ফলের দাম নির্ধারন সহজতর হয় । এতে করে ক্রেতা তার পছন্দ মত ফল ক্রয় করে সমতুষ্ট হতে পারে । ফলের উৎপাদিত অঞ্চল হতে দূরবর্তী কোন অঞ্চলে প্রেরণের উদ্দেশ্য থাকলে ফলের পরিপক্কতার মাত্রানুযায়ী বাছাই করে পৃথক পৃথক বাক্সে পাঠানো প্রয়োজন । এতে ফল নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে । ফল সংগ্রহকালীন সময় হতে শুরু করে বিক্রয় পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে কমবেশি ফল বাছাই সম্পন্ন হয় ।

পরিপক্ব হওয়ার পর একই গাছ হতে সংগ্রহ করা ফল একইরকম গুণ সম্পন্ন হয় না । কেননা একই গাছের সব ফল এক সাথে বড় হয় না এবং একই আকৃতির হয় না । একই সাথে পরিপুষ্ট হয় না এবং একই সাথে পাকেও না । এমনকি পাকার সময় একই ধরনের রংও ধারন করে না । একই গাছের বা একই জাতভুক্ত গাছের ফল কতগুলো রোগাক্রান্ত, পোকায় খাওয়া বা শারীরিকভাবে বিকৃত হতে পারে । এমন কি একই গাছে ফুল ও ফল হওয়ার সময় যে অংশ রোদ বা আলো বাতাস বেশি পায় সে অংশের ফলের মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন দেখা দেয় । আবার গাছের ভিতরের দিকের বা ডালপালার ছায়ায় যে সব ফল হয় সেগুলোর মধ্যে অন্য ধরনের পরিবর্তন দেখা যায় । গাছের যে অংশে রোদ ও আলোবাতাস বেশি পায় সে অংশের ফল সাধারণত রোদ পোড়া, উজ্জ্বল রং বা ফলের ত্বকে ফোটা ফোটা তিলের মত দাগ ইত্যাদি পাওয়া যায়। এ ফলগুলো আগে পাকে এবং বেশি মিষ্টি হয় । গাছের ভিতরে বা ছায়ায় যে ফলগুলো হয় সেগুলো সাধারণত আকারে বড় হয়, ফল ও জাত বিশেষে রং সবজ বা কোমল হয় এবং মিষ্টতা কম হয় ।

পাড়ার পর সমস্ত ফল একত্রে মিশানো অবস্থায় না রেখে বড়, ছোট, রোগাক্রান্ত বা পোকায় খাওয়া, অপরিপক্ক, শারীরিকভাবে বিকৃত, রঙ ইত্যাদি দিক বিবেচনা করে বাছাই করে শ্রেণিবিভক্ত করা উচিত । তাছাড়া ভালো ফলের আকর্ষণীয়তা ফুটে ওঠে না । ফল দেখতে সুন্দর না হলে ক্রেতা যথোপযুক্ত দাম দিতে আগ্রহী হয় না । তাই ফল পাড়ার পর বাজারে পাঠানোর আগে বাছাই করে শ্রেণিবিভক্ত করা একান্ত প্রয়োজন । খারাপ ফলগুলোকে স্থানীয় বাজারে বিক্রয় করা যেতে পারে । ফল বাছাইকরণের সময় উচ্চমান সম্পন্ন ফলের সাথে নিম্নমানের ৫-১০ ভাগ মিশ্রন গ্রহণযোগ্য বলে ধরা যেতে পারে । সাধারণত আকার, আকৃতি, রং, পরিপক্বতার মাত্রা, রোগাক্রান্ত, পোকা খাওয়া ইত্যাদির উপর নির্ভর করে ফল বাছাই করা হয়ে থাকে । খারাপ ফলগুলোকে ফলজাত দ্রব্য তৈরীতে ব্যবহার করা যেতে পারে । ফল বাছাই দু'ভাবে করা যায় । যথা: ক) হাতের সাহায্যে এবং খ) মেশিনের সাহায্যে

ক) হাতের সাহায্যে ফল বাছাই করতে হলে ফল হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে ফলের আকার নির্ণয় করা হয় । চোখে দেখে ফলের আকার ও রং অনুমান করে শ্রেণি করা হয় । অনেক সময় হাতে নিয়ে ফলের ওজন নির্ণয় করা হয় । ফল শক্ত কেমন তা হাতে ধরে অনুমান করা হয় । তবে এ কাজটি ফল ভেদে বিভিন্ন রকম হতে পারে । গাছ হতে পাড়ার পর সব ফল একই রকম পাওয়া যায় না । কোনটি হালকা হলুদ, কোনটি গাঢ় সবুজ, কোনটি বড়, কোনটি ছোট, কোনটি খুব শক্ত এবং ওজন বেশি আবার কোনটি তেমন শক্ত নয় এবং ওজনে হালকা, কোনটি রোগ ও পোকা মাকড়ে আক্রান্ত কোনটি পাড়ার সময় আঘাতপ্রাপ্ত বা থেতলানো, আবার কোনটি সুস্থ ও সতেজ, কোনটি মিষ্টি ঘ্রাণ যুক্ত, আবার কোনটির কোন ঘ্রাণ নেই ইত্যাদি । হাতের সাহায্যে ফল বাছাই করলে বাছাই কাজটি অনেকাংশেই নিখুঁতি ও ভালো হয় ।

খ) মেশিনের সাহায্যে বাছাই করতে হলে ফল বাছাইয়ের আকৃতি নির্ধারণী রিং ব্যবহার করা হয় । ফল ভেদে বিভিন্ন মাপের নির্ধারণী রিং হতে পারে । যেমন- ৬০, ৬৪, ৭০, ৭৫, ৮০, ৮৫ সেমি. সাইজের রিং মেশিনে ফল বাছাই ও গ্রেডিং সহজে এবং দ্রুত করা যায় । কিন্তু কোন ফল থেতলানো বা রোগ ও পোকামাকড়ে আক্রান্ত থাকলে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে হাতে আলাদা করে নিতে হয় । এমনকি ফলের গায়ে ময়লা থাকলে তা হাত দিয়ে আলাদা করে নিতে হয় । মেশিনে বাছাই করা ফল কনভেয়ারের মাধ্যমে বিভিন্ন আকারের প্যাকিং বাক্সে স্থানান্তরিত হয়, যা আগে হতে নির্ধারণ করা থাকে ।

ফল বাছাইকরণের সুবিধা

১ । বিভিন্ন আকারের ফল আলাদা আলাদা করা থাকে, তাই দাম নির্ধারণ করা সহজ হয় । 

২ । আঘাত প্রাপ্ত, রোগ ও পোকামাকড়ে আক্রান্ত ফল আলাদা আলাদা থাকে, তাই ফল নষ্ট হয় না । 

৩ । ফল বাছাই করার জন্য শ্রমিক নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয় । 

৪ । বিভিন্ন আকারের ফল বিভিন্ন প্যাকিং বাক্সে সর্বোচ্চ সংখ্যায় সাজানো হয় । 

৫। প্যাকিং-এর জন্য ব্যবহৃত প্যাকেজের সংখ্যা দেখে ফলের সংখ্যা নিরুপণ করা হয় । 

৬ । ফল বাছাইকরণের মাধ্যমে ফলের মান নির্ণয় করা সহজ হয় । 

৭ । ফলের আকার এবং পরিপক্বতার ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় যে তা দূরে পাঠানো যাবে কিনা ।

কেননা বড় ফলের সাথে ছোট ফল একত্রে থাকলে বড় ফলের চাপে ছোট ফল নষ্ট হতে পারে ।

ফল বাছাইকরণে সতর্কতা ফল বাছাইয়ের পূর্বে বিবেচ্য বিষয় :

১ । ফল বাছাইকরণের স্থান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যকর, ঠান্ডা, ছায়াযুক্ত ও যথেষ্ট বাতাস চলাচল সম্পন্ন । হতে হবে। 

২। ফল বাছাইকরণের সময় ভালো ফলের সাথে আঘাত প্রাপ্ত, রোগাক্রান্ত বা পোকামাকড়ে আক্রান্ত ফল একত্রে রাখলে নষ্ট ফল দ্রুত পচে তা ভালো ফলকে নষ্ট করতে পারে । ভালো ফল এবং নষ্ট ফল পৃথক রাখতে হবে। 

৩ । বাছাই করার সময় ফল এক জায়গা হতে অন্য জায়গায় ছুড়ে না ফেলে আস্তে আস্তে রাখতে হবে । 

৪ । বাছাই করার সময় নিচে চট বা নরম জিনিস বিছায়ে নিয়ে তার উপর ফল নাড়াচাড়া করা উচিত । তাতে ফল কম আঘাত পাবে । 

৫ । যতদূর সম্ভব কম সংখ্যক ফল একত্রে স্তুপ করা উচিত । কেননা বেশি উঁচু করে ফলের তুপ করা হলে চাপে নিচের ফল নষ্ট হতে পাবে । 

৬ । বাছাই করার সময় উচ্চমান সম্পন্ন ফলের সাথে নিম্নানের ফলের ৫ থেকে ১০ ভাগের বেশি যেন মিশ্রণ না হয় । সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে ।

ফলের আকার অনুযায়ী গ্রেডিং

বাছাইয়ের পর ফলের আকার ও মান অনুযায়ী ফল শ্রেণিবিন্যাস করতে হবে । কারণ ভালো আকার ও ভালো মানের । ফল বেশি অর্থায়নে সাহায্য করে । বৃহৎ ও উৎকৃষ্টতর গুণসম্পন্ন ফল প্রায় সর্বদাই ক্ষুদ্র ও নিকৃষ্ট ফল অপেক্ষা অধিক অর্থ আনায়ন করে থাকে । সর্ব আকারের ও প্রকারের ফলকে একই সঙ্গে না রেখে ও গুলোকে আকার ও গুণ অনুসারে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করে নিলে বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয়ের পক্ষেই সঠিক মূল্য নির্ধারণের সুবিধা হয় এবং তাতে কারারেই ঠকবার সম্ভাবনা থাকে না । সুতরাং বিক্রয়ের জন্য ফল বাক্সবন্দী করা অথবা স্থানান্তরিতকরণের পূর্বেই সেগুলোকে কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে নেয়া উত্তম । একই বস্তা, ঝুড়ি বা বাক্সের নিচে ছোট এবং উপরে প্রদর্শনের জন্য বড় আকারের ফল রাখার প্রথাটি একান্তভাবে বর্জনীয় । ফলকে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট মানে বিভক্তকরণ (Standardization) একটি উত্তম পদ্ধতি ।

Content added || updated By

অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন

১। ফলের পরিপক্বতা কীভাবে নির্ণয় করা যায়? 

২। অপরিণত বয়সে ফল পরিপক্ক হওয়ার কারণ কী ? 

৩ । উচ্চমান ও নিম্নমান ফলের মিশ্রণ কত ভাগ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য ? 

৪ । পরিপক্ক হওয়ার পর ফল সাধারণত কতভাবে সংগ্রহ করা যায় ?

সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন

১। ফল বাছাইকরণে কী কী সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় লেখ। 

২। ফলের পরিপক্বতার লক্ষন কাকে বলে? 

৩। ফলের পরিপক্বতার ও পাকার মধ্যে পার্থক্য কী ? 

৪ । গ্রেডিং কেন করা হয় ? 

৫ । ফল বাছাইকরণের সুবিধাগুলো লেখ ।

রচনামূলক প্রশ্ন

১ । ফল বর্ধনের ধাপ গুলো কি কি এবং কোন কোন অবস্থায় ফলের পরিপক্বতা নিরুপণ করা হয় লেখ । 

২। ফল সংগ্রহ, বাছাই ও বাজারজাতকরণ সংক্ষেপে আলোচনা কর । 

৩ । ফল কীভাবে সংগ্রহ করা যায় এবং ফল সংগ্রহের বিভিন্ন পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা আলোচনা কর । 

৪ । ফলের পরিপক্বতা কীভাবে নিরূপণ করা যায় ? আম, কাঁঠাল ও পেয়ারার পরিপকৃতা পদ্ধতি লেখ ।

Content added By